তুমি_সূচনায়,পর্ব-৭

0
418

#তুমি_সূচনায়,পর্ব-৭
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

ঊর্মি আর তানভীর একটা লেকের সামনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে কারো মুখে কোনো কথা নেই। আজ এ লেকের পাশটাতেই তেমন কোনো মানুষ নেই। ঊর্মি নিরবতা ভেঙে তানভীরকে বলে….(যেহেতু আহিলের পরিচয় সবাই জেনেই গেছে সেহেতু এখন থেকে তানভীর নামটাই উল্লেখ হবে)

আমি : আজ সারাদিন আমার সাথে ঘুরবে?
তানভীর : হুম! (মুচকি হেসে)

ঊর্মি তানভীর এর হাত ধরে হাঁটছিলো, সামনেই একটা বাচ্চা মেয়ে ফুল বিক্রি করছে। তানভীর ঊর্মির জন্য বেলী ফুলের মালা আর দুটো লাল গোলাপ কিনে দিলো। তানভীর বেলী ফুলের মালা হাতে পেঁচিয়ে, একটা গোলাপ ফুল কানের পাশে গুজে দিলো ঊর্মির। এই সুযোগে কয়েকটা সেল্ফি তুলে নিলো ঊর্মি। হয়তো এটাই তানভীর এর সাথে তার শেষ সময় কাটানো। সময় গুলো তো আটকে রাখতে পারবে না তাই মুহূর্ত গুলোকে ক্যামেরায় বন্দী করে রাখলো।
গোলাপ ফুলটা হাতে নিয়ে আরেক হাত তানভীর এর হাতের উপর রাখলো ঊর্মি। দু’জন মিলে ফুচকা, ঝালমুড়ি খেলো। বেলা সে কখন গড়িয়ে গেছে সেদিকে কারোরই খেয়াল নেই। যেতেই যেতেই ঊর্মি তানভীরকে দাঁড় করালো আর বললো…..

আমি : তোমাকে আমার একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার আছে।
তানভীর : কি সারপ্রাইজ?
আমি : বললে কি আর সারপ্রাইজ থাকবে বোকা?

তারপর ঊর্মির হাতে থাকা স্কার্ফ দিয়ে তানভীর এর চোখে বেধে দেয় আর বলে “ভয় পেয়ো না আমার চোখ দিয়েই তুমি দেখে দেখে যাবে” তারপর তানভীর এর হাত একটা ট্যাক্সিতে বসে দু’জন। প্রায় আধ ঘণ্টা পর ঊর্মি তানভীরকে নিয়ে একটা বড় হসপিটালের সামনে আসে৷ ঊর্মি যেহেতু বলেছিলো আজই তানভীর তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেবে তার মিসেস তারানা ডক্টর সাথে কথা বলে আজই তানভীর এর অপারেশনের ডেট ফিক্সড করেছে। ঊর্মি তানভীরকে নিয়ে কেবিনের সামনে পৌঁছে গেছে। এখানে মিসেস তারানা, তিয়াস আহমেদ, আরুহি, আমান চৌধুরী একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। রিয়া আর সাহিলও এখানেই আছে, ঊর্মি যাতে নিজেকে শক্ত রাখতে পারে তাই ওরা এসেছে ঊর্মিকে সাপোর্ট করতে।

তানভীর : আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ঊর্মি? কখন দিবে সারপ্রাইজ?
আমি : এ..এই তো এক্ষুনি (কান্না আটকে)

কথাটা বলেই ঊর্মি তানভীর এর চোখ থেকে স্কার্ফ টা খুলে ফেলে। তানভীর চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে এটা একটা হসপিটাল। তারপর ঊর্মিকে জিজ্ঞেস করে…

তানভীর : এখানে আবার কিসের সারপ্রাইজ দেবে তুমি?
আমি : ইনি হচ্ছেন তোমার মাম্মাম (মিসেস তারানাকে দেখিয়ে) আর ইনি তোমার পাপা (তিয়াস আহমেদকে দেখিয়ে)
তানভীর : একি তুমি কাঁদছো কেনো?
আমি : কই আমি কান্না করছি না তো? (তাড়াতাড়ি করে চোখে মুছে ফেলে)

(মিসেস তারানা আর তিয়াস আহমেদ এসেই তানভীরকে জড়িয়ে ধরে)

তিয়াস আহমেদ : এতোদিন কোথায় ছিলি বাবা তুই? আমরা তোকে কোথায় না খুঁজেছি। (কান্না করে)
মিসেস তারানা : তানভীর আমি তোর মাম্মাম! আমাকে চিনতে পারছিস না বাবা? আমরা আজই তোর অপারেশন করাবো তাহলে আবার তুই আমাদের চিনতে পারবি!
তানভীর : অপারেশন করালে আমি ঊর্মিকে ভুলে যাবো। না আমি অপারেশন কিছুতেই করাবে না (মনে মনে) না আমি অপারেশন করাবো না

চিৎকার করে বলে পাগলামি শুরু করে দেয় তানভীর। কোনো উপায় না পেয়ে ডক্টর একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন তানভীর এর ঘাড়ে পুশ করে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তানভীর ঘুমিয়ে পড়ে।

————————————

রাত প্রায় ১২টা বাজে। বাসায় ফেরার পর থেকে ঊর্মি আর কারো সাথে কোনো কথা বলে’নি। খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে ঊর্মি ডাইরি লিখছে। ঊর্মি যখন খুব বেশি মন খারাপ থাকে তখন সে লিখতে বসে, তবে মন খারাপ ছাড়াও ঊর্মি ডাইরি লিখে বেশ পছন্দ করে। ১০ম শ্রেণি থেকে সে এই ডাইরিটা লেখা শুরু করেছে। লিখতে লিখতে টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে ঊর্মি।
সকালের রোদ চোখে মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় ঊর্মির, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা ১১টা বাজে।

হসপিটালের করিডরে পেতে রাখা চেয়ার বসে চোখের জল ফেলছে ঊর্মি। ঘুম থেকে উঠে শাওয়ার নিয়ে নাস্তা না করেই বেরিয়ে এসেছিলো ঊর্মি সাথে রিয়া, সাহিল আছেই। ঊর্মিকে কিছুতেই ওরা একা ছাড়তে চায় না। কিছুক্ষণ আগে ঊর্মি হসপিটালে এসে তানভীর এর কেবিনের দিকে পা বাড়ায়।
তানভীর এর কেবিনে ওর পরিবারে সবাই উপস্থিত আছে। তানভীর এর আগের সকল স্মৃতি ফিরে পেয়েছে তবে ঊর্মির সাথে পরিচয় হওয়ার পরের সকল স্মৃতি তানভীর ভুলে গেছে চিরকালের মতো।

আমি : আহিল!

ঊর্মি ডাক শুনে সবাই ওর দিকে তাকায় তানভীরও ঊর্মির দিকেই তাকিয়ে আছে। রিয়া আর সাহিল ওর পেছনে দাঁড়িয়ে।

আমি : আহিল তুমি ঠিক আছে?
তানভীর : আহিল কে? আর আপনিই বা কে?
আমি : তুমি!
তানভীর : আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে আমার নাম তানভীর! (কথাটা শোনা মাত্রই ঊর্মির চোখে থেকে জল গড়িয়ে পড়লো)
আমি : তোমার কি সত্যিই কিছুই মনে নেই? তুমি তো আমাকে ভালোবাসো আমাকে চিনতে পারছো না?
তানভীর : যদি আমরা একে অপরকে ভালোবেসেই থাকি তাহলে আমি কেনো অনুভব করতে পারছি না? আমি শুধুমাত্র রুহিকেই (আরুহি) ভালোবাসি। প্লিজ আমাকে বিরক্ত করবেন না চলে যান।
আমি : আহিল!
আরুহি : তানভীর বলছে তো ও তোমাকে চেনে না তাহলে কেনো অযথা ওকে বিরক্ত করছো?
সাহিল : আমাদেরই ভুল হয়ে সেদিন কেনো যে আহিলের কথা গুলো শুনতে গেলাম।
রিয়া : চল এখান থেকে!
সাহিল : তোমার জন্য আজ আমার বান্ধুবীটা কষ্ট পাচ্ছে।

হসপিটাল থেকে সাহিল আর রিয়া, ঊর্মিকে নিয়ে সাহিলের ফ্লাটে চলে এসেছে। বিছানার তিন কোণে তিনজন বসে আভহে কারো মুখে কোনো কথা নেই। ঊর্মি হসপিটাল থেকে আসার পর থেকেই চুপ করে আছে কোনো কথা বলছে না।

সাহিল : ঊর্মি বোন আমার প্লিজ কথা বল!
রিয়া : দেখ তোর এই নিরবতা আমাদের কারোরই সহ্য হচ্ছে না।

ইদানীং ঊর্মি কারোর সাথে তেমন একটা কথা বলে না। সারাক্ষণ নিজের রুমেই থাকে। ঊর্মি বাবা মাও মেয়ের জন্য আড়ালে চোখের জল ফেলে। অনন্ত তো বোনের সাথে করে দুষ্টুমি গুলো খুব মিস করে। অনন্ত মনে প্রাণে চায় তার বোন আবার আগের মতো স্বাভাবিক হোক, হাসি খুশিতে থাকুক।

রাতে আনিসুল সাহেব প্লেটে করে মেয়ের পছন্দের চিকেন বিরিয়ানি নিয়ে ঊর্মির রুমে আসে। ঊর্মি তখন বিছানার আধো শোয়া হয়ে শুয়ে ছিলো।

আনিসুল সাহেব : আসবো মামুনি?
আমি : আব্বু তুমি! আসো।
আনিসুল সাহেব : দেখো আব্বু তোমার জন্য তোমার পছন্দের চিকেন বিরিয়ানি এনেছি।
আমি : আব্বু আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।
মিসেস অন্তরা : মা রে সন্তান যদি না খেয়ে থাকে তাহলে কি কোনো বাবা মা খেতে পারে? (ঊর্মি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো মিসেস অন্তরা আর অনন্ত দাঁড়িয়ে আছে)
অনন্ত : প্লিজ আপু আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যা না? তোকে এভাবে দেখতে আমার সত্যিই ভালো লাগছে না।
আনিসুল সাহেব : মামুনি! আমি তোমাকে খাইয়ে দেই?

(ঊর্মি বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো উনারা খুব যত্নের সাথে খাবারের প্লেটটা নিয়ে বসে আছে তাই মুচকি হেসে বাবার হাতে খেয়ে নিলো)

————————————

দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেছে তানভীর এখন পুরোপুরি ভাবে সুস্থ। আজ তানভীর আর আরুহির বিয়ে ছিলো। সেদিন হসপিটাল থেকে আসার পর আর কখনোই ঊর্মি তানভীর এর সামনে যায়নি। ঊর্মি এখনো আগের মতোই চুপচাপ থাকে, বেশির ভাগ সময়ই ডাইরি লেখে তবে সকলের সামনে যথাসম্ভব হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করে।
ঊর্মি ডাইরি লিখছিলো হঠাৎ করে বাইরে থেকে দমকা হাওয়ায় পাতা গুলো এলোমেলো হয়ে যায় তখনই ঊর্মি নজরে পরে তানভীর এর দেওয়া সেই দুটো গোলাপ আর বেলী ফুলের মালা। ঊর্মি যত্ন সহকারে ডাইরির ভাজে রেখে দিয়েছিলো। তানভীর এর সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো মন পড়তেই ঊর্মি ডুকরে কেঁদে উঠলো।

অন্যদিকে……..

নিবিড় : এতোদিন কাজের প্রেসারে তোমার কোনো খোঁজই নিতে পারিনি শ্যামা’বতী। আব্বু আম্মু আগে গ্রাম থেকে ফিরুক তারপর বলবো আমাদের বিয়ের কথা বলতে। খুব মিস করছি তোমাকে (ঊর্মির একটা হাস্যজ্বল ছবির দিকে তাকিয়ে)

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here