তুমি_তাই,পর্বঃ৭,৮

0
709

#তুমি_তাই,পর্বঃ৭,৮
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৭

থানায় নিয়ে আসার পর থেকে এই পর্যন্ত নিলির ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেছে পুলিশ। নানারকম ভাবে তাঁর মুখ দিয়ে কথা আদায়ের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেটা যখন সম্ভব হলো না তখন বাধ্য হয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তিনদিনের রিমান্ড চেয়ে কোর্টের কাছে আবেদন করলো।
সকল ধরনের নির্যাতনের অনুমতি পেয়ে গেলে নিলির মুখ থেকে কথা আদায় করা সহজ হয়ে যাবে।

দুদিন বাদেই কোর্টের হিয়ারিং। ধারণা করা হচ্ছে, আইনি আবেদনকে প্রাধান্য দিয়ে রিমান্ড মঞ্জুর করবে কোর্ট।

আজিজের বিরুদ্ধেও এখনো কোন শক্ত প্রমাণ জোগাড় করা সম্ভব হয় নি। জোগাড় করার খুব একটা চেষ্টাও পুলিশের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তাঁরা ধরেই নিয়েছে নিলিই প্রধান আসামী। তাই আদালতে নিলিকে দোষী প্রমাণ করার চেষ্টাই চলছে।

রিমান্ড মঞ্জুর হয়ে যাওয়ার আশংকাটা শুনে থেকে ভয়ে, আতংকে নিলির সমস্ত শরীর অবস হয়ে আসছে। এই দুইদিনে তাঁর ওপর যেই পরিমান টর্চার করা হয়েছে তাতে করে যদি রিমান্ড মঞ্জুর করা হয় তাহলে আর সে বেঁচে ফিরতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। এর চেয়ে বেশি টর্চার সহ্য করার ক্ষমতা নিলির নেই।

অনেক ভেবে শেষমেশ নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য তথ্য চুরির অপবাদ স্বীকার করার সিদ্ধান্ত সে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। স্বীকারোক্তি না দিলে এরা রিমান্ডে নিয়ে নিলিকে মেরে আধমরা করে ফেলবে। সামান্যতম মায়া দয়াও দেখাবে না।


এদিকে নিলির স্বীকারোক্তি দেওয়ার কথাটা খুব তাড়াতাড়ি অফিসের সবার কাছে পৌঁছে গেলো। পরেরদিন রেজোয়ানের পার্সনাল সেক্রেটারি জাহিদ এলো নিলির সঙ্গে দেখা করার জন্য। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না। স্বীকারোক্তি ছাড়া পুলিশ নিলিকে জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানালো।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস দেখে নিজের ওপর করুণা হলো নিলির। এভাবে তিল তিল করে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে তো একবারে মরে যাওয়াই তো ভালো। কিন্তু মরে যাওয়া কি এতই সহজ? চাইলেও মরার কথা ভাবতে পারে না নিলি। অনেকের অনেক ঋণ শোধ করার বাকি আছে তাঁর। সেসব ঋণ শোধ করতে না পারলে যে মুক্তি নেই। অসহ্য বেদনায় বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে এলো। কেন সৃষ্টিকর্তা তাঁকে এত দুঃখ দিলেন?

জাহিদের হাত ধরে হুহু করে কেঁদে ফেললো নিলি। অসহায়ের মত করুণা আর্তনাদ করে বললো,’বিশ্বাস করুন স্যার। আমি কোন ইনফরমেশন লিক করি নি। আমি কিচ্ছু জানি না। আমাকে আজিজ সাহেব বলেছিলেন মেইলটা রেজা গ্রুপের কাছে পাঠাতে।’

তাঁর কান্না দেখে জাহিদের মায়া হলো। গতদুইদিন ধরে আজিজের ওপর নজর রাখছে সে। লোকটার ব্যবহার হঠাৎ করেই কেমন যেন সন্দেহ জনক মনে হচ্ছে। কিন্তু সে-ই আসল কালপ্রিট কিনা সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না। নরম মোলায়েম কন্ঠে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,’আপনি কাঁদবেন না মিসেস নিলি। আমি দেখছি কি করা যায়।’

-‘আপনি আমাকে বাঁচান প্লিজ। আমি আপনার পায়ে পড়ছি।’ বলতে বলতে মেঝেতে বসে পড়লো নিলি। কিন্তু পা চেপে ধরার আগেই তাঁর হাত ধরে ফেললো জাহিদ। পুনরায় সান্ত্বনা দিয়ে বললো,’কি করছেন মিসেস নিলি? আমিতো আপনাকে বলেছি আমাকে একটু সময় দিন। আমি আসল অপরাধীকে ঠিক খুঁজে বের করবো। আপনাকে বিনা অপরাধে কিছুতেই শাস্তি পেতে দেবো না।’ তাঁর কথা শুনে কিছুটা শান্ত হলো নিলি। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। মলিনমুখে খানিকটা হাসার চেষ্টা করে বললো,’সরি স্যার। আমি আসলে আপনাকে বিব্রত করতে চাই নি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার কাছে আর কোন উপায় নেই।’

-‘আমি জানি। আপনি কিছু করেন নি। আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি,খুবই শীঘ্রই আসল অপরাধী ধরা পড়বে। আপনি প্লিজ ধৈর্য রাখুন। এখন আসছি আমি।’

জাহিদ সেদিন নিলিকে পাহাড় পরিমান ভরসা দিয়ে গেলেও দুঃখের বিষয় হচ্ছে সেদিনের পর থেকে আর একবারও নিলির যোগাযোগ হয় নি তাঁর। মনে মনে হাল ছেড়ে দিলো নিলি। বাঁচার আর কোন সম্ভাবনা নেই। একমাত্র ভরসা ছিলো জাহিদ। সেও গায়েব হয়ে গেছে!

আগামীকাল কোর্টের হিয়ারিং। সময় যত ঘনিয়ে আসলো ভয়টা ততই বাড়ছে নিলির। আজিজের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। অতএব দোষী নিলি। শাস্তি তাঁকেই ভোগ করতে হবে। ভাগ্যকে মেনে নিয়ে নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করার চেষ্টা করলো নিলি। কিন্তু যতবারই তাঁর প্রতি করা রেজোয়ানের নিষ্ঠুর আচরণগুলোর কথা মনে পড়লো ততবারই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। বিনা অপরাধে মিথ্যে অপবাদের দায়ভার মাথায় নিয়ে শাস্তি পেতে যাচ্ছে নিলি, এবার নিশ্চয়ই রেজোয়ান ভালো থাকবে। খুব খুশি হবে। তাঁর মনের আশা পূরণ হবে। রেজা গ্রুপের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকাটাও পেয়ে যাবে।

কিন্তু পরেরদিনই অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটলো নিলির সঙ্গে। জাহিদকে সাথে করে রেজোয়ান নিজে এসেছে নিলির সঙ্গে দেখা করার জন্য। জাহিদের হাতে নিলির জামিনের কাগজ পত্র। রেজোয়ানকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না নিলি। হতবম্ভ, বিস্মিত চেহারা নিয়ে জাহিদের দিকে চাইলো। জবাবে জাহিদ মুচকি হেসে মাথা দোলালো। সে তাঁর কথা রেখেছে। আসল অপরাধীকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।

সেদিন অন্য একটা নাম্বার থেকে নিলিকে কল করায় আজিজকে ধরতে পারে নি জাহিদ। কিন্তু নিলির ফোনে অটো কল রেকোর্ড সিস্টেম চালু থাকায় দুজনের মধ্যকার কথোপকথন আপনা আপনি রেকোর্ড হয়ে যায়। সেটা থেকেই আজিজের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করে পুলিশ।

জেল থেকে বেরিয়ে ধীরপায়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো নিলি। তাঁর ঠোঁট ফোলা। মাঝখান থেকে কেটে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। গালের একপাশে কালশিটে পড়ে গেছে। মাথার চুল জটলা বেধে উষ্কখুষ্ক! তাঁর অবস্থা দেখে রেজোয়ানের চোখে পানি চলে আসার জো! নিরব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে নিলো সে। বুকের ভেতরে পিনপিন ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালো।

সে বেরিয়ে গেলে নিলিকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো জাহিদও। কিন্তু কয়েকমিনিটও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না নিলি। গাড়িতে বসার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। ঐ অবস্থায়ই তাঁকে নিয়ে সরাসরি হস্পিয়ালের দিকে রওনা দিলো জাহিদ এবং রেজোয়ান।

আধঘন্টা বাদে নিলির জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফিরতে আতংকিত চেহারা নিয়ে চারপাশে চাইলো। বেডের পাশে চেয়ারে বসে আছে রেজোয়ান। নিলিকে চোখ খুলতে দেখে হাতের কাগজ রেখে যথাসম্ভব শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,’এখন কেমন লাগছে?’

-‘ভালো!’

-‘কিছু খাবে?’

উপরে নিচে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো নিলি। কিন্তু রেজোয়ান যখন পাশের টেবিলের ওপর রাখা ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল বের করে তাঁর হাতে দিলো তখন বহুদিনের অভুক্তের ন্যায় লজ্জা শরমের বালাই ভুলে সেটার ওপর হামলে পড়লো নিলি। বুভুক্ষের মত তাতে কামড় বসালো। রেজোয়ান চুপ করে তাঁর খাওয়া দেখে গেলো।
মোট মিলে গোটা তিনেক আপেল, তিনখানা ফ্রুট স্যান্ডউইচ এবং প্রায় হাফ কেজি আঙ্গুর খেয়েছে নিলি। তাঁর খাওয়া দেখে রেজোয়ানের মনে হলো আদিমযুগের বনমানুষরা যেমন হুট করে শিকারের সন্ধান পেলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক তেমনি করে খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিলি।

রেজোয়ানকে চেয়ে থাকতে দেখে বেশ লজ্জা পেলো নিলি। রাক্ষসের মত খেয়েছে সে। তাঁর দৈন্যদশা একেবারে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে রেজোয়ানের সামনে। লজ্জায়, শরমে ভেতরে ভেতরে একেবারে সংকুচিত হয়ে গেলো। এভাবে খাবারের প্রতি লোভ দেখানোটা মোটেই উচিৎ হয় নি। ইতস্তত করে বললো,’ওদের শক্ত রুটি আমি খেতে পারি নি। তরকারিতে ভীষণ ঝাল দেয়…!’

তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই গলা খাঁকারি দিলো রেজোয়ান। মিথ্যে বলেছে নিলি। জেলে থাকা অবস্থায় একটা আধপোড়া রুটি আর আধবাটি ঝাল আলুর তরকারিকেই অমৃতের মতন খেয়েছে সে। কিন্তু এত অল্প খাবারে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ অসম্ভব।
ভাজির সঙ্গে একটা মরা টিকটিকিও পাওয়ার পরেও সেই খাবারগুলো খেয়েছে সে। কিন্তু সারাদিনের টর্চারের পর সামান্য এই খাবারটুকু পেটের এককোনায়ও পড়তো না। তাই চোখের সামনে খাবার দেখে নিজেকে সামলাতে পারে নি। কিন্তু রেজোয়ানের কাছে ভেতরের দুর্বলতা প্রকাশ করতে চাইলো না। রেজোয়ান হয়ত ভাববে সিমপ্যাথি আদায়ের জন্য মিথ্যা কষ্ট পাওয়ার নাটক করছে সে।

রেজোয়ান সেটা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইলো। কিন্তু সে কিছু বলার তার আগেই দরজার কাছ থেকে জাহিদের কন্ঠস্বর শোনা গেলো। হাতে ওষুধপত্র এবং ফলমূল নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে নিলিকে উদ্দেশ্য করে উৎফুল্ল স্বরে বললো,’বাহ মিসেস নিলি? আপনার জ্ঞান ফিরে গেছে? এখন কেমন লাগছে? আগের চাইতে ভালো?’

জবাবে মলিন মুখে সামান্য হাসলো নিলি। জাহিদ ওষুধের বোতলগুলো তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,’এই নিন আপনার ওষুধ। নিয়ম করে খাবেন। রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছে আপনার। গাফিলতি দিলে চলবে না।’
তারপর বিলের কাগজটা রেজোয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’খরচের হিসেব স্যার। বিল আমি জমা করে দিয়েছি। ডাক্তার বলেছেন ভয়ের কোন কারণ নেই। তবে কিছুদিন অবজারভেশনে রাখতে হবে!’

রেজোয়ান চুপচাপ বিলের কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো। দেখা শেষে সেটা পুনরায় জাহিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,’উনাকে বলবেন, সামনের মাসে এই টাকাটা উনার বেতনের অংশ থেকে কেটে নেওয়া হবে।’

রোগীর সামনে এই ধরণের কথাবার্তায় বেশ বিব্রত হলো জাহিদ। চট করে নিলির মুখের দিকে চাইলো। চোখভর্তি পানি নিয়ে নিজের অসহায়ত্ব লুকানোর চেষ্টা করছে মেয়েটা। হস্পিটালের খরচ বহন করার মতন সামর্থ্য তাঁর নেই। জাহিদকে উদ্দেশ্য করে বললো,’শুধুশুধু হস্পিটালের বিল বাড়িয়ে কি লাভ। অযথা পয়সা নষ্ট! আপনি বরং আজই আমার রিলিজের ব্যবস্থা করে দিন।’

জবাবে জাহিদ ইতস্তত করে বললো,’কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয় মিসেস নিলি। আপনি অলরেডি অ্যাডমিট হয়ে গেছেন। কালকে ছাড়া রিলিজ সম্ভব না। এদিকে কালকে আবার হস্পিটালের বড় ডাক্তার ছুটি আছেন।উনাকে না দেখানো পর্যন্ত আপনি রিলিজ নিতে পারবেন না। আপনার শারীরিক কন্ডিশন সেটা পারমিট করবে না।’

-‘কিচ্ছু হবে না। আমি এখন একদম সুস্থ আছি। আপনি প্লিজ আজকেই রিলিজের ব্যবস্থা করুন।’

-‘আপনি বুঝতে পারছেন না মিসেস নিলি ওরা এখন দেবে না আপনাকে রিলিজ।’

-‘প্লিজ। একবার অন্তত চেষ্টা করে দেখুন।’

ফোন স্ক্রল করার বাহানায় চুপচাপ বসে দুজনের কথাবার্তা শুনছিলো রেজোয়ান। কিন্তু আর পারলো না। অসুস্থ শরীরে নিলির রিলিজ নেওয়ার তাড়া দেখে উঠে বেরিয়ে গেলো। বড্ড অসহায় লাগছে তাঁর।একনিমিষেই সব কিছু অর্থহীন মনে হচ্ছে। এতকিছুর পরেও একটা স্বার্থপর লোভী মেয়ের জন্য কেন এত কষ্ট হচ্ছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না।

মানুষ চাইলেও অনেক সময় অনেক কিছু ভুলতে পারে না। তেমনি করে রেজোয়ানও পারছে না। হাজার চেষ্টা করেও সে ভুলতে পারছে না এই স্বার্থপর,লোভী মেয়েটাকেই একদিন নিজের চাইতে বেশি ভালোবেসে ছিলো সে। তাঁর সমস্ত কিছুর ওপর সবচেয়ে বেশি অধিকার ছিলো নিলির। অথচ সবচেয়ে বেশি ঘৃণা এখন তাঁকেই করতে হচ্ছে। একজন প্রেমিকের জন্য এরচাইতে দুঃখের, এর চাইতে বেদনার আর কি হতে পারে?

#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৮

গরম ধোঁয়া উঠা কফির মগ হাতে নিয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে রেজোয়ান। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধ্যে হতে আর বেশি বাকি নেই। তথাপি নিচে নামতে মন চাইছে না রেজোয়ানের। বিকেলের এই সময় নিরিবিলিতে বসে প্রকৃতি উপভোগ করতে বেশ ভালো লাগে তাঁর। গোধুলীর সময় ঘরে ফিরতে ব্যস্ত পাখিদের কিচিরমিচির অদ্ভুত এক প্রশান্তি দেয়।

কিন্তু এই বিল্ডিংয়ে যে তিন্নি নামের একজন আছে সেটা সে ভুলে গিয়েছিলো। তাই তো প্রকৃতি উপভোগ করার জন্য বারান্দায় না দাঁড়িয়ে ছাদে এসেছে।

তিন্নি এসেছিলো ছাদে কাপড় নিতে। রেজোয়ানকে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, সহ্য হলো না। না হওয়ারই কথা। বেশিকিছুদিন ধরে মনমতো ঝগড়া করতে পারছে না রেজোয়ানের সঙ্গে।
তারওপর এক তারিখ থেকে ফাইনাল পরীক্ষা। একমাস রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা হবে না।
পা টিপেটিপে রেজোয়ানের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপরই সজোরে ‘ভাউ’ বলে তাঁর কানের কাছে চিৎকার করে উঠলো। আচমকা ভয় পেয়ে গেলো রেজোয়ান। চমকে উঠে পেছনে সরে গেলো। রাগে কটমট করে তিন্নির দিকে চাইলো।

এদিকে তাঁকে চমকে দিতে পেরে বেজায় খুশি তিন্নি। চোখেমুখে দুষ্টুমিভরা চাহনি নিয়ে বললো,’ভয় পেয়ে ছিলেন?’

রেজোয়ানের মন চাইলো কষে এই বদ মেয়েটার কানের নিচে একটা চড় বসিয়ে দিতে। তথাপি, অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজেকে সামলে নিলো। কারণ মিথ্যে বলায় তিন্নির জুড়ি নেই। দেখা যাবে তাসলিমা বেগমের কাছে গিয়ে বলবে রেজোয়ান তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিতে চেয়েছিলো।

তাই তিন্নির প্রশ্নটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সামনে ঘুরে গেলো। কফিতে চুমুক দিয়ে আপনমনে সেটার স্বাদ অনুভবের চেষ্টা করলো। কিন্তু তাতেও বাগড়া বসালো তিন্নি। কফির মগটা নিয়ে রেজোয়ানের অনুমতি ছাড়াই তাতে চুমুক বসালো। ধমকে উঠলো রেজোয়ান। কিন্তু পাত্তা দিলো না তিন্নি। নিজের মত করেই বলে গেলো,’আপনার কি মন খারাপ? কি হয়েছে বলুন তো? ইদানীং দেখছি খুব চুপচাপ হয়ে গেছেন?’

কফির মগটা তাঁর হাতে দিয়ে রেজোয়ান নেমে যাচ্ছিলো। প্রকৃতি উপভোগের সাধ মিটে গেছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে রাজ্যের গল্প শুরু করে দেবে তিন্নি। বকবক করে মাথাটা খারাপ করে দেবে। তারচেয়ে বাসায় বসে রেস্ট করাই ভালো। কিন্তু তিন্নি তাঁকে নিচে নামতে দিলো না। সামনে দাঁড়িয়ে হাত দুটো মেলে ধরে পথ আটকালো। ফের নরম গলায় বললো,’কি হয়েছে আপনার? কেন এমন করছেন?’

-‘কিছু হয় নি। তুই প্লিজ সামনে থেকে সর।’

-‘কি হয়েছে সেটা না বললে আমি সামনে থেকে সরবো না।’

-‘বললাম তো কিছু হয় নি।’

-‘হয়েছে। আপনি আমাকে বলতে চাইছেন না।’

-‘সেটা যখন বুঝতেই পারছিস তখন খামোখা বিরক্ত করছিস কেন?’

তিন্নি বেশ অবাক হওয়ার ভান করে বললো,’ওমা! আপনি জানেন না? আপনাকে বিরক্ত করাটাই তো আমার প্রধান কাজ। এখন সময় নষ্ট না করে ঝটপট বলে ফেলুন কি হয়েছে?’

-‘তুই আমাকে জ্বালানো বন্ধ কর প্লিজ।’

তিন্নি ঠোঁট উল্টালো। জোর করে লাভ হবে না। রেজোয়ান একবার যখন ঠিক করে নিয়েছে তখন বলবে না। জোরাজুরি বাদ দিয়ে অনুরোধের সুরে বললো,’ঠিক আছে বলতে হবে না। শুধু একটা প্রশ্নের জবাব দিন, আপনি কি কোন কিছু নিয়ে আপসেট?’

-‘হুম।’

-‘কি সেটা?’

-‘তোকে বলা যাবে না।’

-‘এমন করছেন কেন? কি হয় একটু বললে? আমি কথা দিচ্ছি কাউকে বলবো না।’

-‘তোকে আমি বিশ্বাস করি না।’

তিন্নির হাসি পেয়ে গেলো। মুচকি হেসে বললো,’ঠিক আছে। কিন্তু আপনি চলে যাচ্ছিলেন কেন? আমি আপনার কফিতে চুমুক দিয়েছি বলে? দাঁড়ান আমি আরেক মগ বানিয়ে নিয়ে আসছি।’

-‘লাগবে না।’

-‘আর ইউ সিউর? পরে আবার আমাকে এই নিয়ে কথা শোনাবেন না তো?’

রেজোয়ান তাঁর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পুনরায় আকাশ পানে চাইলো। মনটা ভীষণ খারাপ তাঁর। অদ্ভুত বিষন্নতায় সমস্ত শরীর ছেয়ে আছে। মন,মস্তিষ্ক কোনটা থেকেই নিলিকে বাদ দিতে পারছে না। পুরোনো স্মৃতিগুলো একএক করে চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
উদাস গলায় বললো,’তুই গান গাইতে জানিস তিন্নি? পুরোনো দিনের রোমান্টিক বাংলা গান?’

-‘অল্প অল্প।’

-‘সমস্যা নেই।’

তিন্নি দুষ্টুভাবে ভ্রু জোড়া নাচালো। ফিচেল হেসে বললো,’কি ব্যাপার বলুন তো? আমাকে কি আজকে বেশি সুন্দর লাগছে?’

তাঁর এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে রেজোয়ান ঠাট্টারচ্ছলে খানিকটা হাসলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললো,’তুই সত্যিই গান গাইতে জানিস তো?’

-‘আরে জানি, জানি।’

তারপর তিন্নি তাঁকে অবাক করে দিয়ে যথেষ্ট কনফিডেন্স এর সহিত গান গাইতে শুরু করে দিলো,
‘আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা
ভালো না হাতের লেখা।
আসো যদি বাঁশবাগানে
আবার হবে দেখা গো আবার হবে দেখা।’

রেজোয়ান হতবম্ভ! হাতে উচিয়ে চড় মারার ভঙ্গি করে বললো,’তুই থামবি? না আমি কানের নিচে একটা দিবো?’

-‘গান শুনবেন না?’

-‘তোর এই গান শুনে গান নামক বস্তুটার ওপর থেকে রুচি উঠে গেছে আমার।’

ইচ্ছে করে রেজোয়ানকে হাসানোর জন্য গানটা গেয়েছে তিন্নি। রেজোয়ান মুড অফ করে থাকলে তাঁর একদম ভালো লাগে না। কিন্তু হাসার পরিবর্তে রেজোয়ানকে বিরক্ত হতে দেখে তাঁর নিজেরই হাসি পেয়ে গেলো। হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতন অবস্থা।

তাঁর অবস্থা দেখে রেজোয়ানও হেসে ফেললো। মৃদু হেসে বললো,’তুই এসব কই থেকে শিখেছিস?’

-‘আরো আছে। শুনবেন?’

-‘আর দরকার নেই। যথেষ্ট হয়েছে।’

-‘তাহলে আপনি একটা গেয়ে শুনান।’

-‘আমি গান পারি না।’

-‘পারতে হবে না। লিরিক্স মুখস্থ থাকলেই হবে।’

রেজোয়ান যেন তাঁর কথা শুনতেই পায় নি এমনভাবে বললো,’আমি নিচে যাচ্ছি। তুই কি এখন যাবি না আরো কিছুক্ষণ থাকবি?’ বলতে বলতেই হাঁটা ধরলো সে। তিন্নিও তাঁর পেছন পেছন দৌঁড়ে লাগালো।

লিফটে করে নামার সময় তাড়াহুড়া করে বললো,’আপনার সাথে আগামী একমাস আমার দেখা হবে না রেজোয়ান ভাই।’

-‘আলহামদুলিল্লাহ।’ সকৌতুকে হাসলো রেজোয়ান।

কিন্তু তিন্নি এবার সত্যি সত্যি মুখটা ভার করে বললো,’আমি সত্যি বলছি। কাল থেকে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে না। এক তারিখ থেকে ফাইনাল পরীক্ষা। আম্মা বলেছে পরীক্ষার সময় একদম বাসা থেকে বেরোনো যাবে না। এই একমাস ভালো করে পড়তে হবে।’

-‘ঠিকই তো বলেছেন। সারা বছর তো পড়াশুনা করিস নি। ফাঁকিবাজি করেই কাটিয়ে দিয়েছিস। এখন মন দিয়ে না পড়লে পাশ করবি কি করে?’

-‘সেসব নাহয় বুঝলাম। কিন্তু একটা কথা বলুন তো,আপনি আমাকে মিস করবেন না?’, এবার আগের চাইতেও বেশি করুণ শোনালো তিন্নির কন্ঠস্বর। চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। এই একমাস রেজোয়ানের সঙ্গে তাঁর দেখা হবে ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। অথচ রেজোয়ান কিছুতেই তিন্নির ভালোবাসাটা বুঝতে চায় না। সারাক্ষণ শুধু পালিয়ে বেড়ায়।

তার করুণ মুখ পানে চেয়ে মিথ্যে বলতে পারলো না রেজোয়ান। নরম গলায় বললো,’করবো।’

বাস্তবিকই এই মেয়েটাকে ভীষণ মিস করবে সে। তিন্নি ভীষণ মিশুক একটা মেয়ে। যখনই দেখা হবে রেজোয়ানের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কিছু না কিছু করবে। যদিও বেশিরভাগ সময় ঝগড়াই করে তবুও ওর এই চঞ্চল স্বভাবের জন্যই রেজোয়ান ওকে বিশেষ স্নেহ করে।

তিন্নির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বলা বাহুল্য, রেজোয়ান তাঁকে মিস করবে শুনে ভেতরে ভেতরে অসম্ভব খুশি হয়েছে সে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করলো না।

লিফটের কাছাকাছি এসে রেজোয়ান তাঁর মাথায় একটা হাত রেখে স্নেহের সুরে বললো,’পরীক্ষাটা এবার ভালো করে দে তিন্নি। এখন আর অন্য কোন দিকে মনযোগ দিস না। হাতে মাত্র একমাস সময় আছে। এই একমাস একটু ভালো করে পড়।’

তিন্নি বাধ্য মেয়ের মতন হ্যাঁসূচক মাথা দোলালো। রেজোয়ান ভাই যখন বলেছে, তখন ভালো করে পড়াশোনা করতেই হবে তাঁকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here