#তুমি_সূচনায়
#পর্ব-৯
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
দুটো নৌকা নিয়েছে ওরা, একটায় রিয়া-সাহিল আর একটায় ঊর্মি-নিবিড়। সারা বিকেল ওরা নৌকায় করে ঘুরলো এরই ফাঁকে নিবিড় ঊর্মির অগোচরে বেশ কয়েকটা ছবিও তুলেছে। ঊর্মির মনটা এখন বেশ ফুরফুরে, আজ অনেক দিন পর এভাবে মন খুলে আনন্দ করছে। মাঝি নৌকা চালাচ্ছে। সাহিল মোবাইল বের করে রিয়ার ছবি তুলছে সাথে ভিডিও করছে, মাঝে মাঝে ঊর্মি আর নিবিড়ের ছবি তুলছে চুপিসারে যাতে আজকের এই মুহুর্তটা স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতে পারে।
আমি : ভাইয়া একটা গান শোনাবেন? আমি জানি আমি খুব ভালো গান জানেন।
নিবিড় : শ্যামা’বতী যখন বলেছে তখন তো শোনাতেই হয়!
–
ওহে কি করিলে বলো পাইবো তোমারে রাখিবো আঁখিতে আঁখিতে (2x)
ওহে এতো প্রেম আমি কোথা পাবোনা (2x)
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে….
আর সাধ্য কি বা তোমারে, দয়া না করিলে কে পারে
তুমি না এলে কে পারে, বিরহে রাখিতে…
মাঝে মাঝে তব দেখা চিরদিনই কেনো পাই না (2x)
–
বিকেল অবধি আকাশটা পরিষ্কার ছিলো কোথাও কোনো মেঘের আনাগোনা ছিলো না। সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে কোত্থেকে দমকা বাতাস বইতে লাগলো তার কিছু সময়ের মাঝেই তুমুল বৃষ্টি নামা শুরু হয়ে গেলো। সাহিল আর রিয়াকে নিবিড় আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। ভেবেছিলো ঊর্মিকে সাথে নিয়ে বাকি রাস্তাটুকু হেটেই যাবে। আশেপাশে কোনো রিকশা যাচ্ছে না তাই ওরা একটা দোকানের ছাওনির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। ঊর্মি তেমন না ভিজলেও নিবিড় ভিজেছে বেশ খানিকটা।
নিবিড় : ছাতা বিহীন কোনো বর্ষার সন্ধ্যায় তোমার সাথে হাঁটতে চাই, যেথায় বিরাজ করবে একরাশ মুগ্ধতা। আশেপাশের কোনো দোকানপাট খোলা থাকবে না আর না থাকবে কোন যানবাহন। আজ আমার সেই ইচ্ছেটুকু পূরণ হয়ে গেলো।
ঊর্মি কোনো কথা বলছে না নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। দোকানের সামনের ছাওনিটা সরু হওয়ায় ঊর্মি আর নিবিড় বেশ কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। মেঘ কিছুটা থেমে গিয়েছে তবুও ঝিরিঝিরি পড়ছে।
নিবিড় : বৃষ্টি থেমেছে কিছুটা চলো এখন আমাদের বাড়ির যাওয়া উচিত না-হয় আবার জোরে নামতে পারে।
আমি : হুম!
এরপর দু’জন বাড়ি চলে এলো। ঊর্মিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিবিড় বাসায় চলে যাবে এমন সময় আবার তুমুল বৃষ্টি নামা শুরু হয়েছে তাই আজ রাত’টুকু নিবিড় ঊর্মিদের বাড়িতেই থাকবে। নিবিড় বাড়িতে ফোন করে মিসেস অহনাকে জানিয়ে দিয়েছে। রাতের দিকে নিবিড় না খেয়েই শুয়ে ছিলো, মিসেস অন্তরা নিবিড়কে খাবারের জন্য ডাকতে এসে দেখে সে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। মিসেস অন্তরা নিবিড়ের কপালে হাত দিয়ে দেখে ছেলেটার শরীর ভীষণ তাপ হয়তো জ্বর এসেছে। ঊর্মিকে ডেকে নিবিড়ের খাবারটা উনি ঘরে আনিয়ে খাইয়ে দিলেন সাথে ঔষধও। নিবিড়ের সাথে অনন্ত শুয়েছে যাতে রাতে কোনো সমস্যা না হয়।
————————————
আজ সকাল সকাল ঊর্মির ঘুম ভেঙে যায়। বিছানার ছেড়ে উঠেই ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে বের হতে ঊর্মির মনে হলো একবার নিবিড়কে দেখে আসা উচিত জ্বর কমেছে কি-না। যে ভাবা সেই কাজ নিবিড় যেই রুমটাতে শুয়েছে সেখানে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো নিবিড় এখনো ঘুমোচ্ছে। অনন্তর সকালে কোচিং আছে তাই সে উঠেই ফ্রেশ হতে চলে গেলো নিজের রুমে। ঊর্মি নিবিড়ের কাছে গিয়ে ওর কপাল স্পর্শ করলো ‘না এখনো জ্বর নেই শরীরের তাপমাত্রা ঠিকই রয়েছে। ঊর্মি সোজা রান্নাঘরে চলে আসে, মিসেস অন্তরা সকালের নাস্তা তৈরি করছে।
মিসেস অন্তরা : আজ সূর্য কোন দিকে উঠলো? এতো তাড়াতাড়ি তো তুই ঘুম থেকে উঠিস না!
আমি : ঘুম ভেঙে গেছে। আম্মু আমি কফি বানাই?
মিসেস : হুম!
সবাই একসাথেই খাবারের টেবিলে বসেছে। নিবিড় একেবারে তৈরি হয়েই বেরিয়েছে, এখান থেকে সোজা অফিসে চলে যাবে। মিসেস অন্তরা বেশ কয়েকবার বলেছে আজ সারাদিন এখানেই বিশ্রাম নিতে, গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে বিধায় নিবিড়কে যেতে হচ্ছে।
আনিসুল সাহেব : নিবিড় বাবা তোমার জ্বর কমেছে?
নিবিড় : হ্যাঁ খালুমণি এখন জ্বর নেই।
নাস্তা সেরেই নিবিড় আর আনিসুল সাহেব দু’জনেই অফিসে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পরে। মিসেস অন্তরা টেবিলের গ্লাস/প্লেট গুলো গুছিয়ে রাখছিলেন তখন ঊর্মি বলে….
আমি : আম্মু আজকে আমি দুপুরে রান্না করে চাই।
মিসেস অন্তরা : আজ আমার মেয়ে রান্না করবে তা তো বেশ ভালো কথা।
আমি : হুম।
বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে ঊর্মি আধো শোয়া হয়ে ফেসবুক স্ক্রলিং করছিলো এমন সময় গার্লস গ্রুপে তানভীর আর আরুহিকে নিয়ে একটা পোস্ট দেখে। একটা মেয়ে পোস্ট করেছে ‘ক্রাশও যেমন সুদর্শন তার বউও তেমন সুন্দরী। Made for each other’ এতোক্ষণ ফুরফুরে থাকা মনটা পোস্টটা দেখা মাত্র খারাপ হয়ে গেলো, সে চায় তানভীরকে ভুলে যেতে।
আমি : আমাদের এই দুরত্বটা জানে একদিন আমরা কাছে পাশে ছিলাম।
মিসেস অন্তরার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ঊর্মি, হঠাৎ করে আসা বিষন্নতায় তার রান্না করার ইচ্ছেটাই মাটি হয়ে গেছে। মিসেস অন্তরার রুমে থেকে ফোনে কথা বলার আওয়াজ আসছে।
মিসেস অন্তরা : জানো ঊর্মির আব্বু আজ তোনার মেয়ে বলেছে নিজের হাতে রান্না করবে৷ আমার মেয়েটা আবার হাসিখুশি হয়েছে শুধুমাত্র নিবিড়ের জন্য। তুমি দুপুরে তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে এসো।
ঊর্মি আর এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের রুমে চলে আসে। বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে মনে মনে ভাবে….
আমি : এই মানুষ গুলোর জন্য হলেও আমি মন খারাপ করবো না। তানভীর শুধুমাত্র আমার অতীত, ওকে ভুলে গিয়ে আমাকে আমার বাবা-মা, ভাইয়ের জন্য হলেও হাসিখুশি থাকতে হবে।
————————————
ডাইনিং টেবিলে ঊর্মি সব খাবার একে একে সাজিয়ে রাখছে। চিকেন বিরিয়ানি, গরুর মাংসের রেজালা রান্না করেছে। মিসেস অন্তরা, আনিসুল সাহেব, ঊর্মি, অনন্ত সবাই একসাথেই খেতে বসেছে। আনিসুল সাহেব মেয়ের রান্নার তারিফ করতে লাগলেন….
আনিসুল সাহেব : আমার মা কত সুস্বাদু খাবার রান্না করেছে। পেটের সাথে খুশিতে আমার মনও ভরে গেছে।
অনন্ত : আমি রান্না করলে এর থেকেও বেশি সুস্বাদু হবে। তোমরা একটু বেশি বেশি তারিফ করছো একটুও সুস্বাদু হয়নি খাবার গুলো।
আমি : তাহলে খাচ্ছিস কেনো? যা না যা নিজে রান্না করে খা বেয়াদব ছেলে।
অনন্ত : একশো বার খাবো হাজার বার খাবো তোর কি? আমি আমার বোনের হাতের রান্না খাচ্ছি।
মিসেস অন্তরা : তোরা আবার শুরু করেছিস?
অনন্ত : আমাদের বাজে স্বভাব কোনো দিন যাবে না!
মিসেস অন্তরা : আমাদের ভাই বোনদের মাঝে কি মিল ছিলো আর তোরা সারাদিন দু’টোতে লেগেই থাকিস। না আছে মিল না আছে মোহাব্বত।
অন্যদিকে……
নিবিড় নিজের কেবিনে বলে কাজ করছিলো এমন সময় কেউ দরজায় নক করে। নিবিড় দরজার দিকে তাকাতেই দেখে নাজিফা টিফিন বক্স নিয়ে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
নিবিড় : দাঁড়িয়ে আছিস কেনো ভেতরে আয় আর এগুলো কি?
নাজিফা : ভাইয়া আমি আজ তোমার জন্য রান্না করে নিয়ে আসছি।
নিবিড় : তোকে কষ্ট করে এখানে আসতে কে বলেছে? আমাকে বললেই তো আমি বাড়িতে চলে আসতাম। আব্বু-আম্মু খেয়েছে? তুই খেয়েছিস?
নাজিফা : হুম! তোমার শরীর এখন কেমন আছে ভাইয়া? আর জ্বর আসলো কি করে?
নিবিড় : আমার শরীর ভালোই আছে। কাল সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিলাম।
নাজিফা : আচ্ছা তুমি হাত ধুয়ে এসো আমি সার্ভ করে দিচ্ছি।
নিবিড় : হুম!
কিছুক্ষণ পরই নিবিড় হাত ধুয়ে বোনের রান্না করা খাবার গুলো খেয়ে নেয়। ছোট বেলা থেকেই নাজিফা নিবিড়ের খুব আদরের। নাজিফা ভাই বলতে পাগল, শান্ত স্বভাবের নিবিড়কে বরাবরই নাজিফা সবার থেকে বেশি ভয় পায়। নিবিড় খুব যত্নে বোনকে ছোট থেকেই আগলে রেখেছে।
————————————-
আজ শুক্রবার রিয়ার বাবা-মা আজ ঊর্মিদের বাড়িতে এসেছে রিয়া আর সাহিলের বিয়া দিন-তারিখ ঠিক করতে। যেহেতু সাহিলের বাবা-মা কেউ নেই আর আনিসুল সাহেবই সাহিলের বর্তমান অবিভাবক তাই সব কথাবার্তা এই বাড়িতেই হচ্ছে।
বড়রা সবাই মিলে ঠিক করেছে আর ১৫ দিন বাদে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। বিয়ে, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান আর রিসেপশন সেন্টারেই হবে। ঊর্মি খুবই এক্সাইটেড তার বেস্টফ্রেন্ডস দের বিয়ে বলে কথা। কাল থেকেই বিয়ের শপিং করা শুরু করে দিবে সবাই।
পরের দিন…..
সবাই মিলে শপিং মলে এসেছে বিয়ের শপিং করতে। রিয়ার পরিবার, ঊর্মির পরিবার, নিবিড়ের পরিবারও আছে সাথে। সাহিল আর রিয়ার বিয়ে, গায়ে হলুদ, মেহেন্দি, রিসেপশনের সবকিছুই প্রায় কেনা হয়ে গেছে, গহনাও কেনা কমপ্লিট। বাকিরা নিজেদের জন্য টুকিটাকি শাড়ি, ড্রেস দেখছে।
নাজিফা মেহেন্দি আর বিয়ের দিনের জন্য দুটো লেহেঙ্গা নিয়েছে, গায়ে হলুদের জন্য শাড়ি আর রিসেশনের জন্য গাউন। ঊর্মি গায়ের হলুদের জন্য শাড়ি আর রিসেশনে পড়ার জন্য বেবি পিংক কালার গাউন নিয়েছে সাথে অর্নামেন্টস। বিয়ের আর মেহেন্দির জন্য লেহেঙ্গা দেখছিলো এমন সময় নিবিড় দুটো ব্যাগ এনে ঊর্মির হাতে ধরিয়ে দেয়
নিবিড় : বিয়ের দিন তুমি মেরুন রঙের লেহেঙ্গাটা পড়বে আর মেহেন্দি অনুষ্ঠানে জলপাই রঙের লেহেঙ্গাটা পড়বে সাথে অর্নামেন্টস রয়েছে ব্যাগে।
আমি : আপনি শুধু শুধু…..
নিবিড় : No more words.
চলবে?….