তুমি_কেনো_এলে_জানিনা_এখনও #একাদশ_পর্ব শেষ

0
959

#তুমি_কেনো_এলে_জানিনা_এখনও
#একাদশ_পর্ব শেষ
#লেখনীতে_সুহানা_সুলতানা

আরাফাত ভিলা আজ আলোর রোশনাইয়ে সেজে উঠেছে। লোকজনদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। চারিদিকে হই হুল্লোলের আওয়াজে মেঘার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো সন্ধ্যা সাতটা বাজছে। এমন সময় ইয়াসির হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকলো। ফর্মাল ড্রেসআপে ইয়াসিরকে দেখে প্রশ্ন করলো,,,

আজকে কি কোনো পার্টি আছে?

আছে তো।

আমাকে তো জানাওনি এই ব্যাপারে।

সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। আজকে বেবি শাওয়ারের পার্টি রেখেছি। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও। গেস্টরা আসতে শুরু করে দিয়েছে।

মেঘা পীচ কালারের ওজনহীন গাউনটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। ও বেরোতেই ইয়াসির ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে দুই গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তারপর দুজনেই বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। পুরো বাড়িটা সাজানো হয়েছে ব্লু এর ডেকরেশনে। চারিদিকে সবাই আনন্দ করছে। কিন্তু এতো মানুষজনের মধ্যেও একজনের হিংসাত্মক চাহনী মেঘার ওপর বিরাজমান। মেঘার মনে হলো কেউ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এতো মানুষের ভীড়ে সে কে সেটা বুঝতে পারলো না।

নির্বিঘ্নে পার্টিটা সমাপ্ত হলো। মেঘা খুবই ক্লান্ত ওর পা দুটোও ভীষন ব্যাথা করছে। মেঘাকে ছটফট করতে দেখে ইয়াসির ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে উঠলো,,,

কি হয়েছে মেঘ? কি কষ্ট হচ্ছে আমায় বলো।

পায়ে ব্যাথা করছে। ইচ্ছে করছে পা দুটো কেটে ফেলে দিই।

ইয়াসির কোনোরূপ বাক্য বিনিময় না করে মেঘার পা টিপতে শুরু করলো।

ছি ছি কি করছো তুমি। আর যাই করো না কেনো পায়ে হাত দিও না। প্লীজ।

যাকে ভালোবেসে বুকে টেনে নিতে পারি তার পায়েও হাত দিয়ে পারি। আর একটা কথাও শুনতে চাই না চুপচাপ চোখ বন্ধ করো।

ইয়াসির শেষের কথাটা বেশ জোরেই বলেছে তাই মেঘাও দেরী না করে চোখের পাতা মুদে নিলো।

মাঝে কেটে গেছে আরও একমাস। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও সময়কে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সে তার আপন বেগে বহমান। দেখতে দেখতেই মেঘার নয় মাস হয়ে গেল। আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। তারপরই পৃথিবীর আলো দেখবে ‘পটললতা’। মেঘা ইয়াসির দুজনেই খুব এক্সাইটেড।

আজ বহুদিন পর মেঘাকে রেখে অফিসে গিয়েছে ইয়াসির। যাওয়ার আগে মেঘাকে হাজারো সাবধান বাণী শুনিয়ে দিয়ে গেছে। মেঘাও ভালো মেয়ের মতো সব কথা মেনে চলবে বলে ইয়াসিরকে আশ্বস্ত করেছে। ইয়াসির অফিসে গেলেও মনটা বাড়িতেই মেঘার কাছে পড়ে আছে। অবশেষে তিন ঘণ্টার অবসানের পর ইয়াসির বাড়িতে পৌঁছালো।

বাড়ীতে ঢুকতেই বেডরুম থেকে কিছুর আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি রুমে গেলো। রুমের ভেতরের অবস্থা দেখে ওর হাত পায়ের নড়াচড়া ওখানেই থেমে গেছে।

মেঘা রক্তাত্ব অবস্থায় ফ্লোরে শুয়ে কাতরাচ্ছে আর ওর সামনে পৈশাচিক হাসি মুখে ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াসিরের বন্ধু সিয়াম। ইয়াসির মেঘার কাছে ছুটে গিয়ে রক্তে ভেজা ছোট্ট শরীরটা কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো আর গার্ডদের কিছু একটা ইশারা করলো।

ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে গন্তব্য হসপিটাল।

ইয়া ইয়াসির সাহেব আমাদের বাচ্চাটাকে মায়ের অ অভাব বুঝতে দেবে না। ওকে ভালো করে মানুষের মতো মা মানুষ করবে। আমার কথা ভেবে কান্না কিন্তু কান্না করবে না। চ চোখ মোছো।

দোহাই লাগে মেঘ এইসব কথা বোলো না। আমি কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারবো না।

আ আমি কিন্তু আমার ‘পটললতা’র কোনোরূপ অব অবহেলা সহ্য করবো না। আপনার দ্বিতীয় বউ যদি আমার সন্তানকে কষ্ট দেয় না আমি কি কিন্তু ভূত হয়ে আবার ফিরে আসবো।

মেঘ আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনাও করি না। প্লীজ মেঘ এইসব বোলো না। দেখো আমরা হসপিটালে যাচ্ছি তুমি ঠিক হয়ে যাবে।

মেঘার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তবুও বললো,,,

শেষ উষ্ণতাটুকু চাই ইয়াসির সাহেব।

দুজনের ওষ্ঠ জোড়া একত্রিত হলো।

শেষবারের মতো মেঘা বলে উঠলো,,,

ভালোবাসি।

আমিও ভালোবাসি।

হসপিটালে পৌঁছতেই মেঘাকে দ্রুত অ্যাডমিট করে নিলো। ইয়াসির চিন্তিত মুখে করিডোরে পায়চারি করছে। সায়নও চিন্তিত মুখে এককোনায় দাঁড়িয়ে আছে। এই বোনটার এই নির্মম পরিণতি মেনে নিতে পারছে না কোনোভাবেই। দীর্ঘ একটা সময় অতিক্রান্ত হলো।

নার্স সাদা তোয়ালে জড়ানো একটা বাচ্চাকে ইয়াসিরের কোলে দিয়ে বললো আপনার মেয়ে হয়েছে স্যার। ইয়াসির বাচ্চাটার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে উঠলো,,,

আমার ওয়াইফ কেমন আছে?

নার্সের উজ্জ্বলতায় ভরা মুখটা নিমেষেই আঁধারে ছেয়ে গেল।

আমি কিছু জিগ্গেস করেছি?

ইয়াসিরের উচ্চস্বরের ধমকে নার্সটা কেঁপে উঠলো আর বাচ্চাটা কাঁদতে শুরু করলো।

শি ইজ নো মোর। সরি স্যার। আসলে ইন্টারনাল ব্লিডিং এর কারণে ওনার মৃত্যু হয়েছে।

ইয়াসির ক্রন্দনরত বাচ্চাটাকে নিয়েই মেঘার কাছে গেলো। উজ্জ্বল মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ইয়াসির মেঘার নিঃসাড় দেহটার কপালে শেষ বারের মতো ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সায়ন ইয়াসিরের চোখ মুখ দেখে ঘাবড়ে গেল। আবার যেনো পুরনো ইয়াসিরকে দেখতে পাচ্ছে। পরক্ষনেই ভাবলো হয়তো মেঘার জন্য কান্না করে এমন হয়েছে।

ইয়াসির বাচ্চাটাকে নিয়ে সোজা বাড়ীতে এলো। পুরো বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। মেঘার অনুপস্থিতি বড্ড পোড়াচ্ছে ইয়াসিরকে। সব সার্ভেন্টদেরকে হুঙ্কার ছেড়ে এক ডাকে ড্রয়িং রুমে জড়ো করলো ইয়াসির। বাচ্চাটাকে রুম শুইয়ে দিয়ে এসেছে কান্না করতে করতে বেচারি ঘুমিয়ে পড়েছে।

সার্ভেন্টরা ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুরনো ইয়াসিরকে এতোদিন পর দেখে ওদের শরীরে কাঁটা দিচ্ছে।

আমি কয়েক ঘণ্টার জন্য বাইরে যাচ্ছি আমার মেয়ের খাবারের ব্যাবস্থা করবে আর ওর খেয়াল রাখবে। কোনো রকম গাফিলতি আমি সহ্য করবো না। মনে থাকে যেন।

ইয়াসির বেরিয়ে যেতেই সার্ভেন্টগুলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ইয়াসিরের কথা মতো কাজে লেগে পড়লো ওরা।

নিভু নিভু হলদে আলোর নীচে একটা কাঠের চেয়ারে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে কাউকে। শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্তের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে তার ওপর দিয়ে অনেক বড় সংকট বয়ে গেছে। ব্যাথায় জর্জরিত শরীরটা নিয়ে চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দিয়ে যে বসে আছে সে আর কেউ না সিয়াম। হঠাৎ মুখের ওপর গরম তরল এসে পড়ায় চিৎকার করে উঠলো সে। চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো ইয়াসির বসে আছে। চোখ দুটো অসম্ভব রকমের লাল হয়ে রয়েছে। এতো বছরের বন্ধুত্বে কখনো ইয়াসিরের এমন রূপ দেখেনি সিয়াম।

আমার মেঘের কি দোষ ছিল?

ইয়াসিরের অতি শীতল কণ্ঠস্বর যে কারোর শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিতে সক্ষম।

তোর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী বেঁচে আছে না পরপারে পাড়ি দিয়েছে?

হাসতে হাসতেই বলে উঠলো সিয়াম।

কেনো আমার বাচ্চাটাকে মা হারা করলি?

শোন তাহলে, যেদিন আমি প্রথম মেঘাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছিলাম সেদিনই ওর প্রেমে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম আর কয়েকটা মাস পর ওর বাড়ীতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। কিন্তু তুই কি করলি ওকে বিয়ে করে নিলি। আমি যে জিনিসটা পাই না সেটা অন্যকেও পেতে দিই না। তাই মেঘার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়েছে সেম জিনিসটা। তাই ওকে আমি মেরে ফেলেছি। আমি তো ওকে পাইনি আর তুই পেয়েও হারিয়ে ফেললি।

তুই কোনোদিন মেঘকে ভালবাসিস নি। তোর মুখে প্রেম-ভালবাসা শব্দগুলো মানায় না। আর তোর ওই নোংরা মুখে আমার মেঘের নাম নিস না।

আমাকে এখানে এই ভাবে আটকে রেখেছিস কেন?

আমার মেঘ যতোটা না কষ্ট পেয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি কষ্ট আমি তোকে দেবো।

ইয়াসির সেম একটা চাকু দিয়ে সিয়ামের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করছে। সিয়ামের চিৎকারও ওর পাষাণ হৃদয়টাকে গলাতে পারছেনা।

কে তুই?

Y.A গ্যাংয়ের নাম শুনেছিস কখনো?

হ্যাঁ শুনেছি।

আমি ওই গ্যাংয়ের লিডার। শুধুমাত্র মেঘ আর আমার অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করে এসব মাফিয়াদের কাজ ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার মেঘের খুশির জন্য যা যা প্রয়োজন ছিলো সব করেছিলাম। কিন্তু তোর মতো কুকুরের জন্য আমার মেঘ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ প্রবাদটাকে সত্যি প্রমাণ করতে বড্ড ইচ্ছে করছে।

ইয়াসির কাউকে নুন আনতে বললো। সিয়াম নিজের পরিণতির কথা চিন্তা করে ঘামতে শুরু করেছে। কাটা জায়গায় নুনের অস্তিত্ব অনুভব করতেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলে শুরু করলো সিয়াম। চোখের সামনে দুটো বড়ো বড়ো কুকুর দেখে সিয়াম ক্ষমা চাইতে শুরু করলো।

তোকে ক্ষমা করা মানে অন্যায় সহ্য করা। আমি অন্যায়ের সঙ্গে আপস করি না। স্কুবি ববি, তোদের খাবার দিয়ে গেলাম। কিছু বাদ রাখবি না সবটা খেয়ে নিবি।

ঘরের ভেতরে একটা গার্ডকে ডেকে বলে উঠলো,,,

এর শরীরটা খাওয়া হয়ে গেলে আমাকে ইনফর্ম করে দেবে।

ওকে স্যার।

সিয়ামের চিৎকারের আওয়াজ সাউন্ডপ্রুফ ঘরের বাইরে পৌঁছাচ্ছে না। গগণবিদারী চিৎকার উপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে এলো ইয়াসির। ফ্রেশ হয়ে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলো। ইয়াসিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ছোট্ট ছোট্ট চোখজোড়া। কয়েক মুহূর্তের জন্য ইয়াসিরের মনে হলো মেঘা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মুচকি হেসে মেয়ের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলে উঠলো,,,

লতা এখন থেকেই তুই কিন্তু তোর মায়ের মতো হচ্ছিস। মায়ের মতো তাকিয়ে আছিস। মেঘ আমায় ছেড়ে চলে গেলে কি হবে সবচেয়ে দামী জিনিস তোকে দিয়ে গেছে আমার কাছে।

আবারও মেয়ের পুরো মুখে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো ইয়াসির আর চোখ থেকে গাল বেয়ে তরল নোনা জল গড়িয়ে পড়ল।

যদি সারাজীবন আমার সাথে নাই থাকতে তবে কেনো এসেছিলে এই বিষাদময় জীবনে?

“আমার পোড়া কপালে আর আমার সন্ধ্যা সকালে,

তুমি কেন এলে জানিনা এখনও।”

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here