তুমি_তাই,পর্বঃ২৫,২৬

0
715

#তুমি_তাই,পর্বঃ২৫,২৬
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৫

রেজোয়ান বিদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়া দিতে শুরু করেছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছা শায়লা মুরসালীনের নেই। ছেলের বিয়ে দিয়ে তবেই দেশ ছাড়বেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এদিকে রেজোয়ান বিয়ের কথা শুনতেই নারাজ। সে আছে তাঁর ব্যবসা আর দত্তক নেওয়া কন্যাসন্তান দুটিকে নিয়ে। এসব নিয়েই ব্যস্ত সারাদিন। শায়লা মুরসালীন চুপিচুপি জাহিদকে ডেকে পাঠালেন। উদ্দেশ্য নিলির খোঁজ জানা। জাহিদ ডেকে ফিসফিস করে বললেন,’ঐ মেয়েটার সঙ্গে কি রেজোয়ানের আবার দেখা হয়েছে? তুমি জানো কিছু?’

জাহিদ প্রথমে ইতস্তত করলেও সত্যিটা বলে দিলো। নিলির সঙ্গে রেজোয়ানের দেখা হয়েছে শুনে শায়লা মুরসালীন চুপ করে গেলেন। মিনিট খানেক সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’ঠিকানা আছে?দেখা করা যাবে ওর সঙ্গে?’

জাহিদ বেশ অবাক হলো। নিলির সঙ্গে শায়েলা মুরসালীনের হঠাৎ করার কি কারণ থাকতে পারে বুঝতে পারলো না। বললো,’আমার কাছে ঠিকানা নেই ম্যাম। জোগাড় করতে হবে।’

-‘তাহলে তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো আমাকে ঠিকানাটা জোগাড় করে দাও। আমি ফিরে যাওয়ার আগে ওর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।’

-‘ঠিক আছে ম্যাম।’

-‘আর শোনো, রেজোয়ানকে কিছু জানানোর দরকার নেই। প্রয়োজন হলে আমিই পরে জানাবো ওকে।

ড্রয়িংরুমে বসে আছে ফুয়াদ এবং রেজোয়ান। রেজোয়ানের দুই কন্যাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে তাঁরা।

রান্নাঘরে সবার জন্য নাশতা রেডি করছিলো তিন্নি, আর ভাবছিলো বিয়ের পর এই প্রথম রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁর। আসার পর থেকেই রেজোয়ান তিন্নিকে ভাবি বলে সম্বোধন করছে। শুধু ভাবি নয়, আপনি বলেও সম্বোধন করছে। যদিও শুনতে খানিকটা ঠাট্টাসূচক লাগছে তথাপি রেজোয়ান যে তিন্নির কাছ থেকে পরিমিত দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছে সেটা তিন্নি বেশ ভালো করেই বুঝে গেলো।

কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো রেজোয়ানের ভাবি ডাকা নিয়ে কোনরকম খারাপ লাগা কাজ করছে না তিন্নির। বরং ভালো লাগছে তাঁর। ভীষণ ভালো লাগছে। তবে কি সত্যিই ফুয়াদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সে? হেসে ফেললো তিন্নি। ফুয়াদের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। তিন্নিকে সে এত ভালোবাসবে বলেছিলো যে দিন রাত চব্বিশঘণ্টা তিন্নি নাকি শুধু তাঁর নামই জপ করবে। অদ্ভুত লোক একটা! তিন্নি তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলেও বলবে তিন্নি নাকি তাঁর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে! তাঁকে ছাড়া নাকি তিন্নি একমুহূর্তও থাকতে পারবে না।

ফের হেসে ফেললো তিন্নি। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো ড্রয়িংরুমের দিকে। বাচ্চাদের সঙ্গে দুষ্টুমি করছে তাঁর সুদর্শন, সুপুরুষ বরটা। কি মায়া লাগছে দেখতে! চোখেচোখে চোখ পড়ে গেলো দুজনের। ফুয়াদ ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,’কি?’

তিন্নি হাত ইশারায় কাছে ডাকলো তাঁকে। এগিয়ে এলো ফুয়াদ। বললো,’কিছু লাগবে?’

-‘লাগবে তো।’

-‘কি?’

-‘আপনাকে!’, বলেই লজ্জায় উল্টো দিকে ঘুরে গেলো তিন্নি। কারণ সে জানে এক্ষুনি তাঁকে কতগুলো নির্লজ্জ কথা শুনিয়ে দেবে ফুয়াদ, কিংবা কাছে আসার বাহানায় জ্বালাতন শুরু করে দেবে। তাঁকে অবাক করে দিয়ে ফুয়াদ মিষ্টি করে হাসলো। বললো,’আমাকে দিয়ে কি কাজ?’

-‘অনেক কাজ। আসুন আমার সঙ্গে আটা মাখাবেন।’ বলেই মুখটিপে হাসলো তিন্নি।

ফুয়াদও পালটা জবাব দিয়ে বললো,’আটার সঙ্গে আমাদের দুজনার মাখামাখি হলে আপত্তি নেই।’

-‘আচ্ছা? তবে তো মাখামাখি শেষে তাওয়ায় সেঁকতে ও হয়? কি বলেন সেঁকবো আপনাকে?’

ফুয়াদ হাল ছেড়ে দিয়ে সোজা তিন্নির আঁচল টেনে ধরলো। বললো,’লজ্জাবতীর মুখে খই ফুটেছে দেখছি!’

তিন্নি লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। আঁচল ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,’ছাড়ুন আমাকে। বউয়ের আঁচল ধরে কারা ঘুরে বেড়ায় জানেন?’

-‘কারা?’

-‘ভেড়ারা। আপনি তো পুরুষ। আপনি কেন আঁচল ধরে টানাটানি করবেন?’

আঁচল ছেড়ে দিলো ফুয়াদ। এবারে সোজা কোমর চেপে ধরলো তিন্নির। ফিসফিস করে বললো,’খুব কথা শিখে গেছো না? দেই মুখটা বন্ধ করে? দেবো?’ বলতে বলতেই সে ঠোঁটজোড়া তিন্নির মুখের কাছে নিয়ে গেলো। তিন্নি সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিলো। হার স্বীকার করে নিয়ে বললো,’ঠিক আছে, ঠিক আছে। আর বলবো না। ছাড়ুন আমাকে। রান্নাঘরে কেউ দেখলে কি ভাববে?’

-‘তাহলে এবার বলো ফুয়াদ আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

-‘পারবো না।’

-‘না পারলে আমিও ছাড়বো না।’

-‘আমার লজ্জা লাগে।’

-‘এসব বলে কোন লাভ নেই। আজকে তোমার মুক্তি নেই। হয় আমাকে তুমি করে বলবে নইলে আমি জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো।’

-‘ছাড়ুন বলছি। অসভ্য লোক!’

-‘অসভ্য বলেছো আমাকে। এবার ‘তুমি’র সাথে গালে চুমুও খেতে হবে। নইলে কিছুতেই ছাড়বো না।’

-‘আমি কিন্তু মাকে ডাক দেবো?’

-‘দাও। মা এসে দুজনকেই দেখুক।’

তিন্নি ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। ফুয়াদ এর সঙ্গে জোরাজুরি করতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেছে সে। বেশ ভালো করে বোঝা হয়ে গেলো এই লোক আজকে তাঁকে ছাড়বে না। তাই বাধ্য হয়ে তুমি বলার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু সেখানেও যন্ত্রণা। লজ্জায় মুখ দিয়ে কিছুতেই বেরোচ্ছে না। অবশেষে চোখ বন্ধ করে মৃদু কোমল কন্ঠে তড়িঘড়ি করেবললো,’ছাড়ো আমাকে। সবাইকে নাশতা দিতে হবে। দেরী হয়ে যাচ্ছে।’

ফুয়াদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তাঁর লাজুক লাজুক মুখখানার দিকে। কোমরের বাঁধন হালকা করে দিলো। আলতো করে হাত রাখলো তিন্নির দুই গালে। সস্নেহে চুমু খেলো তিন্নির কপালে। মোলায়েম কন্ঠে বললো,’লজ্জা পেলে আমার বউটাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়।’.

তিন্নি হাসলো। ফুয়াদ হাতের ওপরের নিজের একটা হাত রেখে বললো,’আর আমার এই দুষ্টু বরটাকে সবসময়ই সুন্দর দেখায়। পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর পুরুষ সে।’

নিলি কাঁদছে। শায়লা মুরসালীন মৌনমুখে তাঁর সামনে বসে আছেন। রেজোয়ানের বৃত্তান্ত সব খুলে বলেছেন তাঁকে। সব শুনে নিলি বুঝতে পারছে না তাঁর কি করা উচিৎ। সে চেয়েছিলো রেজোয়ান সুখি হোক, ভালো থাকুক।
নিজের অপরাধের দায়ভার মাথায় নিয়ে একা বেঁচে থাকবে সে। কিন্তু রেজোয়ান যে তাঁকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজের জীবন নিয়ে খেলা শুরু করে দেবে একথা নিলি স্বপ্নেও ভাবে নি।

শায়লা মুরসালীন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আফসোসের সুরে বললেন,’ভেবেছিলাম জীবনে কোনদিন মুখ দেখবো না তোমার। কিন্তু কি করবো, আল্লাহ আমাকে ঠেকিয়েছেন। আমার ছেলে তোমার মধ্যে কি পেয়েছে তা কেবল সেই জানে। এত মেয়ের ছবি দেখালাম কাউকে মনে ধরলো না। তাঁর একই কথা, মেয়ের আমার পছন্দ নয়। তুমি বিয়ের চিন্তা বাদ দাও মা।

নিলির টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ঝরঝর করে কাঁদছে। কি করলে সে রেজোয়ানকে তাঁর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবে! নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে।

-‘এতিমখানা থেকে বিদেশি বাচ্চা দত্তক নিয়েছে। মেয়ের বাবা সেজেছে। মা হয়ে ছেলের এমন দুর্দশা আমি দেখতে পারছি না। তাই তোমার কাছে এসেছি। তুমি তো জানো আমার ছেলে তোমাকে কতটা ভালোবাসে। তাই এবার সেই ভালোবাসার প্রতিদান চাইতে এসেছি আমি। আমার ছেলের ভালোবাসার মূল্য পরিশোধ করে আমাকে উদ্ধার করো।’

-‘আমি কি করবো? কি করলে রেজোয়ান কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে? আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। মরতে বললেও রাজি আছি।’

-‘তোমাকে মরতে বলার মতন অমানুষ আমি নই। আমি তোমার সঙ্গে রেজোয়ানের বিয়ে দেবো বলে ঠিক করেছি। একটাই পথ আমাকে ছেলেকে ঘরমুখি করার। আমার একটা মাত্র ছেলে। ওর জন্য আমি সব করতে পারি।’

নিলি পুনরায় ডুঁকরে উঠলো। এত অপরাধ নিয়ে রেজোয়ানের মুখোমুখি কি করে দাঁড়াবে সে? শায়লা মুরসালীনের হাত চেপে ধরে বললো,’আপনি আমাকে শাস্তি দিন মা। মেরে ফেলুন। কিন্তু ফিরে যেতে বলবেন না প্লিজ। দোহাই আপনার। রেজোয়ানের কাছে ফিরে যাওয়ার মতন মুখ আমার নেই।’

শায়লা মুরসালীন হাত ছাড়িয়ে নিলেন। এই মেয়েটার জন্যই তাঁর ছেলের এমন করুণ অবস্থা। একে তিনি এত সহজে ক্ষমা করবেন না। শুধু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই তাঁকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে এসেছেন। তবুও যদি রেজোয়ান সংসারী হয়!

#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৬

নিলি গিয়ে রেজোয়ানের বিছানার পাশে বসলো।
আলতো করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতেই রেজোয়ান সচেতন হলো। ঘুমঘুম চোখে মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলো,’এসেছো নিলি?’

নিলির চোখ ভিজে গেলো। দুগাল বেয়ে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল। এত ভালোবাসা তাঁর পাওয়া ছিলো কিনা সে জানে না। রেজোয়ান নির্ঘাত পাগল। নতুবা এমন একটা মেয়েকে কেউ ভালোবাসে?
রেজোয়ান আবার চোখ বন্ধ করলো। নিলি তাঁর জন্য কাঁদছে। স্বপ্নেই সম্ভব। কাঁদুক! বেশ করে কাঁদুক। রেজোয়ান তো চায় নিলি তাঁর জন্যে কাঁদে! ছটফট করে। নইলে তাঁর অহংকারী পুরুষসত্তাটা যে ভীষণভাবে আঘাত পায়।

নিলি নিজের মাথাটা রেজোয়ানের বুকে স্থাপন করলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’অপরাধিনী হাজির। শাস্তি দেবে না?’

-‘শাস্তি তো দিচ্ছিই।’

-‘নিজেকে কষ্ট দিয়ে এ কেমন শাস্তি?’

-‘এই হলো উপযুক্ত শাস্তি। এমন শাস্তি সবাই দিতে পারে না।’

নিলি ফের ফুঁপিয়ে উঠলো। রেজোয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,’রোজ এত মানুষ মরে আমি কেন মরি না বলতে পারো? কেন আমি বারবার বেঁচে যাই?’

রেজোয়ান তাঁর মাথার একগাছি চুল আঁকড়ে ধরলো। চোখ বন্ধ রেখেই মিটিমিটি হাসলো। এ-তো স্বপ্ন নয়! চোখের পানিতে তাঁর বুক ভিজে যাচ্ছে ! শান্তি! উত্তপ্ত বুকে জল ঢেলে দিয়েছে এই অনুতাপের অশ্রুবিন্দু। পুরুষসত্তা স্বার্থক। এবার হবে প্রতিঘাতের পালা।

নিলি মুখ তুলে চুমু খেলো রেজোয়ানের বন্ধ চোখের পাতায়। ফিসফিস করে বললো,’আমি তোমাকে ভালোবাসি!’

রেজোয়ান মুচকি হাসলো। বললো,’শুনতে পাই নি।’

-‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

-‘হ্যাঁ? কি বললে?’

-‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

-‘সাজা মওকুফ এর ফন্দি করছো? সে হবে না।’

-‘অপরাধী স্বেচ্ছায় সাজা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত।’

-‘বেশ তবে আজ থেকেই শুরু হোক।’

-‘হোক তবে। কিন্তু শাস্তিটা কি?’

ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো রেজোয়ানের। চোখ মেলে উদ্ভ্রান্তের মত এদিক ওদিক চাইলো সে। এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিলো ! আশ্চর্য! এমন স্বপ্ন কেন দেখলো? এসব কি হচ্ছে তার? কেন বারবার নিলির চেহারাটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠছে? নিলি ভালো নেই বলেই কি? তবে কি রেজোয়ান এখনো কাছে পেতে চায় নিলিকে?
দুহাতে মুখ ঢেকে বিছানায় বসে রইলো কিছুক্ষন। বুকের ভেতর তোলপাড় চলছে। এত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে মন চাইছে না। খাটের পাশে ফটোফ্রেম টাতে মেয়েদুটোর ছবি। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রেজোয়ান। তারপর উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।

জাহিদের সঙ্গে একটা ব্যবিসায়িক মিটিংয়ে অ্যাটেন্ড করতে হবে রেজোয়ানকে। বিদেশে যাওয়ার আগে যদিও পুরোনো কম্পানীটা সে বেচে দিয়েছিলো কিন্তু সেখানে গিয়ে নতুন করে আবার একটা ব্রাঞ্চ খুলেছে বাংলাদেশে। গত একবছর আগেই ইনোগ্যরেশন হয়েছে ব্রাঞ্চটার।
এটার দায়িত্ব অবশ্য পুরোপুরি জাহিদের ওপরেই। জাহিদই সবকিছু একা হাতে সামাল দেয়। রেজোয়ানকে এদিকটা নিয়ে এত ভাবতে হয় না। কিন্তু আজকে জাহিদ ভীষণ ভাবে জোর করলো অফিসটা দেখে আসার জন্য। তাই বাধ্য হয়ে মিটিং অ্যাটেন্ড করতে রাজি হয়েছে।

রেডি হচ্ছিলো, এমন সময় শায়লা মুরসালীন এসে ঘরে ঢুকলেন। খাটের ওপর বসতে বসতে বললেন,’কোথাও বেরোবি?’

-‘হ্যাঁ। বনানী যাবো। কেন তোমার কিছু লাগবে?’

-‘না। তুই ফিরবি কখন?’

-‘ফিরতে ফিরতে রাত হবে। তোমরা খেয়ে নিও।’

-‘তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিলো। খুব জরুরি।’

রেজোয়ান টাই বাঁধছিলো। বাঁধা শেষে ড্রেসিংটেবিলের ওপর থেকে ঘড়িটা নিলো। সেটা পরতে পরতে বললো,’বলো। কি বলবে?’

-‘এদিকে আয়। আমার কাছে এসে বস।’

মায়ের আবদার সুলভ কন্ঠস্বর শুনে রেজোয়ান সাবধান হয়ে গেলো। বললো,’তুমি আমার বিয়ে নিয়ে আবার ঝামেলা করতে এসেছো। তাই না?’

-‘মোটেই না। ঝামেলা তো তুই করছিস আমার সঙ্গে। মা হয়ে ছেলের বিয়ে দেওয়ার অধিকার কি আমার নেই? নাকি তোর মা হয়ে পাপ করেছি আমি? সেইজন্য শাস্তি দিচ্ছিস আমাকে?’

-‘এসব তুমি কি বলছো মা?’

-‘একদম ঠিক বলছি। তোর কাছে আগের মত আমার কথার এখন কোন দাম নেই।’

মা খেপে গেছেন বুঝতে পেরে রেজোয়ান খাটে এসে বসলো। হেসে উঠে বললো,’অনেক হয়েছে মা। এবার একটু থামো। কম মেয়ে দেখেছো এই পর্যন্ত? কোন লাভ হয়েছে কি? কোন লাভ হয় নি। প্রতিবারই একটা না একটা ভেজাল লেগেছে। তাই এসব বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে তুমিও শান্তিতে থাকো আমাকেও শান্তিতে থাকতে দাও। বোঝার চেষ্টা করো, এখন আর আমার বিয়ে নিয়ে লাফালাফি করার বয়স নেই। পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে অলরেডি ছত্রিশ পা দিয়েছি।’

-‘চুপ কর। এসব বলে তুই আর আমাকে ভুল বোঝাতে পারবি না। বিয়ে কেন হচ্ছে না, সেটা আমি ভালো করেই জানি। তুই সবাইকে গিয়ে বারণ করে দিস।’

-‘কি বলছো তুমি মা?’ রেজোয়ান হেসে ফেললো। বললো,’সেরকম হলেও বা সবাই আমার কথা শুনবে কেন?’

-‘কেন শুনবে তা আমি কি জানি? কিন্তু তুই যে ওদের বারণ করে দিস সেটা আমি ভালো করেই জানি। তাই এবার আর তোর কোন কথা শুনবো না। আমার পছন্দের পাত্রীর সঙ্গেই তোর বিয়ে দেবো।’

-‘কোন লাভ হবে না মা। আমি বিয়ে করবো না।’ অগত্যা সত্যিটা স্বীকার করে নিলো রেজোয়ান। বারবার বিয়ে নিয়ে শায়লা মুরসালীনের চাপাচাপি তাঁর আর ভালো লাগছে না। মায়ের অজান্তে পুরোনো বিয়েগুলো সে নিজেই ভেঙ্গেছিলো। কিন্তু এখন যখন মা সবটা জেনে গেছে তখন আর সত্যিটা লুকিয়ে কোন লাভ নেই। তারচেয়ে বরং তিনি সত্যিটা জানলে আরো বেশি উপকার হবে। একবারেই ঝামেলা মিটে যাবে। আর বিয়ে নিয়ে জোরাজুরি করবেন না।’

রেজোয়ানের জবাব শুনে চমকালেন না শায়লা মুরসালীন। তিনি আগেই জানতেন রেজোয়ান এমন উত্তর দেবে। সামান্য হেসে জিজ্ঞেস করলেন,’নিলিকেও না?’

নিলির নাম শুনতেই থমকে গেলো রেজোয়ান। কয়েকমুহূর্তের জন্য মস্তিষ্ক অনুভূতি শূন্য মনে হলো! তারপর ধীরে ধীরে একটু আগের স্বপ্নটার কথা মনে পড়লো। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রেজোয়ান। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,’না। কাউকেই না।’

-‘তবে আমি যে ওকে রাজী করাবো বলে জাহিদকে ঠিকানা জোগাড় করতে বলেছিলাম তার কি হবে?’

-‘তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে ওর?’

-‘না। কি করে দেখা হবে? আমি ওর ঠিকানা জানি মাকি?’, মিথ্যে বললেন শায়লা মুরসালীন। রেজোয়ানের মুখ থেকে বিয়ের জন্য ‘হ্যাঁ’ না শোনা অব্দি তিনি মুখ খুলবেন না।

-‘তাহলে হঠাৎ ওর কথা উঠলো কেন?’

-‘তুই যখন ওকে ভুলতেই পারবি না তখন তো ওর কথা উঠবেই। ওর সঙ্গেই আমি তোর বিয়ে দেবো।’

-‘কি বলছো কি তুমি? আমি তোমাকে একবারও বলেছি আমি ওকে বিয়ে করবো?’

-‘তাহলে আমি অন্য মেয়ে দেখবো?

-‘বললাম তো আমি কাউকেই বিয়ে করবো না। তাছাড়া তোমার সঙ্গে অনেকবারই আমি মেয়ে দেখতে গিয়েছি। কাজের কাজ কিচ্ছু হয় নি। এখন এসব বাদ দাও।’

-‘মায়ের সঙ্গে চালাকি করার চেষ্টা করবি না রেজোয়ান। তুই এড়িয়ে গেলেও কোন লাভ হবে না। আমি তোর বিয়ে দিয়ে তবেই দেশ ছাড়বো।’

-‘এসব কেন করছো মা? নতুন করে আবার মেয়ে দেখতে যেতে হবে তোমার সঙ্গে? সেইজন্যই এত বাহানা করছো? ঠিক আছে যাবো। কিন্তু এখন আমার বেরোতে হবে।’

-‘মেয়ে আমি দেখেই এসেছি। তুই শুধু বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দে।’

-‘পাত্রী কে?’

-‘নিলি।’

-‘তুমি না বললে ওর সঙ্গে তোমার দেখা হয় নি?’

-‘না হয় নি। তো কি হয়েছে? ওকে আমি আগে দেখেছি না?

-‘মা সত্যি করে বলো তো ওর সঙ্গে কি তোমার দেখা হয়েছে?’

-‘না। জাহিদকে বলেছি খুঁজে বের করতে।’

-‘কোন দরকার নেই। এসবের মধ্যে তোমার ঢোকার কোন দরকার নেই। আমি তোমাকে রিকোয়েস্ট করছি মা তুমি প্লিজ আমাদের দুজনের মধ্যে ঢুকো না। ওর সঙ্গে আমার সারা জীবনের মতন বোঝা পড়া চলছে। আমাকে আমার বোঝাপড়াটা করতে দাও।’

-‘তবে তুই তোর বোঝাপড়া নিয়েই থাক। আমি আর তোর সঙ্গে ফিরবো না। এখানেই থাকবো। ফুয়াদ যদি রাখতে রাজি না হয় তাহলে ওকে বলবো ওর পরিচিত কোন বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে। সংসার যখন করবি না তখন আর আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে কি লাভ। নিজের নাতি নাতনী তো আর দেখবো না?’

রেজোয়ান রাগতে গিয়েও রাগলো না। এই একটা কাজই তাঁর মা খুব ভালো মত পারে। সেটা হচ্ছে ব্ল্যাকমেইলিং। ব্ল্যাকমেইল করে করেই একসময় নিলির সঙ্গে দূরত্ব টাও বাড়িয়েছিলেন। এখন আবার তাঁর সঙ্গেই বিয়ে দিতে চাইছেন। অদ্ভুত মহিলা তাঁর মা!
তবুও রেজোয়ান মাকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। মায়ের বয়সও হয়েছে। এই বয়সে ছেলের কাছ থেকে কোন কঠিন কথা তিনি সহ্য করতে পারবেন না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, যার জন্য রেজোয়ান কঠিন কথা বলবে সে নিজেও তো রেজোয়ানের ভালোবাসার মূল্য দেয় নি। তবে দোষটা কাকে দেবে রেজোয়ান?

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। গায়ে কোট জড়িয়ে নিয়ে বললো,’আমি রাতে এসে তোমার সঙ্গে এই ব্যাপারে আলাপ করবো। এখন আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। আসি!’

কথা শেষ করে শায়েলা মুরসালীনের কপালে চুমু খেলো সে। হাত দুটো ধরে তালুতেও চুমু খেলো। মুচকি হেসে বললো,’আসি মা।’

শায়লা মুরসালীলের ক্রমাগত ফোন পেয়ে একপ্রকার বাধ্য হয়েই কাজ ফেলে বেরিয়ে পড়লো রেজোয়ান। তথাপি ফিরতে ফিরতে রাত বারোটার মতন বেজে গেলো। কিন্তু বাসায় ঢুকেই হতবম্ভ!
ভেতরে এলাহি আয়োজন চলছে। রান্নাবান্না, সাজগোজ এর বাহার দেখা মনে হচ্ছে বড় কোন অনুষ্ঠান। রেজোয়ান কিছুতেই বুঝতে পারছলো না। তাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন শায়লা মুরসালীন। অন্যদিকে ফুয়াদ আর তিন্নি কোন কারণ ছাড়াই মুখটিপে হাসছে। রেজোয়ান ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। ওরা কেউ কোন জবাব দিলো না।

-‘মেহমান এসেছে নাকি মা? বাসায় এত ভীড় কেন?’

-তোর বিয়ে। তাই আত্মীয়স্বজন সবাইকে খবর দিয়েছি।’ কথা শেষ বেশ বড়সড় একখানা গর্বিত হাসি উপহার দিলেন শায়লা মুরসালীন। সেইসঙ্গে ফুয়াদও ফোঁড়ন কেটে বললো,’তোর মেয়েরা কিন্তু তাদের নতুন মাকে খুব পছন্দ করেছে। কোলের ওপর উঠে বসে আছে দুজনে।’

রেজোয়ান স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। মা এত রকেটের গতিতে নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য এগোবেন সে ভাবতেই পারে নি। ভেবেছিলো বাসায় এসে তাঁকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠান্ডা করে ফেলবে। কিন্তু এখন তো দেখছে মা ই উল্টো ওকে ঠান্ডা করে দিয়েছে। এমন হবে জানলে রেজোয়ান আজকে বাসাতেই ফিরতো না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here