#তুমি_কেনো_এলে_জানিনা_এখনও
#সপ্তম_পর্ব
#লেখনীতে_সুহানা_সুলতানা
মেঘা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু শব্দগুলো গলার কাছে আসতেই ও ঢোক গিলে শব্দগুলোকে গলার নীচে নামিয়ে নিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আরও বেশ কিছুক্ষন জার্নির পর ওরা পৌঁছোলো ইয়াসিরের বাড়িতে।
মা বাবা তো জানেন না আমাদের ব্যাপারে তাহলে আমি আমাদের বাড়িতে যাই?
আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। তুমি আমার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে যাবে ব্রেকফাস্ট করবে তারপর আমার কথা মন দিয়ে শুনবে। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু হেয়ার এনিথিং।
মেঘা ইয়াসিরের কথার পাল্টা জবাব দিতে পারলো না। ইয়াসিরের এই আওয়াজটা শুনলেই ও চুপসে যায় যেমন একটা ফোলানো বেলুনে ফুটো থাকলে সেটা ফুললেও যেমন চুপসে যায় ঠিক তেমন। ওরা দুজন ভেতরে ঢুকলো। সার্ভেন্টরা ইয়াসিরের আদেশে ব্রেকফাস্ট রেডী করে রেখেছে। ওরা দুজনেই ফ্রেশ হয়ে এসে ব্রেকফাস্ট করে নিলো। ইয়াসিরের রুমে ইয়াসিরের কোলের ওপর বসে গলা জড়িয়ে ধরে আছে মেঘা। এখনও পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি সে। যেনো কথা বললেই ওকে ট্যাক্স দিতে হবে। ইয়াসিরও ওর চুলের মাঝে সযত্নে এক হাত দিয়ে বিলি কেটে দিচ্ছে। এমন সময় ইয়াসিরের ফোনটা বেজে উঠলো।
স্যার আপনার পি.এ মিষ্টার সায়ন এসেছে।
আচ্ছা নীচে ড্রয়িং রুমে বসতে বলো আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।
ওকে স্যার।
মেঘ আমাকে নীচে যেতে হবে। অফিসের ফাইলগুলো দিয়ে আসতে হবে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবো। তখন না হয় সারাদিন আমার কোলের ওপর বসে থেকো।
মেঘার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে মুখের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দেখলো মেঘা ঘুমিয়ে গেছে। মেঘাকে ঠিকঠাক মতো বালিশে শুইয়ে দিয়ে ড্রয়ার থেকে ফাইলগুলো নিয়ে নীচে ড্রয়িং রুমে চলে গেল ইয়াসির। দেখলো সায়ন বসে আছে। ইয়াসিরকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালো সায়ন। ইয়াসির সারভেন্টকে দুই কাপ কফি অর্ডার দিয়ে সায়নকে সব কিছু বুঝিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি চলে আসায় কফিটুকু খেতে খেতেই বাকি আলোচনাটুকু সেরে ফেললো দুজনে। সায়নকে বিদায় দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা পর রুমে এলো ইয়াসির। মেঘা তখনও ঘুমোচ্ছে। ইয়াসির ঘুমন্ত মেঘার পাশে বসে মেঘার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। আরও আধ ঘণ্টা পর মেঘা চোখ খুলে তাকালো দেখলো ওর পাশে শুয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও ইয়াসিরের কাছে এগিয়ে গেলো। ইয়াসির ওকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মেঘা ইয়াসিরের বুকে মাথা রাখলো।
ঘুম হয়েছে বউ?
ইয়াসিরের মুখে বউ ডাকটা শুনে আবারও লজ্জা পেলো মেঘা। কোনো উত্তর না দিয়ে ইয়াসিরের বুকে নাক ঘষে দিল। তারপর ইয়াসিরের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিয়ে এলো। বেরিয়ে এসে বেডে বসতে গেলেই ইয়াসির ওকে টেনে নিয়ে কোলে বসিয়ে নিল তারপর বেশ খানিকটা সময় নিয়ে মেঘার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বললো,,,
মেঘ আমি তোমাকে খুবই ইম্পর্ট্যান্ট একটা কথা বলতে চলেছি। কোনো রকমের বাধা দিওনা আমার বলার সময়। এখন তোমারও অধিকার আছে সত্যিটা জানার। কথা দাও আমি যা যা বলতে চলেছি তা তুমি মন দিয়ে শুনবে।
তাহলে কি উনি সত্যিই অন্য কোনো উদ্দেশ্য আমাকে বিয়ে করেছেন? আমায় উনি ভালোবাসেন না?
মেঘা মনে মনে এসব চিন্তা করছিল তখনই ইয়াসিরের কণ্ঠ ভেসে এলো।
কি হলো কথা দাও।
কথা দিলাম কোনরকম ডিস্টার্বেন্স ক্রিয়েট করবো না।
মেঘ যেদিন তুমি জন্মেছিলে সেদিনও আকাশে ঘন কালো মেঘের অস্তিত্ব ছিল তাইতো তোমার মা আদর করে তোমার নাম রেখেছিল মেঘা। কিন্তু দেখো যে মা তোমাকে আদর যত্নে একটা বছর বড় করলো সেই সারা জীবনের মতো তোমাকে ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু সেই মমতাময়ী তোমায় এই পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখতে সব ধরনের রিস্ক নিয়েছিলো। যাতে তার ক্ষতি হলেও যেনো তোমার ঊনিশ বছর বয়সে যেনো কেউ তোমায় বাঁচিয়ে নেয়।
কথাগুলো বলে থামলো ইয়াসির। মেঘার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো মুখটা একরাশ চিন্তা আর প্রশ্ন নিয়ে ইয়াসিরের দিকে চেয়ে আছে কিন্তু কথা দেওয়ার জন্য কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না। ইয়াসির আবারও বলতে শুরু করলো,,,
মেঘ যাকে তুমি নিজের মা বলে চেনো সে তোমার নিজের মা নয়। তোমার মা ছিলেন মাহিরা নৌশিন। তোমার বাবা সম্পত্তির লোভে তোমার মায়ের সঙ্গে মিথ্যে বিয়ের নাটক করেছিল। তোমার মাকে ড্রিংক করিয়েছিল সব সম্পত্তি লিখিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তখন তুমি ওনার শরীরে একটু করে বেড়ে উঠছিলে। হয়তো উনিও জানতেন এমন কিছু হতে পারে তাই তোমার নামে সম্পত্তির একটা উইল তৈরি করেছিলেন। তোমার মা বিজনেস জগতে বিজনেস ওম্যান নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তোমার বাবা আগে থেকেই বিবাহিত ছিলো। কিন্তু তোমার মায়ের সম্পতি পাওয়ার জন্য তোমার মাকে খুন করতেও পিছুপা হয়নি। যখন তোমার এক বছর বয়স তখন তোমার মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তোমার বাবা ফার্ম হাউসে নিয়ে যায় আর ওখানেই নির্মমভাবে হত্যা করে। ওনার স্ত্রী মেহের চৌধুরীও ওনাকে সাহায্য করেছিলো।তুমি ছোট থাকায় তোমার মায়ের স্মৃতিগুলো তোমার মনে পড়ে না। কালকে কোর্টে ওদের শুনানি হবে। ফাঁসির শাস্তি দিতে পারে। এছাড়াও উনি ড্রাগস স্মাগলিং করেন আর তার সঙ্গে আরও অনেক খারাপ কাজে লিপ্ত আছে।
কথাগুলো শেষ হতেই ইয়াসির দেখলো মেঘার চোখে ভিড় করা অশ্রু বিন্দুগুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গাল দুটো ভিজিয়ে দিচ্ছে। পরম যত্নে ইয়াসির ওর গাল দুটো মুছে দিলো।
এবার তোমার যা ইচ্ছা জিজ্ঞেস করতে পারো।
আমার মনে তো কোনো দোষ করেনি তবুও কেন চলে গেল বলুন তো? হয়তো এই জন্যই মেহের চৌধুরীও আমাকে প্রতি পদে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি আমার নিজের মা নন। আমার আপন বলতে তো কেউ থাকলো না ইয়াসির সাহেব।
একদম বাজে কথা বলবে না। আমি আছি তো সারাজীবন তোমার হয়ে।
মেঘা এখনও কেঁদে যাচ্ছে। ইয়াসিরও বাধা দেয়নি। থেকে থেকে কিছুক্ষন পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছে মেঘার ছোট্ট শরীরটা। ইয়াসির এবার বলে উঠলো,,,
অনেক কান্নাকাটি করেছো এবার ফ্রেশ হয়ে নাও। জেনি আসতে চাইছে তোমার কান্নার জন্য বারন করেছি। বেশি দেরি করলে কিন্তু ও ওর সামনে যাকে পাবে তাকেই কামড়ে দেবে। তুমি কি চাও তোমার জন্য কারোর জলাতঙ্ক হোক?
মেঘা মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো।
তবে যাও চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে এসো।
মেঘা চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে এসে দেখলো ইয়াসির আর জেনি খুনসুটি করছে। মেঘাকে দেখেই জেনি ওর কাছে গিয়ে লেজ নাড়াতে নাড়াতে গোল করে চারপাশে ঘুরতে শুরু করলো। মেঘা ওকে কোলে তুলে নিয়ে বেডে বসলো। জানি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
কি রে তুই আমার বউয়ের দিকে এভাবে কেনো তাকিয়ে আছিস?
মেঘা আবারও লজ্জা পেলো। আর ওখানে না বসে নীচে ড্রয়িং রুমে চলে এলো জেনিকে কোলে নিয়ে। ছোটো একটা রেড কালারের বল নিয়ে জেনির সঙ্গে খেলা জুড়ে দিলো। ইয়াসির বেড রুমে বসে ফোন স্ক্রোল করতে শুরু করলো।
প্রায় আধ ঘন্টা পর নীচে নেমে এলো ইয়াসির। দেখলো মেঘা ক্লান্ত দেখাচ্ছে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে আর ওর পাশেই গুটিশুটি হয়ে বসে আছে জেনি। ইয়াসিরকে নামতে দেখেই ইয়াসিরের কাছে দৌড়ে চলে গেল। ইয়াসির ওকে কোলে তুলে নিলো। তারপর মেঘার কাছে এগিয়ে গেলো।
মেঘ কোথাও যেতে চাও?
মেঘা মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। ইয়াসিরের কথাগুলো শোনার পর থেকে আর একটা কথাও বলেনি মেঘা। এবার ইয়াসির জেনিকে নামিয়ে দিয়ে মেঘাকে কোলে তুলে নিলো।
#চলবে