তুমি_সূচনায় #পর্ব-১

0
1333

#তুমি_সূচনায়
#পর্ব-১
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

কিছুদিন ধরে ভ্যাপসা গরমের পর কাল সারারাত মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে ভোরের দিকে থেমেছে, এখনো বৃষ্টির কণা গুলো টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে বেলকনির গ্রিল থেকে। বৃষ্টি হওয়ার আবহাওয়ায় কিছুটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। ঘড়িতে প্রায় ৯টা বাজতে চললো, মিসেস অন্তরা সেই কখন থেকে ডেকেই চলেছে এখনো মেয়ের ঘুম থেকে ওঠার নাম নেই, সে তো কাঁথা মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ডাকতে ডাকতে হয়রান হয়ে কিছুটা রেগে গিয়েই তিনি মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন…..

মিসেস অন্তরা : আর একবারও আমি ডাক দিবো না। সারারাত জেগে জেগে গল্প পড়বি আর সকালে ঘুম থেকে উঠতে চাস না, গল্প পড়ে কি মজা পাস সেটাই তো বুঝি না। বলি ৯টা বাজতে চললো এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস জমিদারের মেয়ে!
আমি : আজ রিয়া আর সাহিল তো আমাকে মেরেই ফেলবে। রোজ রোজ কেনো আমি ঘুম থেকে দেরি করে উঠি? আল্লাহ তুমি কি আমাকে সকাল সকাল ঘুম ভাঙিয়ে দিতে পারো না? আম্মু তুমিও তো ডেকে দিতে পারতে নাকি বলো? (কপাল চাপড়ে)
মিসেস অন্তরা : বেয়াদব মেয়ে! সেই কখন থেকে তোকে ডাকছি আর এখন বলছিস আমি ডেকে দেই না।
আমি : আম্মু এখন কথা বলার সময় নেই। (তাড়াতাড়ি বিছানা ওয়াশরুমে দৌঁড় লাগায়)

<(এবার পরিচয় দেয়া যাক এতোক্ষণ যার কথা হচ্ছিলো সে আপনাদের প্রিয় ঊর্মি। আব্বু আম্মু আর ছোট ভাইকে নিয়েই ওর পরিবার। ঊর্মির আব্বু একজন বিজনেস ম্যান, আম্মু গৃহিণী আর ছোট ভাই দশম শ্রেণিতে পড়ে, ঊর্মি অনার্স ৩য় বর্ষে পড়ছে। ঊর্মি, রিয়া আর সাহিল একই ভার্সিটিতে। রিয়া আর সাহিলের সাথে ঊর্মি বন্ধুত্ব সেই স্কুল জীবন থেকে। ঊর্মি দেখতে উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের হলেও চেহারায় ভীষণ মায়া আছে, হরিণ টানা চোখে রয়েছে ঘণ লম্বা পাপড়ি, সোনালী চুল গুলো বেশ লম্বা না হলেও কোমড় ছাড়িয়ে যায় আর হাসলে গালে টোল পড়ে।)>

কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে। ভার্সিটিতে আসতেই রিয়া আর সাহিল ঊর্মির দিকে চোখ গরম করে তাকায় আর ঊর্মি ইশারায় কান ধরে, যার অর্থ “আজকের মতো মাফ করে দে আর হবে না” কিন্তু ঊর্মি এই কথাটা প্রতিদিনই বলে তারপরও দেরি হয়েই যায়। তারপর তিনজনে ক্লাসে চলে যায়। পর পর তিনটা ক্লাস করেই ওরা বেরিয়ে যায় আর যেতে যেতে সাহিল আর রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে…..

আমি : ওই শোন না তোরা! চল না ফুচকা খেয়ে আসি, ক্লাস করতে করতে বোরিং লাগছে।
রিয়া : হ্যাঁ রে চল না।
সাহিল : হ্যাঁ আমি যাই আর তোরা আমার পকেট ফাঁকা কর। ভাগ্য গুনে তোদের মতো বান্ধুবী পেয়েছি। কিভাবে আমাকে ফকির বানানো যায় সেই ধান্দায় থাকিস!
আমি : এটা আমাদের বন্ধুগত অধিকার। তুই খাওয়াবি কি না বল নয়তো আমরা জোর করে তোর পকেট ফাঁকা করবো।
সাহিল : তোদের সাথে কথায় কোনো দিন পারবো না। হ্যাঁ রে রিয়া এই তোর ভালোবাসা?
রিয়া : লাগতে আসিস কেনো? আর হ্যাঁ এটাই ভালোবাসা!

তারপর তিনজন মিলে ফুচকা খেয়ে যে যার বাড়িতে ফিরে আসে। ঊর্মি বাড়িতে এসেই আগে ফ্রেস হয়ে খেয়ে নেয়। সন্ধ্যার দিকে ঊর্মি ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছে হঠাৎ কোথা থেকে অনন্ত হুট করে এসে রিমোট কেড়ে নিয়ে চ্যানেল পাল্টে দেয়। এই নিয়ে আবার দুই ভাই-বোনের মধ্যে ২য় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

আমি : ওই তুই চ্যানেল পাল্টালি কেনো? ডোরেমন দেখছিলাম আমি!
অনন্ত : চুপ থাক পেত্নী! দেখছিস না আমি খেলা দেখছি? খেলা দেখায় কন্সেন্ট্রেট করতে দে।
আমি : একদম আমাকে পেত্নী বলবি না! তুই কি তুই তো একটা রাক্ষস। (অনন্তর চুলে টান দিয়ে)
অনন্ত : তুই আমার চুল টেনেছিস? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। (সোফায় থাকা কুশন গুলো একে অপরের দিকে ছোড়াছুড়ি করে)
আমি : বেয়াদব ছেলে বড় বোনের সাথে তর্ক করিস! (এমন সময় মিসেস অন্তরা এসে দেখে ড্রইং রুমের যা তা অবস্থা)
মিসেস অন্তরা : থামবি তোরা? আজ আসুক তোদের আব্বু, তোদের হচ্ছে আজ। (রেগে গিয়ে)

————————————

রাতে খাবার টেবিলে……..আনিসুল সাহেব তার পরিবারের সাথে খেতে বসেছে। কথার মধ্যে মিসেস অন্তরা তাদের ছেলে মেয়ে উচ্ছন্নে যাওয়ার কথাটি তুলে ধরে। খাবার খেতে খেতে ওসমান সাহেব বলে…..

আনিসুল সাহেব : বাচ্চা ছেলে মেয়ে গুলো এখন দুষ্টুমি করবে না তো কখন করবে আমাদের মতো বুড়ো হয়ে গেলে? (হেসে হেসে)
মিসেস অন্তরা : তোমার আশকারা পেয়ে ছেলে মেয়ে দুটো উচ্ছন্নে গেছে। কই শাসন করবে তা না আরও প্রশ্রয় দিচ্ছে! (রেগে গিয়ে)
আনিসুল সাহেব : আহা তুমি রেগে যাচ্ছো কেনো? দেখো আমাদের ছেলে মেয়ে কি সুন্দর চুপচাপ খাচ্ছে। তুমিও মাথা ঠান্ডা করে খাওয়া শেষ করো।
আমি : এই না হলে আমার আব্বু।
অনন্ত : i love you আব্বু।
আনিসুল সাহেব : love you too বাচ্চা!

রাতে শুয়ে শুয়ে ঊর্মি ফেসবুকিং করছে হঠাৎ একটা পোস্টে তার চোখ আটকে যায়। গার্লস গ্রুপে একটা মেয়ে তার ক্রাশকে নিয়ে পোস্ট করেছে পিক সহ। “ছেলেটি দেখতে ফর্সা, গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর সুঠাম দেহের অধিকারী।” ছেলেটির নাম দেখার আগেই ফেসবুক রিফ্রেশের জন্য পোস্টটা নিউজফিড থেকে হারিয়ে যায়। ঊর্মির চোখে এখনো সেই ছেলেটার হাসি মাখা মুখটাই ভাসছে। এমন সময় ঊর্মির ফোনে ভিডিও কল আসে, গ্রুপ থেকে কল দিয়েছে সাহিল আর রিয়া, ঊর্মি কলটা রিসিভ করে।

সাহিল : এই মাত্র খবর পেলাম সামনে সপ্তাহে ভার্সিটি থেকে পিকনিকে নিয়ে যাওয়া হবে।
রিয়া : ইয়েএএএ আমার তো এখনই যেতে ইচ্ছে করছে। (খুশি হয়ে)
সাহিল : তো যা না এই রাতের বেলায় ভুতের সাথে ঘুরে আয়। (বিরক্ত হয়ে) তো কি যেনো বলছিলাম? ও হ্যাঁ ঊর্মি আমরা তিনজনই কিন্তু কনফার্ম যাচ্ছি!
আমি : তা তো অবশ্যই! (হাসি মুখে)

আজ শুক্রবার ভার্সিটি যাওয়ার তাড়া নেই ঊর্মি নিজের রুমে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। বেলা ১১ঃ৩০ রিয়া এসে ঊর্মিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। ঊর্মি ফ্রেশ হয়ে আসে কিছুক্ষণ পর সাহিল চলে আসে। আজ তিনজনে সারাদিন ঊর্মির বাড়িতে আড্ডা দেবে।
বিকেলে ঊর্মি, রিয়া আর সাহিল ছাদের এক কোণায় বসে আড্ডা দিচ্ছে হঠাৎ সাহিল বলে উঠলো ওরা একসাথে গান গাইবে, যা ওরা তিনজন প্রত্যেকবার একসঙ্গেই গায়। (গানটা বদমাইস পোলাপান সিরিজ থেকে নেয়া, তবে ব্যক্তিগত ভাবে গানটা আমার ভালো লাগে)


আমার এ ক্লান্ত বিকেল বুকে হাওয়া লাগিয়ে হাঁটা কতটা পথ
হেঁটেছি গন্তব্যহীন চেনা এ শহরের গলি
তোদের মাঝে যখন থাকি আমি পৃথিবী তখন আপন লাগে
তোরা ভুলে যাস’না কখনো আমাদের বন্ধুত্ব রঙিন কোনো ঘুড়ির মতো…

চিরচেনা শহরে প্রতিটি দেয়ালে বুকে চাঁপা অভিমান
তাও প্রতি প্রহরে চোখে স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার গান
খুব বেশি না বোঝা আমার জীবনে কিছু বন্ধু নিয়ে
রাতের পরে দিন, দিনের পরে রাত এই অভিযান
সন্ধ্যা নামার আগে ঘামে ভেজা শরীরে বাড়ি ফেরার তাড়া
আমার শহুরে জীবনের গল্প লেখে যারা তোদের বলি

আমার এ ক্লান্ত বিকেল বুকে হাওয়া লাগিয়ে হাঁটা কতটা পথ
হেঁটেছি গন্তব্যহীন চেনা এ শহরের গলি
তোদের মাঝে যখন থাকি আমি পৃথিবী তখন আপন লাগে
তোরা ভুলে যাস’না কখনো আমাদের বন্ধুত্ব রঙিন কোনো ঘুড়ির মতো..

পরের দিন সকালে……আজও ঊর্মি ঘুম থেকে দেরি করে উঠেছে, তবে অনন্ত স্কুল বন্ধ থাকায় ঊর্মিকে বাইকে করে ভার্সিটি পৌঁছে দিয়ে এসেছে। ঊর্মি, সাহিল আর রিয়া ক্যানটিনে বসে ছিলো হঠাৎ মাইকে এনাউন্সমেন্ট হয়ে “যারা যারা পিকনিকে যাবে তারা যেনো কাল আর পরশুর মধ্যে টাকা জমা দিয়ে দেয়, আগামী বৃহস্পতিবার পিকনিকে নিয়ে যাওয়া হবে।” তারপর ক্লাস শেষ করে ঊর্মি বাড়িতে চলে আসে।
বিকেলে…..ঊর্মি বেশ কিছুক্ষণ নিজের রুমে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে সিদ্ধান্ত নেয় কিভাবে আম্মুকে ম্যানেজ করা যায়। ঊর্মি তার মায়ের রুমের সামনে গিয়ে দেখে মিসেস অন্তরা কাবার্ডে কাপড়চোপড় গুলো গুছিয়ে রাখছে, হয়তো ধুয়ে দিয়েছিলো এগুলো। ঊর্মি মনে সাহস জুগিয়ে, মায়ের কাছে যায় আর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।

আমি : আমার সোনা আম্মু, কি করছো তুমি?
মিসেস অন্তরা : তা তো দেখতেই পারছিস, কাপড়চোপড় গুলো গুছিয়ে রাখছি।
আমি : আমি গুছিয়ে দেই না আম্মু! সারাদিন তুমি কতো কাজ করো!
মিসেস অন্তরা : আজ এতো ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে কেনো? তোর মতলব কি বল তো, নতুন কোনো আবদার নিয়ে এসেছিস? সত্যি সত্যি বল!
আমি : আসলে আম্মু হয়েছে কি…
মিসেস অন্তরা : আসল নকল বাদ দিয়ে বল তো কি চাই?
আমি : আম্মু আমাদের ভার্সিটি থেকে পিকনিকে নিয়ে যাচ্ছে, কাল বা পরশুর মধ্যে টাকা জমা দিতে হবে।
মিসেস অন্তরা : তোমার কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। সারাদিন মোবাইল আর ঘুরাঘুরি ছাড়া তো আর কিছুই জানো না, লেখাপড়ায় সামান্য মনোযোগ দেখছি না তোমার।
আমি : আম্মু প্লিজ এমন করো না, আমি আগের থেকে আরও মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করবো। আম্মু আমার সব বন্ধুরা যাচ্ছে, প্লিজ আম্মু রাজি হয়ে যাও। তুমি রাজি হয়ে গেলে আব্বুও বারণ করবে না। প্লিজ প্লিজ আম্মু (ন্যাকা স্বরে)
মিসেস অন্তরা : হয়েছে আর ন্যাকা কান্না করতে হবে না।
আমি : এত্তো গুলো ভালোবাসি আম্মু (জড়িয়ে ধরে)
মিসেস অন্তরা : হয়েছে এবার ছাড়, কাজ করতে দে।

চলবে?..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here