তুমি_তাই,পর্বঃ২৩,২৪

0
792

#তুমি_তাই,পর্বঃ২৩,২৪
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৩

ফুয়াদ অফিস থেকে এসেছে আধঘণ্টা হয়েছে। ফ্রেশ হয়ে বেডরুমে শুয়ে টিভি দেখছিলো। তিন্নি শ্বাশুড়ির সঙ্গে রাতের রান্নাবান্না সেরে ঘরে এলো।
তিন্নির ঘরকন্না দেখলে সত্যিই বোঝার উপায় নেই এই সংসারে তার অনাগ্রহ। শ্বাশুড়ির সঙ্গে রান্না করা, শ্বশুরের ওষুধপত্রের খেয়াল রাখা, সময়মত ফুয়াদের সব কিছু রেডি রাখা এসব দেখে যে কেউই ভাববে বাড়ির আদর্শ বউ সে। দুমাস হয়েছে কেবল এই সংসারে এসেছে। এর মাঝেই সবার মন জয় করে নিয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ ক্লান্ত তিন্নি। দিনের পর দিন সবার সঙ্গে মিথ্যে ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে সে।

ভেতরে ঢুকে এসে দেখলো টিভি খামোখা চলছে, দেখার কেউ নেই। ফুয়াদ ফোন নিয়েই ব্যস্ত। এলো চুলগুলো হাতখোপা করে নিতে নিতে বললো,’নিচে খেতে ডাকছে।’

ফুয়াদ ফোন থেকে চোখ তুললো। তিন্নিকে সামনে দাঁড়ানো দেখে ভ্রুজোড়া অটোমেটিক কুঁচকে গেলো তাঁর। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো,’আজকে এত তাড়াতাড়ি?’

-‘কাল সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে। মা খালাম্মার বাসায় যাবেন। তাই সবাইকে তাড়াতাড়ি খেতে ডাকছেন।’

ফোন পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো ফুয়াদ। স্মিত হেসে বললো,’ঠিক আছে চলো।’

-‘আমি খাবো না। আপনি যান।’

-‘কেন খাবে না কেন? শরীর খারাপ?’

-‘শরীর ঠিক আছে। খিদে নেই। আপনি যান।’

ফুয়াদ জোরাজুরি করলো না। চুপচাপ খেতে চলে গেলো। তিন্নি বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আজকে মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে। ছুটে পালিয়ে যেতে মন চাইছে এই দমবন্ধকর সংসার জীবন থেকে থেকে।

অন্ধকারে চোখ দিয়ে গলগল করে পানি পড়ছে তাঁর। এতগুলো দিন হয়ে গেছে অথচ ফুয়াদের সঙ্গে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না সে। বারবার মনে হচ্ছে জেনে বুঝে ইচ্ছাকৃত ভাবে ফুয়াদ ঠকাচ্ছে। মিথ্যে ভালো থাকার অভিনয় করছে। তিন্নি মাঝেমাঝে মনে হয় ফুয়াদ অনেককিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে। ইচ্ছে করেই তিন্নি নিজের মত করে থাকতে দিচ্ছে সে।

এদিকে খেতে বসে আজকে আর ফুয়াদ ভাবছে কখন রুমে যাবে সে। এই প্রথম তিন্নিকে একা ফেলে খেতে চলে এসেছে ফুয়াদ। গত দুমাসে এমনটা কোনদিন হয় নি। তাই তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস আজকে তিন্নির কাছ থেকে একটা না একটা রিয়েকশন সে পাবেই পাবে। কারণ অতিরিক্ত কেয়ার পেলে মানুষ হঠাৎ করে সামান্যতম অবহেলাও সহ্য করতে পারে না। এছাড়া তিন্নিকে বিগত দুমাস যাবত পর্যবেক্ষণ করছে ফুয়াদ। তাঁর এই নিরামিষ প্রকৃতির পিচ্চি বউটির মনের মধ্যে কোন একটা গোপন রহস্য আছে। যেটা চাইলেও ফুয়াদকে বলতে পারছে না সে। কিন্তু ফুয়াদ থেমে থাকবার পাত্র নয়। অনেক হয়েছে পার্সোনাল স্পেস দেওয়া। এবার সময় এসেছে আস্তে আস্তে তিন্নির পেট থেকে সব কথা টেনে বের করার।

অস্থিরতা চেপে, ইচ্ছে করেই দেরীতে ঘরে গেলো সে। গিয়ে দেখলো ঘর অন্ধকার। পা টিপে টিপে ভেতর ঢুকে দেখলো। তিন্নি শুয়ে পড়েছে। কিন্তু ঘুমায় নি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোঁপাচ্ছে। অবাক হলো ফুয়াদ। এইটুকুতেই এত কান্না? মেয়ে মানুষের জাতটা এমন কেন? এত কান্না তাদের আসে কোথা থেকে?

কাছে গিয়ে গলা খাঁকারি দিলো ফুয়াদ। আস্তে করে তিন্নিকে ডাক দিলো,’ঘুমিয়ে পড়েছো?’
তিন্নি জবাব দিলো না। ফুয়াদ আবার ডাক দিলো,’ঘুমিয়ে পড়েছো?’

-‘না। আপনার কিছু লাগবে?’

ফুয়াদ ইতস্তত করে বললো,’না মানে। আসলে আমি সরি। তোমাকে রেখে খেতে যাওয়াটা আমার একদমই উচিৎ হয় নি। আমি কি ভাত নিয়ে আসবো?’

-‘না।’ সংক্ষিপ্ত জবাব তিন্নি।

-‘কেন? রাতে না খেয়ে থাকা ভালো না।’

-‘আমার খিদে নেই।’

ফুয়াদ সাবধানে বিছানায় বসলো। তিন্নি ঠিক রেগে আছে নাকি অভিমান করেছে বোঝা যাচ্ছে না। অন্ধকারে তাঁর চেহারাও দেখতে পারছে না।

তিন্নি পাশ ফিরে বললো,’আপনি শুয়ে পড়ছেন না কেন? কালকে সকালে তো অফিস আছে।’

-‘আছে। কিন্তু…!’

-‘কিন্তু কি?..’ ফের বালিশে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো তিন্নি।

ফুয়াদ বিপাকে পড়ে গেলো। উঠে গিয়ে লাইট অন করলো সে। লাইট অন করতেই দেখলো তিন্নি শুধু ফোঁপাচ্ছে না কাঁদতে কাঁদতে অলরেডি তাঁর চোখমুখ ফুলে গেছে।
সামান্য ভাত খাওয়া নিয়ে নিশ্চয়ই এত কান্না করার কথা নয়? ফুয়াদ চিন্তায় পড়ে গেলো। তিন্নির সামনে চেয়ার টেনে বসলো সে। আলতো করে কনুই চেপে ধরে বললো,’এই ওঠো। ওঠো। দেখি কি হয়েছে বলো আমাকে?’

তিন্নি তৎক্ষণাৎ চোখ মুছে নিয়ে বললো,’কিচ্ছু হয় নি। আপনি যান শুয়ে পড়ুন।’

ফুয়াদ তিন্নির হাত চেপে ধরলো। জোরপূর্বক তাঁকে শোয়া থেকে টেনে তুলে বললো,’না বলতে চাইলে আমি জোর করবো না। কিন্তু খাবে চলো। মা তোমার কথা বারবার জিজ্ঞেস করছেন। ডাকতেও চাইছিলেন আমিই বারণ করেছি। চলো খাবে চলো।’

তিন্নি দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে বললো,’খাবো না আমি।’

-‘কেন খাবে না?

-‘আমি একজনকে ভালবাসতাম।’

ফুয়াদের হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে গেলো। তবে ছাড়লো না। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তিন্নির দিকে চেয়ে রইলো। তারপর খুব স্বাভাবিক ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলো,’বাসতাম মানে কি? এখন বাসো না?’

তিন্নি মুখে জবাব এলো না। এটা কি ধরণের প্রশ্ন করেছে ফুয়াদ? লোকটার কি মাথাটাথা গেছে? তাঁকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফুয়াদ ফের একই প্রশ্ন করলো।

অনেকক্ষণ বাদে ধীরে ধীরে মুখ খুললো তিন্নি। বললো,’আপনি নিশ্চয়ই আমাকে ভুল বুঝছেন। কিংবা আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না! আমি সত্যি বলছি বিয়ের আগে আমি একজনকে ভালোবাসতাম।’

-‘এটা তো আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না? তুমি আমাকে বলছো তুমি একজনকে ভালোবাসতে। এর মানে আমি কি ধরে নেবো? তুমি এখন তাঁকে ভালোবাসো না? এই তো?’

-‘সে আমাকে কোনদিন ভালোবাসে নি।’

-‘এটাও আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না। যাইহোক, এখন কি সেই দুঃখে কাঁদছো? আমি গিয়ে তাঁকে রিকোয়েস্ট করবো?’, ফুয়াদ চেহারা এবং কণ্ঠস্বর দুটোই স্বাভাবিক।

-‘আপনি আমার কথা কেন বিশ্বাস করছেন না? আমি ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট পাচ্ছি। আর পারছি না ভালো থাকার অভিনয় করতে।’

-‘তো আপনি আমাকে কি করতে বলছেন? আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। আপনি যদি চান তবে, ঐ ছেলেকে গিয়ে রিকোয়েস্টও করবো। শুধু মুখ দিয়ে বলতে হবে আমাকে। না বললে আমি বুঝবো না।’

তিন্নি কি করবে বুঝতে পারছে না। সে যতটা দুশ্চিন্তা নিয়ে কথাটা বলেছিলো ফুয়াদের কাছ থেকে ততটা রিয়েকশন পাচ্ছে না। নিতান্তই রাগ লাগছে তাঁর। সবাই কেন তাঁকে এমন হালকা ভাবে নেয়? আগে রেজোয়ান নিতো, এখন ফুয়াদ। এরা ভাবে টা কি? তিন্নি বাচ্চা? কান্না থেমে গেলো তাঁর। হতাশা এসে ভর করলো চোখের পাতায়।

ফুয়াদ তাঁর মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,’কি ব্যাপার? আপনি কথা বলছেন না কেন?’

-‘বলবো না আমি আপনার সঙ্গে কথা।’

-‘ও আচ্ছা। তা,আপনি কি খাবেন? নাকি আমি শুয়ে পড়বো?’, ফুয়াদ বিছানার ওপর পা তুলে বসলো।

-‘আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন?’,

ফুয়াদ তাঁর প্রশ্নের জবাব দিলো না। স্থিরভাবে তিন্নির মুখের দিকে চেয়ে অল্প হাসলো। তিন্নি অস্বস্তিতে জড়সড় হয়ে বললো,’তাঁর সঙ্গে কিন্তু আমার কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিলো না।’

-‘তো?’

-‘না মানে ভালোবাসাটা একতরফা ছিলো।’

-‘আচ্ছা।’

ফুয়াদ শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিলো। তাঁর ঠান্ডা রিয়েকশন তিন্নির মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এতক্ষণ কি করছে সে নিজেও জানে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিজ হাতে সংসারটা ভেঙ্গে দিতে চলেছে সে! নতুবা ফুয়াদ এমন শান্ত আচরণ করবে কেন? নিশ্চয়ই তিন্নিকে ত্যাগ করার পরিকল্পনা করছে সে! তাই যদি হয় তবে বাবা মাকে কি জবাব দেবে তিন্নি? অকস্মাৎ ভয়ে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেললো। ফুয়াদ বাধা দিলো না।
উঠে গিয়ে চুপচাপ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো সে। কিছুক্ষণ বারান্দায় কাটিয়ে এসে তিন্নির পাশে বসলো। বললো,’তাঁকে যখন এতই ভালোবেসেছো তখন আমাকে বিয়ে করেছো কেন?’

-‘তাঁর প্রতি এখন আর আমার কোন ফিলিংস নেই।’

-‘তারমানে তুমি বলতে চাইছো এখনো আমার একটা সুযোগ আছে?’

তিন্নি অবাক হলো ফুয়াদের প্রশ্ন শুনে। সে মোটেও এমন কিছু বলতে চাই নি। সে শুধু সত্যিটা জানিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু পরিণতির কথা ভাবে নি। তাঁর রিয়েকশন দেখে ফুয়াদের হাসি পেয়ে গেলো। তিন্নির সম্পর্কে রেজোয়ানের কাছ থেকে অল্পবিস্তর জেনেছে সে। মেয়েটা ভীষণ ইমোশনাল! খামখেয়ালিও। আবেগ চেপে রাখতে পারে না। হাসি ঠেকিয়ে বললো,’কি তাইতো?’,

-‘আমার মনে হয়েছিলো সত্যিটা আপনার জানা দরকার। আপনাকে অন্ধকারে রেখে আমি ভালো থাকতে পারছিলাম না।’
তিন্নি মাথা নিচু করে হাতদুটো মুঠো করে ফেললো।

-‘এখন বয়স কত তোমার?’

-‘জানুয়ারিতে উনিশ হবে।’

-‘বাহ! তাহলে তো ভালোই ইঁচড়েপাকা তুমি। একেবারে আণ্ডাবাচ্চা থাকতেই প্রেম ভালোবাসা বুঝে গেছো। গুড। ভেরি গুড।’

তিন্নির এবার রাগ লাগছে। গম্ভীরমুখে প্রতিবাদ করে বললো,’প্রেম ভালোবাসার কোন বয়স হয় না। আমি তাঁকে সত্যিই খুব ভালোবাসতাম।

-‘আমার বয়স কত জানো? একত্রিশ বছর, চার মাস, দশ দিন। আমাকে এসব প্রেম ভালোবাসা বোঝাতে এসো না। যা বলছি মনযোগ দিয়ে শোনো, এখন থেকে লক্ষ্মী মেয়ের মত মন দিয়ে সংসার করবে। পুরোনো প্রেমিকের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো, ওসব বাচ্চাকালের প্রেম ভালোবাসা সকলেরই দুচারখানা থাকে। তাই বলে জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। আর বাকিটা আমার দায়িত্ব। আমি যতদিন বেঁচে আছি,ততদিন মনে মনেও আমার স্ত্রীকে দ্বিচারিণী হতে দেবো না। এত ভালোবাসবো যে, দিনরাত চব্বিশঘন্টা শুধু আমার নামই জপ করবে।’
কথা শেষ করে ফুয়াদ তিন্নিকে কোন প্রতিউত্তর করার সুযোগ দিলো না। জোরপূর্বক তাঁকে টেনে ভাত খাওয়াতে নিয়ে গেলো।

#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৪

এয়ারপোর্ট থেকে শায়লা মুরসালীনকে নিয়ে সরাসরি মামার বাসায় উঠেছে রেজোয়ান। প্রায় তিন বছর পর দেশে ফিরেছে তাঁরা। শায়লা মুরসালীন ভীষণ খুশি। এসেই খবর পেয়েছেন তিন্নি সন্তানসম্ভবা। তিন্নিকে তিনি বাস্তবিকই ভীষণ ভালোবাসতেন।

তিন্নিকে দেখে অবাক না হয়ে পারলো না রেজোয়ান। পাকা গিন্নী হয়ে উঠেছে একেবারে। সংসারের দায়িত্ব বেশ ভালোই বুঝে নিয়েছে। তার ওপর পাঁচমাসের অন্তঃসত্ত্বা। ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছে। না দেখলে রেজোয়ান বিশ্বাসই করতো না আগের সেই ছোট্ট তিন্নি এত বড় হয়ে গেছে।

রেজোয়ান কাছে গিয়ে তিন্নির মাথায় হাত রাখলো। মিষ্টি হেসে বললো,’কি খবর ভাবীসাহেবা, কেমন আছেন আপনি?’

তিন্নি সপ্রতিভ হাসলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,’ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’

রেজোয়ান হাত দুটো দুদিকে প্রশস্ত করে বললো,’আছি তো ভালোই। কিন্তু দেখুন তো বুড়োটুড়ো হয়ে গেছি কি না?’

তিন্নি শব্দ করে হাসলো। বললো,’বসুন। আপনার জন্য শরবত নিয়ে আসি। জার্নি করে এসেছেন ভালো লাগবে।’

তিন্নি চলে গেলে রেজোয়ান সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বুকের ওপর থেকে অনেক বড় বোঝা নেমে গেছে তাঁর। তিন্নি সুখি হয়েছে। তাঁর স্বপ্নের রাজকুমার সে পেয়ে গেছে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলো রেজোয়ান তিন্নির মুখের এই হাসি যেন চিরকাল বজায় থাকে। সে যেন রাজরানী হয়।’

সেদিন আর কোথাও বেরোলো না রেজোয়ান। অনেক দিন বাদে দেশে ফিরেছে বাসার সবার সঙ্গে গল্পগুজব করেই কাটিয়ে দিলো। পরেরদিন বিকেল বেলা জাহিদকে নিয়ে বাসার কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্ট কফি খেতে বেরোলো।

ভেতরে বসে পুরোনো কিছু ব্যবিসায়িক আলাপ আলোচনা সেরে নিচ্ছিলো দুজনে। হঠাৎ ওয়েটারের ড্রেস পরিহিতা গৌরবর্ণ, শীর্ণদেহী এক নারীকে দেখে দুজনেই থমকে গেলো।
ব্যস্ত ভঙ্গিতে টেবিলে টেবিলে ওর্ডার পরিবেশন করছে নিলি। রেজোয়ানদের টেবিলে কফির অর্ডার নিয়েই এগিয়ে আসছে। রেজোয়ানের চোখের পলক পড়লো না। মূর্তির মতন নির্বাক হয়ে সামনের দিকে চেয়ে রইলো সে।
একটু একটু করে সামনে এগিয়ে আসছে নিলি। আর একটু একটু করে বাড়ছে রেজোয়ানের হৃদস্পন্দন। তিন বছর পর আবার সেই জ্বালাময়ী মুখ! এখনো সেই আগের মতন বিষাক্ত অনুভূতি। ছলছল করে উঠলো চোখজোড়া!

সেদিন রেজোয়ানের দেওয়া ফ্ল্যাটটা নেয় নি নিলি। হস্পিটাল থেকে বাবাকে নিয়ে মাস খানেকের মত নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলো। কোথায় গিয়েছিলো কাউকে বলে যায় নি। তারপর একদিন জাহিদ খবর পায় নিজামউদ্দিন সাহেব মারা গেছেন। তাঁকে নিয়ে দেশের বাড়িতেই গিয়েছিলো নিলি। সেখান থেকে ফিরে এসে রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের চাকরি। তারপর থেকে জাহিদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথাবার্তা হয়। কিন্তু নিলি থাকে কোথায়, চাকরী করে কোথায় এসব জাহিদ জানতো না। তাই আজকে হঠাৎ নিলিকে দেখে সেও চমকে গেছে। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে একহারা হয়ে গেছে নিলি। শরীরে রক্তমাংস বলতে কিচ্ছু নেই। যেন ফ্যাকাসে একটা মূর্তি এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।

টেবিলের কাছে কফি রেখে চলে যাচ্ছিলো নিলি। কিন্তু রেজোয়ানের চোখে চোখ পড়তেই থমকে গেলো। হতবিহ্বল, বিস্মিত চেহারা নিয়ে দুজনেই অনেকক্ষণ একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর আচমকাই হেসে ফেললো নিলি। স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করলো,’কেমন আছো?’

রেজোয়ান স্বাভাবিক হতে পারলো না। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে তাঁর। জড়সড় গলায় কোন রকমে উত্তর দিলো সে,’ভালো। তোমার কি খবর?’

-‘এই তো আছি কোনরকম। ঘর, চাকরী এসব নিয়েই দিন কেটে যাচ্ছে।’

-‘ও।’, কথা হারিয়ে ফেলেছে রেজোয়ান।

-‘তোমরা কি বসবে কিছুক্ষণ? আমার আসলে তাড়া আছে।’, রেজোয়ানের সামনে থেকে তাড়াতাড়ি পালাতে চাইলো নিলি। জাহিদ যেন সেটা বুঝতে পেরেই বললো,’ইট’স ওকে। তুমি যেতে পারো। আমরা বেশিক্ষণ থাকবো না।’

-‘থ্যাংক ইউ।’, নিলি মুচকি হাসি দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। কিন্তু রেজোয়ানের চোখের আড়াল হতেই গলগল করে চোখের পানি পড়তে শুরু করলো তাঁর। এতদিন বাদে এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে সে ভাবতেই পারে নি। ভালোবাসার মানুষটাকে কতদিন বাদে দেখতে পেয়েছে অথচ পাহাড়সম অপরাধবোধ নিলিকে সামনে দাঁড়াতে পর্যন্ত দেয় নি।

নিলি চলে গেলে,শক্ত হয়ে বসে রইলো রেজোয়ান। কফি ঠান্ডা হয়ে গেলো। তাঁর মুখে উঠলো না। উঠে দাঁড়ালো সে। বিল পে করে জাহিদকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

রবিবার সন্ধ্যায় নিলি বেরিয়েছিলো সাপ্তাহিক বাজারের যোগান করতে। রেজোয়ান মেয়েকে ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় ফিরছিলো।
পথিমধ্যে পুনরায় দেখা হয়ে গেলো দুজনার। নিলি না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু রেজোয়ান সেটা হতে দিলো না। মেয়েকে জাহিদের কোলে দিয়ে নিলির পিছু নিলো সে। কিছুদূর এগিয়ে ডাক দিলো।

-‘নিলি দাঁড়াও!’

অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিলি দাঁড়িয়ে পড়লো। মুখ তুলে চাইলো। রেজোয়ানও তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলো।

-‘কিছু বলবে?’

-‘অনেকদিন বাদে দেখা। সেদিন তো কথাই বলতে পারি নি।’

-‘হ্যাঁ। প্রায় তিনবছর পর।’

-‘আমি তো ভেবেছিলাম আর কখনো বোধহয় তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।’

নিলি সামান্য হাসলো। তবে ওর হাসিতে প্রাণ নেই। আছে শুধু ক্লান্তি। রেজোয়ান হাতে বাজারের ব্যাগের দিকে ইশারা করে বললো,’এত বাজার? বিয়ে করেছো নিশ্চয়ই?’

নিলি হালকা হাসলো। বললো,’আমার কথা বাদ দাও। তোমার কি খবর? জাহিদের কাছে শুনলাম সন্তানের বাবা হয়েছো?’

রেজোয়ান মুখে খুশির রেখা টেনে নিলো। সপ্রতিভ হাসলো। বললো,’হ্যাঁ। ফুটফুটে দুটো কন্যাসন্তান আছে আমার।’

চোখের কোনে সামান্য জল বুঝি জমা হলো নিলির। কিন্তু রেজোয়ানকে দেখাতে চাইলো না। বাঁ হাতের কোনে চোখ মুছে মৃদু হেসে বললো,’তা দেশে হঠাৎ কি মনে করে?’

-‘এমনি। মেয়েদেরকে নিয়ে ঘুরতে এসেছি।’

-‘ওদের মা আসে নি?’

-‘না।’

-‘ আচ্ছা। ঠিক আছে আমি তাহলে আসি।’

বাজারের দিকে পা বাঁড়ালো নিলি। রেজোয়ান ফের পিছু ডাক দিলো।

-‘একটা প্রশ্ন ছিলো নিলি!’

-‘কি প্রশ্ন?’

-‘রেজাকে কি তুমি সত্যিই ভালোবাসতে?’

নিলি পুনরায় হাসলো। এইসব প্রশ্নের এখন কোন মানে হয় না। পুরো কাসুন্দি ঘেটে কি লাভ! বললো,’থাক না এসব কথা।’

-‘আমি জানতে চাই।’

-‘কেন?’

রেজোয়ান লজ্জা পেলো। পূর্বের কথাটা সংশোধন করে বললো,’না মানে কৌতুহল আর কি। যার জন্য তুমি আমাকে ত্যাগ করেছো তাকে সত্যিই ভালোবাসতে কিনা আমি জানতে চাই।’

-‘রেজা সাহেবকে আমি শ্রদ্ধা করতাম।’

-‘ভালোবাসতে না?’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিলি বললো,’বাসতাম।’

মিথ্যে বলেছে সে। ইচ্ছে করেই বলেছে। রেজোয়ান সংসারী হয়েছে। নিলির আর কিছু চাই না। নিজের অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে সারাজীবন রেজোয়ানের কাছ থেকে দূরে সরে থাকবে সে। রেজোয়ানকে কোনদিন জানতে দেবে না তাঁকে ঠিক কতটা ভালোবাসে নিলি। কখনো, কোনদিন, কোন একমুহূর্তের জন্যেও না। রেজোয়ান তাঁকে ঘৃণা করে করুক। কিন্তু নতুন করে তাঁকে আর কোন পিছুটানে ফেলতে চায় না নিলি। এমনিতেই নিলির জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে সে। আর তাঁকে কষ্ট দিতে চায় না নিলি।

-‘তারজন্যই বুঝি বারবার আমাকে অপমান করেছিলে? তোমার জন্যই নিশ্চয়ই রেজা আমার গায়ে হাত তোলার সাহস পেয়েছিলো?’

-‘এখনো মনে আছে তোমার?’

জবাবে রেজোয়ান ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নিলির প্রতি। সেদিনের কথা কোনদিন ভুলবে না রেজোয়ান। হলভর্তি লোকজনের সামনে তাঁকে অপমান করে দুশ্চরিত্র, লম্পট রেজার হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছিলো নিলি।
নিলি হেসে উঠে বললো,’পুরুষমানুষের দাম্ভিকতায় আঘাত লাগলে তারা সহজে ভুলতে পারে না। বড় অদ্ভুত তোমরা পুরুষজাতি। সেই কবে দুটো চড় খেয়েছিলে এখনো মনে আছে। অথচ আমি রোজ মুবিনের হাতে মার খেতাম। তারপরেও সে মরে যাওয়ায় কষ্ট হয়েছিলো আমার।’

-‘সবার জন্যই তোমার কষ্ট হতো কেবল আমার জন্য ছাড়া।’

-‘তা অবশ্য ঠিক বলেছো।’

আশ্চর্য হলো রেজোয়ান। এতদিন বাদে নিলির উদাসীনতা তাকে আঘাত করার কথা নয়। অথচ তাঁর কষ্ট হচ্ছে! এই একটি মাত্র নারীর কাছে এলে নিজেকে বড় তুচ্ছ মনে হয় রেজোয়ানের। তাঁর প্রতি এত অন্যায়, এত অবিচার করার পরেও সদর্পে গলা উঁচু করে কথা বলছে নিষ্ঠুর রমণীটি। বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ নেই কথার মাঝে!

-‘আমি আসি?’, সামনের দিকে পা বাঁড়ালো নিলি।

জবাবে রেজোয়ান গম্ভীর গলায় বললো,’এসো। কিন্তু যাওয়ার আগে একটা কথা জেনে রেখো গোটা পৃথিবী একমাত্র তোমাকে আমি সবথেকে বেশি ঘৃণা করি। এত ঘৃণা করি যে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।’

নিলি কোন কথা বলতে পারলো না। নির্বাক চোখে চেয়ে রইলো রেজোয়ানের দিকে। পুরোনো অনেক কথাই মনে পড়ছে তাঁর। রেজার সঙ্গে বিয়ে নিয়ে কতই না তোলপাড় করেছিলো রেজোয়ান। প্রথমে অবশ্য নিলি বুঝতে পারে নি। ভেবেছিলো তাঁকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নতুন করে ফন্দি আঁটছে রেজোয়ান। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো রেজোয়ান ভালোবাসা মিথ্যে নয়। তাঁকে সত্যিই ভালোবাসে রেজোয়ান।

কিন্তু এরপরেও রেজাকে দেওয়া কথা থেকে সরে আসতে পারলো না নিলি। বিবেকের কাছে হেরে গেলো সে। বিপদের দিনে রেজাই তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলো। তাছাড়া তখন শায়লা মুরসালীনও টেলিফোন করে খুব ধমকাচ্ছিলেন নিলিকে। বারবার ফোন করে শুধু একটা কথাই বলতেন নিলি যেন ভুলেও রেজোয়ানের জীবনে ফিরে যাওয়ার কথা না ভাবে।

যাইহোক, এসব কথা এখন আর ভাবতে চায় না নিলি। সবকিছুর উর্ধ্বে, সবচেয়ে বড় সত্যিটা হলো যেভাবেই হোক রেজোয়ানের সঙ্গে অন্যায় করেছে নিলি। ভীষণ অন্যায় করছে। রেজাকে বিশ্বাস করে অন্যায় করছে, রেজোয়ানের ভালোবাসার মূল্য না দিয়ে অন্যায় করেছে। আর তাই সেই অপরাধবোধ নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চায় নিলি।

কিন্তু নিজের অন্যায়ের কথা কোনদিন মুখ ফুটে বলতে চায় না রেজোয়ানের কাছে। রেজোয়ান তাঁকে ঘৃণা করে সুখে থাকুক। নিলি নিজেই চায় তাঁর প্রতি কোন মায়া রেজোয়ানের না জন্মাক। নিলির একজীবন এমনিতেই পচে গলে নষ্ট হয়ে গেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর জীবনের প্রতি আর কোন চাওয়া নেই নিলির। এখন কেবল বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকা।

ছলছল চোখে রেজোয়ানের দিকে চেয়ে থেকে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু হাসি এলো না। তার পরিবর্তে বুক ভর্তি কান্না বেরিয়ে আসতে চাইলো। এতদিন বাদে রেজোয়ানকে সামনে দেখে আবেগ চেপে রাখতে পারছে না। সময় নষ্ট না করে বাজারের দিকে এগিয়ে গেলো । পিছু ফিরে আর চাইলো না পাছে রেজোয়ান তাঁর চোখের পানি দেখে ফেলে সেই ভয়ে।


ঘর অন্ধকার করে একা একা হাসছে রেজোয়ান। অথচ তাঁর চোখে পানি। নিলির কাছ থেকে খুব বড়সড় একটা সত্যি গোপন করে গেছে সে। ইচ্ছে করেই গোপন করেছে। নিলি কোনদিন জানতে পারবে না শুধুমাত্র তাঁর জন্য গোটা একজীবন একা পার করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেজোয়ান। শুধুমাত্র তাঁর জ্বালাময়ী মুখ ভুলতে পারবে না বলে।
মনে মনে হাসলো রেজোয়ান। বেশ হয়েছে। এটাই তাঁর শাস্তি। রেজোয়ানকে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি। আচ্ছা, এমন যদি কখনো হয় বৃদ্ধ বয়সে, মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে নিলি হঠাৎ জানতে পারলো রেজোয়ান তাঁকে ভালোবেসে সারাজীবন বিয়ে করে নি। তাহলে কেমন হবে? সে কি আফসোসে মাথা খুঁড়ে মরবে নাকি কাঁদতে কাঁদতে প্রাণ দিয়ে দেবে? ভালোবাসা পেয়েও পেলো না! আহা বেচারি! ভাবতেই রেজোয়ানের হাসি পাচ্ছে। কি অদ্ভুত জ্বালাভরা হাসি। এই হাসি চোখে জল এনে দেয় ঠিকই কিন্তু সুখ দিতে পারে না।

অন্যঘরে ফুয়াদের কাছে নিজের দুঃখের কথা বর্ণনা করছেন শায়লা মুরসালীন। তাঁর দুঃখের প্রসঙ্গ সব রেজোয়ানকে ঘিরেই। বিদেশি একটা অরফানেজ থেকে বাচ্চা দত্তক নিয়ে বাবা সেজেছে রেজোয়ান। বিয়ের কথা শুনতেও চায় না। এইবয়সে এসে ছেলের এমন পাগলামি দিনদিন মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন শায়লা মুরসালীনকে। তাই কেঁদে কেঁদে ফুয়াদের কাছে অনুরোধ করছেন সে যেন রেজোয়ানকে বোঝায়। রেজোয়ান যেন বিয়ে করতে রাজী হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here