#তুমি_এবং_তুমি,পর্ব : ০৪
লেখনী : #তাসমিয়াহ
“মিহিরররর…!”
লিয়ার চিৎকারে ধপ করে সোফা থেকে আধশোয়া অবস্থা থেকে পড়ে যায় মিহির। মাথার এক কোণে ছোট করে ফুলে ওঠে সাথে সাথেই। আধবোজা তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে আপাতত সব ঝাপসা আর অচেনা লাগছে। দ্বিতীয় বার লিয়া চিৎকার করে উঠলে মিহিরের ঘোর ফেরে।
“কী রে, কী সমস্যা তোর? আনন্দ হচ্ছে ভালো কথা, চেঁচাবি কেনো কানের কাছে!”
“বাহ! আমি চেঁচাচ্ছি? আর এদিকে তুই যে জেগে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিস। আমি বললেই দোষ! তোর জন্য এখনো এংগেজমেন্ট শুরু পার্টী হল না। সবাই অপেক্ষা করছে বলে ডাকতে এসে দেখি মহারাণী স্বপ্ন দেখায় মত্ত!”
লিয়ার কথায় মিহিরের মনে পড়ে যায় যে ও তো অপেক্ষা করছিল মেকআপ করবার পর রেডি হবে বলে। আর্টিস্টের সিরিয়ালে বিরক্তি বোধ হচ্ছিল কিন্তু কখন যে চোখ লেগে এসেছিল, খেয়াল পায়নি একটুও। আর স্বপ্ন? অবশ্য চোখটা লেগে আসছিল বোধ হয় পুরোনো স্মৃতির খাতার ওপর জমে থাকা ধুলো ময়লাগুলো সরিয়ে অস্তিত্বের প্রভাব জানান দিতে।
এজন্যই মিহির সেদিনের পর আর কখনো সায়ানের মুখোমুখি হবার কথা ভাবেনি। সামনে থেকে দাঁড়িয়ে দেখা দেয়নি ওকে। আড়াল থেকে দেখেছে অল্প কদিন। তারপর তো দূরত্ব বেড়ে গিয়ে যোগাযোগের সুতোও ছিঁড়ে ফেলেছে। আস্তে আস্তে কাজেকর্মে প্রকাশ পাওয়ার অভ্যাসগুলো তাড়া করা ছেড়ে দিলেও স্মৃতিতে ঠিকই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইতো।
হুটহাট আনমনা, অবাস্তব কল্পনা, তন্দ্রাবেশ স্বপ্ন – নানাবিধ। তবে আজকের মত প্রশ্রয় আর বিস্তার কোনো দিন ঘটেনি। এর একমাত্র কারণই হল আবার মুখোমুখি হওয়া। মিহির আর কোনো দিন সায়ানের সম্মুখে যেতে চায়নি। কিন্তু আজ এই পার্টীতে সায়ানকে দেখে অন্তর কেঁপে ওঠে। অভিমানের সীমানা ছাড়িয়ে অভ্যাস আবার বেয়ারা হয়ে উঠতে চায়। তাই বাধ্য হয় এড়িয়ে চলে আসতে। কিন্তু তা তো স্বল্পকালীন।
পার্টীতে বিস্মিত হলেও সত্য এটাই যে লিয়া আর ইলহামের চেয়েও বেশি ফোকাস সায়ানের ওপর। কারণ আগ্রহ করে জানবার প্রয়োজন হয়নি। এমনিই কানে এসেছে। আর তা হলো সায়ান ইলহামের বেস্ট ফ্রেন্ড। ইলহামের সমবয়সী, একসাথে বেড়ে ওঠা কাজিন সমাজেরও ততটা অধিকার নেই ইলহামের ওপর, যতটা ইলহামের সামনে খুব নগণ্য দাবি করে থাকে সায়ান।
ইলহামরা এসে উপস্থিত হওয়া মাত্রই সায়ানের সাথে লিয়ার পরিচয় করিয়ে দেয় ইলহাম। অতঃপর প্রশংসায় পঞ্চমুখ সায়ান সবার কাছেই। প্রশংসা শুনিয়ে মিহিরকেও ডেকে আনে লিয়া পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। মিহির ততটা আগ্রহ না দেখালেও দূরতম কল্পনায়ও ইলহামের বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে সায়ানকে কল্পনা করেনি সে। তাই সামনাসামনি এসে দাঁড়ানো মাত্রই শক খায় মিহির। সায়ান অবশ্য ওকে দেখে চমকায়নি। ভাব এমন যেন ও জানতো য়ে মিহিরের সাথে সাক্ষাৎ হবেই। তাই প্রস্তুত হয়েছিল আগে থেকে। মুচকি হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় মিহিরের দিকে। তখন মিহিররাও সবেমাত্র এসেছে হলে। ট্রায়ালে গিয়ে ফ্রেশ হওয়ারও সুযোগ পায়নি সে। ওমন পরিশ্রান্ত বেশে সায়ানের মুখোমুখি হয়ে আরো অস্বস্তি বোধ করছিল সে। কারণ সায়ানের মতে সে বাচ্চা। আর বাচ্চারা পরিপাটি গোছানো থাকতে জানে না। অগোছালো ভাব যেন নিত্য ভূষণ। তাই বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে এসে পড়ে তখনি। সায়ান কিছু মনে করে না। সবটাই বুঝতে পেরে মুচকি হাসে শুধু। এদিকে লিয়া ক্ষিপ্ত হয় মিহিরের এমন আচরণে। কিছু বলতে গেলে ক্লান্তিজনিত দোহাই দিয়ে সরে আসে মিহির। তখন ও বলে রেস্ট নেয়া শেষ হলে জলদি যেন পরিপাটি হয়ে সুন্দর করে সেজে পার্টীতে উপস্থিত হয়। সাজবার ইচ্ছে না হলেও আপত্তির অবকাশ পায় না মিহির। অগত্যা সব মেনে নিলেও বিপত্তি বাধে পোষাক নিয়ে। ব্যস্ততার চাপে মিহির প্রায় ভুলে গিয়েছিল যে ওর আর লিয়ার লেহেঙ্গা একইসাথে কেনা হয়েছে, এমনকি একই রঙের। ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে এভাবেই সাজবে বলে আদেশ লিয়ার। পছন্দ করেছে ইলহাম নিজে। কিন্তু সায়ানকে দেখে বেগুনী রঙের মাঝে আনন্দ হারিয়ে পুরোনো বিষাদগম্ভীর স্মৃতি হাতরে ফেরে মিহির। কিন্তু এই পোষাক ছাড়া দ্বিতীয় অপশন নেই, আবার লিয়াও কষ্ট পাবে। তাই দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগে সে। সায়ান সবার সামনে আবার কিছু বললে!
অবশেষে মিহিরকে লিয়া রেডি করে বের করালো, তাও মাত্র পাঁচ মিনিটে। মানে শুধুই লেহেঙ্গা পরেছে। চুল বাঁধবার সময় না হওয়ায় স্রেফ এক পাশে এনে রেখেছে। এটুকুই। এমনিতে মিহিরকে দেখতে কিন্তু খারাপ নয়। গর্জিয়াস সাজের প্রয়োজন শখ ছাড়া আর তেমন কিছু নয়। তবে আজ যেন সাজ ছাড়াই একটু অন্য রকম লাগছে সব।
লিয়া মিহিরের ডান হাতটা ধরেই বেরিয়ে আসলো ট্রায়াল রুম থেকে। সেখানে ইলহাম অপেক্ষা করছিল ওদের জন্য। তার পাশে সায়ান দাঁড়িয়ে আছে। মিহির একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেও সায়ান একভাবে মিহিরের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। আহামরি কিছু সেজে বেরোয়নি মিহির। বরং নিজ দোষে কিছুই সাজা হয়নি। তাই দেখবার মত কিছুই আকর্ষণীয় নয়। কিন্তু বাকিরা তেমন না তাকালেও সায়ান দৃষ্টি ফেরাচ্ছে না বলে অস্বস্তিতে পড়ে আছে মিহির। নিজ থেকে কিছু বলতেও পারছে না, আবার সইতেও পারছে না। লিয়া তো এক দুবার ক্ষেপাচ্ছিলও এটা বলে যে কোনো সাজ ছাড়াই সায়ান ভাইয়া এভাবে তোর দিকে নজর দিয়ে রয়েছে। তবে সাজলে আরো কী হবে শুনি! লিয়ার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় মিহির। সায়ান ওর দিকে কখনো নজর দেয়ইনি। সরাবে কী আর! সাজ, বরং হয়তবা বেগুনি রঙের পোষাক বলেই এভাবে দেখছে। আবার কিছু বলে না বসে…
মোটামুটি একটা আয়োজন, সরব, হাসি-মজায় এংগেজমেন্ট হয়ে যায় লিয়া আর ইলহাম। সবাই ওদেরকে অনেক সাধুবাদ ও অভিনন্দন জানায়। লিয়া খুশিতে মিহিরকে জড়িয়ে ধরে আর ইলহামকে বুকে টেনে নিয়ে শুভকামনা জানায় সায়ান। কিন্তু তারপরই ঘটে এক বিস্ময়কর ঘটনা!
চলবে…