তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী,পর্ব-০৬,০৭

0
1252

তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী,পর্ব-০৬,০৭
লাবিবা_ওয়াহিদ
পর্ব ০৬

বিকালের দিকে ফারিশ বাড়ি ফিরলো। বাড়ি ফিরে সোজা সানামের ঘরে ঢুকলো। সানাম তখন বেলকনি থেকে শুকনো জামাকাপড় নিয়ে রুমে ঢুকছিলো। ফারিশ সানামকে দেখতেই সানামকে বললো,

-“তোমার জন্য একটা টিউশনি পেয়েছি। আমাদের এপার্টমেন্টের ৫ম ফ্লোরের ৫.০২ নং ইউনিটে কাল বিকালে অথবা সন্ধ্যায় পড়িয়ে দিয়ে আসবে। স্টুডেন্ট ক্লাস সেভেনের। মেয়ে। তোমার কোনো সমস্যা হবে না তো? আর সেলারি কতো দিবে সেটা তুমি নিজেই বুঝে নিও তার থেকে।”

টিউশনির কথা শুনে সানামের খুশি দেখে কে। সে হাসিমুখে ফারিশকে একটা ধন্যবাদ জানালো। ফারিশ মুচকি হেসে সানামের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। সানাম খুশিতে পারে না লাফ দিতে। হঠাৎ তার মনে হলো, একটা টিউশনিতে তার কী হবে? তার তো আরও টিউশনি প্রয়োজন। ভাবতেই সানাম মুখটা বেজার করে ফেলে। পরমুহূর্তে ভাবলো টিউশনি খোঁজা মুখের কথা না, এই দুইদিনে যে একটা পেয়েছে তাতেই অনেক। আস্তে আস্তে ইনশাল্লাহ আরও আসবে। ভেবেই সানাম ঠোঁট দুটি প্রসারিত করলো।
এমন সময়ই অন্তু সানামের রুমে প্রবেশ করলো।

-“সানাম কি করছো?”

সানাম চমকে পিছে ফিরে দেখে অন্তু আন্টি। সানাম ঠোঁটে বিনয়ের হাসি হেসে বলে,

-“তেমন কিছু না আন্টি। আসুন, বসুন।”

-“না, না। আমি ঠিক আছি। জানো বড্ড বরিং ফিল হচ্ছে। ফারিশের বাবা তো তার বন্ধুদের সাথে টঙে আড্ডা দিতে গেলো, মাও ঘুমোচ্ছে। কি করা যায় বলো তো একা একা?”

-“একা কোথায় আন্টি আমি তো আছি।” মুচকি হেসে বললো সানাম। সানামের হাসির সাথে তাল মিলিয়ে অন্তু আন্টি বললেন,

-“তা অবশ্য ঠিক। ও হ্যাঁ মনে পরেছে। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের ভাবী আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলো সকালে কিন্তু কাজের চাপে ভুলে গেছি। এখন চলো তার বাসায় যাই, সাথে তুমিও আসো। জানো ভাবীর খুব মিষ্টি একটা মেয়ে আছে। নাম রুবা। তুমি চাইলে তার সাথে মিশতে পারো।”

-“ঠিক আছে আন্টি। আমি আপনার সাথে যাবো।”

-“তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো আমি মাকে একটু দেখে আসছি।”

বলেই অন্তু আন্টি বেরিয়ে গেলো। সানামের পানি পিপাসা পাওয়ায় সেও বেরিয়ে চলে গেলো কিচেনের দিকে। ফারিশের রুম ক্রস করতেই ফারিশ দরজার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠলো,

-“মা এক কাপ কফি দিও তো। শরীরটা বেশ ম্যাজম্যাজ করছে।”

ফারিশের কথায় সানাম দাঁড়িয়ে গেলো। অতঃপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখে অন্তু আন্টি নেই। তাই সানামই গেলো ফারিশের জন্য কফি করতে। যেহেতু ফারিশ তাকে একটা টিউশনি খুঁজে দিয়েছে সেহেতু এইটুকু সানাম ফারিশের জন্য করতেই পারে। কফি বানাতে গিয়ে সানাম কিছুটা চিন্তায় পরে গেলো। ফারিশ কফি কেমন খায় সানাম তা জানে না। কফিতে চিনি দিবে নাকি দিবে এ নিয়ে সানামের কনফিউশান। তখনই তার ফারিশের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। সানাম আন্তাজে সিদ্ধান্ত নিলো চিনি দিবে। তাক থেকে চিনির বোয়াম নিতে গিয়ে ভুলবশত লবণের বোয়াম নিলো সানাম। ৩ চা চামচ দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে দেয়। সানাম হাসিমুখে কফি আর কিছু বিস্কিট ট্রে-তে করে নিয়ে ফারিশের ঘরের দিকে চলে গেলো। এদিকে সানাম ধারণাও করতে পারছে না সে ঠিক কি করেছে। ফারিশের দরজায় নক করতেই ফারিশ কাবার্ড থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। সানামের হাতে ট্রে দেখে ফারিশ কিছুটা অবাক হলো। তার বিস্ময় প্রকাশ না করে স্বাভাবিকভাবেই বললো,

-“তুমি?”

-“হু আমি…” বলেই সানাম ট্রে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। অতঃপর ট্রে-টা সেন্টার-টেবিলে রেখে সানাম বললো,

-“আন্টি আপনার নানীর ঘরে। তাই ভাবলাম আমি-ই আপনাকে কফি বানিয়ে দেই।”

তখনই অন্তু আন্টি বাইরে থেকে সানামকে ডাকলো। সানাম “যাচ্ছি” বলে চলে গেলো। ফারিশ সানামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। অতঃপর মিনমিন করে বললো,

-“যাক মেয়েটা বকবক ছাড়াও কাজ পারে। উফফ, কি সুন্দর করে কফিতে ধোঁয়া উড়ছে।”

বলতেই ফারিশ চেয়ার টেনে বসলো। কফির মগ নিয়ে কফিতে ফুঁ দিয়ে চুমুক দিতেই সবটা ফ্রুত করে ফেলে দিলো।

-“ইয়াক! এটা কফি নাকি তিতা করলা। ছিঃ! এ তো আমাকে মারার জন্য লবণ নামক বিষ ঢেলে দিয়ে গেছে। আসলেই মেয়েটা ফালতু ধুর,ধুর! মুডটাই নষ্ট করে দিলো। ”

বিরক্তি নিয়ে বললো ফারিশ। কফির মগ সাথে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে বেসিনে সবটা কফি ফেলে দিলো। অতঃপর কল ছেড়ে মগটায় পানি নিয়ে আবারও সেগুলা ফেললো। এতে মগটাও পরিষ্কার হলো, বেসিনটাও। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে কফির মগটা কিচেনে রেখে আবারও রুমে ফিরলো। রুমে এসে ট্রের বিস্কিটগুলা দেখে ফারিশের খুদা পেলো। তাই সে আবার গিয়ে চেয়ারে বসে বিস্কিট খাওয়া শুরু করলো।

-“এই মেয়েটা কে ভাবী?”

সানাম মহিলার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো। হঠাৎ তার লজ্জা লাগতে শুরু হলো। অন্তু আন্টিদের বাসায় কী পরিচয় তার? আশ্রিতা? কোন মুখে অন্যদের বলবে সানাম? তার তো একটাই পরিচয়, সে এতিম। নাহ সানাম তো তাদের আশ্রিতা নয়, ফারিশ তো বলেছেই তার ঘরের ভাড়া মেটাতে। তাহলে কী ভাড়াটিয়া? সানামের এমন নানান কথা মাথায় ঘুরপাক করছে। সানামের ভাবনার অবসান ঘটিয়ে অন্তু আন্টি বলে উঠলো,

-“আরে না ভাবী, ও আমার বড় বোনের মেয়ে। বুঝেনই তো তারা শহরের বাইরে থাকে। তাদের অনেক ইচ্ছা তাদের মেয়ে শহরের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তাই আর কী আমার এখানে থেকেই পড়াশোনা করবে।”

অন্তু আন্টির কথায় সানাম একবার অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। অতঃপর নিজেও ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রাখলো। মহিলা বিনয়ের সুরে বলে,

-“ভারী সুন্দর মেয়েটা। ফারিশকে চোখে চোখে রাখিয়েন, এমন রমনীদের দেখলে ওদের মতো জুয়ান ছেলেদের তো আবার মাথা ঠিক থাকে না।”

মহিলার কথায় মহিলা এবং অন্তু আন্টি অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। এদিকে সানাম বিষম খেলো। ফারিশ কেমন ছেলে সে ভালো করেই জানে। ফারিশ তো কখনো তাকে অসম্মান করে কথা বলেনি। আর অন্তু আন্টিও-বা কেমন? তার সামনে তারই ছেলেকে খোঁচা করে এতোবড় কথা বললো আর তিনি হাসছেন? এসবই মনে মনে ভেবে চলেছে সানাম। অন্তু আন্টি হাসি থামিয়ে বলে,

-“তুমি কিছু মনে করো না সানাম। ভাবী বরাবরই রসিক মানুষ। তার মুখে অনেক কিছুই শুনেছি বুঝলে?”

সানাম হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়ালো। তারা দুজন বেশ কিছুক্ষণ কথা বললো। অতঃপর মহিলা আবারও কথায় কথায় বলে উঠলো,

-“তা ভাবী ফারিশের বিয়ে দিচ্ছেন কবে?”

-“ছেলেটা মাত্র চাকরি পেয়েচাকরি পেয়েছে। তাই আপাতত বিয়ে নিয়ে ওকে চাপ দিচ্ছি না। আস্তে আস্তে নিজের কাজ বুঝুক, নিজেকে সময় দিক। তারপরই বিয়ে নিয়ে ভাবা যাবে।”

-“কেন আপনার ছেলে কী বিয়ের কথা বলে না?”

-“আরে না। সে তো সবসময় এক কথাই বলবে। আগে নিজের ফ্যামিলি সামলাবে তারপর বিয়ে করবে। আমি আমার ছেলের মতামতকে যথেষ্ট সাপোর্ট করি। আমার বিশ্বাস আমার ছেলে নিজেকে ভালোভাবেই গড়ে তুলবে।”

সানাম মুগ্ধ হয়ে অন্তু আন্টির দিকে তাকিয়ে আছে। মায়েরা বুঝি এমনই হয়। ফারিশ কতো লাকি যে এমন একজন মা পেয়েছে। আচ্ছা আমার মা কী আছে? থাকলে কী সে আমাকে মনে করে? সানামের চোখে কোণ ভিজে গেলে সে নিজেকে সামলে নিলো। তখনই সদর দরজা দিয়ে একটা ছোট মেয়ে ভোঁ দৌড় দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। আন্টি চেঁচিয়ে বলে,

-“আরে সাবধানে যা মা, পরে যাবি তো। আর হ্যাঁ ওয়াশরুম গিয়ে ভালো করে হাত-পা, মুখ ধুঁয়ে নিবে আম্মুনি। এতে করে তুমি জীবানু মুক্ত হবে।”

ছোট্ট মেয়েটির পক্ষ হতে কোনো উত্তর এলো না। মহিলা নিরাশ হয়ে বলে,

-“এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না ভাবী। মেয়েটা আমার কোনো কথাই শুনবে না। সারাদিন ফোন, গেম, বল এগুলা নিয়ে পরে থাকবে। পড়তে তো বসাতেই পারি না। যে ক’জন হোম টিউটর রেখেছি একজনও এই মেয়েটার জ্বালায় টিকতে পারিনি। কি যে করবো মেয়েটাকে নিয়ে।”

-“আরে কিছু হবে না। বড় হতে হতে স্বভাব চেঞ্জ হয়ে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না ভাবী।” মুচকি হেসে উত্তর দিলো অন্তু আন্টি। সানামের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। তাই সে বিনা সংকোচে বলে উঠে,

-“আন্টি, আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে আমি আপনার মেয়ের হোম টিউটর হতে চাই।”

মহিলাটি যেন সন্তুষ্ট হলেন। অতঃপর খুশি হয়ে বললো,

-“তুমি পারবে সানাম?”

-“জ্বী আন্টি ইনশাল্লাহ।”
-“তাহলে প্রতিদিন সকাল ৭টায় চলে এসো। সাড়ে আটটা থেকে ওর স্কুল তাই সকাল সকাল পড়তে রুবারই সুবিধা হবে। তুমি রাজি তো?”

-“জ্বী আন্টি, আমি রাজি।” মুচকি হেসে বললো সানাম। সানাম আজ একটু বেশিই খুশি। দুই-দুইটা টিউশনি পেয়ে গেছে সে। আর কী লাগে? ভেবেই আবারও মুচকি হাসলো সে।

চলবে

#তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৭ ||

ব্যাগ নিয়ে রেডি হলো সানাম, ভার্সিটির জন্য। এই পর্যন্ত কয়েকবার আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়েছে সে। ফারিশ সানামের ঘরে সানামকে ডাকতে এসে দেখলো সানাম একটু পরপরই গিয়ে আয়না দেখছে। ফারিশ বেশ কিছুক্ষণ সানামের কান্ড দেখলো। অতঃপর বিরক্তির সাথে বললো,

-“নিজেকে দেখা শেষ হলে এখন কী আমরা যেতে পারি?”

ফারিশের কন্ঠ শুনে সানাম কিছুতা অপ্রস্তুত হয়ে পিছে ফিরে দাঁড়ালো। আমতা আমতা করে বললো,

-“মা..মানে?”

-“মানে বুঝো না? ১০১ আয়নার দেখার মানে কী? তুমি কী মডেলিং করতে যাচ্ছো নাকি ভার্সিটিতে পড়তে?”

-“আপনি বেশি বুঝেন! আমি তো জাস্ট ওই একটু নার্ভাস ছিলাম।” চোখ ছোট করে বললো।

-“নার্ভাস হলে যে এতোবার আয়না দেখতে হয়, তা তোমাকে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। নার্ভাস হলে আয়না দেখতে হয় আর কফিতে চিনির জায়গায় লবণ! হাউ ফানি!”

-“দেখেন আপনি কিন্তু কাল থেকে আমাকে এক কথা বলে বলে কান খাচ্ছেন। বললাম তো আমি ইচ্ছা করে কিছু করিনি। এক এক্সপ্লেইন দিতে দিতে আমি ক্লান্ত!”

-“হু বুঝেছি। এখন জলদি আসো। এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছো।”

বলেই ফারিশ বেশ বেরিয়ে গেলো। সানাম আল্লাহর নাম নিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার আগে ইকরাম ফরিদ এবং অন্তু আন্টির থেকে দোয়া চেয়ে বিদায় জানালো। এবার লিফটে সানামের তেমন সমস্যা হলো না।

ভার্সিটিতে পৌঁছে দেখলো সামি এবং সেজান একসাথে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সানামকে দেখতেই দুজনে সানগ্লাস খুলে বিনয়ের হাসি হেসে এগিয়ে আসলো। ফারিশ চোখে সানগ্লাস দিয়ে বাইক থেকে নামলো। কমবেশি সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সেজান সানামের সামনে এসে মুচকি হেসে বলে উঠলো,

-“হেই ইয়াং লেডি! হোয়াট’স আপ? চিনতে পেরেছো আমাদের?”

-“আপনাদের না চেনার কী আছে? যাইহোক আমার তাড়া আছে। ভালো থাকবেন আপনারা।”

বলেই সানাম দুজনকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। সামি এবং সেজান দুজনেই শকড সানামের এমন ব্যবহারে। ফারিশ তো ফিক করে হেসে দিলো।

-“বেস্ট রিপ্লাই করেছে। তোদের মতো দুই লোফারের জন্য এমন রিপ্লাই দেয়াই ব্যাটার।”

-“কেন আমরা কী করেছি?”

-“আমার ঘাড়ে বোঝা চাপিয়েছিস! এখন আমার তোদের ঘাড় ভাঙবো!”

-“দেখ ভাই আমরা তো জাস্ট তোর…” বলতেই সামির মুখ সেজান চেপে ধরলো। ফারিশ ভ্রু কুচকে বলে উঠলো,

-“কী হলো, তুই সামির মুখ চেপে ধরেছিস কেন?”

-“আরে কিছু না এমনি। সামি বেশি কথা বলে এই আর কি।” দাঁত কেলিয়ে বললো সেজান।

-“তোর এই দাঁত কেলানিতে বেশ বুঝতে পারছি তোদের মধ্যে গন্ডগোল আছে। দেখ সামি আমি তোরে লাস্ট অপশন দিচ্ছি! বলবি নাকি কেলানি খাবি?”

সামি, সেজান একে অপরের দিকে তাকালো। দুজনের চুপ থাকায় ফারিশ সামিকে জোরে এক চড় দিলো। অতঃপর সামি গালে হাত দিয়ে মুখ গোমড়া করে বললো,

-“আমরা তোর আর ওই মেয়েটার লাইন লাগানোর চেষ্টায় আছি, তাকে ভাবী হিসেবে আমরা সিলেক্ট করেছি, বাই!”

বলেই সামি, সেজান পগাড়পাড়! ফারিশ জুতা খুলতে যেয়েও পারলো না। এই দুই বান্দার উপর তার যে কি রাগ লাগছে সেটা একমাত্র ফারিশই উপলব্ধি করতে পারছে। হঠাৎ কারো চেঁচামেচির শব্দ কানে আসতেই ফারিশ দেখলো সানামকে কয়েকটা ছেলে ঘিরে ধরেছে। তাদের মাঝে একজনকে ফারিশ চিনতে পারলো আর ঠোঁটদুটি প্রসারিত করলো। অতঃপর পকেটে হাত গুজে সানামদের দিকে এগোতে লাগলো। ফারিশের পেছনে সামি এবং সেজানও আসছে।

-“আমার পথ ছাড়ুন! এটা কোন ধরণের অসভ্যতামি?” অনেকটা রেগে বললো সানাম।

-“কেন সেদিনের কথা ভুলে গেলে? সিনিয়রের মুখে মুখে কথা বলেছো। তাই আজ তোমার শাস্তি পাওনা আছে।”

-“আমি এখানে এসেছি পড়তে, আপনাদের পকপকানি শুনতে নয়। যেখানে স্যারদের সাথেই পরিচিত হলাম না সেখানে খাম্বার মতো আমার পথে দাঁড়িয়ে তখন থেকে সিনিয়র সিনিয়র করেই চলেছেন! এমন ভাব ধরছেন যেন কোন মন্ত্রী-মিনিস্টার আসছেন!”

সানামের কথায় সন্ধি অত্যন্ত রেগে গেলো। রাগ দমাতে না পেরে যেই সানামকে চড় মারবে তখনই ফারিশ এসে সন্ধির হাত ধরে ফেললো। সানাম এক মুহূর্তের জন্য চোখ বুজে ছিলো। যখন দেখলো সন্ধির হাত তার গাল স্পর্শ করেনি তৎক্ষনাৎ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলো ফারিশ বরাবরের মতো এবারও তাকে বাঁচালো। সানাম চুপ মেরে ফারিশের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফারিশ হেসে সন্ধির হাত ছেড়ে হেসে বললো,

-“হোয়াট’স আপ সন্ধি! কী করা হচ্ছে এখানে?”

পাশ থেকে সন্ধির বন্ধু বলে উঠে,
-“দেখেন ফারিশ ভাই এখানে আমাদের র‍্যাগিং চলছে তাই আপনি সাইডে যান, আপনার এই ভার্সিটিতে কোনো কাজ নেই।”

ছেলেটির বলতে দেরী কিন্তু সামির থাপ্পড় মারতে দেরী নেই। সামির থাপ্পড়ে ছেলেটা মুখে তালা লাগিয়ে ফেলে। ফারিশ হেসে ফেললো ছেলেটির কথায়। অতঃপর সে আবারও বললো,

-“সন্ধি, আই থিংক আমার তোমাদের মনে করিয়ে দিতে হবে আমি তোমাদের কী ধরণের র‍্যাগিং করেছি?”

সানাম ফারিশের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। মনে মনে ভাবলো, ফারিশ কী এই ভার্সিটিরই স্টুডেন্ট? ফারিশের কথার মাঝেই সেজান বলে উঠলো,

-“আরে বলা জরুরি ব্রোহ! সে আমাদের সামনে আরেকজনকে র‍্যাগিং করার চেষ্টা করছে। যারা বর্তমান জুনিয়র তারাও জানুক এই সিনিয়র নামক মানুষগুলা আমাদের থেকে কেমন র‍্যাগিং উপহার পেয়েছে।” সন্ধিসহ সকলেই মাথা নিচু করে ফেললো লজ্জায়। এই সময়ে সিনিয়র হয়ে নিজেদের র‍্যাগিংয়ের ঘটনা সকলের মধ্যে জানাজানি হলে ইজ্জত এক চুলও থাকবে না। অতঃপর সন্ধি নরম সুরে বলে উঠলো,

-“সরি ভাই, আর কোনোদিন মেয়েটাকে ডিস্টার্ব করবো না।”

-“আপু বলেও ডাকবি। বোন হিসেবে তার প্রয়োজনে সাহায্য করবি। নয়তো জানিস তো আমরা কী জিনিস? ভার্সিটি ছেড়েছি বাট কেরেক্টার চেঞ্জ হয়নি” ফারিশ বললো। ফারিশের উত্তরে সন্ধি শুধু মাথা নাড়ালো। ফারিশ সানামের দিকে ফিরে কঠিন গলায় বলে,

-“ক্লাসে যাও।” তখনই সন্ধির এক বন্ধু বলে উঠলো,

-“আপু আপনি কোন ডিপার্টমেন্টের বলুন, আমি নিজে গিয়ে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।”

-“এইতো গুড বয়। ওকে সানাম, যাও। আমরাও আসছি।” সেজান বলে উঠে।

সানাম উত্তরে শুধু মাথা নাড়ায়। ছেলেটা যেতে যেতে সানামের ডিপার্টমেন্ট জেনে নিলো। অতঃপর কথার ফাঁকে বলে উঠলো,

-“ফারিশ ভাই আপনার কে হয়?”

ছেলেটার কথায় এক মুহূর্তের জন্য সানাম থমকে গেলো। সে বন্ধু বলতে গিয়েও কেন যেন পারছে না। নিজের সাথে যুদ্ধ করেও হারমেনে নিলো সানাম। বলতে পারলো না প্রশ্নটির উত্তর। সানাম উত্তর না দেয়ায় ছেলেটিও আর প্রশ্ন করলো না ভয়ে। ছেলেটি সানামকে তার ক্লাসরুম দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলো। সানাম ক্লাসে গিয়ে একটা মেয়ের পাশে বসলো। সানাম বসতেই মেয়েটা তার সাথে কথা বলা শুরু করে দিলো। মেয়েটা খুব মিশুক প্রকৃতির, নাম তার ইতি। ইতির সাথে সানামও বেশ মিশে গেলো। এমন বান্ধুবি-ই তো সে চেয়েছিলো। একে একে ক্লাস হলো। ক্লাস শেষ হতেই দুজন মিলে ক্যান্টিনে চলে গেলো।

-“তুমি কিছু মনে করো না সানাম। আসলে না খেয়ে এসেছি তো তাই আর কী তোমাকে নিয়েই ক্যান্টিন আসলাম।”

-“আরে না না, সমস্যা নেই। তোমার সাথে থাকতে আমার খারাপ লাগবে না।” মুচকি হেসে বললো সানাম। সানামের উত্তরে ইতিও মুচকি হাসি উপহার দিলো। সানাম এবং ইতি এক টেবিলে বসে বকবক করছিলো তখনই সন্ধি এসে সানামের সামনে দাঁড়ালো। সানাম এবং ইতি দুজনই ভ্রু কুচকে সন্ধির দিকে তাকালো।

-“তোমার নাম সানাম রাইট?”

-“হু কেন?”

-“আসলে, আই এম সরি। আমার উচিত হয়নি তোমার সাথে ওভাবে কথা বলার। আমি জানতাম না তুমি ফারিশ ভাইয়ের ক্লোজ।”

-“ইট’স ওকে।” বলেই সানাম সন্ধির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। সন্ধি আরও কিছু বলতে গিয়েও বললো না কারণ, সানাম তার বিষয়ে আগ্রহী নয়। সানামের পাত্তা না দেয়া সন্ধির ইগোতে লাগলো। তাও নিজের মান-সম্মান খোয়ানোর ভয়ে কিছু বললো না। সেই স্থান দ্রুতই ত্যাগ করলো। সন্ধি যেতেই ইতি বলে উঠলো,

-“বাহ বোন, তোমার ভার্সিটির প্রথমদিনেই সন্ধি ভাইরে হাত করে নিলা? তোমায় সরি বললো সে ওয়াও!”

-“সন্ধি কে? ”

-“আরে বাবা, যে তোমায় সরি বলে গেলো তাকে তুমি চিনো না? অদ্ভুত ব্যাপার তো। তবে যাই বলো সন্ধি ভাই দেখতে বেশ কিউট, তাই না বলো?”

সানাম এতক্ষণে বুঝলো এই সন্ধি কে। অতঃপর ইতির কথাগুলো শুনে সানাম মনে মনে বলল,

-“এই সন্ধি যে তার সৌন্দর্যের এক অংশও নয়। আমার কল্পনা যে একমাত্র সে-ই।”

-“এই সানাম, কোথায় হারিয়ে গেলে?”

-“হু… না কিছু না। তোমার খাবার শেষ হলে চলো ক্লাসে যাই!”

-“হ্যাঁ চলো।”

কিছুক্ষণের মাঝেই দুজন “তুমি” থেকে “তুই” তে চলে গেলো। তাদের বন্ধুত্ব কিছুটা ঘনিষ্ঠ হলো। ইতি এমনই একটা মেয়ে, যার সাথে কথা না বলে থাকা যায় না। শেষ পিরিয়ডে এক ম্যাম এসে জানালো তাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠান হবে আগামী পরশু। এই কথা শুনে ইতি তো এক লাফ দিলো। আর সানাম মুখটা বেজার করে রাখলো।

ক্লাস শেষে ভার্সিটি থেকে বের হতেই দেখলো ভার্সিটির একপাশে ডেকোরেশনের কাজ চলছে। নিশ্চয়ই প্রোগ্রামের আয়োজন আজ থেকেই শুরু হয়েছে। ভার্সিটির গেট থেকেই সানাম একটা রিকশা নিয়ে চলে আসলো বাসায়। ফারিশই বলেছে তাকে এভাবে চলে আসতে। এদিকে ফারিশ অফিস গিয়ে বেশ অনেক নতুন মুখ দেখলো। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কুলফি। নামটা বড়োই অদ্ভুত তার। তবে তার নামটা ঠান্ডা হলেও মানুষটা শয়তানিতে মাস্টার, যে কিনা সকলকে চা, কফি পরিবেশন করে। কেউ যদি তাকে বকা দেয় অথবা তার নামে কটুকথা বলে তাহলে সে তার চা, কফিতে কুলফির জুতার কিছুটা বালি মিশিয়ে দেয়। এমন নিখুঁতভাবে সে কাজটা করে যে কেউ টের অবধি পায় না। ফারিশ কিচেনের পাশ কেটে যাওয়ার সময়ই এই কুলফির অকাজ দেখে ফেললো। কুলফি দাঁত কেলিয়ে ভালোভাবে চা এ মিশিয়ে কিচেন হতে বের হতেই দেখলো ফারিশ তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ফারিশকে এভাবে তাকাতে দেখে কুলফি বলে উঠে,

-“কী গো সাহেব? এমনে তাকায় রইসেন কেন?”

-“কিছুক্ষণ আগে এ তুমি কি করলে কুলফি?”

কুলফি জিবহা কাটলো। অতঃপর নরম সুরে বললো,

-“এডা আমি সারাজীবনই করি সাহেব। তবে আপনি চিন্তা করবেন না, আপনারে আমার মনে ধরসে তাই আপনার সাথে এরকম কিছু করুম না।”

-“তা নাহয় বুঝলাম কিন্তু এটা কার?”

-“ওইতো আপনার সামনের ডেক্সের একটা মহিলা আছে না? মিষ্টি না সৃষ্টি জানি নাম, তার জন্য। বেডি আমারে আজকা বকসে অনেক। আচ্ছা সাহেব আমি যাই।”

বলেই ফারিশকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কুলফি চলে গেলো। ফারিশ বোকার মতো কুলফির চলে যাওয়া দেখছে। এই মিষ্টি ফারিশকে সকালবেলাতেই প্রপোজাল দিয়েছিলো বাট ফারিশ তাকে রিজেক্ট করে। রিজেক্ট করার পরেও মিষ্টি বারবার বেহায়ার মতো ফারিশের সাথে মিশতে এসেছিলো কিন্তু ফারিশ একবারের জন্যেও মেয়েটিকে পাত্তা দেয়নি। এ বিষয়টা রাতুলও খেয়াল করেছে তবে কিছু বলেনি।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here