তুমি_এবং_তুমিই,পর্ব : ০২

0
745

তুমি_এবং_তুমিই,পর্ব : ০২
লেখনী : #তাসমিয়াহ

“সিনহা, বাড়ি যাও। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।”

শান্ত স্বর সায়ানের। কিন্তু এদিকে চোখের জল নাকের জল এক করে ভয়ার্ত হয়ে বসে রয়েছে মিহির। সায়ান রাগী জানতো, তবে এমন একটা কথা ওকে বলবে তা আশা করেনি ও। ও বে’য়া’দ’ব হয়ে গেল সিনহাকে একটু ধমকে কথা বলায়!

মিহির প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছে, অভিমান হচ্ছে ওর সায়ানের ওপর। যাকে ভালো লাগে, তার কাছে থেকে একটু কটু কথাও তীরের নত আঘাত করে। আর সায়ান কত্ত জোরে বকলো ওকে, তাও এই সিনহার সামনে। সে যদি মনের খবর জানতো, তবে কি এমন করে কথা শুনিয়ে দিতে পারতো মিহিরকে? কিশোরী মনের আবেগ অভিমানগুলোকে এত প্রশ্রয় দেয় যে পরিস্থিতি সামলে থাকা আর হয়ে ওঠে না মিহিরের বয়সী মেয়েদের।

সিনহা চলে যেতেই সায়ান এবার মিহিরের দিকে এগিয়ে আসলো। মিহির সায়ানের দিকে তাকিয়ে কাছুমাছু করতে লাগলো।

“তোমার মতলব কী মিহির? সময়-অসময়ে সাজগোজ করে এদিকওদিক ঘুরাঘুরি করো। ঘর-বাহির মানো না নাকি?”

মিহির আবারো কষ্ট পেলো সায়ানের কথায়। তাও চুপচাপ মেনে নিল। শুধু বললো –

“কই ঘুরাঘুরি করলাম ভাইয়া, আমি তো ছাদে ওঠা ছাড়া আর কোথাও যাই না।”
“আচ্ছা, তাই নাকি? তুমি বাহিরে ঘুরো না? আমি কি তবে ভুল দেখি প্রায়শই? নাকি আমার সামনে পেছনে আমাকে দেখবার জন্যই পড়ে থাকো এভাবে?”

সায়ানের ধারণশীলতা আর বিচক্ষণ প্রশ্নে দাঁত দিয়ে জিভ কাটে মিহির। বুঝে ফেললো ভাইয়া, তাও এত জলদি! আমতাআমতা করতে করতে বললো মিহির –

“আসলে…মানে…ভাইয়া, হয়েছে কি…”
“কী হয়েছে তা বোধহয় তোমার চেয়ে আমি ভালো বুঝতে পারছি। কারণ কথায় আমার জড়তা না থাকলেও তোমার অঢেল জড়তা লুকিয়ে রয়েছে। আসলে যে কী হয়েছে বা হতে চলেছে তা বুঝবার মত বয়স তোমার হয়নি তো!”

সায়ান বয়সের কথা তুলায় মিহিরের হালকা অপমানবোধ হয়। এভাবে না বললেও কী হত না! বয়স কম হলে কী কারোর জন্ম কারোর প্রতি ভালোলাগা সৃষ্টি হওয়া বা কাওকে ভালোবাসা অন্যায়? বরং ছোটরা এদিক দিয়ে সৎ আর শ্রদ্ধাশীল। কারণ পরিণত বয়সের মানুষগুলো সবদিক সামলে নিয়ে ঠিকই নিজে ছেড়ে য়েতে পারে। কিন্তু এরা তো আঁকড়ে থাকতে চায়। যাবার চিন্তা মোটেও করে না, তবে?

“আমি অতটাও ছোট নই সায়ান ভাইয়া। ক্লাস এইটে পড়ছি, চৌদ্দ বছর শেষ আমার!” – (মুখ ভার করে জবাব দেয় মিহির)
“বাহ্, তাইনাকি! চৌদ্দ বছর শেষ? তারপর? আর?”
“আর…”

কথা জড়িয়ে আসে মিহিরের। কারণ ক্রমশ রাগলর মাত্রা বেড়ে চলেছে সায়ানের। তাচ্ছিল্য শুরু করছে এবার। তাই ভয় ঘিরে ধরছে ওকে। কিন্তু সায়ানের হাত থেকে এখন নিস্তার নেই আর। পালিয়ে বেরোনো সম্ভব নয়। আর পালালেও আজকেই যা। কিন্তু পরবর্তীতে কখনো ওর সামনে পড়লে আস্ত চিবিয়ে খাবে এমনটা ভেবে শিউরে ওঠে মিহির।

“তুমি চৌদ্দ বছর শেষ করেছ,এতেই এত প্রাউড ফিল করবার কিছু নেই মিহির! তোমার চেয়ে আমি সাত বছরের সিনিয়র, জানো এটা?”
“হু, জানি, তুমি আমার চেয়ে বেশ বড়। কিন্তু তাতে কী?”
“আমি একুশটা বছর পার করে ফেলেছি জীবনে। কখনকার আবেগ কেমন হয় তা জানা আছে। কাজেই কীসে কী তা তোমার চেয়ে ভালো বুঝি।”
“আমি তো তোমাকে ভালোবাসি সায়ান ভাইয়া!”

কথাটা বলে চুপ করে মাথা নিচু করে ফেলে মিহির। কারণ সায়ানের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সইবার মত সাহস আর ওর মধ্যে সঞ্চিত নেই। এতক্ষণে যা ছিল, সবটা খরচ করে মনের কথাটা জানিয়ে দেয় সায়ানকে। প্রচুর ভয় হলেও কিশোরী মনের অবাধ্য ইচ্ছেগুলো চাচ্ছে সায়ান অবাক হোক ওর সাহসিকতায়। তার চেয়ে বেশি সারপ্রাইজড্ হোক ওর অনুভূতির ব্যাপ্তি জেনে। আর ওকে আগলে নিক নিজের ভালোবাসার বাহুডোরে। আর কি চাই! তবে আফসোস খুব হবে যদি এসবের অন্যথা হয়।

“কী বললে তুমি মিহির!”

গর্জে ওঠে সায়ান। আর কাঁপতে লাগে মিহির। আর বুঝি শেষ রক্ষা হল না। এতক্ষণে মনের মধ্যে হাজার রঙের ভাবনার ড়াছড়ি হলেও সায়ানের এক হুংকারে ওকে ছেড়ে পালিয়ে যায় ভাবনাগুলো। এবার শুধু মনে হচ্ছে মাথা জাগিয়ে তাকাতেই যদি সায়ান থাপ্পড় দেয়,তখন!

“কী হল, চুপ করে আছ কেন মিহির? মানে এই বাহিরে ঘুরাঘুরি, পাকনামি আর সিনেমা দেখে বেশ ভালোই আবেগ জমিয়েছ নিজের কাছে। আর সেই সাথে মিল রেখে প্রকাশও করলে ওমন করেই। কিন্তু তোমার এই আশা পূরণ হচ্ছে না। কারণ এটা সিনেমা নয়, আর তুমি-আমিও কোনো চরিত্র নই। মোটেও আমাকে হিরো ভেবে ভুল করো না য়ে তোমার এমন কথায় একেবারে মাথায় তুলে নেবো! মোটেও না। বরং ইচ্ছে করছে একটা… নাহ, তোমার আম্মুকে বিচার দিয়ে আসি। তবেই প্রকৃত সফলতা আসবে এর।”

সায়ানের প্রথম কথাগুলোতে খারাপ লাগলেও শেষ কথায় চমকে ওঠে মিহির। একইসাথে কাঁপতে থাকে ভয়ে। মা যদি জানতে পারে তবে তো আস্ত রাখবে না আর। এমনি সারাক্ষণ বকুনি দিয়েই থাকে। তার ওপর সায়ান ভাইয়ার বিচার! মাথা ফাঁকা লাগতে থাকে মিহিরের। আপাতত সায়ানের কাছে সরি বলে হলেও ছাড় নিতে হবে। নাহলে..!

“সায়ান ভ-ভা-ভাইয়া, প্লিজ আম্মুকে কিছু বলো না!”
“কেনো? আন্টির তো জানা থাকা প্রয়োজন যে তার মেয়ে বড় হয়ে গিয়েছে। চৌদ্দ বছর শেষ!”
“আমি কি তোমার মিথ্যে বলেছি যে তুমি আমার নামে আম্মুকে বিচার দেবে!”
“সত্যি বলেছ বলেই জানাবো, এতে বিচারের কী হল!”
“আম্মু জানলে…”
“আন্টি জানলে কী করবে তা বরং গিয়েই দেখি!”

কথাটা বলেই সায়ান মিহিরের বাঁ হাতটা ধরে টানতে টানতে ওকে নিয়ে যেতে থাকে ছাদ থেকে। ঠকঠক করে কাঁপছে মিহির। সায়ান এমন করবে জানলে মোটেও বলতো না ওকে এসব কথা। সব স্বপ্ন, আশা তো ভেঙেই গেলো। বরং এবার আর রক্ষা হবে না মায়ের হাত থেকে বাঁচবার।

“সায়ান ভাইয়া, আম্মু বকবে আমায়!”
“কেনো বকবে?”
“তুমি বুঝতে পারছো না কেনো বকবে! আম্মু না আমাকে মেরেও ফেলতে পারে!”
“আসলেই আমি বুঝতে পারছি না, বড় হয়েছ বললে, তবে আন্টি কেনো তোমাকে বকবে-মারবে?”

মিহির বুঝে যায় সায়ানকে থামানো সম্ভব না। এক কথার মানুষ ও। তার ওপর রাগি, জেদি। আর মিহিরের এমন কথায় অনবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। মিহির মনে মনে কাঁদতে থাকে। মায়ের বকুনি খাবার ভয়ের চেয়ে বেশি খারাপ লাগে সায়ানের ব্যবহার। এমন করলো কেনো ওর সাথে। বয়সে ছোট হওয়াটা এতটাই অপরাধ যে এটার শাস্তি এভাবে দিতে হবে। ছোটদের অনুভূতিগুলোর মূল্য কেউ দিতেই পারে না। শুধু আবেগ বলে থামিয়ে দিতে পারলেই যেন বড় হবার স্বার্থকতা পায় ওরা।

বাসায় আসবার পথে আর কোনো কথা বলে না মিহির। মুখ ভার করে থাকে। সায়ান ওর বাসার সামনে এসে হাত ছেড়ে দেয়। তারপর কলিং বেল বাজাতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই দরজা খুলে দেয় মিহিরের মা মিসেস মনা। দরজা খুলে মিহিরকে বকতে শুরু করে।

“কী রে, কোথায় ছিলি তুই? সিনহা নাকি বাসায় আগেই পৌঁছে গিয়েছে। এদিকে তুই ফিরিসনি। চিন্তা হয় না আমার!”

মিহির চুপ করে থাকে। কোনো জবাব দেয় না মায়ের কথার। এতে মনা আরো রেগে যান। আবারো চেঁচিয়ে ওঠার আগে সায়ান ওনাকে সালাম দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এবার উনি খেয়াল করে দেখেন যে মিহিরের পাশে সায়ান দাঁড়িয়ে আছে, যা উনি খেয়ালই করেননি এতক্ষণ। বেশ জিজ্ঞাসু আর অবাক হয়ে উনি সায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সায়ান বলে ওঠে –

“একটু কথা ছিল আন্টি…”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here