#তুমি_এবং_তুমিই,পর্ব : ০৬
লেখনী : #তাসমিয়াহ
“ভালোবাসি মিহির!”
ছাদে কোনো একটা বিস্ফোরণ সংঘটিত হয় বলে মনে করে মিহির। চারপাশ যেন স্তব্ধ, শান্ত। ওর মনে হচ্ছে এই টুকু জায়গা যেন জগতের বাইরে কোথাও হারিয়ে গিয়েছে। যেখানে সব কিছু অচেনা, অজানা লাগছে ওর কাছে। যা হবার কথা নয়, তা নিজ হাতে এসে অন্তরে দাখিল হতে চাইলে শরীর যে অসারত্ব বরণ করে তা বেশ টের পাচ্ছে সে। সায়ান কী বলেছে তা কানে বাজলেও যেন বিশ্বাসের দেয়াল ভেদ করে পুরোপুরি ওপারে ছু্ঁতে পারছে না ওকে। পুনরায় সায়ান বলতে থাকে –
“মিহির, তুমি হয়তবা ভেবেছ তোমার ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়েছিলাম আমি। কিন্তু আদতে তা আমি আরেকটু বৃদ্ধিকরণের লোভে তোমার কাছেই গচ্ছিত রেখেছিলাম। আজ নেবার সময় এসে গিয়েছে। ফিরিয়ে দাও সেই ভালোবাসাগুলো। বিনিময়ে আমার হৃদয়মহল তোমায় উৎসর্গ করতে প্রস্তুত আমি!”
মিহির নিজের মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। এত সব কিছু একসাথে নিতে পারছে না ও। হুট করে আবেগের টাল সামলাতে না পেরে নেতিয়ে পড়তেই সায়ান ওকে আঁকড়ে ধরে ফেলে। এরপর নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। প্রথম বার এমন কোনো স্পর্শের কাছে নত স্বীকার করে চোখ বুজে ঢলে পড়ে মিহির। কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরতেই সায়ানের থেকে ছিটকে দূরে সরে আসে। কিছুটা যে অভিমানের প্রভাব রয়েছে, তা বুঝতে বাকি থাকে না সায়ানের। তবে বাকিটুকু যে ম্যাচিউরিটি, বিবেক-বিবেচনা আর ব্যক্তিত্বের সীমারেখা, তা চিনতে পেরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সায়ান। ওর সাত বছরের অপেক্ষা বৃথা যেতে পারে না। পূর্ণতা পেতেই হত এমন করে! এবার শুধু পালা নিজের স্বপ্নগুলোকে রঙিন প্রজাপতির ডানায় ভাসিয়ে উড়িয়ে দেয়া। যা জীবনের রঙহীন পাঠগুলোকে রাঙিয়ে তুলবে অনায়াসেই। আর সুখ রংধনু হয়ে ধরা দেবে হৃদয়মহলের দোর গোড়ায়। এবার শুধু বাঁধনে আটকে নেওয়াটা বাকি। যার অপেক্ষা এত দিন ধরে করে এসেছে ও।
“আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে সায়ান ভাইয়া। তাকে না বলে, আমায় এসব বলছেন কেনো?”
উদ্ভ্রান্তের মত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সায়ানের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লো মিহির। সায়ান বেশ কল্পময় অনুভূতিতে বিচরণ করছিল তবে মিহিরের এরূপ কথায় রেশ কেটে যায় ক্ষণিকেই। খানিক বাদে হো হো করে হেসে ওঠে সায়ান। মিহির ওর হাসির কারণ বুঝতে পারে না। তবে বিরক্ত হয়। এটা কোনো হাস্যকর পরিস্থিতি নয় যা সায়ান দাঁড় করিয়েছে। আর এতে এমন হাসি মানাবে না তাও বুঝে নেয়াটা ওর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু সব ছেড়েছুঁড়ে অনবরত হেসে চলবার গতিপথ সুবিধা জনক হবার আশা করা বৃথা। মিহির আশপাশে তাকায় কেউ আছে কি না তা বুঝতে। কারণ সায়ানের এমন গগনচারী হাসি ওদের ধরা খাইয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। আর এভাবে ওদের একসাথে দেখলে নানা মন্তব্য হতে পারে। যদিও গুরুজন কেউ উপস্থিত নেই পার্টিতে, তবুও ব্যাপারটা সমালোচ্য আর দৃষ্টিকটুতা প্রকাশ করে।
মিহিরকে চারপাশে তাকাতে দেখে সায়ান হাসি থামিয়ে বলে –
“চিন্তা করো না, ছাদের গেট লক করে দিয়েছি ভেতর থেকে। চাবি শুধুমাত্র আমার কাছে। আর এদিকে এমন সময় কেউ আসবে না। নেতিবাচক কিছু ভাববার কারণ নেই এতে।”
মিহির চুপ করে যায় একেবারে। কিন্তু অস্বস্তি আর অস্থিরতা দূর হতে চায় না। কেবল বেড়েই চলে। ও সায়ানের দিক থেকে মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে চারপাশে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়। এসবকে আবারো মশকরা বা তাচ্ছিল্য বলে মনে হচ্ছে। নচেৎ এত বছর পর কোনো মানে হয় না এগুলোর। ও ত আর সেদিনের পর কোনো দাবি করেনি। জোর জবরদস্তির ত প্রশ্নই ওঠে না। অভিমানগুলার আড়ালে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকলেও তা খুব সন্তর্পণে নিজের কাছে গচ্ছিত রেখেছে সবসময়। যেন খুব কাছ ঘেঁষে ছুঁয়ে যাওয়া বাতাসও এর অস্তিত্ব ভার টের না পায়। তবে আজ কেনো যেন আনন্দ না হয়ে কষ্ট হচ্ছে। কারণ এর সত্যতা নেই। থাকলে সেদিনই পথচলা রঙিন হত। কিন্তু না! তার বদলে ও রঙহীন হয়ে পড়েছে। তাই আজ রাঙিয়ে উঠবার আগ্রহ তেমন হচ্ছে না। পাথর চাপায় পড়ে থাকা ঝরে যাওয়া সেই কুঁড়ি যেন সেখানে পুনরায় না বাঁচতে চায় তাই-ই চাচ্ছে ও।
সায়ান কী করে যেন ওর মনের কথাগুলো বুঝে ফেলে ওর দিকে না তাকিয়েই। তাই কাছে এগিয়ে এসে আলতো হাতে মিহিরকে নিজের দিকে মুখ করে ঘুরিয়ে বলতে থাকে –
“পুরোনো কথাগুলোকে পুরোনো আঙ্গিকে কেন বিবেচনা করছো নতুন পন্থা সেজে। আজ যেমন আমার আকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়াটাও উপেক্ষা করে বিবেক বোধ থেকে সরে পড়লে, ঠিক তেমন করেই ভাবো একটু যে সাত বছর আগে এমন পরিস্থিতি দাঁড়াতে দিলে কত শত ভুল এসে তোমার সুন্দর জীবনটাকে কলুষিত করতে পারতো! তখন এসব প্রতিরোধ করতে পারতে না আজকের মত করে। সেখানে আমি থাকলেও ভুলগুলো প্রশ্রয় পেয়ে যেতো কোনো ভাবে। আর অন্য কেউ হলে সদ্য ফুটা পবিত্রতম পরিবর্তনের সুযোগ নিতো কেমন করে!”
মিহির সায়ানের কথার প্রেক্ষিতে কোনো জবাব দিতে পারে না। তবে অনবরত ঠোঁট কাঁপতে থাকে ওর। কী কী দুর্ঘটনা হতে পারতো তা ভেবে এমন হচ্ছে নাকি চাপা কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না ও। সায়ানের এমন দূরদর্শী ভাবনায় ওকে দূরে সরিয়ে রাখবার জন্য ওর সায়ান কে শ্রদ্ধা করা উচিত নাকি এখনো অব্ধি অভিমানকে জাগতে দেয়া উচিত তা নিয়ে মন মস্তিষ্কের যুদ্ধ চলছে ভীষণ। মস্তিষ্ক ইতোমধ্যে সায়ান যে সম্মান পাবার কাবিল তাতে তাকে অধিষ্ঠিত করে ফেলেছে। তবে মন এখনো এতদিনের তিলে তিলে পাওয়া কষ্টগুলোকে খুব সহজে হাওয়ার ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে সায়ানের কাছে নিজেকে সহজ করে দিতে পারছে না। কী হত যদি সায়ান আম্মুকে বিচার না দিয়ে আলোচনায় আসতো। বুঝিয়ে বলতো একটু খানি। অপেক্ষা করালে কি ও ধৈর্য ধরে থাকতো না? নাহ, এখনো অভিমান ঠিকই মাথাচাড়া দিয়ে চলেছে। তাই মুখ ফুটে বলেই ফেলে মিহির।
“আপনার বিবেচনাপ্রসূত চিন্তা ভাবনা খুবই প্রখর, মানছি। তবে আম্মুর কাছে আমায় ছোট না করলেও পারতেন সায়ান ভাইয়া। অতটা অবুঝ ছিলাম না যে আদেশ টুকু সমঝে চলতে পারতাম না!”
মিহিরের কথায় সায়ানের হাসি পায়। তবে এবার আর উচ্চ স্বরে নয়, ঠোঁট টিপে হাসে ও। ওর মান না ভাঙানো অব্ধি একটু সহ্য করে নিতে হবে। তা একটু রাশভারী ভাব টেনে বলে –
“আন্টির কাছে তোমায় মোটেই ছোট করিনি আমি। বলতে পারবে না এটা যে আন্টি সরাসরি কখনো তোমায় এই বিষয় উল্লেখ করে খোঁটা শুনিয়েছেন। হ্যাঁ, শাসনে রেখেছেন বটেই। তা ত বলে এসেছিলাম আমি নিজেই। যেমন কথা দিয়ে এসেছি, তেমনি নিয়ে এসেছি। তাই আজ আমি আর তুমি এখানে, এভাবে!”
চলবে…