তুমি_সূচনায়,অন্তিম_পর্ব

0
900

#তুমি_সূচনায়,অন্তিম_পর্ব
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

মাঝরাত অবধি দু’জনের মধ্যে ফোনালাপ চলেছে, বেলা দশটা বাজতে চললো এখনো ঊর্মি ঘুমোচ্ছে। এই নিয়ে মিসেস অন্তরা বেশ কয়েকবার মেয়েকে ডেকে গেছেন। ইদানীং ঊর্মির ভালোই লাগে নিবিড়ের সাথে কথা বলতে, সময় কাটাতে কথা। আগে ঊর্মি মনে করতো লোকটা ভীষণ গম্ভীর আর ইগো অনেক, তার এই ধারনাকে ভুল প্রমাণ করেছে নিবিড়। দু’জনের মাঝে বেশ ভালো একটা বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, নিবিড় বেশ হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল একটা ছেলে।
মোবাইল ভাইব্রেশনের কারণের ঊর্মির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো। পিটপিট চোখে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো রিয়া কল করছে। মোবাইলটা রেখে পাশ ফিরতেই রিয়াকে ঊর্মির বিছানার ওপর প্রান্তে বসে থাকতে দেখা গেলো।

আমি : এভাবে ভূতের মতো বসে আছিস কেনো? ভয় পাই তো!
রিয়া : সারারাত প্রেমালাপ করে দিন বেলায় ঘুমোনো হচ্ছে? তোর এতো বড় সাহস তুই আমাকে ভূত বললি। দেখ তোর আমি কি করি তাড়াতাড়ি ওঠে ফ্রেশ হয়ে আয়।

ঊর্মিকে সাদা ভূতের মতো করে, মুখে কিছু একটার পেস্ট লাগিয়ে ফ্যানের নিচে বসিয়ে রেখেছে রিয়া। রিয়ার এখানে আসার মূলত একটাই উদ্দেশ্য আজকে থেকে ঊর্মি রূপচর্চার সব দায়ভার তার উপর দিয়েছেন মিসেস অন্তরা। রিয়া এখন সেই দায়িত্বটাই পালন করছে।
অনন্ত এখন আর আগের মতো বোনের সাথে ঝগড়া দুষ্টুমি করেনা। বোনের বিয়ে হয়ে যাবে বলে বেচারা বেশ আপসেট। বোনকে সে ভীষণ ভালোবাসে তবে তা কখনোই প্রকাশ করে না। সারাদিন বোনের সাথে ঝগড়া মারামারি করলেও একজন বড় ভাইয়ে মতো করে বোনকে আগলে রাখার চেষ্টা করে।
বাড়িতে এখনই ডেকোরেশনের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে আর দু’দিন পর গায়ের হলুদ তারপর বিয়ে। আত্মীয় স্বজন’রা ইতিমধ্যে অনেকেই চলে এসেছে ঊর্মি দাদু বাড়ি আর নানু বাড়ি থেকে। ঊর্মি নিজের রুমে চুপটি করে বসে ছিলো, কোলাহল থেকে বরাবরই ঊর্মি দুরত্ব বজায় রেখে চলে। তবে নিজের বিয়েতে তো সে এসব কোলাহল থেকে কোনো ভাবে মুক্তি পাবে না এটা সে আগেই বুঝতে পেরেছে।

আজ নিবিড়ের গায়ে হলুদ কাল ঊর্মির এর কারণটা হচ্ছে দু’পক্ষই যাতে সমান ভাবে আনন্দ করতে পারে। ঊর্মির সব কাজিন’রা আর রিয়া, সাহিল মিলে নিবিড় হলুদ মেখে ভূত বানিয়ে ছেড়েছে। সাহিল সুযোগ বুঝে ভূতের রূপে নিবিড়ের কয়েকটা ছবি তুলে নিয়েছে। হৈ-হুল্লোড়ের মাঝেই ওরা নিবিড় হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতে বাড়ি ফিরে আসে।
পরের দিন ঊর্মিদের বাড়িতে ওর হলুদের অনুষ্ঠানে আয়োজন করা হয়েছে। মূলত গায়ে হলুদের পর্ব শেষ হলেই ঊর্মিকে মেহেন্দি লাগিয়ে দেওয়া হবে। সাহিল তার ক্যামেরা দিয়ে ঊর্মির মেহেন্দি রাঙা হাত নিয়ে বেশ অনেক গুলো ছবি তুলেছে, সব গুলো ছবিতে ঊর্মির মুখে প্রাণোচ্ছল হাসি। নাচ গান আনন্দের মাঝেই হলুদ মেহেন্দি একসাথেই সম্পন্ন হয়েছে। ঊর্মির নিয়ে রুমে বসে হাতের শুকিয়ে যাওয়া মেহেদী তুলছিলো। ঊর্মির সব কাজিনরা আর রিয়া ওর রুমে আসে।

রিয়া : আরে তোর মেহেদীর রঙ তো দেখছি হেব্বি কড়া এসেছে।
আমি : তো কি হয়েছে?
সাদিয়া : তুই জানিস না, যার মেহেদীর রঙ যত গাঢ় তার বর তাকে তত বেশি ভালোবাসে। নিবিড় ভাইয়া তোকে খুব ভালোবাসবে দেখে নিস।
আমি : এইসব আজগুবি কথা রাখ তো আপু।
আশা : আপুর তোলা ছবি গুলো জিজুর কাছে পাঠিয়ে দাও রিয়া আপু।
রিয়া : হুম দিচ্ছি।

অন্যদিকে নিবিড় তার রুমের বেলকনিতে রাখা চেয়ারে বসে ছিলো এমন সময় নিবিড়ের ফোনে নোটিফিকেশন আসে। সে চেক করে দেখে রিয়া এসএমএস পাঠিয়েছে সাথে লেখা আছে “আপনার বউ”। বউ কথাটা মনের মধ্যে আওড়াতেই তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।

গোল্ডেন সুতোয় বাঁধা লাল বেনারসি শাড়ি পড়ে ঊর্মি বউ সেজে বসে আছে। নববধূ বেশে আজ ঊর্মিকে অপ্সরীর থেকে কম লাগছে না। বরযাত্রীরা সবাই চলে এসেছে, ঊর্মির সব কাজিনরা নিবিড়ের সাথে হাসি মসকারা করছে। ঊর্মির কাজিন সাদিয়া আর আশা মিলে বলে “আচ্ছা তোমাদের দু’জনকে এখন থেকে কি ডাকবো ভাইয়া/দুলাভাই নাকি আপু/ভাবী?” বলেই সবাই জোরে জোরে হাসতে থাকে।
বিয়ে পড়ানোর সময় নিবিড় ঊর্মিকে বলে….

নিবিড় : আমি তোমার জীবনের সূচনায় নাই-বা রইলাম উপসংহারে না-হয় আমাকে রেখো। হবে কি আমার বাকি জীবনটুকুর পথ চলার সাথী?
আমি : হুম (কিছুক্ষণ সময় নিয়ে)

এরপর কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো সম্পন্ন করেন। দেখতে দেখতে বিদায়ের পালা চলে আসে। অনন্ত কিছুতেই বোনের সামনে কান্না করবে না তাই সে আড়ালে দাঁড়িয়ে চল জল ফেলছে। মিসেস অন্তরা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছেন। ঊর্মিও তার মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দিয়েছে। ঊর্মি কখনোই তার বাবাকে কাঁদতে দেখেনি কিন্তু আনিসুল সাহেব আজ কান্না করছেন। আজ তার কলিজার টুকরো মেয়েটা অন্যের ঘরে চলে যাবে। আনিসুল সাহেব ঊর্মির হাত নিবিড়ের হাতে দিয়ে বলেন……

আনিসুল সাহেব : আমি জানি তুমি আমার মেয়েটাকে সবসময় সুখেই রাখবে তবুও বলছি বাবা আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো। আমার মেয়েটা বড্ড চঞ্চল, তবে আমি জানি ও তোমাদের সংসার সুন্দর ভাবেই গুছিয়ে রাখবে। (নিবিড়ের হাত ধরে)
নিবিড় : তুমি চিন্তা করো না খালুমণি। ঊর্মি যেমন তোমার ঘরের রাজকন্যা ছিলো তেমনই আমার ঘরের রানী হয়ে থাকবে।
আনিসুল সাহেব : আমার তোমার উপর ভরসা আছে বাবা।
আমি : তোমাদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না আব্বু। (এক হাত দিয়ে আনিসুল সাহেবকে জড়িয়ে ধরে)
মিসেস অন্তরা : প্রত্যেকটা মেয়েকেই একদিন বাবার বাড়ি ছেড়ে শশুর বাড়ি যেতে হয় মা, এটাই যে সমাজের নিয়ম।
নেহাল সাহেব : ভাই সাহেব এখন আমাদের বেরিয়ে পড়া উচিত।
আনিসুল সাহেব : হুম! (চোখের পানি মুছে)

ঊর্মির সাথে ওর কাজিন ওরফে নিবিড়ের কাজিন সাদিয়া আর আশাও এসেছে। মিসেস অহনা তার বউমা’কে বরণ করে ঘরে তুলেছেন, আজ তার অনএক দিনের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। ঊর্মি বরাবরই মিসেস অহনার বেশ আদরের ছিলো, উনি সবসময়ই চাইতেন ঊর্মিকে উনার ছেলের বউ করবেন।
নিবিড়ের সব কাজিনরা মিলে ঊর্মিকে ওর রুমে বসিয়ে দিয়ে যায়। রুমটা ঊর্মির কাছে বেশ ভালোই লাগে তবে আগে রুমটা’তে তেমন একটা আসা হয়নি তার। বিছানার একপাশে বসে নিবিড়ের জন্য অপেক্ষা করছে সে। বিয়ের শাড়িটা এখনো গায়ে জড়ানো, কান্না করার ফলে চোখের কাজল হাল্কা লেপ্টে আছে। শাড়ি আর গহনা বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ পড়ে থাকার কারনে তার বেশ অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।
কিছুক্ষণ বাদেই নিবিড় দরজায় নক করে রুমে প্রবেশ করে। নিবিড় আসতেই ঊর্মি তাকে সালাম জানাই, সে সালামের উত্তর নিয়ে ঊর্মিকে বলে “তুমি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওজু করে এসো নামাজ পড়বো৷” ঊর্মি তার ব্যাগ থেকে থ্রি-পিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই নিবিড়ও ওজু করে এসে নামাজ আদায় করে নেয়।

নিবিড় : তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তুমি শুয়ে পড়ো আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

ঊর্মি বাধ্য মেয়ের মতো বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ে, নিবিড় ঊর্মির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ক্লান্ত থাকার করণে ঊর্মি এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে, তারপর নিবিড়ও তার পাশে শুয়ে পড়ে।

————————————

“মাম্মাম আজ না একটা মেয়ে আমাকে লাভ লেটার দিয়েছে” ঊর্মি বিছানায় ভাজ করে রাখা কাপড় গুলো আলমারিতে তুলে রাখছিলো এমন সময় নীড় কথাটা বলে। ঊর্মি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে তার সাত বছরের বাচ্চা ছেলেটা ইনোসেন্ট ফেস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীড়ের চোখ মুখ সব যেনো নিবিড়ের কার্বনকপি, ছেলেও তার বাবার মতোই গম্ভীর স্বভাবের। পরিবারের মানুষ’জন ছাড়া বাইরের কারোর সাথেই তেমন একটা কথা বলে না। নীড় পরিবারের সবার বেশ আদরের, দেখতে একদম চকলেট বয় হাসলে ঊর্মির মতোই গালে টোল পড়ে। সবে মাত্র সে ক্লাস টু’ তে পড়ে তবে এ আর নতুন কিছু না কিছুদিন পর পর’ই ছেলের কাছ থেকে ঊর্মি এমন কথা শুনে কিন্তু সে বুঝে পায় না এতোটুকু ছেলেকে কেউ চিঠি দেবে ভাবা যায়? নিবিড় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলের কথা গুলো শুনে একপ্রকার জোরে হেসে দেয় আর বলে….

নিবিড় : এই না হলে বাপ কা বেটা। (ঊর্মি চোখ রাঙিয়ে নিবিড়ের দিকে তাকায়)
নীড় : পাপা আমি তোমার আর মাম্মামের সাথে ঘুরতে যাবো।
আমি : পড়া বাদ দিয়ে ঘুরতে বের হওয়া চলবে না!
নীড় : মাম্মাম পরে বেশি করে পড়ে নেবো। প্লিজ!
নিবিড় : আমার বাবা যখন বলেছে ঘুরতে বের হবে তখন তো যেতেই হবে।
আমি : ছেলেকে আরও মাথায় তুলুন।

বিকেলে নীড়কে নিয়ে ওরা একটা পার্কে ঘুরতে আসে। আজও নিবিড় ঊর্মিকে আর নীড় একটা জায়গায় বসিয়ে দিয়ে কোথাও যায় আবার মিনিট পাঁচেক পর ফিরে আসে হাতে বেলী ফুলের মালা নিয়ে। প্রায়শই নিবিড় কোথাও ঘুরতে বের হলে ঊর্মির জন্য বেলী ফুলের মালা কিনে নিজ হাতে তার প্রিয়তমার হাতে পড়িয়ে দেয়।
সন্ধ্যে প্রায় ঘনিয়ে আসছে নিবিড় স্ত্রী সন্তান নিয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে আসতে নিলেই পেছন থেকে কেউ ঊর্মি বলে ডাক দেয়। ওরা পেছনে তাকিয়ে দেখে আরুহি আর তানভীর দাঁড়িয়ে ওদের হাত ধরে আট/নয় বছরের মেয়ে রয়েছে। ঊর্মি চলে আসতে নিলেই আরুহি পেছন থেকে বলে…..

আরুহি : তুমি আমাদের উপর এখনো রেগে আছো ঊর্মি?
আমি : না! আপনাদের উপর রাগ করবো কেনো?
আরুহি : তোমার সাথে অনেকবার খারাপ ব্যাবহার করেছি। আসলে ডক্টর বলেছিলো তানভীরের কোনো’দিনই তোমাদের সাথে থাকাকালীন কোনো স্মৃতি’ই ফিরে আসবে না আর আমরা চাইছিলাম না ওর মাথায় কোনো প্রেসার পড়ুক।
আমি : আমি ওগুলো কিছুই মনে রাখি’নি আর আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। উনি আমার স্বামী নিবিড় আর এই আমার ছেলে নীড়। আমি আমার স্বামী সন্তান নিয়ে সুখেই আছি। আমি আমার স্বামী সন্তান নিয়ে সুখেই আছি।অতীতের কোনো কিছুই আমি মনে রাখতে চাই না, আমার বর্তমান আর ভবিষ্যত শুধুমাত্র এই দু’জনকে নিয়েই (নিবিড় আর নিবিড়ের কোলে থাকা নীড়কে দেখিয়ে। তানভীর নিবিড়ের সাথে হাত মিলায়)
আরুহি : এইযে আমাদের মেয়ে তোহা। (মেয়েটা একদমই তানভীরের মতো হয়েছে)
তানভীর : স্যরি ঊর্মি! আমি তোমার সাথে খুব খারাপ ব্যাবহার করেছি। পূর্বের কোনো কিছুই আমার মনে নেই।
আমি : ইটস ওকে!

রাতে ঊর্মি নীড়কে ঘুম পাড়িয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো এমন সময় নিবিড় তার প্রেয়সীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আর বলে “আজ কি আমার শ্যামা’বতীর মন খারাপ?”

আমি : উহু! (ঊর্মিকে ছেড়ে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় নিবিড়)
নিবিড় : তা আমার সুন্দরী বউয়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আমায় কি করতে হবে? (নিবিড়ের এমন কথা শুনে ঊর্মি ফিক করে হেসে দেয়)
নিবিড় : তোমার হরিণ টানা চোখ আর টোল পড়া হাসিতে আমি প্রেমে পড়ি বারংবার।
আমি : আপনার চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় কতটা প্রখর সেই অনুভূতি।
নিবিড় : আমার শ্যামা’বতী কবে থেকে আমার আমার অনুভূতি গুলোকে অনুভব করতে লাগলো?
আমি : যেদিন থেকে এই গম্ভীর ওরফে প্রাণোচ্ছল মানুষটা ভালোবেসে ফেলেছি। (বলে নিবিড়ের বুকে মাথা রাখে)
নিবিড় : আমিও যে আমার শ্যামা’বতীকে বড্ড ভালোবাসি।

সমাপ্ত!…..!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here