#তুমি_তাই,৫,৬
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৫
বারান্দায় একা একা পায়চারি করছে রেজোয়ান। বাসায় ফেরার পর থেকেই অদ্ভুত, বাজে রকমের একটা অনুভূতি হচ্ছে তাঁর। মনে হচ্ছে বুকের ওপর কেউ শক্ত পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ শুনে রুমে ঢুকলো দরজা খুলার জন্য। দরজা খুলতেই দেখলো হাসিমুখে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তিন্নি।
-‘তুই?’
-‘আম্মা বাসায় নেই। ছোট খালাম্মা অসুস্থ। উনাকে দেখতে গেছে। রাতে ফিরবে না।’
-‘তো?’
-‘রান্না করে দিয়ে যায় নি। একটুপর আব্বা আসবে খেতে। ফ্রিজেও রান্না করার মত কিছু পাচ্ছি না।’
রেজোয়ান দরজা থেকে সরে তিন্নিকে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিয়ে বললো,’ফ্রিজে কি আছে দেখ। যা লাগবে নিয়ে নে। আর শোন..’
-‘কি?’
-‘ফ্রিজের চাবি ওপরে রাখা আছে।’
-‘আচ্ছা। ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে একটা কথা বলুন তো, আপনার ফ্রিজে কি আছে আপনি সত্যিই জানেন না?’
-‘না। কেন?’
-‘আশ্চর্য!’
-‘এখানে আশ্চর্যের কি আছে?’
-‘সেটাই তো এখানে আশ্চর্যের কি আছে। জীবনে তো কখনো বাজার করেছেন বলেছেন বলে মনে হয় না। দু একবার করলে তবেই না জানতেন। সব তো কর্মচারীদের দিয়েই করান।’
-‘তোর তাতে কি সমস্যা?’
-‘আমার আবার কি সমস্যা? খালি বিয়ের পর আপনার এসব জমিদারি আমাকে সহ্য করতে হবে। সেটা ভেবে একটু কষ্ট হচ্ছে। এই আর কি।’
-‘বেশি বকবক করিস না। কি লাগবে নিয়ে বিদায় হ আমার সামনে থেকে।’
তিন্নি ফ্রিজ খুলে দেখলো ভেতরে নাস্তার আইটেম ছাড়া রান্নার করার মতন কিছুই নেই। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তাঁর। বিদ্রুপের সুরে বললো,’আপনার ফ্রিজ খালি। রাতের খাবারের জন্য ডিম ছাড়া আর কিছুই নেই।’
-‘কি বলছিস? দেখ ভালো করে।’
-‘ঠিকই বলছি। বিশ্বাস না হলে আপনি এসে দেখুন।’
খানিকটা অবাক হলো রেজোয়ান। ফ্রিজের কাছে এগিয়ে এসে দেখলো সত্যিই ফ্রিজে মাছ, মাংস, সবজি কিচ্ছু নেই। খানিকটা লজ্জা পেলো। প্রতিমাসে বাজারের জন্য আলাদা করে জাহিদের কাছে টাকা দিয়ে দেয় সে। সেই হিসেবে ফ্রিজ ভর্তি বাজার থাকার কথা। কিন্তু বাজার এর ‘ব’ ও নেই। তৎক্ষণাৎ জাহিদের নাম্বারে ফোন করলো। দুবার রিং হতেই রিসিভ করলো জাহিদ। সালাম দিয়ে ফোন করার কারণ জানতে চাইলো।
রেজোয়ান কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললো,’আসলে একটা দরকারে ফোন করেছি তোমাকে!’
-‘জি স্যার বলুন। আমি শুনছি।’
-‘আমার ফ্রিজ খালি কেন বলো তো? তোমাকে তো আমি মাসের শুরুতেই বাজারের জন্য টাকা দিয়ে দেই। সেটা কি শেষ? ‘
-‘জি না স্যার। আসলে বাজারের টাকা তো আমি মতিনের কাছে দিয়ে দেই। ও-ই আপনার জন্য রোজ বাজার করে আনে।’
-‘তাহলে ফ্রিজ খালি কেন? বাজার করলে তো নিশ্চয়ই সেটা ফ্রিজে থাকার কথা?’
-‘না মানে স্যার আপনি তো রোজ বাসায় খাওয়াদাওয়া করেন না। তাই বাড়তি বাজার করতে আমিই নিষেধ করেছিলাম। ফ্রিজে রেখে দিলে খাবারের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। ফ্রেশ খাবার খাওয়া যায় না। তাই মতিন প্রতিদিনের বাজার প্রতিদিন নিয়ে আসে।’
-‘ও আচ্ছা। ঠিক আছে আমি তাহলে রাখি।’
-‘আপনার কি কিছু লাগবে স্যার? আমি কি নিয়ে আসবো?’
-‘তার দরকার নেই। তুমি বরং মতিনকে বলে কিছু বাজার পাঠিয়ে দাও আমার বাসায়।’
-‘জি স্যার। আমি এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিলো তিন্নি। সেই সাথে মুখ টিপে হাসছিলো। রেজোয়ান ফোন রাখতেই সেই হাসিটা আরেকটু প্রশস্ত করে বললো,’বাহ! আপনার সেক্রেটারি তো দেখছি একেবারে নতুন বউদের মতন খেয়াল রাখে আপনার। টাটকা শাকসবজি খাওয়াবে বলে ফ্রিজে বাজার করে রাখে না।’
-‘তোর বাজার লাগবে না? বলে দিয়েছি। নিয়ে এলে আমি ডাকবো। এবার যা।’
-‘বাব্বাহ! এমনভাবে কথা বলছেন যেন আমি আপনার এখানে থাকতে এসেছি?’
-‘আমি জানি তুই থাকতে আসিস নি। তুই এসেছিস আমাকে জ্বালাতে। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমার একফোঁটাও এনার্জি নেই। আমি ভীষণ টায়ার্ড। প্লিজ বিরক্ত করিস না।’
রেজোয়ানের বিরক্ত মুখ দেখে কিছুটা দমে গেলো তিন্নি। চুপচাপ বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। কিন্তু পরোক্ষণেই আবার ফিরে এসে বললো,’বাজার না নিয়ে আসা পর্যন্ত চলুন আমরা দুজনে মিলে গল্প করি। তাহলে আমারও সময় কেটে যাবে আপনারও মন ভালো হবে।’
-‘আমার এখন গল্প করার মতন মুড নেই।’
-‘কেন? কি হয়েছে? শরীর খারাপ?’
-‘কিচ্ছু হয় নি। তুই যা বাসায় যা। বাজার এলে আমি পাঠিয়ে দেবো।’
অগত্যা মুখ ভার করে উঠে যেতে হলো তিন্নিকে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো তাঁর। আজকে দুদিন পর একটু খানি দেখা পেয়েছে রেজোয়ানের। তাও ভালোমতন কথা বলে নি মানুষটা।
তার মন খারাপের বিষয়টা রেজোয়ানেরও নজর এড়ালো না। কিন্তু এইমুহূর্তে তাঁর কিছুক্ষণ একা থাকা প্রয়োজন। নিজেকে সময় দিতে হবে। নইলে কোনভাবেই ভেতরে অস্থিরতা কাটবে না। তাই আগ বাড়িয়ে পিছু ডাকলো না।
চুপচাপ বেড রুমে ঢুকে গেলো। কিন্তু সে ঢুকতে না ঢুকতে ড্রয়িংরুম থেকে তিন্নির চিৎকার শোনা গেলো।
কাছে গিয়ে দেখলো ডান হাতে কনুই চেপে ধরে কাঁদছে তিন্নি। সে ধরতে নিলেই ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে দিলো। একটু আগে রেজোয়ান তাঁকে ইগ্নোর করেছে। তাই সে-ও এখন কথা বলবে না।
রেজোয়ান ফের ধরতে চাইলে আবারো ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে নিলো। কিন্তু জোর করে তাঁকে নিজের দিকে ঘোরালো রেজোয়ান। ব্যথার জায়গায় হালকা মালিশ করে দিতে দিতে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,’বাড়ি খেলি কি করে?’
-‘এখন কি আবার বাড়ি খেয়ে দেখাবো?’, ক্ষিপ্ত শোনানো তিন্নির কন্ঠস্বর।
রেজোয়ান হেসে ফেললো। মালিশ করতে করতে বললো,’তুই আসলেই একটা ঝগড়ুটে। ঝগড়া ছাড়া তোর পেটের ভাত হজম হয় না।’
তিন্নি তাঁর কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে পুনরায় নাকি কান্নার সুরে বললো,’মলম টলম থাকলে একটু দিন না। দেখছেন না কেমন লাল হয়ে গেছে?’
বাড়ি লেগে রক্ত জমাট বেধে সামান্য একটু লাল হয়েছে। অথচ তিন্নি ছোট বাচ্চাদের মতন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রেজোয়ান তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে মলম নিয়ে এলো। ছিপি খুলে খানিকটা মলম আঙ্গুলে নিয়ে সেটা লাগাতে লাগাতে বললো,’সামান্য একটু লাল হয়েছে। তাতেই এমন ভাব করছিস যেন হাতে নয় তোর ফুসফুসে দাগ পড়ে গেছে।’
বস্তুত, যদিও খুব সামান্যই লাল হয়েছে কিন্তু যথেষ্ট পরিমানেই ব্যথা পেয়েছে তিন্নি। বাড়ি খাওয়ার পর থেকেই হাতটা ঝিনঝিন করছে। তিন্নির মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। একে তো ব্যথা পেয়েছে তাঁর ওপর রেজোয়ান খোঁচা দিয়ে কথা বলছে। রাগে হাত সরিয়ে নিয়ে বললো,’আমারই ভুল হয়েছে। আপনার বাসায় আসাটাই আমার উচিৎ হয় নি। যাচ্ছি আমি। আব্বাকে ফোন করে বলবো হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসতে। লাগবে না আপনার বাজার।’
কথা শেষ করে গটগট করে বেরিয়ে গেলো সে। রেজোয়ান তাঁর যাওয়ার পানে চেয়ে হতবম্ভ হয়ে বসে রইলো।
★
পরদিন সকালে রেডি হয়ে অফিসের জন্য বেরোচ্ছিলো রেজোয়ান। গেটের কাছেই তিন্নির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। সেজেগুজে বান্ধবী বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, ভারী মেকাপে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাঁকে। রেজোয়ান দেখেও না দেখার ভান করে রইলো। সেটা বুঝতে পেরে মনে মনে বিরক্ত হলো তিন্নি। ইচ্ছে করেই ভেংচি কাটলো রেজোয়ানকে। কিন্তু রেজোয়ানের কোন রিয়েকশন হলো না দেখে পরপর আরো দুবার ভেংচি কাটলো। তৃতীয় বারের সময় এ রেজোয়ান পেছন থেকে তাঁর লম্বা বিনুনিটা টেনে ধরে সেটা মুঠোয় প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বললো,’ভেংচি কাটছিলি কেন? দেই চুল টেনে?’
এতক্ষণ রেজোয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলেও চুল টেনে ধরায় বিরক্ত হলো তিন্নি। সাবধান করে দিয়ে বললো,’আমি ব্যথা পেলে কিন্তু আপনার খবর আছে?’
-‘কি করবি তুই?’
-‘হিল পরেছি। পায়ে পাড়া দিয়ে একদম চামড়া তুলে ফেলবো।’
তাঁর পায়ের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই দুপা পিছিয়ে গেলো রেজোয়ান। তৎক্ষণাৎ চুলে টান পড়লো তিন্নির। চোখ পাকালো সে। রেজোয়ান ভয়ে তাড়াতাড়ি কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,’ইচ্ছে করে দেই নি। টান পড়ে গেছে।’
-‘ছাড়ুন।’
ছেড়ে দিলো রেজোয়ান। সে ছেড়ে দিতে না দিতেই ফিক করে হেসে দিলো তিন্নি। ভ্রু জোড়া দুষ্টুভাবে নাচিয়ে বললো,’ভয় পেয়েছেন তাই না?’
রেজোয়ান জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর প্রশংসাসূচক গলায় বললো,’তোকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে।’ প্রশংসা শুনে খুব খুশি হয়ে গেলো তিন্নি। লাজুক হেসে বললো,’থ্যাংক ইউ।’
#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৬
রিক্সায় পাশাপাশি বসে আছে রেজোয়ান এবং তিন্নি। রেজোয়ানের অবশ্য এই সময়ে তিন্নির সঙ্গে থাকার কথা ছিলো না। অফিসের একটা কাজে তিনদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা ছিলো তাঁর। কিন্তু হঠাৎ করে রেজা গ্রুপের সাথে ঝামেলা হয়ে যাওয়ায় কাজটা স্থগিত হয়ে যায়। রওনা দেওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরুণ মাঝরাস্তা থেকে ফিরতি পথে ব্যাক করতে হচ্ছে তাঁকে।
এদিকে কপাল খারাপ, গাড়িটাও মাঝরাস্তায় এসে খারাপ হয়ে যায়। বেশ বিপাকে পড়ে গেলো সে। অফিস থেকে অন্য গাড়ি এসে এখানে পৌঁছাতে আধঘন্টার মত লেগে যাবে। কিন্তু এতসময় ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার কোন ইচ্ছে রেজোয়ানের নেই। সেক্রেটারি জাহিদকে দায়িত্ব দিলো একটা রিক্সার ব্যবস্থা করার জন্য।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রিক্সা জোগাড় করে ফেললো জাহিদ। প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র তাঁর হাতে দিয়ে রিক্সায় উঠে পড়লো রেজোয়ান।
তখনি বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করেই কোথা থেকে উদয় হলো তিন্নি। অনুমতি ছাড়াই তড়িঘড়ি করে রিক্সায় উঠে পড়লো। রেজোয়ান কিছু বলতে গিয়েও বললো না। জাহিদের সামনে তিন্নির সঙ্গে ঝগড়া করাটা সুবিধাজনক হবে না। কি বলতে কি বলে ফেলে তিন্নি, শেষে দেখা যাবে তাঁর মানইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়েছে। তাই চুপ করে রইলো। জাহিদও আর বেশিক্ষণ দাঁড়ালো না। তাঁকে রিক্সায় তুলে দিয়ে অন্য একটা রিক্সায় উঠে পড়লো।
★
রিক্সা চলতে শুরু করে দিয়েছে। তিন্নি গুনগুন করে গান গাইছে। রেজোয়ান ডানদিকে সামান্য চেপে ওকে ঠিকমতন বসার জায়গা করে দিয়ে বললো,’তোর কলেজ রোজ এই সময়ে ছুটি হয়?’
-‘কেন? আপনি রোজ এই সময়ে আমাকে নিতে আসবেন?’
তিন্নির ভাবখানা এমন যেন রেজোয়ান সত্যি সত্যি তাঁকে নিতে আসার জন্য প্রশ্নটা করেছে। জবাবের অপেক্ষায় রেজোয়ানের মুখের দিকে চেয়ে রইলো সে। রেজোয়ান জবাব না দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। এই বিষয়ে তিন্নির সঙ্গে খামোখা তর্ক করার কোন ইচ্ছে তাঁর নেই। কারণ হ্যাঁ বললেও সমস্যা না বললেও সমস্যা। সে যাই বলুক না কেন তিন্নি তাঁর মাথা খারাপ করে দেবে। তাই চুপ থাকাটাই ঠিক মনে করলো। কিন্তু তিন্নি থেমে থাকার মেয়ে নয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত রেজোয়ান তাঁর কথা শুনে কোন রিয়েক্ট করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে খুঁচিয়েই যাবে। গলায় খানিকটা ঠাট্টার সুর এনে বললো,’তেলের খরচ বাঁচাতে রিক্সায় যাচ্ছেন বুঝি?’
-‘হ্যাঁ। ভাবছি গাড়ি বিক্রি করে একটা রিক্সা কিনবো।’
-‘তাই নাকি? তাহলে তো খুব ভালো হবে। আমি রোজ আপনার সঙ্গে রিক্সায় করে ঘুরতে পারবো। আরো ভালো হবে যদি আপনি রিক্সা চালানোটা শিখে যান।’
-‘তুই কিন্তু এবার আমার হাতে মার খাবি!’
তাঁকে রেগে যেতে দেখে ফিক করে দিলো তিন্নি। মুচকি হেসে বললো,’রাগ করছেন কেন? আমি তো মজা করছিলাম।’
রেজোয়ান জবাব দিলো না। এই কড়া রোদের মধ্যে তিন্নির এত আনন্দ কোথা থেকে আসছে সেটা ওর মাথায় ঢুকছে না। গরমে তাঁর জান বেরিয়ে যাচ্ছে। আর এই দিকে এই মেয়ে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। তাঁকে অবাক করে দিয়ে তিন্নি এবার অদ্ভুত একটা কাজ করে বসলো। চোখ বন্ধ করে নিজের মাথাটা রেজোয়ানের কাধে এলিয়ে দিয়ে বললো,’আপনি কি পারফিউম ইউজ করেন রেজোয়ান ভাই? এত মিষ্টি গন্ধ! বিনা অ্যালকোহলে আমার নেশা ধরিয়ে দেয়।’
সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো রেজোয়ান। কাঁধ ঝাকিয়ে তিন্নিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললো,’সর। এমন জোঁকের মতন ঘাড়ে চেপে বসেছিস কেন? গরম লাগছে আমার।’
কিন্তু একফোঁটাও নড়লো না তিন্নি। সেঁটে বসে রইলো একেবারে।
-‘আমি কখনো ভাবতেই পারি নি আপনার সঙ্গে একসাথে রিক্সায় ঘুরবো। আমার যে কি খুশি লাগছে না, আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না।’
রেজোয়ান এবারেও নিরুত্তর বসে রইলো। তিন্নি হঠাৎ তাঁর ডান হাতটা চেপে ধরে মুচকি হেসে বললো,’আচ্ছা রেজোয়ান ভাই, ধরুন এইমুহূর্তে যদি আমি আপনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিই তাহলে আপনি কি করবেন?
-‘ঠাস করে তোর গালে একটা চড় মারবো!’
অনেকক্ষণ ধরে তিন্নির এসব ফালতু বকাবক সহ্য করেছে রেজোয়ান। আর পারলো না। কাঁধ থেকে তাঁর মাথাটা সরিয়ে ধমক দিয়ে বললো,’সোজা হয়ে বস! একদম নড়াচড়া করবি না।’
নিমিষেই মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো তিন্নির। রেজোয়ানের কাছ থেকে অবশ্য এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। কৃত্রিম অভিমানে গাল ফুলিয়ে বললো,’কে, কখন, কবে কি কারণে আপনাকে ছ্যাকা দিয়েছে তার শোধ আপনি আমার ওপর কেন নিচ্ছেন রেজোয়ান ভাই? আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি?’
-‘তোর ওপর নিচ্ছি মানে?’
-‘আমার ওপরেই তো নিচ্ছেন। নইলে বিয়ের কথা বললে আপনি এত রেগে যান কেন? আপনি জানেন আমার কত কষ্ট হয় আপনাকে ছাড়া?’
-‘তুই আবার শুরু করেছিস?’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে আর করবো না। কিন্তু আপনি আমাকে কথা দিন আপনি ঐ ছ্যাঁকাওয়ালীর জন্য আর কষ্ট পাবেন না?’
জবাবে রেজোয়ানকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেলো তিন্নি। বলা যায় না, কখন এই খিটখিটে লোকটা তাঁর মাথায় চাটি মেরে বসে। আর বেশি রাগানো ঠিক হবে না। রিক্সার একপাশে খানিকটা সরে বসে মিনমিন করে বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে। কথা দিতে হবে না। শুধু মনে রাখলেই হবে।’
বেশিক্ষণ গাম্ভীর্য ধরে রাখতে পারলো না রেজোয়ান। তিন্নির ভীত চেহারা দেখে হেসে ফেললো। রোজ রোজ কোথা থেকে এই মেয়েটা এত এনার্জি পায় সেটা রেজোয়ান নিজেও ভেবে পায় না। মুচকি হেসে বললো,’আরো এদিকে এসে বস। নইলে পড়ে যাবি।’
তাঁকে হাসতে দেখে তিন্নিও হেসে ফেললো। তারপর বেশিকিছুক্ষণ নিরবে বসে রইলো দুজনে। কিন্তু বাসার কাছাকাছি আসতেই আবার শুরু করে দিলো তিন্নি। তাঁর শরীর খারাপ লাগছে। মাথা ঘোরাচ্ছে। পেটে ব্যথা করছে। ইত্যাদি নানার রকমের বকবক।
বাসার সামনে এসে রিক্সা থেকে নামলো দুজনে। রেজোয়ান ভাড়া মিটিয়ে লিফটের কাছে দাঁড়াতেই তিন্নি কৃত্রিম অসুস্থতার ভান করে বললো,’আমার মাথাটা ঘুরছে রেজোয়ান ভাই। আমি দাঁড়াতে পারছি না। পড়ে যাচ্ছি। এই পড়ে যাচ্ছি, পড়ে যাচ্ছি!’
রেজোয়ান পাত্তা দিলো না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। তাঁকে চুপ থাকতে তিন্নি যেন খুব দুঃখ পেয়েছে এমন একটা ভাব করে বললো,’আমি আজকে কলেজ থেকে কেন তাড়াতাড়ি চলে এসেছি আপনি জানেন? আমার শরীরটা একদম ভালো লাগছিলো না। খুব খারাপ লাগছিলো। তাই।’
রেজোয়ান জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাঁর দিকে চাইলো। কিন্তু তিন্নি কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলো না। তথাপি একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’আমার হাত ধর।’
-‘ছিঃছিঃ আপনার হাত ধরবো কেন?’
-‘তুই না বললি পড়ে যাচ্ছিস?’
-‘হ্যাঁ। যাচ্ছি তো। আমার মাথা ঘুরছে!’
-‘তাই হাত ধরতে বলেছি।’
তিন্নি খুব লজ্জা পেয়েছে এমন ভাব করে জিভ কাটলো। তারপর ফিসফিস করে বললো,’হাত ধরতে লজ্জা লাগে। মানুষ দেখলে কি বলবে?’
রেজোয়ান ভ্রু কুঁচকালো। তিন্নি এদিক ওদিক তাকিয়ে পুনরায় ফিসফিস করে বললো,’তবে আপনি চাইলে আমাকে কোলে নিতে পারেন!’
লিফটের দরজা খুলে গেছে। তিন্নির কথাটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভেতরে ঢুকে পড়লো রেজোয়ান। তাঁর বুঝতে বাকি নেই ইচ্ছে করে এসব অসহ্যকর কথাবার্তা বলছে বাঁদর মেয়েটা। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে রেজোয়ানের সঙ্গে ঝগড়া করা। অতএব কথা না বাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। তিন্নি পেছন পেছন ঢুকতে নিলে ধমক দিয়ে বললো,’তুই একদম ভেতরে আসবি না। সিঁড়ি বেয়ে উঠবি। এতক্ষণ বকবক করে আমার মাথা খারাপ করার জন্য এটা তোর শাস্তি।’
-‘আমি আপনার কথা কেন শুনবো?’
-‘শুনবি তার কারণ, তুই যদি আমার কথা না শুনিস তাহলে আমি আবার ঐ ছ্যাঁকাওয়ালীর কথা ভেবে খুব কষ্ট পাবো। এবার তুই ভেবে দেখ কি করবি? আমার কথা শুনবি নাকি আমাকে ঐ ছ্যাকাওয়ালীর জন্য কষ্ট পেতে দিবি।’
তিন্নির মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। একরকম কাঁদোকাঁদো অবস্থা। সে ভাবতেই পারে নি রেজোয়ান এভাবে তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করবে। যাইহোক, কথাটা যখন সে নিজেই বলেছে তখন হার মানলে চলবে না। রেজোয়ান যাই করুক না কেন,তিন্নি তাঁকে ঐ ছ্যাকাওয়ালীর জন্য কষ্ট পেতে দেবে না। কিছুতেই না। অতএব সিঁড়ি বেয়ে ওঠা শুরু করলো। রেজোয়ান মুখ টিপে হাসছে। এবার তাঁকে বিরক্ত করার শাস্তি হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে তিন্নি। বেশ হয়েছে! সারাটা রাস্তা বকবক করে একেবারে মাথা খারাপ করে দিয়েছে।