#তুমি_কেনো_এলে_জানিনা_এখনও
#পঞ্চম_পর্ব
#লেখনীতে_সুহানা_সুলতানা
দীর্ঘ একঘন্টার একটা হট শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলো মেঘা। চুল থেকে টাওয়াল খুলে ইয়াসিরের দেওয়া ডায়েরিটা নিয়ে রুম সংলগ্ন ব্যালকনিতে থাকা দুটো বেতের চেয়ারের একটিতে বসলো। চুল না মোছায় চুল থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। রাত্রি এখন কটা বাজছে সে সম্পর্কে কোন ধারনা নেই মেঘার। মৃদু আলোয় ডায়েরিটা খুললো সে। মুখটা তুলে আকাশের দিকে তাকালো। গোল থালা আকৃতির চাঁদ উঠেছে। আজকে পূর্ণিমা। চাঁদের কালো কালো দাগগুলো অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে মেঘার কাছে।
আজ রাত বারোটার পর আমার জন্মদিন। মা বাবা তো কোনোদিনও আমার জন্য স্পেশাল কিছু করেনি দিনটাতে। বরং এই দিনটিতেই ওরা বিজনেস মিটিং নাহলে পার্টিতে যেত। আমায় তেমন সময়ও দিতো না।
কথাগুলো বলে মেঘা ওর অনুভুতিগুলো খুলে রাখা ডায়েরির পাতায় তুলে ধরলো,,,
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ঊনিশ বছরের হয়ে যাবো। তখন তো আমার ইচ্ছে মতো সব কিছু করতে পারবো। তাই আমি এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মা বাবার সঙ্গে দেখা করে যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যাবো। আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কাঁদতে ইচ্ছে করে না। চোখের জলের প্রতিটা ফোঁটার মূল্য অসীম। তাই সেই মূল্যবান জিনিসটা নষ্ট করতে ইচ্ছে করে না। মা বাবা আমার সঙ্গে এমন ব্যাবহার করে যেনো আমি জন্মে অনেক বড়ো পাপ করে ফেলেছি। আত্মহত্যা যদি মহাপাপ না হতো তবে এই দুনিয়ায় আমার চিন্হ বহু আগেই বিলীন হয়ে যেতো। কিন্তু পারি না। নিজেকে কষ্ট দিতে পারি না। আমার না দম বন্ধ হয়ে আসছে। কেউ আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না। ইয়াসির সাহেব তো আমাকে কিডন্যাপই করে নিলো। আমার মরে….
আর কিছু লিখতে পারলো না মেঘা। হাত থেকে কলমটা পড়ে গিয়ে অনেকটা দূরে গড়িয়ে গেলো। কোলের ওপর থাকা ডাইরিটাও মুখ থুবড়ে নীচে পড়লো। মেঘা অচেতন হয়ে চেয়ারেই গা এলিয়ে দিল।
নির্জন রাস্তায় ফুল স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছে ইয়াসির। কানে থাকা ব্লুটুথ ডিভাইস এর মাধ্যমে কাউকে ইচ্ছেমত বকাঝকা করছে। ওর গাড়িটা এসে থামলো ওর নিজস্ব বাগানবাড়িতে। কলটা কিছুক্ষন আগেই ডিসকানেক্ট করে দিয়েছে সে।
এটাই সেই জায়গা যেখানে মেঘাকে রেখেছে ইয়াসির। গাড়ী থেকে নেমে মেঘা যেই রুমে রয়েছে সেই দিকে পা বাড়ালো ইয়াসির।
তুমি তো জানো আমাদের কাছে আজ রাত বারোটা থেকে কাল রাত বারোটা পর্যন্ত সময় আছে। এরপরে তুমি যতো চেষ্টাই করো না কেনো মুখপুরী মেঘার কোনো সম্পত্তিই পাবে না।
মেহের আমার সবটা জানা আছে। আর আমি তো হাত গুটিয়ে বসে নেই। এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ওকে খোঁজার জন্য। আর ওর মাকে যেভাবে শেষ করেছিলাম সম্পত্তি হাতানোর পর মেঘারও সেই অবস্থা করবো।
ইয়াসির রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো কিন্তু মেঘাকে দেখতে পেলো না। ওয়াশরুমের দরজাও বাইরে থেকে বন্ধ। ইয়াসির ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেল। দেখতে পেল মেঘা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে রয়েছে।
মেঘা?
কোনো উত্তর এলো না।
মেঘা তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
এবারও কোনো উত্তর এলো না। তাই ইয়াসির এবার মেঘার একদম কাছে চলে গেল। দেখলো মেঘা চোখদুটি বন্ধ করে রয়েছে। ও বুঝতে পারলো মেঘা সেন্সলেস হয়ে গেছে। মেঘাকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে এসে বেডে শুইয়ে দিল। তারপর ওর বন্ধু সিয়ামকে ফোন করলো যে একজন ডক্টর। লোকেশন সেন্ড করার তাড়াতাড়ি চলে আসতে বললো। প্রায় আধ ঘণ্টা পর সিয়াম এলো। বেডে মেঘাকে শুয়ে থাকতে দেখে সিয়াম বলে উঠলো,,,
মেঘা তোর বাগানবাড়িতে কি করছে?
তুই ওকে চিনিস?
হ্যাঁ। মাসদুয়েক আগে আমার কাছে একজন ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা ওকে এনেছিলেন। তখনও ও সেন্সলেস ছিলো। এবার বল ও এখানে কি করছে?
আমার বউ, বিয়ে করেছি ওকে।
সিরিয়াসলি!! আই কান্ট বিলিভ দিস নিউজ।
ওকে দেখ। আর ফালতু কথা বাদ দে।
সিয়াম একটা ইঞ্জেকশন পুশ করে দিলো মেঘার হাতে।
চিন্তা নেই আধঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরবে।
কি হয়েছে ওর?
ও কোনো কারণে ডিপ্রেসনে আছে। দুই মাস আগে যখন আমার কাছে এসেছিলো আমি ওর গার্ডিয়ানদের বলেছিলাম ডিপ্রেশনের কথা ওরা মেঘার ওপর রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘যতোসব ডং’। আমি খেয়ালও রাখতে বলেছিলাম। কিন্তু এখন পরিস্হিতি খুব খারাপ হয়ে গেছে। ওর প্রপার কেয়ার নিতে হবে। এখন এটা তোর শুধু তোর দায়িত্ব না কর্তব্যের মধ্যেও পড়ে।
কি কারণে ডিপ্রেস তা কি বলতে পারবি?
গতবার ওর জ্ঞান ফেরার পর কথা বার্তা বলে জেনেছিলাম ও খুব অবহেলা, তাচ্ছিল্য আর অপমানের সঙ্গে বড় হয়েছে। সব ছেড়ে দিয়ে ও এমন জায়গায় চলে যেতে চাই যেখানে ওকে অপমান করার কেউ থাকবে না। ওকে বাইরে থেকে যতটা হাসিখুশি দেখিস ও কিন্তু ভেতর থেকে ততটাই দুঃখী। ওকে একটু ভালবাসা দিস। আমি আসি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘার জ্ঞান ফিরবে।
ইয়াসির, সিয়ামকে এগিয়ে দিয়ে এলো। রুমে এসে মেঘার পাশে বসে মেঘার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অবিরাম চুমু এঁকে দিচ্ছিলো। কিছুক্ষন পর মেঘা নড়েচড়ে উঠলো। পিটপিট করে চোখ খুলে দেখলো ইয়াসির ওর পাশে বসে আছে। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক বারোটা বেজে গেল।
ইয়াসির ওর মুখের দিকে ঝুঁকে বললো,,,
হ্যাপি বার্থডে মেঘ। সারাজীবন হাসিখুশি থাকবে দুঃখ কষ্টগুলো যেনো তোমায় ছুঁতেও না পারে। সেগুলো না হয় আমার জন্যই বরাদ্দ থাক আর আমার ভালবাসাগুলো তোমার নামে লেখা হোক।
বার্থডে উইশ করার পর মেঘার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো ইয়াসির। অতি খুশিতে মানুষ যেমন বাক হারা হয়ে যায় মেঘারও একই অবস্থা হয়েছে। এই ভাবে বার্থডে উইশ করে প্রপোজ করার ভিডিওগুলো দেখেছে ও। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদিও ইয়াসিরকে দেখেও ও প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। যেটাকে ফার্স্ট সাইট অফ লাভ বলে।
মেঘা শোয়া থেকে উঠে বসলো। এখনও ওর বিশ্বাস হচ্ছে না ইয়াসির ওকে প্রপোজ করেছে।
মেঘা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইয়াসিরের দিকে।
কি দেখছো এমন করে। কেক কাটবে না।
আপনি কি করে জানলেন? আমার মা বাবারই তো কখনো মনে থাকে না।
ইয়াসির মেঘার হাত দুটো ধরলো।
জানো মেঘ কিছু স্পেশাল মানুষদের সব কিছু মনে রাখা আমার জন্য স্পেশাল। নাও চলো কেক কাটবে।
ওরা দুজন বাগানবাড়ির রুফ টপে গেলো। পুরো ছাদটা বেলুন আর লাইট দিয়ে সাজানো। মাঝখানে একটা ফাইভ লেয়ারের কেক রাখা আছে। কেকটা নীল রঙের আর ওপরে নাইনটিন লেখা একটা ক্যান্ডেল রাখা আছে।
ওয়াও! সো মাচ বিউটিফুল। এভরিহোয়ার ইজ ব্লু। ইটস আ ব্লু হেভেন। থ্যাংক ইউ ইয়াসির সাহেব।
ইয়াসির মেঘার হাত ধরে সামনে এগিয়ে গিয়ে কেক কাটতে বললো। মেঘাও আর দেরী না করে কেকটা কেটে ইয়াসিরকে খাইয়ে দিল। ইয়াসিরও ওকে খাইয়ে দিল। তারপর পকেট থেকে একটা ব্রেসলেট বার করে মেঘার হাতে পরিয়ে দিলো।
মেঘা আমি উত্তরটা জানতে চাই।
কিসের উত্তর।
নীচে যেই কথাগুলো বলেছি সেগুলোর উত্তর।
মেঘা ইয়াসিরকে জড়িয়ে ধরে বললো,,
ইয়াসির সাহেব যদি আপনাকে ভালো নাই বাসতাম তবে কি আপনার কথা শুনতাম।
মেঘা ইয়াসিরের ক্লিন শেভড ডান গালে চুমু দিয়ে বললো,,,
আমাকে আজকের দিনটাতে স্পেশাল ফিল করানোর জন্য ধন্যবাদ ইয়াসির সাহেব।
কথাটা বলেই মেঘা চলে যেতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ইয়াসির ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে আরও কাছে টেনে নিল। মেঘার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো,,,
#চলবে….