তুমি_সূচনায় #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা #পর্ব-৬

0
384

#তুমি_সূচনায়
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-৬

বাড়ি ফেরার পথে ঊর্মি আহিলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকে “আমাদের চলার পথ এতোটুকুই ছিলো, আহিল আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাকে নিজের কাছে আটকে রাখতে চাই না। যখন তোমার সব স্মৃতি মনে পড়ে যাবে তখন আমি তোমার স্মৃতিতে কোথাও থাকবো না।”

অন্যদিকে আরুহি বাড়ি পৌঁছে মিসেস তারানাকে ডাকতে শুরু করে দেয়।

আরুহি : মাম্মাম! কোথায় তুমি?
মিসেস তারানা : কি হয়েছে রে মা?
আরুহি : মাম্মা আমি তানভীরকে খুঁজে পেয়েছি।
মিসেস তারানা : সত্যি বলছিস? (কান্না করে) কোথায় আছে আমার ছেলেটা?
আরুহি : কাল তোমাকে আমি নিয়ে যাবো সেখানে! আমি দ্বিতীয় বার তানভীরকে হারাতে চাই না। জানো মাম্মাম তানভীরের আগের কোনো স্মৃতি মনে নেই, ও এখন একটা মেয়েকে ভালোবাসে (চোখের জল মুছে)
মিসেস তারানা : ও ওর মাম্মাম’কেও ভুলে গেছে? (কান্না করে)
আরুহি : কাউকেই চিনতে পারছে না। আচ্ছা মাম্মাম ও কি আমাকে কোনোদিন চিনতে পারবে না? আমাদের ভালোবাসা কি মিথ্যে হয়ে যাবে?
মিসেস তারানা : তোদের দু’জনকে আমি কখনো আলাদা হতে দেবো না। আমি আমার ছেলেকে শহরের বেস্ট ডক্টর দেখাবো, দরকার পড়লে বিদেশ নিয়ে যাবো।

অন্যদিকে……..

ঊর্মি তার রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে এক মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বিষন্নতা আজ তাকে পুরোপুরি গ্রাস করেছে। আহিলকে হারানোর ভয় তাকে শান্ত হতে দিচ্ছে না। রাতের খাবারটাও খায়নি, মিসেস অন্তরা বেশ কয়েকবার খাবার খাওয়ার জন্য ডেকে গেছেন। আহিলের সাথে কাটানোর মুহুর্ত গুলো কথা ভাবছে আর নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। তখনই মিসেস অন্তরা পেছন থেকে ঊর্মিকে ডাক দেয়, ঊর্মি কিছু নড়েচড়ে আগের মতোই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

মিসেস অন্তরা : আমার মেয়েটার কি আজ মন খারাপ?

(মায়ের এমন কথা শুনে সে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি, মাকে জড়িয়ে ধরেই কান্না করে দেয়)

মিসেস অন্তরা : কি হয়েছে মা কাঁদছিস কেনো? (মেয়ে কান্না দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যায়)
আমি : আম্মু আমি আহিলকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলতে চলেছি (কান্না করে)
মিসেস অন্তরা : কান্না বন্ধ করে বল তো কি হয়েছে?

(ঊর্মি মিসেস অন্তরাকে একে একে সব কথা বলে)

মিসেস অন্তরা : আহিল এখন হয়তো ওর আগের স্মৃতি গুলো ভুলে গেছে কিন্তু কিছুদিন পর তখন তো ও তোদের সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো ভুলে যাবে। আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম এমন একটা কিছু হবে। এখন কান্না করলে হবে? নিজেকে শক্ত কর।
আমি : আম্মু আমি আহিলকে খুব ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।
মিসেস অন্তরা : কেঁদে কি হবে বাবু এমনটা তো হবারই ছিলো।

————————————

আরুহির যখন ৮ বছর তখন ওর মা মারা যায়, মাকে হারানোর পর সবসময় আপসেট হয়ে থাকতো আরুহি। তানভীর এর বাবা তিয়াস আহমেদ আর আরুহির বাবা আমান চৌধুরী ছিলো বেস্টফ্রেন্ড। আরুহি সারাক্ষণ মিসেস তারানার কাছেই থাকতো। মিসেস তারানা আরুহিকে নিজের মেয়ের মতো করে বড় করে। বোঝ হওয়ার পর থেকে তানভীর আর আরুহি একে অপরকে ভালোবাসে।
রাত প্রায় দেড়টা বাজতে চললো আরুহির চোখে ঘুম নেই আধো শোয়া হয়ে বসে আছে। তানভীরকে হারানোর পর একটা রাতও ভালো ভাবে ঘুমোতে পারেনি, একা হাতে তানভীর দের বিজনেস সামলেছে। তিয়াস আহমেদ ছেলেকে হারাতেই হার্ট অ্যাটাক করে, আরুহি তানভীর এর পরিবারের খেয়াল রেখেছে। আরুহি ফোনের গ্যালারিতে তানভীর এর ছবি দেখছে আর এনগেজমেন্টের দিনের কথা গুলো ভাবছে। এনগেজমেন্টের এক সপ্তাহ পরেই তানভীর আর আরুহি বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছিলো।

ছয় মাস আগে…….

Welcome to our engagement ceremony Tanvir & Aruhi” পুরো বাড়ি আজ সাদা গোলাপ দিয়ে সাজানো, সাথে সাদা লাইটিং। শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা বড় হোটেল, হোটেলটায় আজ মানুষে গিজগিজ করছে, করবে না-ই বা কেনো বিখ্যাত বিজনেস ম্যান তিয়াস আহমেদের একমাত্র ছেলে তানভীর আহমেদের এনগেজমেন্ট বলে কথা। সব মেয়েদের ক্রাশ আইকন তানভীর আহমেদ, যেমন সে দেখতে তেমনই তার যোগ্যতা। বিদেশ থেকেই গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করে, আহমেদ ইন্ডাস্ট্রি এখন তানভীরই সামলায়। তানভীর আজ সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো ব্লেজার, কালো সু পড়েছে। হাতে ব্রান্ডেড ঘড়ি, সিল্কি ব্রাউন চুল গুলো স্পাইক করা এক কথা ড্যাশিং লাগছে তাকে আজ। তানভীর আগে থেকে রেডি হয়ে আরুহির রুমের সামনে গিয়ে নক করে ভিতরে যায়। আজ আরুহিকেও বেশ সুন্দর দেখচ্ছে, সে আজ সাদা গাউন পড়েছে সাথে হালকা সাজ। কানে ছোট ডাইমন্ডের টপ, হাতে ডাইমন্ডের ব্রেসলেট আর মাথায় পাথরের ক্রাউন এক কথায় কোনো সাদা পরীর মতো লাগছে তাকে। তানভীর আরুহিকে দেখে মুচকি হাসে।

তানভীর : You’re looking beautiful. (তানভীর কথায় আরুহি লজ্জা মিশ্রিত হয়ে মুচকি হাসে)
তানভীর : এনগেজমেন্ট রিং টা এখনো আনা হয়নি, আমি নিজে গিয়ে সেটা নিয়ে আসতে চাই।
আরুহি : এক ঘন্টা পরেই এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। তোমার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রেহানকে বলো নিয়ে আসতে।
তানভীর : আমি অন্য কাউকে দিয়ে রিং আনতে দিতে পারবো না। আমি নিয়ে আসতে পারবো।
আরুহি : তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবে আর সাবধানে যাবে। I’m waiting for you. (তানভীর মুচকি হেসে আরুহির কপালে চুমু এঁকে দেয়)

(তানভীর আর আরুহি একে অপরকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে। আরুহির বাবা আর তানভীর এর বাবা বেস্টফ্রেন্ড। আরুহির মা নেই সেই সুবাদে আরুহি বেশিরভাগ সময় তানভীরদের বাড়িতেই তানভীর এর মায়ের সাথে কাটাতো। তানভীর রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই তানভীর এর আম্মু (তারানা আহমেদ) আসে। আরুহিকে পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরে বলে…

মিসেস তারানা : সেই দিনটা এসেই গেলো, তুই আমার বউমা হওয়ার আগে আমার মেয়ে।
আরুহি : মামনি! আমি সবসময় তোমার মেয়েই থাকবো।
মিসেস তারানা : আজ আমার মেয়েটাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।

অন্যদিকে………..

তানভীর শো-রুম থেকে এনগেজমেন্ট রিং নিয়ে বেরিয়ে গেছে। তানভীর ড্রাইভ করা শুরু করতেই পেছন থেকে আরেকটা গাড়ি তানভীরকে ফলো করা শুরু করে। তানভীর এক হাতে ড্রাইভ করছে আরেক হাতে রিং বক্সটার দিয়ে তাকিয়ে আছে। ড্রাইভিং করার মাঝেই হঠাৎ করে তানভীর এর গাড়ির ব্রেক ফেইল হয়ে যায়, যার ফলে তানভীর কোনো মতে গাড়িটি নিজের কন্ট্রোলে আনোট পাড়ছে না। এমন সময় হঠাৎ করেই তানভীর এর গাড়ির সামনে একটা ট্রাক এসে পড়ে, ঘটনাটি আকস্মিক হওয়ায় তানভীর এর গাড়ি ছিটকে খাদে পড়ে যায়।
মিসেস তারানা অনেকক্ষণ যাবৎ আরুহির রুমে বসে থাকে। এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে তাই তিয়াস আহমেদ আর আহান চৌধুরী আরুহির রুমে আসে। তিয়াস আহমেদ তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলে….

তিয়াস আহমেদ : তানভীর কোথায়?
মিসেস তারানা : এনগেজমেন্ট রিং নিয়ে আসতে গিয়েছে। কতবার বলেছিলাম অন্য কাউকে দিয়ে আনিয়ে নে শুনলো না আমার কথা।
তিয়াস আহমেদ : আচ্ছা! আমি কল দিয়ে দেখছি কোথায় আছে।
আহান চৌধুরী : হুম কল দে।
তিয়াস আহমেদ : তানভীর এর ফোন তো বন্ধ দেখাচ্ছে। (এমন সময় কারো কল আসে) হ্যালো! কে বলছেন?
অপর পাশ থেকে : আমি পুলিশ অফিসার মাহবুব আলম বলছিলাম!
তিয়াস আহমেদ : হ্যাঁ বলুন!
অফিসার : আসলে এখানে খাদের কাছে আপনাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়েছে। গাড়ির নেমপ্লেট থেকে শনাক্ত করেছি।
তিয়াস আহমেদ : কি বলছেন কি অফিসার? আমার ছেলে ঠিক আছে তো?
অফিসার : আমরা গাড়ি আশেপাশে থেকে কাউকে খুঁজে পাইনি।
তিয়াস আহমেদ : অফিসার গাড়িতে আমার ছেলে ছিলো। যে করেই হোক তাকে আপনার খুঁজে বের করুন। (বুকে হাত দিয়ে)
মিসেস তারানা : তানভীর এর পাপা তুমি প্লিজ উত্তেজিত হইও না, তোমার বুকে ব্যথাটা বেড়ে যাবে।

এদিকে প্রায় ১২ ঘন্টা হয়ে গেছে কিন্তু ঘটনা স্থল থেকে এখনো তানভীরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, পুরো জায়গাটা তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে তানভীর এর আম্মুর অবস্থা শোচনীয়, তানভীর এর পাপা হার্ট অ্যাটাক করেছে এখন হসপিটালাইজড।

তিয়াস আহমেদের কেবিনে আরুহি, মিসেস তারানা আর আমান চৌধুরী বসে রয়েছে। নার্স কিছুক্ষণ আগেই মেডিসিন দিয়ে গেছে।

তিয়াস আহমেদ : পেয়েছো আমার ছেলেটাকে (অস্পষ্ট ভাবে)
মিসেস : তোমার শরীর এখন অনেকটা দূর্বল। তুমি একটা ঘুমোনো চেষ্টা করো, এতো দুঃশ্চিন্তা করো না।
তিয়াস আহমেদ : তানভীর আমাদের একমাত্র ছেলে, ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি কিভাবে নিশ্চিন্তে থাকি? (অস্পষ্ট ভাবে)
আমান চৌধুরী : তুই একটু ঘুমোনোর চেষ্টা কর। তানভীরকে তো খোঁজার চেষ্টা করছি, খুব তাড়াতাড়িই পেয়ে যাবো।

আরুহি আধো শোয়া হয়ে তানভীর এর কথা গুলো ভাবতে ভাবতে সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে।

———————————————

পরের দিন সকাল সকাল মিসেস তারানা আর আরুহি ঊর্মির বাড়িতে আসে। ওরা এসেই ঊর্মি সাথে কিছুটা রূঢ়ভাবে কথা বলে। মিসেস অন্তরার সামনে ঊর্মির সাথে রূঢ়ভাবে কথা বলছে তবুও ঊর্মির বাড়ির সবাই ওদের সাথে স্বাভাবিক আচরনই করছে। মিসেস তারানা এবার শান্ত ভাবে বলে……

মিসেস তারানা : ঊর্মি মা দয়া করে আমার ছেলেকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। তুমি জানো না তানভীরকে হারিয়ে আমাদের পরিবারের ওপর দিয়ে কি গেছে! তানভীর এর পাপা হার্ট অ্যাটাক করেছিলো অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করার জন্য। (কান্না করে)
মিসেস অন্তরা : মিসেস তারানা আপনি শান্ত হোন! আমরা অবশ্যই একটা পথ বের করবো।
আরুহি : তানভীর আমাদের চিনতে পারছে না আর আপনি বলছেন শান্ত হতে। কিভাবে শান্ত হবো আন্টি?
মিসেস তারানা : আপনাদের যত টাকা লাগে আমি দিয়ে দেবো প্লিজ আমার ছেলেকে আমাদের কাছে দিয়ে দিন।
আনিসুল সাহেব : অনেক হয়েছে! কি বার বার আপনারা টাকা টাকা করছেন? আল্লাহর রহমতে আমাদের যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে। আমরা আপনাদের মনে অবস্থা বুঝতে পারছি তাই স্বাভাবিক আচরণই করছি। তাই বলে এভাবে আমাদের অপমান করতে পারেন না।
মিসেস অন্তরা : আমরা আমাদের মেয়েকে সবসময় স্বাধীনতা দিয়েছি, আমরা জানি আমাদের মেয়ে কেমন! ওর চোখ থেকে কখনো আমরা একফোঁটা পানি পরতে দেইনি। তবে দেখুন আপনার ছেলের জন্যই আমাদের মেয়ের চায় থেকে পানি ঝরছে, এতে অবশ্য আমরা আপনার ছেলেরও কোনো দোষ দেবো না।
আমি : আপনারা চিন্তা করবেন না! আমি আগামীকালই তানভীর দিয়ে আসবো আপনাদের বাড়িতে। (বলেই কান্না করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলো)

ঊর্মির কথা শুনে মিসেস তারানা আর আরুহিও চলে যায়, ওদের যাওয়ার সাথে সাথেই অনন্ত কোচিং থেকে এসে বাড়িতে প্রবেশ করে।

অনন্ত : আম্মু কারা এসেছিলো?
মিসেস অন্তরা : আহিলের বাড়ির লোক!

কথাটা বলে মিসেস অন্তরা আর আনিসুল সাহেবও নিজেদের রুমে চলে যান।

চলবে?…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here