তুমি_তাই,পর্বঃ১৭,১৮

0
575

#তুমি_তাই,পর্বঃ১৭,১৮
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৭

ব্যবসায়িক একটা পার্টিতে এটেন্ড করার জন্য একসঙ্গে বেরিয়েছে রেজা এবং নিলি। রেজোয়ান যাওয়ার পর থেকেই নিলির মন ভালো ছিলো না। কিন্তু রেজার চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে অবশেষে বেরলো।

নতুন করে মার্কেটে প্রোডাক্ট লঞ্চ করেছে রেজোয়ান।একই প্রডাক্ট রেজারও লঞ্চ করার কথা ছিলো। কিন্তু ভ্যালিডেশনে আটকে যায়। রেজাকে জ্বালানোর জন্য হঠাৎ করে সেলিব্রেশন পার্টি রাখার সিদ্ধান্ত নিলো রেজোয়ান। নিলি এবং রেজাকেও আমন্ত্রণ জানালো।

রেডি হয়ে বিশাল হলরুমের ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো রেজোয়ান। অত্যাধিক দুঃখে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো সম্মুখপানে। একে অপরের হাত ধরে সবার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে জানাচ্ছে রেজা এবং নিলি। যেন সদ্য বিবাহিত নব দম্পতি। দুর্বিষহ যন্ত্রণায় রেজোয়ানের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। অসহায় চোখে চেয়ে রইলো নিলির হাস্যজ্জ্বল মুখখানার দিকে। তাঁরসঙ্গে থাকাকালীন সময়েও ঠিক এমনি করেই হাসতো বুদ্ধিভ্রষ্ট, মূঢ়চিত্ত রমণীটি। আর্দ্র হয়ে এলো চোখজোড়া। পুরোনো স্মৃতিগুলো নতুন করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

-‘স্যার? আপনি ঠিক আছেন?’, চিন্তিত মুখে প্রশ্নটা করলো জাহিদ। তাঁর কন্ঠে সান্ত্বনার সুর।

জবাব দিলো না রেজোয়ান। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে এগোলো। হাসিমুখে আমন্ত্রিতদের সাথে পরিচিত হতে শুরু করলো।

পার্টির একপর্যায়ে রেজোয়ানের দিকে চোখ পড়লো রেজার। দাম্ভিক হাসি ফুটে উঠলো মুখে। টেবিলের এক কোনায় বসে একের পর এক গ্লাস খালি করছে রেজোয়ান। কম্পানীর এতবড় সাফল্য অথচ তাঁর মুখে হাসি নেই। চোখের সামনে নিলির হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করছে রেজা। তাঁকে দেখেই যেন আরো বেশি করে অন্তরঙ্গতা দেখাচ্ছে।

-‘হ্যালো মি.মুরসালীন?’ হাসিহাসি মুখ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে রেজা। রেজোয়ান জবাব দিলো না।

-‘পার্টিতে এসেছি অথচ আপনি আমাকে একবারও বিয়ের জন্য কংগ্রাচুলেট করলেন না। এটা কিন্তু ঠিক না। আফটার অল আমরা একে অপরের বন্ধু! কংগ্রাচুলেশনস জানাতেই পারতেন।’

রেজোনের পাশেই চেয়ার টেনে বসলো রেজা। মদের গ্লাসটা টেনে নিয়ে ঠাট্টাসূচক গলায় বললো,’আর খাবেন না মি.মুরসালীন। অনেক হয়েছে! এবার আমার এবং নিলির কাপল ডান্স দেখবেন চলুন!’

-‘এসব বলে কোন লাভ নেই মি.রেজা। নিলি কক্ষনো আপনাকে বিয়ে করবে না। সি লাভস ইউ!’,কন্ঠে জেদ চেপে আছে রেজোয়ানের।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো রেজা। রেজোয়ানের পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে বললো,’আপনি এই সান্ত্বনা নিয়েই থাকুন মি.মুরসালীন। সেই ফাঁকে আমি নিলিকে বিয়ে করে সারাজীবনের জন্য নিজের করে নেই!’

-‘ডোন্ট টক রাবিশ! সি ইউল নেভার মেরি ইউ!’

রেজা রেজোয়ানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’সি অলরেডি কিসড মি!’

অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল তাঁর দিকে চেয়ে রইলো রেজোয়ান। যেন মুখের কথা হারিয়ে ফেলেছে। নেশার ঘোরে সত্যি মিথ্যে যাচাই এর ক্ষমতা কাজ করছে না তাঁর। মাথার ভেতর ভনভন করছে। রেজা সেই সুযোগটাই কাজে লাগালো। মৃদু হেসে বললো,’আই স্যয়ার! হার লিপ্স ওয়াজ অ্যামেজিং!’

অতিরিক্ত রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেলো রেজোয়ানের। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে রেজার নাক বরার ঘুষি মারলো। কিন্তু মিস হয়ে গেলো। নেশাগ্রস্ত থাকার ফলে নিশানা ঠিক রাখতে পারলো না। তড়িৎ গতিতে পাশে সরে গেলো রেজা। সরে গিয়ে পালটা ঘুষি লাগালো রেজোয়ানকে উদ্দেশ্য করে। সঙ্গে সঙ্গে গলগল করে রক্ত পড়তে শুরু করলো রেজোয়ানের নাক দিয়ে। এরপর শুরু হলো দুজনের মারামারি। মদের নেশায় রেজোয়ানের হুঁশ নেই। তথাপি শরীরের সব শক্তি দিয়ে রেজার পেটে লাথি মারলো। দূর থেকে সেটা দেখতে পেয়ে দৌঁড়ে এলো নিলি। ধাক্কা দিয়ে রেজোয়াকে সরিয়ে দিলো। ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো রেজোয়ান। উঠার শক্তি নেই তাঁর। একে তো মাতাল তার ওপর মারামারি। তথাপি টেবিলের কোনা চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালো।

রেজাকে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করিয়েছে নিলি। উঠে দাঁড়িয়ে নানারকমভাবে রেজোয়ানকে দোষারোপ করলো রেজা। যেন তাঁর কোন দোষই নেই। এদিকে রেজোয়ান তখনো চিৎ হয়ে পড়ে ছিলো। তাঁর দৃষ্টি নিলির দিকে। নিষ্ঠুর মেয়েটা রেজাকে নিয়েই ব্যস্ত। অথচ মার খেলো সব রেজোয়ান। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, ঠোঁট কেটে গেছে। সেদিকে নিলির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে রেজার হাত ধরে বেরিয়ে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে গেলো রেজোয়ানের। এত নিষ্ঠুর! এত পাষাণ! কবে থেকে হলো নিলি।
মারামারির খবর শুনে দৌড়ে এলো জাহিদ। রেজোয়াকে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে হস্পিটালে নিয়ে গেলো তাড়াতাড়ি।


পেটের ওপর আইস ব্যাগ ধরে আছে রেজোয়ান। জাহিদ তাকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে। খবর পেয়ে তিন্নিকে নিয়ে দেখা করতে এসেছে শায়লা মুরসালীন। জাহিদকে দেখে বহু কষ্টের মাঝেও হাসি চলে এলো তিন্নির। বউদের মতন রেজোয়ানের সেবা করে জাহিদ। ফিক করে হেসে দিলো সে। তাঁকে হাসতে দেখে জাহিদ বিব্রত হলো। শায়লা মুরসালীনকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-‘স্যার কিছুই খাচ্ছেন না ম্যাম। খালিপেটে ওষুধ খাওয়ানো যাবে না।’

শায়লা মুরসালীন গম্ভীরমুখে স্যুপের বাটিটা ওর হাত থেকে টেনে নিলেন। চামচে করে ছেলের মুখের সামনে তুলে ধরে বললেন,

-‘নে ধর, এসব দেখার জন্যই আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই জন্য তোকে আমি পড়াশোনা শিখিয়েছিলাম। লজ্জা করলো না তোর? তুই কি গুন্ডা না বদমাশ? কেন মারামারি করতে গেছিলি?

রেজোয়ান খপ করে মায়ের হাতটা টেনে ধরলো। তারপর মায়ের কোলে মাথা রেখে অশ্রুসিক্ত, বিষন্ন গলায় বললো,’আমাকে জাস্ট আরেকবার সুযোগ দাও মা। নইলে নিলির অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। ওকে আমি ভালোবাসি। ওর কোন ক্ষতি আমি মেনে নিতে পারবো না। প্লিজ মা! আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি এবার যদি ওকে ফেরাতে না পারি তবে তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। কিন্তু আরেক একবার সুযোগ দাও মা! প্লিজ!’

শায়লা মুরসালীন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তাঁর ছেলে ঐ সর্বনাশী মেয়েটার মাঝে কি পেয়েছে তিনি জানেন না। মায়ের দুঃখ, তিন্নির দুঃখ কারো দুঃখ রেজোয়ানের চোখে পড়ে না। সে কেবল আছে ঐ স্বার্থপর মেয়েটাকে নিয়ে। হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন,’তুই ভীষণ স্বার্থপর হয়ে গেছিস রেজোয়ান। মায়ের দুঃখ এখন আর তোর চোখে পড়ে না। মা আর তোকে কিচ্ছু বলবে না। তোর যা ভালো মনে হয় কর।’

রেজোয়ান করুণ চোখে জাহিদের দিকে চাইলো। একমাত্র জাহিদ ছাড়া কেউ তাঁর দুঃখ টা বোঝার চেষ্টা করে না। নিলিও না। সবাই নিজের মত করে রেজোয়ানকে ভুল বুঝে দূরে সরে যায়।
জাহিদ রেজোয়ানের অবস্থা দেখে মনে মনে দুঃখ বোধ করলো। একটা মানুষ সবার কাছে অপরাধী। সবাই তাঁর বাহিরের হাসিমুখটাই দেখে। ভেতরের কষ্ট কেউ বোঝে না।

শায়লা মুরসালীন তিন্নিকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। রেজোয়ান তখন তিন্নির সাথে আলাদা করে কথা বলতে চাইলো। তিন্নি অবাক হলেও প্রতিবাদ করলো না।

-‘কেমন আছিস তিন্নি?’

-‘ভালো।’

-‘পড়াশুনা ঠিকমত করছিস?’

-‘করছি।’

রেজোয়ান স্থিরভাবে কিছুক্ষণ তিন্নির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললো,’একটা প্রশ্ন করি তোকে?’

-‘কি প্রশ্ন?’

-‘তোর কি মনে হয়? আমি সত্যিই স্বার্থপর?’

-‘হ্যাঁ। আপনি খুব স্বার্থপর।’

রেজোয়ান হাসলো। মলিন হাসি। নিলির আজকের এমন নিষ্ঠুর আচরণ ভীষণভাবে আঘাত করেছে তাঁকে। নিলি তাঁর প্রতি এতটা কঠোর হবে ভাবতে পারে নি। বললো,’ সেজন্যই সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তাই না?’

-‘হয়ত বা। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও একথা সত্যি যে মেয়েরা আপনার মতন স্বার্থপর প্রেমিকদেরই বেশি ভালোবাসে। তাঁরা চায় তাঁদের প্রেমিক পুরুষটি এমনি করে সারাজীবন ভালোবাসুক তাঁদের। ‘

-‘ঠাট্টা করছিস?’

-‘মোটেও না। আমার জন্য কেউ এমনভাবে স্বার্থপর হলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম। আপনার ভালোবাসার রাজকন্যাটি বোকা। তাই সে আপনার ভালোবাসা বুঝতে পারছে না।’

রেজোয়ান অবাক হলো। তিন্নি আসলেই অনেক বড় বড় গেছে। অদ্ভুত সুন্দরভাবে ভালোবাসার কথা বলছে।
-‘তুই এত সুন্দর করে কথা বলা শিখলি কবে থেকে রে তিন্নি?’

তিন্নি হাসলো। নিষ্প্রাণ, নিস্তেজ হাসি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’আপনি আমার প্রশংসা করবেন না রেজোয়ান ভাই। সহ্য হয় না। আপনার সাথে আমার ঝগড়ার সম্পর্ক!’

এরপর বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলো তিন্নি। রেজোয়ান মলিন মুখে চেয়ে রইলো তিন্নি বেদনাতুর মুখখানার দিকে। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। অপরাধবোধ হচ্ছে। তিন্নিকে সে কোনদিন ভালোবাসে নি। এমন খেয়াল কখনো মস্তিষ্কে উদয়ই হয় নি। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটা যে ভুল করে তাঁকে এতটা ভালোবেসে ফেলবে এটা সে বুঝতে পারে নি। ভেবেছিলো ইনফ্যাচুয়েশন। সময় দিলে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তিন্নিকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে রেজোয়ান। আরো আগেই বাসাটা ছেড়ে দেওয়া উচিৎ ছিলো তাঁর। তাহলে তিন্নির চিন্তাধারা এতদূর গড়াতো না। শায়েলা মুরসালীনও এতটা বাড়াবাড়ি করতে পারতেন না।

#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৮

নিলি হস্পিটালে এসেছে রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা করতে। সাথে রেজাও ছিলো। তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে নিলি একাই ঢুকলো ভেতরে। দুজনকে একসঙ্গে আসতে দেখেছে জাহিদ। মেজাজ বিগড়ে গেলো তাঁর। নিলির ভেতরে ঢোকার পথে বাধা সৃষ্টি করে বললো,’এখন ভেতরে ঢোকা যাবে না। স্যার ঘুমাচ্ছেন।’

-‘আমার জরুরি কথা আছে ওর সঙ্গে।’

-‘পরে। এখন স্যারকে ডাকা যাবে না।’

-‘প্লিজ জাহিদ ভাই। আমি শুধু পাঁচমিনিট কথা বলেই বেরিয়ে যাবো।’

-‘সরি। আমাকে স্যারের হেলথের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।’

-‘আমি দেখেছি একটু আগে ওর মা দেখা করে গিয়েছে। আপনি ইচ্ছে করে আমাকে ঢুকতে দিচ্ছেন না।’

-‘উনার মায়ের সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার তুলনা করা চলে না?’

-‘আমি তুলনা করছি না। আমি জাস্ট সত্যিটা বলেছি।’

-‘সত্যির প্রসঙ্গ থাক। এমন অনেক সত্যি আছে যেগুলো আমি বললে আপনি নিজেকে সামলাতে পারবেন না।’

জ্বলে উঠলো নিলি। বললো,’বলুন দেখি! কি এমন সত্যি যেটা শুনলে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না?’

-‘এই যে আপনি একজন গোল্ড ডিগার। প্রথমে স্যার এরপর মি.রেজা। তারপর কার সিরিয়াল সেটা আপনিই ভালো জানেন।’

-‘মুখ সামলে কথা বলুন মি.জাহিদ।’

-‘তার আগে আপনি নিজেকে সামলান মিস নিলি। আমি রেজোয়ান মুরসালীন নই যে আপনার সব অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করবো। আমি ইটের জবাব পাটকেলে দিতে জানি। শুধুমাত্র স্যার বারণ করেছেন বলে, তা না হলে আপনাদের চৌদ্দ শিকের ঘানি টানিয়ে ছাড়তাম। একটা মানুষকে মেরে রক্তাক্ত করে দেওয়ার অধিকার কে দিয়েছে আপনাদের? আপনাদের তো মানুষ বলতেও ঘৃনা হচ্ছে!’

-‘সে তাঁর নিজের দোষে মার খেয়েছে!’, নিলি মাথা নিচু করে ফেললো।

-‘সিরিয়াসলি?’ হাসলো জাহিদ।

এতকিছুর পরেও নিলির নির্লিপ্ততা দারুণ ভাবে আঘাত করলো জাহিদকে। স্বার্থপর একটা মেয়ে! রাগে দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’হস্পিটালে কেন এসেছেন?’

-‘সেই কৈফিয়ত কি আপনাকে দিতে হবে?’

-‘হবে’, একটা গমগমে কন্ঠস্বর জাহিদ এবং নিলির বাকবিতণ্ডা থামিয়ে দিলো। চমকে উঠলো দুজনে। নিলির পেছনে দাঁড়ানো আগন্তুকটিকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো জাহিদের। রেজোয়ানের মামাতো ভাই ফুয়াদ। দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ! জাহিদের সঙ্গে এর আগেও দুবার দেখা হয়েছে। ভীষণ ভালোলাগে তাঁকে জাহিদের।

শায়লা মুরসালীনের কাছে রেজোয়ানের খবর শুনে দেখা করতে এসেছে ফুয়াদ। নিলির ব্যাপারে সবই জানে সে। নিলি অবশ্য তাঁকে চেনে না। কিন্তু রেজোয়ানের কাছে নিলির কম করে হলে হাজারখানা ছবি দেখেছে ফুয়াদ। তাই চিনতে বিশেষ অসুবিধে হয় নি। শায়লা মুরসালীনের কাছ থেকে সব শোনার পর নিলির প্রতি আগে থেকেই বিরুপ ধারণা সৃষ্টি হয়েছিলো ফুয়াদের। এখানে এসে মনে হলো ধারণাটা নেহায়েত অমূলক নয়। মেয়েটা অত্যন্ত নির্লজ্জ! অন্যায় করে উলটে ফাঁপর দেখাচ্ছে।

নিলি সরু চোখে চেয়ে রইলো ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদ তাঁকে অবাক করে দিয়ে আচমকা মুখে হাসির রেখা টেনে নিলো। অত্যাধিক মোলায়েম কন্ঠে বললো,’সরি মিসেস নিলি, আপনাকে ভদ্রতা শেখানো খুবই প্রয়োজন। তাই উত্তর না দিয়ে পারলাম না। আসলে আমার ভাইকে আপনি অত্যাধিক সস্তা ভেবে বসে আছেন। তাই আপনি এবং আপনার ঐ দুটাকার প্রেমিক বা ফিয়ন্সে যাই হোক না কেন, দুজনে মিলে রেজোয়ানের গায়ে হাত তোলার সাহস পেয়েছেন। কিন্তু এবার আর সেটা সম্ভব না। এখানে কিছু করতে গেলে…

থেমে গেলো ফুয়াদ। বার তিনেক তুড়ি বাজালো নিলির সামনে। গুম্ভীর গলায় বললো,’আউট!’

অপমানে নিলির চোখে পানি চলে এসেছে। আজকেই শেষবারের মতন রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে সে। এরপর হয়ত আর কোনদিন দেখা হবে না দুজনের। নিলির মনের কথা কোনদিন জানতে পারবে না রেজোয়ান।

এদিকে, রেজোয়ানের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। দরজার কাছে ফুয়াদের গলার আওয়াজ পেয়ে ক্ষীণস্বরে ডাক দিলো সে। ফুয়াদ চট করে ভেতরে ঢুকে গেলো। নিলি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। যে যাই বলুক না কেন আজকে সে রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা করেই যাবে।

ফুয়াদ বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-‘এখনো কেমন লাগছে।’

-‘ভালো। কখন এসেছো?’

-‘মাত্রই!….রেজার সঙ্গে তোর ঝামেলা হলো কি নিয়ে?’

-‘নিলিকে নিয়ে বাজে কথা বলছিলো।’

ফুয়াদও মনে মনে তাই ধারণা করেছিলো। মিছেমিছি কারো সঙ্গে মারামারি করার মতন ছেলে রেজোয়ান নয়। ঘটনা যাই হোক না কেন কারনটা অবশ্যই নিলি। থমথমে গলায় বললো,’একটা কথা বলি তোকে, কিছু মনে করিস না, নিলিকে তুই ছেড়ে দে। এই মেয়েটা তোর জন্য পার্ফেক্ট না। এর চাইতে অনেক ভালো কিছু ডিজার্ভ করিস তুই।’

-‘নিলি হস্পিটালে এসেছে তাই না? ওর গলার আওয়াজ শুনেছি।’

-‘হ্যাঁ। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার সঙ্গে খানিকটা কথা কাটাকাটি হয়েছে। আই ওয়াজ রুড! মেজাজ সামলাতে পারি নি।’

রেজোয়ান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’তুমি ওর সম্পর্কে পুরোটা জানো না। জানলে ওর ওপর রাগ করে থাকতে পারতে না। কারণ ওর এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী।’

-‘ঐ মেয়ে তোকে ভালোবাসে না রেজোয়ান।’

রেজোয়ানকে হতাশ দেখালো। মুখ ফিরিয়ে মলিন মুখে বললো,’আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’

রেজোয়ানকে বুঝিয়ে লাভ নেই। ফুয়াদ মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় নিলিকে উদ্দেশ্য করে বললো,’আপনাকে ডাকছে। দয়া করে এই অসুস্থ শরীরে ওকে কোন মেন্টাল স্ট্রেস দেবেন না প্লিজ। এইটুকু মানবতা বোধ নিশ্চয়ই আপনার আছে?’
নিলি জবাব না দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো।


রেজোয়ান ছলছল দৃষ্টিতে নিলির মুখের দিকে চেয়ে আছে। নিলির যা বলার সে বলে দিয়েছে। বলা হলো না শুধু রেজোয়ানের। মনের কথা মনেই রয়ে গেলো। চুপচাপ নিলির কথাগুলো শুনে গেলো কেবল। অভিমানের পাহাড় জমা হলো। নিলি তাঁকে নিজের জীবন থেকে সরে যেতে বলছে। ভালোবাসার দোহাই দিচ্ছে। আজকে আর অন্যদিনের মতন লড়াই করার শক্তি নেই রেজোয়ানের। চারদিকে থেকে সবার চাপে, নিলির নিষ্ঠুর আচরণে মন ভেঙ্গে গেছে।

-‘ঠিক আছে। আমি আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করবো না। কথা দিচ্ছি।’

-‘মি.রেজাকে কোন ধরনের বিপদে ফেলবে না? কথা দাও।’

-‘দিলাম।’

-‘আমার বিয়েতে কোন ঝামেলা বাধাবে না?’

-‘না।’

-‘থ্যাংক ইউ। আসি আমি। ভালো থেকো।’

বেরিয়ে গেলো নিলি। জাহিদ হাঁ করে রেজোয়ানের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। রেজোয়ান শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে আছে। বুকের ভেতর ভেঙ্গে চুরে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটা একটুও বুঝলো না তাঁকে। অভিমান নিয়ে দূরে সরে গেলো!

-‘স্যার? রেজাকে এতসহজে ছেড়ে দেবেন?’ জাহিদের বিমূঢ় কন্ঠস্বর।

রেজোয়ান জবাব দিলো না। আজকে তাঁর বলার মতন কিছু নেই। নিলি তাঁর হাত ধরে অনুনয় বিনয় করে কেঁদেছে। তাঁকে নিজের মতন করে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। রেজোয়ানের আকুলতা সে দেখে নি। রেজোয়ানও আর দেখানোর চেষ্টা করে নি। তাঁর সকল আকুলতা এখন নিলির কাছে অনর্থক। তাই চুপচাপ নিলির কথা মেনে নিয়েছে।


ড্রয়িংরুমে শায়লা মুরসালীনের সঙ্গে সোফায় বসে আছে ফুয়াদ। শায়লা মুরসালীন কাঁদছেন আর ইনিয়ে বিনিয়ে নিলির বদনাম করছেন। খানিকবাদে শান্ত হয়ে তিন্নির প্রসঙ্গ তুললেন। ভেবেছিলেন তিন্নির সঙ্গে রেজোয়ানের বিয়ে দেবেন। কিন্তু সেটা যখন হলো না তখন ফুয়াদের সঙ্গে জোড় বেধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফোন থেকে তিন্নির একটা ছবি বের করে ফুয়াদকে দেখালেন।

ছবি দেখে ফুয়াদ আঁতকে উঠলো। তিন্নির সেদিনের ব্যবহারের কথা মনে পড়তেই সটাং না করে দিলো সে। শায়লা মুরসালীন ফের হতাশ হলেন। তবে হাল ছাড়লেন না।

-‘ফুপুর কথা শোন ফুয়াদ। এমন মেয়ে লাখে একটা মেলে।’

-‘মেয়ে খারাপ আমি সেকথা বলছি না ফুপু। কিন্তু আমার পছন্দ না। তাছাড়া তুমি নিজেও তো বলেছো মেয়ের বয়স কম। এত ছোট মেয়েকে আমি বিয়ে করবো না।’

-‘তখন ছোট ছিলো। কিন্তু এখন আর ছোট আছে? ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে এবার।’

-‘ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হোক আর যাই হোক আমার সঙ্গে কম করে হলেও বয়সের দশ বছরের ডিফারেন্স হবে।’

-‘হলে কি। মেয়েরা একটু ম্যাচিউর ছেলেই পছন্দ করে। তোর সঙ্গে দারুণ মানাবে।’

ফুয়াদ চুপ করে গেলো। শায়লা মুরসালীনকে বুঝিয়ে লাভ নেই। ফুয়াদ যাই বলুক না কেন তিনি নিজের কথাই উপরে রাখবেন। এরা মা ছেলে হয়েছে একধরনের। অতএব চুপ থাকাই শ্রেয়।

এদিকে শায়লা মুরসালীন ভাবলেন ফুয়াদের বোধহয় মেয়ে পছন্দ হয় নি। একথা সত্যি যে তিন্নি দেখতে আহামরি সুন্দরী নয়। উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ, দীঘল কালো চুল কিংবা টানাটানা চোখ কোনটাই নেই তাঁর। তবে একটা ব্যাপার না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে তিন্নি মুখে অসম্ভব মায়া আছে দেখলেই মনে হয় যুগযুগ ধরে চেনা। যে কেউ নির্দ্বিধায় একথা স্বীকার করে নেবে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শায়লা মুরসালীন। বললেন,’তুই নিশ্চয়ই ভাবছিস ফুপু জেনেশুনে তোর জন্য একটা কম সুন্দরী মেয়েকে কেন পছন্দ করেছি?… রূপ দিয়ে কি হবে বাবা? তোর ভাইও তো রূপসীর প্রেমে পাগল হয়েছিলো, সুখ আছে তাঁর? রাতদিন মনমরা হয়ে পড়ে থাকে। আমার ভয়ে মুখ ফুটে কিছু বলে না। কিন্তু আমি তো বুঝি আমার ছেলে ঐ সর্বনাশী মুখপুড়িকে কতটা ভালোবেসেছে। এখন দিনরাত জ্বলে মরছে।’

শায়লা মুরসালীনের অশ্রুভেজা দৃষ্টি ফুয়াদকে নরম করে দিলো। কোমল কন্ঠে বললো,’আমি তেমন কিছুই ভাবছি না ফুপু। মেয়ে যথেষ্ট সুন্দর। আমি সামনাসামনি দেখেছি কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। মেয়েটার মেজাজ গরম। আমার সঙ্গে মিলবে না। তুমি তো জানোই আমার সম্পর্কে। আমি সবসময়ই শান্তশিষ্ট, নির্ভেজাল প্রকৃতির ছেলে। জীবনসঙ্গী হিসেবে আমার তেমন মেয়েই চাই।’

তারপর শায়েলা মুরসালীনকে সেদিনের ঘটনা সব খুলে বললো ফুয়াদ। সব শুনে শায়লা মুরসালীন তিন্নির পক্ষ নিয়েই কথা বললেন।

-‘তুই যা করেছিস তাতে তো যে কারোরই মেজাজ গরম হয়ে যাবে।’

-‘হ্যাঁ। মেজাজ গরম হওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু ঐ মেয়ের মেজাজ মাত্রাতিরিক্ত গরম। বাড়ি মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।’

শায়লা মুরসালীন আরো কিছু বলতে চাইলেন ফুয়াদ তাঁকে থামিয়ে দিলো। বললো,’আমার বিয়ে নিয়ে চিন্তা বাদ দিয়ে রেজোয়ানের দিকে নজর দাও এখন। ওর মনের অবস্থা ভালো না।’

রেজোয়ানের কথা মনে পড়তেই শায়লা মুরসালীন অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। তাঁর ছেলেটা বিনাদোষে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছে। কি ছেলে কি হয়ে গেছে। ছেলের মুখের দিকে তাকালে ডুঁকরে কান্না আসে শায়লা মুরসালীনের। অথচ চুপচাপ দেখে যাওয়া ছাড়া আর কিচ্ছু করতে পারছেন না তিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here