তুমি_সূচনায় #পর্ব-৮

0
358

#তুমি_সূচনায়
#পর্ব-৮
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

দুদিন পরে…..আজই সকাল সকাল মিসেস অহনা তার পরিবার সহ ঊর্মিদের বাড়িতে এসেছে। ঊর্মি এখনো নিজের ঘরেই রয়েছে, অনন্ত কোচিং এ গিয়েছে সামনে তার এসএসসি পরীক্ষা। অনন্ত এখন পড়ালেখা নিয়েই নিজেকে ব্যস্ত রাখে কারণ ঊর্মির এভাবে বদলে যাওয়াটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। সবাই বসে কথা বলছিলো তখনই কথায় কথায় মিসেস অহনা তার কাঙ্ক্ষিত প্রস্তাবটি দিয়েই দেয়। ছোট বোনের কাছ থেকে এমন কথা শুনে মিসেস অন্তরা আর আনিসুল সাহেব একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছুটা থমকে যায়। সকল দ্বিধা কাটিয়ে মিসেস অন্তরা মেয়ের ঘটা সকল ঘটনাই বলে দেয়।

মিসেস অন্তরা : আমার মেয়েটা কতটা চঞ্চল ছিলো, পরিস্থিতির চাপে আজ সে একেবারেই শান্ত হয়ে গেছে। আমার এই শান্ত মেয়েটাকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। (কান্না করে)
মিসেস অহনা : আপা তুই চিন্তা করিস না। আমাদের উচিত ঊর্মিকে বেশি বেশি সময় দেওয়ার। আমার নিবিড় ঊর্মিকে ভীষণ ভালোবাসে তোরা যদি চাস তাহলে আমরা এগোতে চাই।
নিবিড় : আম্মু এতো তাড়াহুড়োর কিছুই হয়নি। আমি চাই ঊর্মি ভালো থাকুক আবার আগের মতো চঞ্চল হয়ে উঠুক।
আনিসুল সাহেব : নিবিড়ের মতো ছেলে যদি আমরা আমাদের ঊর্মির জন্য পাই আমরাও ভীষণ খুশি হবো কিন্তু আমার মেয়েটা তো নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
মিসেস অন্তরা : আমরা বোঝাবো মেয়েটাকে।
নিবিড় : খালামণি আমি একটু ঊর্মির সাথে দেখা করতে চাই!
মিসেস অন্তরা : হ্যাঁ বাবা যা!

বসা থেকে উঠে ঊর্মির রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো নিবিড়। ওরা সকাল সকাল এসেছে তবুও বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। ঊর্মির রুমে নক করতেই ভেতরে যাওয়ার জন্য বলে। এ সময়ে নিবিড়কে সে আশা করেনি, ভেবেছিলো হয়তো বাবা-মা, অনন্ত অথবা রিয়া, সাহিল এসেছে। নিবিড়কে দেখা মাত্রই ঊর্মি চুপ করে রইলো।

নিবিড় : কয়েক দিনের ভালোবাসার জন্য এতো বছরের ভালোবাসাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছো। একবার ভেবে দেখেছো এই মানুষ গুলো কিভাবে নিঃস্বার্থ ভাবে তোমাকে ভালোবেসে যাচ্ছে আর তুমি কি করছো নিজে তো কষ্ট পাচ্ছোই সাথে তোমার আশেপাশের মানুষ গুলোকেও কষ্ট দিচ্ছো!

(ঊর্মি নিবিড়ের কথায় কোনো উত্তর দিচ্ছে না, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে)

নিবিড় : তুমি তানভীর এর কাছে এখন এক অচেনা অতীত ছাড়া আর কিছুই না যেটা তানভীর স্মৃতিতে নেই। তোমার বাবা মায়ের জন্য হলেও তোমার আগে জীবনে ফিরে আসতে হবে, স্বাভাবিক হতে হবে।
আমি : নিজের বাবা মায়ের জন্য হলেও আমাকে পারতেই হবে। (চোখের জল মুছে)
নিবিড় : that’s like a good girl (ঊর্মির গালে হাত রেখে)

ঊর্মি হাত ধরে বিছানা থেকে দাঁড় করায় নিবিড় আর রুমের বাইরে চলে যায়। সবাই ড্রইং রুমে বসে ঊর্মিকে নিয়েই কথা বলছিলো এমন সময় নিবিড় ঊর্মিকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। ঊর্মিকে দেখে তার সবাই থমকে যায় কারণ এক মাস পর ঊর্মির মুখে আগের মতই সেই হাসিটা দেখছে।

মিসেস অন্তরা : দেখছো ঊর্মির আব্বু আজ কতদিন পর আমার মেয়েটার মুখে হাসি ফুটেছে। নিবিড়ই পারবে আমার মেয়েটাকে আগলে রাখতে। ঊর্মি তো তোমার সব কথাই শোনে, তুমি একটু বুঝিয়ে বললেই ও বুঝবে।
আনিসুল সাহেব : হুম দেখছি।

————————————

নিবিড় আর তার পরিবার বিকেলেই চলে গেছে, ঊর্মি বেলকনিতে থাকা কাঠগোলাপ গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে, চাঁদের আলোতে গাছে ফুটে থাকা ফুল গুলো আবছা দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন জেগে থাকাটা এখন ঊর্মি অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই ঘুম আসছে। বেলকনি থেকে রুমে এসেই ঊর্মি অনন্তকে ডাক দেয়, বোনের ডাকে সাথে সাথে অনন্ত চলে আসে। আগে যখন ঊর্মির ঘুম আসতো না তখন বেশিরভাগ সময় অনন্ত বোনের তেল দিয়ে চুল টেনে দিতো। বাবা-মায়ের ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছা করতো না তাই অনন্তই তেল দিয়ে দিতো এবং খুশি মনেই দিতো। আজও তাই হলো ঊর্মি মেঝেতে বসেছে আর অনন্ত খাটে।

অনন্ত : অনেক দিন পর তোর চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছি। জানিস আমি আমার এই আপুটাকে খুব মিস করেছি। আচ্ছা আমাদের ভালোবাসার কি কোনো মূল্য নেই তোর কাছে? কম ভালোবাসি আমরা তোকে?
আমি : তোদের খুব কষ্ট দিয়েছি আমি তাই না?
অনন্ত : দিয়েছিস তো! আর এমন করবি না।
আমি : আর করবো না।

ওদের কথার মাঝেই আনিসুল সাহেব ঊর্মির রুমে প্রবেশ করেন সাথে মিসেস অন্তরাও আছেন।

আনিসুল সাহেব : কি গল্প হচ্ছে দুই ভাই-বোনের মধ্যে?
মিসেস অন্তরা : সারাদিন তো দুটোর মধ্যে ছোট বড় যুদ্ধ লেগেই থাকে।
আমি : আম্মু আমি কোথাও ঘুরতে যেতে চাই৷ এই চার দেয়ালের মাঝে বন্দী থাকতে থাকতে আমি হাপিয়ে গেছি।
আনিসুল সাহেব : আমি কালই সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি মা।
মিসেস অন্তরা : মা রে আর রাত জাগিস না এখন ঘুমো। আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

ঊর্মি মেঝে থেকে উঠে বিছানায় শুয়ে পড়ে আর মিসেস অন্তরা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, এক সময় ঊর্মিও ঘুমিয়ে পড়ে।

অন্যদিকে…….

নিবিড় : আমার অনেক আগেই উচিত ছিলো তোমাকে মনের কথা গুলো বলে দেওয়া। আমি আগেই যদি বলে দিতাম তাহলে তোমার আমার সম্পর্কটা কিছুটা সহজ হতো। আমি তোমার থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে গেলাম আর এতোসব ঘটে গেলো। যত যাই হয়ে যাক আমি আছি তোমার পাশে সবসময়, তোমাকে কখনো আমি একা হতে দেবো না (মনে মনে)

————————————

পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঊর্মির ঘুম ভেঙে যায়, শব্দটা বেলকনি থেকেই আসছে। ফোন স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি সাড়ে এগারোটা বাজতে চললো। এতো বেলা হয়ে গেলো তবুও কেউ ওকে ডেকে দিলো না, অবশ্য কিছুদিন ধরে এমনটাই হচ্ছে রাতে দেরি করে ঘুম আর সকালে দেরি করে ঘুম ভাঙা। ঊর্মি আড়মোড়া ভেঙে শোয়া থেকে উঠে বসলো, হেঁটে গেলো বেলকনির দিকে।

আমি : আম্মু! আম্মু! (চেচিয়ে)
মিসেস অন্তরা : কি হয়েছে চেচাচ্ছিস কেনো? (মেয়ের রুমে এসে)
আমি : এগুলো কি? কোথা থেকে আসলো (খাঁচাতে আটকে রাখা এক জোড়া লাভবার্ডস দেখিয়ে)
মিসেস অন্তরা : ওগুলো তো নিবিড় নিয়ে এসেছে তোর জন্য।
আমি : আমার জন্য?
মিসেস অন্তরা : হুম! (মুচকি হেসে)
রিয়া : এতো বেলা করে ঘুমোলে হবে? ওঠ আমরা আজ সারাদিন আড্ডা দেবো বিকেলে ঘুরতে বের হবো। (পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে রিয়া দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে)

দুই বান্ধুবী মিলে রুমের মধ্যেই আড্ডা দিয়েছে। দুপুরের খাবার খেয়ে দু’জনেই ড্রইং রুমে বসে হরর মুভি দেখেছে। দুজনেই খুব ভীতু প্রকৃতির তবুও হরর মুভি দেখবে, ভয়ংকর সিন দেখে একটু পরপরই দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার লাগায়।

মিসেস : এই তোরা চুপ করবি? এতোই যখন ভয় পাস তাহলে হরর মুভি দেখছিস কেনো? (নিজের রুম থেকেই চেচিয়ে বললেন কথাটা)

ওদের আর কি যতক্ষণ না মুভি শেষ হয়েছে ততক্ষণই এমন করে চেচিয়েছে। মুভি শেষ হতেই রিয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৪টা বাজতে চললো। তারপর দুজনে রুমে চলে আসলো। রিয়া আগে ওয়াশরুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে আসে।
আলমারি থেকে কালো গাউন নিয়ে ঊর্মিও ওয়াশরুমে দৌঁড় লাগায়। দুই বান্ধুবীই আজ কালো গাউন পড়েছে, রিয়া আসার সময় ওর পোশাক সাথে করে নিয়ে এসেছিলো। প্রায় ১০ পর ঊর্মি ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়, রিয়া একটা রিকশা নিয়ে দুজনে ভার্সিটির সামনে চলে যায়। সাহিল ফুচকার দোকানের সামনেই ছিলো। ওরা প্ল্যান করেছে আজ সারা বিকেল হাঁটবে, ফুচকা/আইসক্রিম খাবে, আড্ডা দেবে।

রিয়া : আমি সাহিলের কথা বাড়িতে বলে দিয়েছি, প্রথমে বাবা-মা একটু রাগ করেছিলো পরে ঠিক হয়ে গেছে।
আমি : এতো কিছু হয়ে গেলো আমি কিছুই জানি না?
সাহিল : তুই তো আমাদের কারো সাথে কোনো কথা বলতি না।
রিয়া : সাহিল আর আমি প্রতিদিনই তোদের বাড়িতে যেতাম। কয়েকদিন আগে আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিলো, আমি বিয়ে করবো না বলায় তারা কারণ জানতে চায় তখনই সাহিলের কথা বলি।

ওদের কথা মাঝেই নিবিড়ের গাড়ি এসে ওদের সামনেই দাঁড় করায়। মিসেস অন্তরা নিবিড়কে কল করে বলেছিলো ঊর্মি বাইরে বেড়িয়েছে, ঊর্মিকে সাথে করে নিয়ে যেনো বাড়িতে আসে। মিসেস অন্তরা চান নিবিড়ের সাথে যেনো ঊর্মি একটু সহজ হতে পারে, আর নিবিড়ও সাথে ঊর্মির সাথে সময় কাটাতে পারে।

নিবিড় : আমিও কি তোমাদের সাথে যোগ হতে পারি?
— আরে জি.. (রিয়া সাহিল একসঙ্গে)
রিয়া : অবশ্যই ভাইয়া।

ওরা দু’জনই জানে নিবিড় ঊর্মিকে পছন্দ করে, বিয়ের প্রস্তাব যে দেওয়া হয়েছে এই কথাটাও মিসেস অন্তরা ওদের বলেছে যাতে করে ওরা ঊর্মিকে বোঝাতে পারে বিষয়টা। আসলে প্ল্যানটা রিয়াই করেছিলো, এই জায়গাটার লোকেশন মিসেস অন্তরাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো কিছুক্ষণ আগেই।
চারদিকে কাশফুলের ছড়াছড়ি পাশেই একটা নদী বয়ে যাচ্ছে, নদীর পাড়ে বেশ কিছু নৌকাও রয়েছে। রিয়া নিজের হাতে কয়েকটা কাশফুল নিয়ে ঊর্মিকে দিলো আর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো…..

রিয়া : আমরা সবাই এখন নৌকায় করে নদী ওপাড়ে যাবো।
আমি : না রে আমার ভালো লাগছে না।
সাহিল : তা বললে তো চলবে না, তুই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে কোনো কিছুতেই মন খারাপ করবি না। আগের মতোই হৈ-হুল্লোড় করবি।
আমি : ঠিক আছে!

দুটো নৌকা নিয়েছে ওরা, একটায় রিয়া-সাহিল আর একটায় ঊর্মি-নিবিড়। সারা বিকেল ওরা নৌকায় করে ঘুরলো এরই ফাঁকে নিবিড় ঊর্মির অগোচরে বেশ কয়েকটা ছবিও তুলেছে। ঊর্মির মনটা আর বেশ ফুরফুরে, আজ অনেক পর এভাবে মন খুলে আনন্দ করছে।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here