তুমি_তাই,২৪,২৫

0
748

#তুমি_তাই,২৪,২৫
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৪

এয়ারপোর্ট থেকে শায়লা মুরসালীনকে নিয়ে সরাসরি মামার বাসায় উঠেছে রেজোয়ান। প্রায় তিন বছর পর দেশে ফিরেছে তাঁরা। শায়লা মুরসালীন ভীষণ খুশি। এসেই খবর পেয়েছেন তিন্নি সন্তানসম্ভবা। তিন্নিকে তিনি বাস্তবিকই ভীষণ ভালোবাসতেন।

তিন্নিকে দেখে অবাক না হয়ে পারলো না রেজোয়ান। পাকা গিন্নী হয়ে উঠেছে একেবারে। সংসারের দায়িত্ব বেশ ভালোই বুঝে নিয়েছে। তার ওপর পাঁচমাসের অন্তঃসত্ত্বা। ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছে। না দেখলে রেজোয়ান বিশ্বাসই করতো না আগের সেই ছোট্ট তিন্নি এত বড় হয়ে গেছে।

রেজোয়ান কাছে গিয়ে তিন্নির মাথায় হাত রাখলো। মিষ্টি হেসে বললো,’কি খবর ভাবীসাহেবা, কেমন আছেন আপনি?’

তিন্নি সপ্রতিভ হাসলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,’ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’

রেজোয়ান হাত দুটো দুদিকে প্রশস্ত করে বললো,’আছি তো ভালোই। কিন্তু দেখুন তো বুড়োটুড়ো হয়ে গেছি কি না?’

তিন্নি শব্দ করে হাসলো। বললো,’বসুন। আপনার জন্য শরবত নিয়ে আসি। জার্নি করে এসেছেন ভালো লাগবে।’

তিন্নি চলে গেলে রেজোয়ান সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বুকের ওপর থেকে অনেক বড় বোঝা নেমে গেছে তাঁর। তিন্নি সুখি হয়েছে। তাঁর স্বপ্নের রাজকুমার সে পেয়ে গেছে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলো রেজোয়ান তিন্নির মুখের এই হাসি যেন চিরকাল বজায় থাকে। সে যেন রাজরানী হয়।’

সেদিন আর কোথাও বেরোলো না রেজোয়ান। অনেক দিন বাদে দেশে ফিরেছে বাসার সবার সঙ্গে গল্পগুজব করেই কাটিয়ে দিলো। পরেরদিন বিকেল বেলা জাহিদকে নিয়ে বাসার কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্ট কফি খেতে বেরোলো।

ভেতরে বসে পুরোনো কিছু ব্যবিসায়িক আলাপ আলোচনা সেরে নিচ্ছিলো দুজনে। হঠাৎ ওয়েটারের ড্রেস পরিহিতা গৌরবর্ণ, শীর্ণদেহী এক নারীকে দেখে দুজনেই থমকে গেলো।
ব্যস্ত ভঙ্গিতে টেবিলে টেবিলে ওর্ডার পরিবেশন করছে নিলি। রেজোয়ানদের টেবিলে কফির অর্ডার নিয়েই এগিয়ে আসছে। রেজোয়ানের চোখের পলক পড়লো না। মূর্তির মতন নির্বাক হয়ে সামনের দিকে চেয়ে রইলো সে।
একটু একটু করে সামনে এগিয়ে আসছে নিলি। আর একটু একটু করে বাড়ছে রেজোয়ানের হৃদস্পন্দন। তিন বছর পর আবার সেই জ্বালাময়ী মুখ! এখনো সেই আগের মতন বিষাক্ত অনুভূতি। ছলছল করে উঠলো চোখজোড়া!

সেদিন রেজোয়ানের দেওয়া ফ্ল্যাটটা নেয় নি নিলি। হস্পিটাল থেকে বাবাকে নিয়ে মাস খানেকের মত নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলো। কোথায় গিয়েছিলো কাউকে বলে যায় নি। তারপর একদিন জাহিদ খবর পায় নিজামউদ্দিন সাহেব মারা গেছেন। তাঁকে নিয়ে দেশের বাড়িতেই গিয়েছিলো নিলি। সেখান থেকে ফিরে এসে রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের চাকরি। তারপর থেকে জাহিদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথাবার্তা হয়। কিন্তু নিলি থাকে কোথায়, চাকরী করে কোথায় এসব জাহিদ জানতো না। তাই আজকে হঠাৎ নিলিকে দেখে সেও চমকে গেছে। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে একহারা হয়ে গেছে নিলি। শরীরে রক্তমাংস বলতে কিচ্ছু নেই। যেন ফ্যাকাসে একটা মূর্তি এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।

টেবিলের কাছে কফি রেখে চলে যাচ্ছিলো নিলি। কিন্তু রেজোয়ানের চোখে চোখ পড়তেই থমকে গেলো। হতবিহ্বল, বিস্মিত চেহারা নিয়ে দুজনেই অনেকক্ষণ একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর আচমকাই হেসে ফেললো নিলি। স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করলো,’কেমন আছো?’

রেজোয়ান স্বাভাবিক হতে পারলো না। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে তাঁর। জড়সড় গলায় কোন রকমে উত্তর দিলো সে,’ভালো। তোমার কি খবর?’

-‘এই তো আছি কোনরকম। ঘর, চাকরী এসব নিয়েই দিন কেটে যাচ্ছে।’

-‘ও।’, কথা হারিয়ে ফেলেছে রেজোয়ান।

-‘তোমরা কি বসবে কিছুক্ষণ? আমার আসলে তাড়া আছে।’, রেজোয়ানের সামনে থেকে তাড়াতাড়ি পালাতে চাইলো নিলি। জাহিদ যেন সেটা বুঝতে পেরেই বললো,’ইট’স ওকে। তুমি যেতে পারো। আমরা বেশিক্ষণ থাকবো না।’

-‘থ্যাংক ইউ।’, নিলি মুচকি হাসি দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। কিন্তু রেজোয়ানের চোখের আড়াল হতেই গলগল করে চোখের পানি পড়তে শুরু করলো তাঁর। এতদিন বাদে এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে সে ভাবতেই পারে নি। ভালোবাসার মানুষটাকে কতদিন বাদে দেখতে পেয়েছে অথচ পাহাড়সম অপরাধবোধ নিলিকে সামনে দাঁড়াতে পর্যন্ত দেয় নি।

নিলি চলে গেলে,শক্ত হয়ে বসে রইলো রেজোয়ান। কফি ঠান্ডা হয়ে গেলো। তাঁর মুখে উঠলো না। উঠে দাঁড়ালো সে। বিল পে করে জাহিদকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

রবিবার সন্ধ্যায় নিলি বেরিয়েছিলো সাপ্তাহিক বাজারের যোগান করতে। রেজোয়ান মেয়েকে ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় ফিরছিলো।
পথিমধ্যে পুনরায় দেখা হয়ে গেলো দুজনার। নিলি না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু রেজোয়ান সেটা হতে দিলো না। মেয়েকে জাহিদের কোলে দিয়ে নিলির পিছু নিলো সে। কিছুদূর এগিয়ে ডাক দিলো।

-‘নিলি দাঁড়াও!’

অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিলি দাঁড়িয়ে পড়লো। মুখ তুলে চাইলো। রেজোয়ানও তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলো।

-‘কিছু বলবে?’

-‘অনেকদিন বাদে দেখা। সেদিন তো কথাই বলতে পারি নি।’

-‘হ্যাঁ। প্রায় তিনবছর পর।’

-‘আমি তো ভেবেছিলাম আর কখনো বোধহয় তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।’

নিলি সামান্য হাসলো। তবে ওর হাসিতে প্রাণ নেই। আছে শুধু ক্লান্তি। রেজোয়ান হাতে বাজারের ব্যাগের দিকে ইশারা করে বললো,’এত বাজার? বিয়ে করেছো নিশ্চয়ই?’

নিলি হালকা হাসলো। বললো,’আমার কথা বাদ দাও। তোমার কি খবর? জাহিদের কাছে শুনলাম সন্তানের বাবা হয়েছো?’

রেজোয়ান মুখে খুশির রেখা টেনে নিলো। সপ্রতিভ হাসলো। বললো,’হ্যাঁ। ফুটফুটে দুটো কন্যাসন্তান আছে আমার।’

চোখের কোনে সামান্য জল বুঝি জমা হলো নিলির। কিন্তু রেজোয়ানকে দেখাতে চাইলো না। বাঁ হাতের কোনে চোখ মুছে মৃদু হেসে বললো,’তা দেশে হঠাৎ কি মনে করে?’

-‘এমনি। মেয়েদেরকে নিয়ে ঘুরতে এসেছি।’

-‘ওদের মা আসে নি?’

-‘না।’

-‘ আচ্ছা। ঠিক আছে আমি তাহলে আসি।’

বাজারের দিকে পা বাঁড়ালো নিলি। রেজোয়ান ফের পিছু ডাক দিলো।

-‘একটা প্রশ্ন ছিলো নিলি!’

-‘কি প্রশ্ন?’

-‘রেজাকে কি তুমি সত্যিই ভালোবাসতে?’

নিলি পুনরায় হাসলো। এইসব প্রশ্নের এখন কোন মানে হয় না। পুরো কাসুন্দি ঘেটে কি লাভ! বললো,’থাক না এসব কথা।’

-‘আমি জানতে চাই।’

-‘কেন?’

রেজোয়ান লজ্জা পেলো। পূর্বের কথাটা সংশোধন করে বললো,’না মানে কৌতুহল আর কি। যার জন্য তুমি আমাকে ত্যাগ করেছো তাকে সত্যিই ভালোবাসতে কিনা আমি জানতে চাই।’

-‘রেজা সাহেবকে আমি শ্রদ্ধা করতাম।’

-‘ভালোবাসতে না?’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিলি বললো,’বাসতাম।’

মিথ্যে বলেছে সে। ইচ্ছে করেই বলেছে। রেজোয়ান সংসারী হয়েছে। নিলির আর কিছু চাই না। নিজের অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে সারাজীবন রেজোয়ানের কাছ থেকে দূরে সরে থাকবে সে। রেজোয়ানকে কোনদিন জানতে দেবে না তাঁকে ঠিক কতটা ভালোবাসে নিলি। কখনো, কোনদিন, কোন একমুহূর্তের জন্যেও না। রেজোয়ান তাঁকে ঘৃণা করে করুক। কিন্তু নতুন করে তাঁকে আর কোন পিছুটানে ফেলতে চায় না নিলি। এমনিতেই নিলির জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে সে। আর তাঁকে কষ্ট দিতে চায় না নিলি।

-‘তারজন্যই বুঝি বারবার আমাকে অপমান করেছিলে? তোমার জন্যই নিশ্চয়ই রেজা আমার গায়ে হাত তোলার সাহস পেয়েছিলো?’

-‘এখনো মনে আছে তোমার?’

জবাবে রেজোয়ান ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নিলির প্রতি। সেদিনের কথা কোনদিন ভুলবে না রেজোয়ান। হলভর্তি লোকজনের সামনে তাঁকে অপমান করে দুশ্চরিত্র, লম্পট রেজার হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছিলো নিলি।
নিলি হেসে উঠে বললো,’পুরুষমানুষের দাম্ভিকতায় আঘাত লাগলে তারা সহজে ভুলতে পারে না। বড় অদ্ভুত তোমরা পুরুষজাতি। সেই কবে দুটো চড় খেয়েছিলে এখনো মনে আছে। অথচ আমি রোজ মুবিনের হাতে মার খেতাম। তারপরেও সে মরে যাওয়ায় কষ্ট হয়েছিলো আমার।’

-‘সবার জন্যই তোমার কষ্ট হতো কেবল আমার জন্য ছাড়া।’

-‘তা অবশ্য ঠিক বলেছো।’

আশ্চর্য হলো রেজোয়ান। এতদিন বাদে নিলির উদাসীনতা তাকে আঘাত করার কথা নয়। অথচ তাঁর কষ্ট হচ্ছে! এই একটি মাত্র নারীর কাছে এলে নিজেকে বড় তুচ্ছ মনে হয় রেজোয়ানের। তাঁর প্রতি এত অন্যায়, এত অবিচার করার পরেও সদর্পে গলা উঁচু করে কথা বলছে নিষ্ঠুর রমণীটি। বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ নেই কথার মাঝে!

-‘আমি আসি?’, সামনের দিকে পা বাঁড়ালো নিলি।

জবাবে রেজোয়ান গম্ভীর গলায় বললো,’এসো। কিন্তু যাওয়ার আগে একটা কথা জেনে রেখো গোটা পৃথিবী একমাত্র তোমাকে আমি সবথেকে বেশি ঘৃণা করি। এত ঘৃণা করি যে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।’

নিলি কোন কথা বলতে পারলো না। নির্বাক চোখে চেয়ে রইলো রেজোয়ানের দিকে। পুরোনো অনেক কথাই মনে পড়ছে তাঁর। রেজার সঙ্গে বিয়ে নিয়ে কতই না তোলপাড় করেছিলো রেজোয়ান। প্রথমে অবশ্য নিলি বুঝতে পারে নি। ভেবেছিলো তাঁকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নতুন করে ফন্দি আঁটছে রেজোয়ান। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো রেজোয়ান ভালোবাসা মিথ্যে নয়। তাঁকে সত্যিই ভালোবাসে রেজোয়ান।

কিন্তু এরপরেও রেজাকে দেওয়া কথা থেকে সরে আসতে পারলো না নিলি। বিবেকের কাছে হেরে গেলো সে। বিপদের দিনে রেজাই তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলো। তাছাড়া তখন শায়লা মুরসালীনও টেলিফোন করে খুব ধমকাচ্ছিলেন নিলিকে। বারবার ফোন করে শুধু একটা কথাই বলতেন নিলি যেন ভুলেও রেজোয়ানের জীবনে ফিরে যাওয়ার কথা না ভাবে।

যাইহোক, এসব কথা এখন আর ভাবতে চায় না নিলি। সবকিছুর উর্ধ্বে, সবচেয়ে বড় সত্যিটা হলো যেভাবেই হোক রেজোয়ানের সঙ্গে অন্যায় করেছে নিলি। ভীষণ অন্যায় করছে। রেজাকে বিশ্বাস করে অন্যায় করছে, রেজোয়ানের ভালোবাসার মূল্য না দিয়ে অন্যায় করেছে। আর তাই সেই অপরাধবোধ নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চায় নিলি।

কিন্তু নিজের অন্যায়ের কথা কোনদিন মুখ ফুটে বলতে চায় না রেজোয়ানের কাছে। রেজোয়ান তাঁকে ঘৃণা করে সুখে থাকুক। নিলি নিজেই চায় তাঁর প্রতি কোন মায়া রেজোয়ানের না জন্মাক। নিলির একজীবন এমনিতেই পচে গলে নষ্ট হয়ে গেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর জীবনের প্রতি আর কোন চাওয়া নেই নিলির। এখন কেবল বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকা।

ছলছল চোখে রেজোয়ানের দিকে চেয়ে থেকে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু হাসি এলো না। তার পরিবর্তে বুক ভর্তি কান্না বেরিয়ে আসতে চাইলো। এতদিন বাদে রেজোয়ানকে সামনে দেখে আবেগ চেপে রাখতে পারছে না। সময় নষ্ট না করে বাজারের দিকে এগিয়ে গেলো । পিছু ফিরে আর চাইলো না পাছে রেজোয়ান তাঁর চোখের পানি দেখে ফেলে সেই ভয়ে।


ঘর অন্ধকার করে একা একা হাসছে রেজোয়ান। অথচ তাঁর চোখে পানি। নিলির কাছ থেকে খুব বড়সড় একটা সত্যি গোপন করে গেছে সে। ইচ্ছে করেই গোপন করেছে। নিলি কোনদিন জানতে পারবে না শুধুমাত্র তাঁর জন্য গোটা একজীবন একা পার করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেজোয়ান। শুধুমাত্র তাঁর জ্বালাময়ী মুখ ভুলতে পারবে না বলে।
মনে মনে হাসলো রেজোয়ান। বেশ হয়েছে। এটাই তাঁর শাস্তি। রেজোয়ানকে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি। আচ্ছা, এমন যদি কখনো হয় বৃদ্ধ বয়সে, মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে নিলি হঠাৎ জানতে পারলো রেজোয়ান তাঁকে ভালোবেসে সারাজীবন বিয়ে করে নি। তাহলে কেমন হবে? সে কি আফসোসে মাথা খুঁড়ে মরবে নাকি কাঁদতে কাঁদতে প্রাণ দিয়ে দেবে? ভালোবাসা পেয়েও পেলো না! আহা বেচারি! ভাবতেই রেজোয়ানের হাসি পাচ্ছে। কি অদ্ভুত জ্বালাভরা হাসি। এই হাসি চোখে জল এনে দেয় ঠিকই কিন্তু সুখ দিতে পারে না।

অন্যঘরে ফুয়াদের কাছে নিজের দুঃখের কথা বর্ণনা করছেন শায়লা মুরসালীন। তাঁর দুঃখের প্রসঙ্গ সব রেজোয়ানকে ঘিরেই। বিদেশি একটা অরফানেজ থেকে বাচ্চা দত্তক নিয়ে বাবা সেজেছে রেজোয়ান। বিয়ের কথা শুনতেও চায় না। এইবয়সে এসে ছেলের এমন পাগলামি দিনদিন মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন শায়লা মুরসালীনকে। তাই কেঁদে কেঁদে ফুয়াদের কাছে অনুরোধ করছেন সে যেন রেজোয়ানকে বোঝায়। রেজোয়ান যেন বিয়ে করতে রাজী হয়।

#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৫

রেজোয়ান বিদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়া দিতে শুরু করেছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছা শায়লা মুরসালীনের নেই। ছেলের বিয়ে দিয়ে তবেই দেশ ছাড়বেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এদিকে রেজোয়ান বিয়ের কথা শুনতেই নারাজ। সে আছে তাঁর ব্যবসা আর দত্তক নেওয়া কন্যাসন্তান দুটিকে নিয়ে। এসব নিয়েই ব্যস্ত সারাদিন। শায়লা মুরসালীন চুপিচুপি জাহিদকে ডেকে পাঠালেন। উদ্দেশ্য নিলির খোঁজ জানা। জাহিদ ডেকে ফিসফিস করে বললেন,’ঐ মেয়েটার সঙ্গে কি রেজোয়ানের আবার দেখা হয়েছে? তুমি জানো কিছু?’

জাহিদ প্রথমে ইতস্তত করলেও সত্যিটা বলে দিলো। নিলির সঙ্গে রেজোয়ানের দেখা হয়েছে শুনে শায়লা মুরসালীন চুপ করে গেলেন। মিনিট খানেক সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’ঠিকানা আছে?দেখা করা যাবে ওর সঙ্গে?’

জাহিদ বেশ অবাক হলো। নিলির সঙ্গে শায়েলা মুরসালীনের হঠাৎ করার কি কারণ থাকতে পারে বুঝতে পারলো না। বললো,’আমার কাছে ঠিকানা নেই ম্যাম। জোগাড় করতে হবে।’

-‘তাহলে তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো আমাকে ঠিকানাটা জোগাড় করে দাও। আমি ফিরে যাওয়ার আগে ওর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।’

-‘ঠিক আছে ম্যাম।’

-‘আর শোনো, রেজোয়ানকে কিছু জানানোর দরকার নেই। প্রয়োজন হলে আমিই পরে জানাবো ওকে।

ড্রয়িংরুমে বসে আছে ফুয়াদ এবং রেজোয়ান। রেজোয়ানের দুই কন্যাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে তাঁরা।

রান্নাঘরে সবার জন্য নাশতা রেডি করছিলো তিন্নি, আর ভাবছিলো বিয়ের পর এই প্রথম রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁর। আসার পর থেকেই রেজোয়ান তিন্নিকে ভাবি বলে সম্বোধন করছে। শুধু ভাবি নয়, আপনি বলেও সম্বোধন করছে। যদিও শুনতে খানিকটা ঠাট্টাসূচক লাগছে তথাপি রেজোয়ান যে তিন্নির কাছ থেকে পরিমিত দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছে সেটা তিন্নি বেশ ভালো করেই বুঝে গেলো।

কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো রেজোয়ানের ভাবি ডাকা নিয়ে কোনরকম খারাপ লাগা কাজ করছে না তিন্নির। বরং ভালো লাগছে তাঁর। ভীষণ ভালো লাগছে। তবে কি সত্যিই ফুয়াদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সে? হেসে ফেললো তিন্নি। ফুয়াদের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। তিন্নিকে সে এত ভালোবাসবে বলেছিলো যে দিন রাত চব্বিশঘণ্টা তিন্নি নাকি শুধু তাঁর নামই জপ করবে। অদ্ভুত লোক একটা! তিন্নি তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলেও বলবে তিন্নি নাকি তাঁর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে! তাঁকে ছাড়া নাকি তিন্নি একমুহূর্তও থাকতে পারবে না।

ফের হেসে ফেললো তিন্নি। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো ড্রয়িংরুমের দিকে। বাচ্চাদের সঙ্গে দুষ্টুমি করছে তাঁর সুদর্শন, সুপুরুষ বরটা। কি মায়া লাগছে দেখতে! চোখেচোখে চোখ পড়ে গেলো দুজনের। ফুয়াদ ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,’কি?’

তিন্নি হাত ইশারায় কাছে ডাকলো তাঁকে। এগিয়ে এলো ফুয়াদ। বললো,’কিছু লাগবে?’

-‘লাগবে তো।’

-‘কি?’

-‘আপনাকে!’, বলেই লজ্জায় উল্টো দিকে ঘুরে গেলো তিন্নি। কারণ সে জানে এক্ষুনি তাঁকে কতগুলো নির্লজ্জ কথা শুনিয়ে দেবে ফুয়াদ, কিংবা কাছে আসার বাহানায় জ্বালাতন শুরু করে দেবে। তাঁকে অবাক করে দিয়ে ফুয়াদ মিষ্টি করে হাসলো। বললো,’আমাকে দিয়ে কি কাজ?’

-‘অনেক কাজ। আসুন আমার সঙ্গে আটা মাখাবেন।’ বলেই মুখটিপে হাসলো তিন্নি।

ফুয়াদও পালটা জবাব দিয়ে বললো,’আটার সঙ্গে আমাদের দুজনার মাখামাখি হলে আপত্তি নেই।’

-‘আচ্ছা? তবে তো মাখামাখি শেষে তাওয়ায় সেঁকতে ও হয়? কি বলেন সেঁকবো আপনাকে?’

ফুয়াদ হাল ছেড়ে দিয়ে সোজা তিন্নির আঁচল টেনে ধরলো। বললো,’লজ্জাবতীর মুখে খই ফুটেছে দেখছি!’

তিন্নি লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। আঁচল ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,’ছাড়ুন আমাকে। বউয়ের আঁচল ধরে কারা ঘুরে বেড়ায় জানেন?’

-‘কারা?’

-‘ভেড়ারা। আপনি তো পুরুষ। আপনি কেন আঁচল ধরে টানাটানি করবেন?’

আঁচল ছেড়ে দিলো ফুয়াদ। এবারে সোজা কোমর চেপে ধরলো তিন্নির। ফিসফিস করে বললো,’খুব কথা শিখে গেছো না? দেই মুখটা বন্ধ করে? দেবো?’ বলতে বলতেই সে ঠোঁটজোড়া তিন্নির মুখের কাছে নিয়ে গেলো। তিন্নি সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিলো। হার স্বীকার করে নিয়ে বললো,’ঠিক আছে, ঠিক আছে। আর বলবো না। ছাড়ুন আমাকে। রান্নাঘরে কেউ দেখলে কি ভাববে?’

-‘তাহলে এবার বলো ফুয়াদ আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

-‘পারবো না।’

-‘না পারলে আমিও ছাড়বো না।’

-‘আমার লজ্জা লাগে।’

-‘এসব বলে কোন লাভ নেই। আজকে তোমার মুক্তি নেই। হয় আমাকে তুমি করে বলবে নইলে আমি জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো।’

-‘ছাড়ুন বলছি। অসভ্য লোক!’

-‘অসভ্য বলেছো আমাকে। এবার ‘তুমি’র সাথে গালে চুমুও খেতে হবে। নইলে কিছুতেই ছাড়বো না।’

-‘আমি কিন্তু মাকে ডাক দেবো?’

-‘দাও। মা এসে দুজনকেই দেখুক।’

তিন্নি ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। ফুয়াদ এর সঙ্গে জোরাজুরি করতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেছে সে। বেশ ভালো করে বোঝা হয়ে গেলো এই লোক আজকে তাঁকে ছাড়বে না। তাই বাধ্য হয়ে তুমি বলার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু সেখানেও যন্ত্রণা। লজ্জায় মুখ দিয়ে কিছুতেই বেরোচ্ছে না। অবশেষে চোখ বন্ধ করে মৃদু কোমল কন্ঠে তড়িঘড়ি করেবললো,’ছাড়ো আমাকে। সবাইকে নাশতা দিতে হবে। দেরী হয়ে যাচ্ছে।’

ফুয়াদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তাঁর লাজুক লাজুক মুখখানার দিকে। কোমরের বাঁধন হালকা করে দিলো। আলতো করে হাত রাখলো তিন্নির দুই গালে। সস্নেহে চুমু খেলো তিন্নির কপালে। মোলায়েম কন্ঠে বললো,’লজ্জা পেলে আমার বউটাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়।’.

তিন্নি হাসলো। ফুয়াদ হাতের ওপরের নিজের একটা হাত রেখে বললো,’আর আমার এই দুষ্টু বরটাকে সবসময়ই সুন্দর দেখায়। পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর পুরুষ সে।’

নিলি কাঁদছে। শায়লা মুরসালীন মৌনমুখে তাঁর সামনে বসে আছেন। রেজোয়ানের বৃত্তান্ত সব খুলে বলেছেন তাঁকে। সব শুনে নিলি বুঝতে পারছে না তাঁর কি করা উচিৎ। সে চেয়েছিলো রেজোয়ান সুখি হোক, ভালো থাকুক।
নিজের অপরাধের দায়ভার মাথায় নিয়ে একা বেঁচে থাকবে সে। কিন্তু রেজোয়ান যে তাঁকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজের জীবন নিয়ে খেলা শুরু করে দেবে একথা নিলি স্বপ্নেও ভাবে নি।

শায়লা মুরসালীন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আফসোসের সুরে বললেন,’ভেবেছিলাম জীবনে কোনদিন মুখ দেখবো না তোমার। কিন্তু কি করবো, আল্লাহ আমাকে ঠেকিয়েছেন। আমার ছেলে তোমার মধ্যে কি পেয়েছে তা কেবল সেই জানে। এত মেয়ের ছবি দেখালাম কাউকে মনে ধরলো না। তাঁর একই কথা, মেয়ের আমার পছন্দ নয়। তুমি বিয়ের চিন্তা বাদ দাও মা।

নিলির টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ঝরঝর করে কাঁদছে। কি করলে সে রেজোয়ানকে তাঁর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবে! নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে।

-‘এতিমখানা থেকে বিদেশি বাচ্চা দত্তক নিয়েছে। মেয়ের বাবা সেজেছে। মা হয়ে ছেলের এমন দুর্দশা আমি দেখতে পারছি না। তাই তোমার কাছে এসেছি। তুমি তো জানো আমার ছেলে তোমাকে কতটা ভালোবাসে। তাই এবার সেই ভালোবাসার প্রতিদান চাইতে এসেছি আমি। আমার ছেলের ভালোবাসার মূল্য পরিশোধ করে আমাকে উদ্ধার করো।’

-‘আমি কি করবো? কি করলে রেজোয়ান কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে? আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। মরতে বললেও রাজি আছি।’

-‘তোমাকে মরতে বলার মতন অমানুষ আমি নই। আমি তোমার সঙ্গে রেজোয়ানের বিয়ে দেবো বলে ঠিক করেছি। একটাই পথ আমাকে ছেলেকে ঘরমুখি করার। আমার একটা মাত্র ছেলে। ওর জন্য আমি সব করতে পারি।’

নিলি পুনরায় ডুঁকরে উঠলো। এত অপরাধ নিয়ে রেজোয়ানের মুখোমুখি কি করে দাঁড়াবে সে? শায়লা মুরসালীনের হাত চেপে ধরে বললো,’আপনি আমাকে শাস্তি দিন মা। মেরে ফেলুন। কিন্তু ফিরে যেতে বলবেন না প্লিজ। দোহাই আপনার। রেজোয়ানের কাছে ফিরে যাওয়ার মতন মুখ আমার নেই।’

শায়লা মুরসালীন হাত ছাড়িয়ে নিলেন। এই মেয়েটার জন্যই তাঁর ছেলের এমন করুণ অবস্থা। একে তিনি এত সহজে ক্ষমা করবেন না। শুধু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই তাঁকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে এসেছেন। তবুও যদি রেজোয়ান সংসারী হয়!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here