#তুমি_তাই,পর্বঃ১৫,১৬
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৫
কপালে ভেজা রুমাল চাপা দিয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফুয়াদ। কিছুক্ষণ আগেই তাঁর কপাল বরাবর কোকাকোলার একটা ক্যান ছুঁড়ে মারা হয়েছে। এবং এত জোরে ছুঁড়ে মারা হয়েছে যে কপাল ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে যিনি ছুঁড়ে মেরেছেন তাঁর বিন্দুমাত্রেও আফসোস নেই। বরঞ্চ রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর চিৎকারে ফুয়াদের কানে তালা লেগে গেছে। কানের কাছে শিঁইইই শিঁইইই টাইপ একটা আওয়াজ হচ্ছে।
ভর্তি পরীক্ষার দেওয়ার জন্য নিজের সার্টিফিকেট গুলো ফটোকপি করতে এসেছিলো তিন্নি। ফাইল থেকে পেপারগুলো বের করে দেখে নিচ্ছিলো কোনটা কোনটা ফটোকপি করতে দেবে, ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা কোকাকোলার ক্যান এসে কাগজের ওপর পড়লো। ভেতরের অবশিষ্ট পানীয় পড়ে ভিজে গেলো সার্টিফিকেটের কাগজগুলো। তাড়াহুড়া করে গুলো ঝেড়ে ফেলতে গিয়ে সার্টিফিকেটের একাংশ টান লেগে ছিঁড়ে গেছে। ব্যস শুরু হয়ে গেলো লঙ্কাকাণ্ড।
কান্নাকাটি, চিৎকার চেঁচামেচি, ক্যান ছুঁড়ে মারা ব্যক্তির চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধারসহ সর্বোপরি তাঁর কপাল বরাবর পুনরায় ক্যানের বোতলটা ছুঁড়ে মেরেও শান্ত হলো না তিন্নি। রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে লোক জড় করলো ফুয়াদকে মারার জন্য।
ফুয়াদ ব্যতিব্যস্ত হয়ে সামনে এগিয়ে এলো। তার কপালে তখনো রুমাল চাপা দেওয়া। মানুষ জন হাঁ করে তামাশা দেখছে। এই নিতান্ত ভদ্রটাইপ ছেলেটার সঙ্গে তিন্নির ঠিক কি কারণে শত্রুটা থাকতে পারে সেটা ওরা বুঝতে পারছে না।
ফুয়াদ তিন্নিকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে বিনয়ী গলায় ডাক দিলো,
-‘এক্সকিউজমি ম্যাম। আমার নাম ফুয়াদ…’
সে কথা শেষ করার আগেই তিন্নি তেঁতে উঠলো। পারলে সে আবার ফুয়াদের মাথা ফাটিয়ে দেয়। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,’ধন্য হলাম। ধন্য হলাম আপনার মত এমন অসভ্য লোকের নাম জানতে পেরে। আরো ধন্য হতাম যদি বাড়ি মেরে আবার আপনার কপালটা ফাটিয়ে দিতে পারতাম।’
-‘আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি আসলে ক্যানটা বিনে ফেলতে চেয়েছিলাম। ভুলবশত আপনার ফাইলের ওপর পড়ে গিয়েছে।’
-‘ভুলবশত? আপনি তিন মাইল দূর থেকে ক্যানের বোতল ছুঁড়ে মারবেন কেন? রাস্তাঘাট কি ক্যান ছোড়াছুঁড়ির জায়গা? এখন যে আমার সার্টিফিকেট গুলো নষ্ট হয়ে গেলো এর দায়ভার কে নিবে?’
ফুয়াদ লজ্জিত মুখে অনুনয় করে বললো,
-‘আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে আমি আপনার পেপার গুলো নতুন করে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। টাকাপয়সা যা লাগবে আমি দেবো। ‘
-‘অবশ্যই দেবেন। কেন কিছু মনে করবো? জিনিস নষ্ট করেছেন, এখন সেটার ক্ষতিপূরণ দেবেন এখানে আমার মনে করার কি আছে? আপনি আজই যাবেন আমার সঙ্গে।’
ফুয়াদ মনে মনে অবাক হলেও রাজী হয়ে গেলো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঝামেলা মিটিয়ে নিতে চাইলো। তিন্নির রাগ যদিও কমে নি তবে ফুয়াদের ফুলে থাকা কপালের দিকে তাকিয়ে খানিকটা শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছে।
রিক্সায় উঠে ফুয়াদ খানিকটা আলাপ জমাতে চেষ্টা করলো। কারণ, তিন্নিকে সে প্রথম দেখাতেই চিনতে পেরেছে। এই মেয়েটার সঙ্গেই একবার বিয়ের প্রস্তাব উঠেছিলো তাঁর। কিন্তু কি একটা ঝামেলার কারণে ফুয়াদের ফুপু সম্বন্ধটা এগোতে দেন নি। এখন মনে হচ্ছে না দিয়ে ভালোই করেছে। এমন ঝগড়ুটে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে ফুয়াদের জীবনটা তামা তামা হয়ে যেতো। এই বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই।
তবে যাই হোক না কেন, ফুয়াদ এইমুহূর্তে ভীষণ লজ্জিত। সে খুবই রেস্পন্সিবল এবং ডিসেন্ট প্রকৃতির ছেলে। এরকম একটা আনসোশ্যাল কাজ তাঁর দ্বারা কোনদিন ঘটে নি। আজকে হঠাৎ কি হলো কে জানে। নেহায়েত ছেলেমানুষি করে ক্যানটা বিন বরাবর সই করতে গিয়েছিলো। তাতেই অঘটনটা ঘটে গেলো। সুতরাং তিন্নির রেগে যাওয়াটা একেবারেই অমূলক নয়। মোলায়েম কন্ঠে বললো,
-‘বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছা করে করি নি।আনফরচুনেটলি আপনার সঙ্গে ঘটনাটা ঘটে গেছে। কেন যে হঠাৎ ক্যানটাকে ছুঁড়ে মারতে গেলাম! ভেবেছিলাম টার্গেট মিস হবে না। সরি, এক্সট্রিমলি সরি।… আপনি কি এখনো আমার ওপর রেগে আছেন?’
-‘কেন রেগে থাকলে কি করবেন? পা ধরে মাফ চাইবেন?’
ফুয়াদ গলা খাঁকারি দিলো। নাহ! এই মেয়ের সঙ্গে কথা না বলাই ভালো। মানসম্মান রাখবে না। ঠোঁটকাটা, বদরাগী।
বোর্ড অফিসে পৌঁছানোর পর তাঁরা থানায় ডাইরী করতে বললো। সেখান থেকে তিন্নিকে নিয়ে থানায় গেলো ফুয়াদ। থানা থেকে জিডির কপি নিয়ে সেটা আবার বোর্ড অফিসে জমা দিতে হবে। একদিনে সমস্তটা সম্ভব নয়। তাই কালকে আবার বেরোতে হবে। থানা বেরোনোর পর ফুয়াদ ভদ্রতা রক্ষার্থে জিজ্ঞেস করলো,
-‘কিছু খাবেন? এতক্ষণ যাবত ঘোরাঘুরি করছেন নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছ?’
-‘তো?’
-‘না মানে খিদে না পেলে থাক।’
তিন্নি জবাব দিলো না। তাঁর মন মেজাজ ভালো নেই। ইদানীং আগের চাইতে অনেক বেশি খিটখিটে হয়ে গেছে সে। মায়ের সঙ্গে পর্যন্ত ঝগড়া বেধে যায়। আর ফুয়াদ তো বাইরের মানুষ। বললো,
-‘আমি এখন কিছু খাবো না। বাসায় যাবো।’
-‘ঠিক আছে আমি আপনাকে রিক্সায় তুলে দিচ্ছি।’
-‘লাগবে না। আমি উঠতে পারবো।’
-‘তাহলে আপনার ঠিকানা কিংবা ফোন নম্বরটা দিয়ে যান। কালকে তো আবার বোর্ড অফিসে যেতে হবে।’
এতক্ষণে কিছুটা শান্ত হলো তিন্নি। ছেলেটা নেহায়েত মন্দ নয়। অনিচ্ছাকৃত ভাবে একটা ভুল করে ফেললেও সেটা শুধরাতে চাইছে। নরম হয়ে এলো তাঁর গলা। বললো,
-‘আপনাকে আর যেতে হবে না। আমি জমা দিয়ে আসবো। ধন্যবাদ।’
-‘সেটা কি করে হয়? আমার জন্যই তো আপনার ক্ষতিটা হলো।’
-‘দেখুন আপনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমাকে সাহায্য করেছেন তার জন্য আপনাকে থ্যাংক ইউ। এর বেশি আর কিছু করার প্রয়োজন নেই। অপরিচিত কারো সঙ্গে আমি নিজের ফোন নাম্বার কিংবা বাসার ঠিকানা কোনটা শেয়ার করতে রাজি নই। সরি। ভালো থাকবেন। আসি।’
কথা শেষ করে চট করে একটা রিক্সায় উঠে পড়লো সে। ফুয়াদ নিজেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারায় নয় এই মেয়ের সঙ্গে তাঁকে আর কোথাও যেতে হবে না সেইজন্য। নিজের কৃতকর্মের জন্য ফুয়াদ অবশ্যই অনুতপ্ত কিন্তু তিন্নির সঙ্গে দেখা আবার করাটা খুবই কষ্টকর। ভালো মানুষেরও মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। রাগ উঠে যাবে ওর ত্যাড়াত্যাড়া কথা শুনলে। যদিও আজকে দোষটা ফুয়াদের কিন্তু সে বেশ বুঝতে পেরেছে তিন্নি স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই রাগী। আবার ঝগরুটেও।
★
নিলির বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রেজোয়ান এবং জাহিদ। রেজোয়ান বারবার জাহিদকে ঠেলছে ভেতরে যাওয়ার জন্য। জাহিদ ভয়ে রাজি হচ্ছে না। নিলির মেজাজ খারাপ। গতকাল রাতেও জাহিদকে ফোন করে রেজোয়ানের নামে নালিশ করেছে। বারবার করে বলেছে জাহিদ যেন রেজোয়ানকে বোঝায় সে ভুল করছে। রেজার মতন একটা ভালো মানুষের সঙ্গে অন্যায় করছে রেজোয়ান। এরজন্য নিলি তাঁকে কোনদিন ক্ষমা করবে না।
আর সেই জাহিদকেই কিনা এখন রেজোয়ান নিলিকে কনভিন্স করার জন্য পাঠাচ্ছে! অসহায় লাগছে জাহিদের। এদের দুজনের মাঝখানে পড়ে তাঁর অবস্থা দফারফা হয়ে যাচ্ছে। দুজনে দুদিক থেকে খারাপ করে দেয়।
রেজোয়ান পুনরায় তাড়া দিলো। জাহিদ মিনমিন করে বললো,’না মানে বলছিলাম কি স্যার, কথাগুলো আপনি গিয়ে বুঝিয়ে বললে ভালো হতো না?’
-‘আমি যতবার বলেছি ও কানে তোলে নি। ওর ধারণা আমি বানিয়ে বানিয়ে রেজার নামে খারাপ কথা বলছি। তাই তুমি গিয়ে বলবে। ওর রিয়েকশন যদি পজিটিভ হয় তখন আমি ভেতরে ঢুকবো।’
বাহ! তারমানে ঝড় যা যাক , সব জাহিদের ওপর দিয়েই যাক। রেজোয়ান সেইফ থাকলেই হলো। স্বার্থপর সুবিধাবাদী লোক একটা!
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো জাহিদ। সে-ই বোধহয় প্রথম ব্যক্তি যে কি না বসের হয়ে তাঁর প্রেমিকার ঝাড়ি খেতে যাচ্ছে। অথচ সে নিজে এই জীবনে একটা প্রেম করতে পারে নি। অর্ধেক জীবন কেটে গেছে রেজোয়ানের সমস্যার সমধান করতে করতে। পারিবারিক কিংবা ব্যবিসায়িক যাই হোক না কেন রেজোয়ানের সকল সমস্যার সমাধানে জাহিদের ভূমিকা অতুলনীয়।
রেজোয়ান অবশ্য এসব কিছু ভাবছে না। তাঁর ধারণা জাহিদের সঙ্গে কোনরূপ খারাপ ব্যবহার করবে না নিলি। জাহিদকে সে রেজোয়ানের চাইতে বেশি ভালো জানে। কিন্তু আধঘন্টা বাদে যখন জাহিদ চুপসে যাওয়া বেলুনের মত মুখ করে বেরোলো তখন রেজোয়ানের ধারণাটা পালটে গেলো। জাহিদ হতাশভাবে মাথা দুলিয়ে বললো,
-‘আই অ্যাম সরি স্যার। আই কান্ট হেল্প। সি ইজ এক্সট্রিমলি ফেড আপ উইথ ইউ। বিয়ের দিন মি. রেজাকে কিডন্যাপ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ‘
জাহিদকে দেখে প্রথমে খুশিই হয়েছিলো নিলি। ভেবেছিলো রেজোয়ানের কুকীর্তির কথা সব জানাবে। রেজার মুখ থেকেই শুনেছে সে রেজোয়ান নাকি বিয়ের দিন রেজার কিডন্যাপ করার হুমকি দিয়েছে। মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে।
সবশুনে মনে মনে রেজার প্রতি দুঃখ বোধ করলো নিলা। তাঁকে হেল্প করতে গিয়ে বেচারা বিনাদোষে বারবার রেজোয়ানের হাতে অপদস্থ হচ্ছে। ভীষণ রাগ হলো নিলির। জাহিদের সঙ্গে এর একটা বোঝাপড়া করে নিতে চাইলো। হয় জাহিদ রেজোয়ানকে বুঝাবে নতুবা নিলি নিজে থানায় গিয়ে রেজায়ানের নামে কমপ্লেইন করে আসবে।
কিন্তু এসবের মাঝখানে জাহিদের মুখ থেকে উলটো রেজার বদনাম শুনে খেপে গেলো। তাঁর ধারণা, রেজোয়ানের শেখানো বুলি কপচাতেই এসেছে জাহিদ। তাই রাগে দুঃখে, ভদ্র ভাষায় কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে বললো।
জাহিদের মুখে সব শুনে রেজোয়ানের একই সঙ্গে মেজাজ খারাপ এবং অসহায় লাগছে। রেজা খুব ভালোভাবে ব্রেনওয়াশ করেছে নিলির। কারো কথা বিশ্বাস করছে না সে। এভাবে চলতে থাকলে বিয়েটা কোনতেই ঠেকাতে পারবে না রেজোয়ান। জাহিদকে অপেক্ষা করতে বলে সে নিজে গেলো নিলির সঙ্গে কথা বলার জন্য।
#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৬
রেজোয়ানকে ভেতরে দেখে নিলির মুখ কালো হয়ে গেলো। আবার কোন মতলবে এসেছে কে জানে। মুখ ঘুরিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যেতে নিলো। তখুনি ডাক দিলো রেজোয়ান,
-‘নিলি! দাঁড়াও তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’
নিলি দাঁড়ায়। বলে,’আমি তোমার কোন কথা শুনতে ইচ্ছুক নই।’
-‘কি মনে হয় তোমার? আমরা সবাই মিথ্যে কথা বলছি?’
-‘বলছো না? একটা নিরপরাধ মানুষকে তুমি আমার জন্য শুধুশুধু কষ্ট দিচ্ছো তারপরেও বলছো মিথ্যে বলছো না?’
-‘না বলছি না। যা সত্যি তাই বলেছি।’
-‘তোমার সব সত্যি আমার কাছে মিথ্যে। আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে মি.রেজা সম্পর্কে বদনাম করছো।’
রেজোয়ানের মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যতবার নিলিকে বোঝাতে গেছে একই টেপরেকর্ডার বাজিয়েছে নিলি। রেজা হারামজাদাটা কি বুঝিয়েছে আল্লাহই জানে।
-‘আমার কথা নাহয় তোমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু জাহিদ? ওকে তো তুমি বিশ্বাস করো?’
-‘না করি না। ও তোমার লোক।’
রেজোয়ান ঠোঁট দিয়ে জিহ্বা ভেজালো। শার্টের হাতা গোটালো। সোফায় বসে দু আঙ্গুলে কপাল চেপে ধরলো। বললো,
-‘ওকে ফাইন। মুখের কথায় তোমার বিশ্বাস হবে না। আমি প্রমাণ দেবো। কিন্তু তার আগে তুমি একটা কথা বলো, এই বিয়েতে তুমি সত্যিই খুশি?’
নিলির মুখটা হঠাৎ করেই চুপসে গেলো। গাঢ় বেদনায় ছেয়ে গেলো সুন্দর, সুশ্রী মুখখানা। রেজাকে সে ভালোবেসে বিয়ে করছে না। রেজা নিজেও জানে সে কথা। আর সেজন্যই নিলি মানুষটাকে এত বেশি সম্মান করে। নিঃস্বার্থভাবে শুধুমাত্র তাঁকে সাহায্য করার জন্য রেজা এত কষ্ট সহ্য করছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’হ্যাঁ আমি। খুশি।’
রেজোয়ান চুপচাপ নিলির মুখের দিকে চেয়ে রইলো। নিজের বিব্রত ভাব লুকানোর জন্য মাথা নিচু করে ফেললো নিলি। ঘনঘন ওড়না ঠিক করলো।
-‘আই ক্যান সি। তুমি কেমন খুশি সেটা আমি দেখতেই পারছি।’
-‘দেখতে যখন পেরেছো এবার তাহলে বেরোও। আশাকরি আর কোন সন্দেহ নেই তোমার।’
রেজোয়ান আচমকা হাসতে শুরু করলো। অট্টহাসিতে মৃদু কেঁপে উঠলো তাঁর শরীর। হাসতে হাসতে ঠাট্টার সুরে বললো,
-‘খুশি? তুমি? বিয়েতে? ভালো। খুব ভালো।’
কথা শেষ করে আবার হাসলো রেজোয়ান। নিলির মেজাজ খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করে এমন নাটক করছে রেজোয়ান। এমন ভাব করছে যেন নিলির মনের কথা সব বুঝে বসে আছে সে। অথচ যখন কাছে গিয়েছিলো ফিরে তাকায় নি। এখন এসেছে নাটক করতে। থমথমে গলায় বললো,
-‘কি চাও কি তুমি? শাস্তি দিতে চেয়েছিলে মাথা পেতে নিয়েছি। তোমার চোখের সামনে থেকে চলে আসতে বলেছিলে চলে এসেছি, তাহলে কেন তুমি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছো না? সমস্যাটা কি তোমার?’
-‘তুমি যেটাকে শান্তি ভাবছো সেটা আসলে শান্তি নয়। রেজার মতন মানুষ কখনো কাউকে শান্তি দিতে পারবে না।’
-‘আর তুমি? তুমি বুঝি খুব পারবে? তো কীভাবে দেবে শুনি? আবার জেলে ঢুকিয়ে? চুরির অভিযোগ দিয়ে? সারাদিন অফিসে রোবটের মতন খাটিয়ে? ভুল হলে কুকুর বেড়ালের মতন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নাকি বিছানায় যাওয়ার অফার দিয়ে….’
বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো নিলি। কি অসহ্য বেদনায় তাঁর দিনগুলো কেটেছিলো এটা কেবল সে-ই জানে। বিনাদোষে দিনের পর দিন তাঁকে অপমান করেছে রেজোয়ান। একবারও নিলির কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করে নি। এখন এই মানুষটা এসেছে ভালোবাসার কথা শোনাতে। বিশ্বাস করে না নিলি। একফোঁটাও বিশ্বাস করেনা।
রেজোয়ান অনুশোচনায় মাথা নিচু করে ফেললো। বুকের ভেতর পিনপিন ব্যথা অনুভব করলো। রাগে, অভিমানে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো সে। সত্যি মিথ্যে যাচাই করার প্রয়োজন মনে করে নি। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পাহাড়সম ব্যথা দিয়েছে। হাটুমুড়ে নিলির সামনে বসে পড়লো সে। ছলছল চোখে চেয়ে থেকে বললো,’ভুল হয়ে গেছে নিলি। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। না জেনে আমি তোমার সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। এরজন্য তুমি আমাকে যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেবো। কিন্তু বিশ্বাস করো,আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি ভালো থাকতে পারি নি। নিজের অজান্তেই সেই একই কষ্ট আমার বুকে এসে লেগেছে। আমাকে আর একটা বার সুযোগ দাও। প্লিজ নিলি।’
নিলির চোখ মুছে মলিন হাসলো। বললো,’তোমার কি মনে হয় রেজোয়ান? আমি তোমার হাতের পুতুল? যখন যা খুশি বলবে, যখন যা খুশি করবে আমি মেনে নেবো? আমার কোন আত্মসম্মান নেই? মি.রেজা আমার জন্য অনেক করেছেন। তাঁকে আমি অপমানিত হতে দিতে পারি না।’
রেজোয়ানের ক্লান্ত লাগছে। কি করলে সে নিলিকে বোঝাতে পারবে রেজা তাঁর সঙ্গে অভিনয় করছে। কোন মন্ত্রবলে নিলিকে সত্যিটা বোঝাতে পারবে।
-‘তুমি কি আমার কোন কথাই বিশ্বাস করবে না?’
-‘না।’
-‘বেশ। তাহলে আমি আমার যা করার করবো। জেনেশুনে তোমাকে তো আমি ঐ লম্পটটার হাতে তুলে দিতে পারি না।’
-‘মুখ সামলে কথা বলো। তুমি কাকে কি বলছো?’
-যা সত্যি তাই বলছি।’
বেরিয়ে গেলো রেজোয়ান। নিলি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রেজোয়ান মিথ্যেবাদী, প্রতারক, নিষ্ঠুর। নিলি অনেক কষ্ট দিয়েছে, অনেক অপমান করছে। কিন্তু তারপরেও একেই ভালোবাসে নিলি। নিজের প্রতি রাগ হয় কিন্তু সত্যিটা অস্বীকার করতে পারে না। তবে এই সত্যিটা কোনদিন রেজোয়ানকে জানতে দেবে না সে। রেজাকেও কোন মতে রেজোয়ানের কাছে ছোট হতে দেবে না।
★
জাহিদ এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো। রেজোয়ানকে শুকনো মুখে বেরোতে তাঁর নিজেরও মুখ কালো হয়ে গেলো। বললো,’উনি বিশ্বাস করে নি তাই না স্যার। আমি জানতাম। কিন্তু এবার কি হবে? আমরা কি সত্যিই সত্যিই রেজাকে কিডন্যাপ করবো?’
-‘ঐ হারামিকে কিডন্যাপ করে কি হবে? উল্টে নিলি খেপে যাবে।’
-‘তাহলে? বিয়ে আটকাবো কি করে?’
জাহিদকে অবাক করে দিয়ে রেজোয়ান হাসলো। ফিসফিস করে বললো,’আমরা নিলিকে কিডন্যাপ করবো!’
জাহিদ হাঁ করে রেজোয়ানের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। সে ভেবেছিলো নিলিকে কনভিন্স করতে না পেরে রেজোয়ান বুঝি হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন তো দেখছে রেজোয়ান পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ গতিতে মাথা খাটিয়েছে। অতঃপর হাসিমুখে দুজনেই নিলি বাসার সামনে থেকে প্রস্থান করলো।
★
পরেরদিন আবার জাহিদকে নিয়ে নিলির বাসায় রওনা হলো রেজোয়ান। জাহিদ কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করতেই বললো, ‘নিলিকে জ্বালাতন করতে’।
ভেতরে ঢুকে রেজোয়ান নিলিকে দেখে হাসলো। প্রতিউত্তরে নিলি ভ্রু কুঁচকালো। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,’আবার কেন এসেছো তুমি?’
-‘তোমার খোঁজখবর নিতে। কেমন আছো?’
নিলি রেজোয়ানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,’আমার খোঁজখবর নিতে?’
-‘হ্যাঁ। কেন নিতে পারি না?’
-‘না পারো না। দুদিন বাদে আমার বিয়ে। এইমুহূর্তে তোমার এত ঘনঘন এই বাসায় আসা আমার এবং মি.রেজার দুজনের জন্যই বিব্রতকর এবং অস্বস্তিকর!’
-‘রেজা আমার আসা নিয়ে কিছু বলেছে তোমাকে?’
-‘কি বলবে? আমি নিজে থেকেই তোমাকে আসতে বারণ করছি।’
-‘কেন?’
-‘কেন মানে? মি.রেজা নাহয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলছে না কিন্তু আমি তো অবিবেচক নই। তুমি আমার হবু স্বামীকে কিডন্যাপ করার হুমকি দিয়েছো, তোমাকে নিশ্চয়ই আমি আমার বাসায় সাদরে আমন্ত্রণ করতে পারি না?’
রেজোয়ানের অসহ্য লাগছে। নিলি তাঁর গালে দুঘা বসিয়ে দিলেও বোধহয় এত কষ্ট লাগতো না যতটা রেজার পক্ষ নিয়ে কথা বলায় লাগছে। তার ওপর আবার বলছে হবু স্বামী! অসহ্যকর। কাছে এগিয়ে গেলো সে। নরম হাতে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে চাইলো নিলিকে। নিলি চট করে সরে গেলো। কঠিন গলায় বললো,’কথায় কথায় আমার গায়ে হাত দেবে না।’
-‘কেন? অশুচি হবে? রেজা দিলে হবে না?’
-‘তিনি কখনো আমার গায়ে হাত দেন নি।’
-‘তিনি? বাহ! রেজা এখন তিনি। তা তোমার এই তিনি আর কি কি করেন না?’
-‘তোমার মতন মিথ্যাচার, আরেকজনের ক্ষতি করা, মানুষকে কষ্ট দেওয়া, মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা এসব তিনি করেন না।’
বাধা দেওয়ার পূর্বেই রেজোয়ান নিলিকে কাছে টেনে নিয়ে এলো। দুহাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে বললো,’তবে তো তিনি সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসীর আবার বিয়ের প্রয়োজন কি? আমি রক্তমাংসে গড়া মানুষ আমার বিয়ে প্রয়োজন।’
নিলির গলা কাঁপছে। রেজোয়ান শক্ত করে ধরেছে ওকে। মৃদু নিশ্বাস ফেলছে মুখের ওপর। অদ্ভুত ভাবে হাসছে।
এদিকে তার অবস্থা দেখে রেজোয়ানের হাসি পেয়ে গেলো। নতুন প্রেমে পড়া কিশোরীর মত ছটফট করছে নিলি। দেখতে বেশ লাগছে।
-‘এমন ছটফট করছো কেন? আমি তো কিছুই করছি না?’
নিলির জবাব দেওয়ার জন্য মুখটাও খুলতে পারছে না। অসভ্যটা একেবারে ঠোঁটের কাছে মুখ নিয়ে এসেছে। ঠোঁট বন্ধ করে চোখ দিয়ে শাসালো সে। এরমানে ‘আমাকে ছাড়ো।’
রেজোয়ান ফুঁ দিলো ওর মুখের ওপর। বললো,’ছাড়তে পারি এক শর্তে। স্বেচ্ছায় আমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে হবে। জড়িয়ে ধরে বলতে হবে,’রেজা একটা হিজড়া। ওকে আমি ভালোবাসি না। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।’
দুম করে তাঁর পিঠের ওপর কিল বসালো নিলি। ত্যাক্ত গলায় বললো,’অসভ্য! মুখে কিছু আটকায় না তোমার?’
রেজোয়ান হাসতে হাসতে বললো,’সিরিয়াসলি আমার কাছে প্রমাণ আছে।’
লজ্জায় অস্বস্তিতে নিলির চোখমুখ লাল হয়ে গেলো। রেজোয়ান এমন নির্লজ্জ, অসভ্য হলো কবে থেকে সেটা ও বুঝতে পারছে না। আবার বলছে প্রমাণ আছে। ছিঃ ছিঃ ছিহ!
-‘তোমার লজ্জা করছে একটা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে এধরণের অসভ্য কথা বলতে?’
রেজোয়ানের হাসি থামে না। ক্ষিপ্ত নিলিকে আরেকটু রাগানোর জন্য চট করে চুমু খেয়ে নিলো সে। বললো,’তোমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। চুমু খেলে মাথা ঠাণ্ডা হয়।’
নিলি প্রথমে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতবম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর রাগত মুখে গর্জে উঠে বললো,’অসভ্য,বর্বর। বেরোও আমার বাসা থেকে।’
-‘যাবো না।’
-‘যাবে না মানে?’
-‘যাবো না মানে যাবো না।’
-‘আমি তোমাকে পুলিশে দেবো।’
-‘দাও। শোধবোধ হয়ে যাবে।’
নিলির রাগে মাথার চুল টেনে ধরলো। রেজোয়ান ইচ্ছে করে তাঁকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ দম নিয়ে, রেজোয়ানের কলার চেপে ধরলো সে। সোফা থেকে টেনে তুললো বের করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তুলে আর নড়াতে পারলো না। রেজোয়ান স্ট্যাচুর মতন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নিলি হাজার চেষ্টা করেও একচুল নড়াতে পারলো না।
-‘ছেড়ে দাও নিলি। পরপুরুষের কলার টানাটানি ভালো দেখায় না। ঘাড়ের কাছে নখের দাগ বসে গেছে। লোকে দেখলে অন্য কিছু মনে করবে।’
নিলি রাগে ঠাটিয়ে চড় মারলো গালে। চড় খেয়েও রেজোয়ান দমলো না। বললো,’সুন্দরী মেয়েদের হাতে চড় খেলে আয়ু বাড়ে। আরো দুটো মারো।’
নিলির অবস্থা কাহিল। ঠোঁট চেপে হতাশ গলায় বললো,’তুমি ব্যবসা ছেড়ে কমেডি শুরু করলে কবে থেকে?’
-‘যবে থেকে রেজা সন্ন্যাসী ছেড়ে বিয়ের কথা ভাবছে তবে থেকে।’
নিলির আর টানাটানি করার শক্তি নেই। হাঁপিয়ে গেছে। হাতপা ছড়িয়ে সোফার ওপর বসে পড়লো সে। রেজোয়ান টাইয়ের নট ঠিক করে নিয়ে বললো,’গা থেকে ওড়নাটা খুলে দাও। বাতাস লাগবে।’
নিলি সোফার পাশের টেবিল থেকে ছোট ফুলদানীটা নিতে যাচ্ছিলো ছুঁড়ে মারার জন্য। রেজোয়ান খপ করে তাঁর হাত ধরে ফেললো। মুচকি হেসে বললো,’তোমার ভালোর জন্যই তো বলছিলাম। তাই বলে এত রাগ করতে হয়? আচ্ছা ঠিক আছে আর বলবো না।’
-‘তুমি বেরোও আমার বাসা থেকে।’
-‘না গেলে হয় না?’
নিলি আবার চোখ রাঙালো। রেজোয়ান মুখে প্রচ্ছন্ন হাসি ঝুলিয়ে বললো,’ঠিক আছে যাচ্ছি। রাতে আবার দেখা। ডিনার করবো একসাথে।’
নিলির জবাবের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে গেলো সে। নিলি উপুড় হয়ে সোফায় শুয়ে রইলো। রেজোয়ানের বলে যাওয়া কথাটা নিয়ে মাথা ঘামালো না। কারণ সে জানে রেজোয়ান মোটেও রাতের বেলা বাসায় আসবে না। দুজনের সম্পর্ক থাকাকালীন সময়েও প্রায়ই রেজোয়ান তাঁকে রাতে দেখা করার কথা বলে সারারাত অপেক্ষা করিয়ে রাখতো। ফোন দিলে বলতো আসছি। কিন্তু পরে আর আসতো না। এই নিয়ে কত মান অভিমান হতো দুজনের। সব এখন স্মৃতি। রেজোয়ান হয়ত দেখতে চাইছে রাত জেগে এখনো তাঁর জন্য অপেক্ষা করে কিনা নিলি। নিলিকে পরীক্ষা করতে চাইছে।