তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী,পর্ব ০৯
লাবিবা_ওয়াহিদ
ছেলেগুলো টিটকারি মেরে সানামকে বললো,
-“কী সুন্দরী? বডিগার্ড লাগে? লাগলে আমরা রাজি শুধু একটু আনন্দ দিলেই চলবে।”(দাঁত কেলিয়ে)
ভয়ে সানামের গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না, সব কথাপাখি যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। এক হাতে পার্স এবং অপরহাতে আঁচলটা মুঠোবদ্ধ করে রেখেছে শক্তভাবে। ভয়ে আবারও সানামের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো এবং পানি পিপাসাও তার পেয়েছে বেশ! ছেলেগুলা এবার এগোতে লাগলো। সানামের এতক্ষণে গলার স্বর ফিরে আসলো। সানাম কাঁপা গলায় বললো,
-“ককককি সমস্যা? আমার দিকে আসছেন কেন? আমায় যেতে দিন!” কান্নার কারণে সানামের কন্ঠটাও অস্পষ্ট।
-“কেমনে যেতেই দেই বলো তো। এমন লালপরী সামনে আসলে যে কেউ-ই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। আমাদের মাথায় যে অন্যকিছু!”
বলেই সানামের হাত ধরতে যাবে এমন সময়ই কেউ বাইক নিয়ে তারলদের মাঝে দিয়ে এন্ট্রি নিলো। পাঞ্জাবি দেখে সানামের চিনতে বাকি রইলো না মানুষটি কে। সানামের ওষ্ঠ জোড়ায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। ফারিশ হেলমেট খুলে ছেলেগুলার দিকে তাকালো। ছেলেগুলো ফারিশকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো কারণ, কিছুদিন আগেই ফারিশ তাদের অবস্থা বেহাল করে দিয়েছিলো। ফারিশ একেকটাকে ভালোভাবে দেখে সানামের হাতে হেলমেটটা দিয়ে চুল একহাত দিয়ে ঠিক করতে করতে বাইক থেকে নেমে ছেলেগুলার সামনে দাঁড়ালো।
-“তোদের শরম-লজ্জা নেই? এতো মাইর খাওয়ার পরেও সেই মেয়েবাজি থামাস না! গতবার ৩দিনে ভালো হইছিস এবার কয়দিনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবি?”
একটা ছেলে কিছুটা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
-“তাতাতাতে তোর কী? আআমরা যা ইচ্ছা করবো!”
ফারিশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকালো। অতঃপর দৃষ্টিনত করে হেসে বললো,
-“তাহলে আমারও অনেক ইচ্ছা করছে তোদের মেরে হসপিটালে এডমিট করতে।”
ছেলেগুলা কয়েকটা ঢোক গিললো। তখনই তাদের মাঝে একজন বলে উঠলো,
-“আরে ভয়ের কি আছে, আজ তো এই পোলায় একলা, এই এক পোলা কিছুই করতে পারবো না, উল্টা এরে মেরে পুঁতে আমরা ওই সুন্দরিরে ভোগ করুম।!”
ছেলেটার কথায় বাকিরা খান্ত হলো আর কিটকিটিয়ে হেসে ব্যাঙ্গ করে ফারিশের দিকে তাকালো। এদিকে সানাম আতকে উঠলো, তারা যদি ফারিশকে কিছু করে বসে? তাহলে সে নিজেকে কী করে ক্ষমা করবে? সানাম কিছু বলতে এগিয়ে আসতে চাইলে ফারিশ হাত দিয়ে থামতে ইশারা করলো। তাও যেন সানামের চিন্তার শেষ নেই। এদিকে চারপাশে এশারের আযান দিচ্ছে। ফারিশ হেসে বললো,
-“দ্যাট মিন এখনো তোদের আমাকে চেনা বাকি!” বলেই ফারিশ আশেপাশে তাকিয়ে একটা ইয়া মোটা গাছের ডাল পেলো। ওইটা নিয়ে এসে সবগুলাকে ইচ্ছা মতো মারলো, কয়েকটার হাত ভেঙ্গেছে তো কয়েকটার পা। বেচারা’রা ফারিশকে ছুঁতে পারলো না। তবে এক বখাটে ফন্দি করে ছোট কাটার দিয়ে ফারিশের হাত কেটে দেয়। যা দেখে সানাম চিৎকার দিয়ে উঠে, ফারিশ কয়েকবার হাত ঝেড়ে অতঃপর সেই ছেলের মাথায় বারি দেয়। এতে করে ছেলেটা জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পরলো। বাকিগুলা সেই ছেলেকে টানতে টানতে কোনোরকমে পালালো। সবাই পালালে ফারিশ হাতের লাঠি ফেলে বাইকের দিকে এগিয়ে গেলো। সানাম হেলমেট বাইকের সাথে ঝুলিয়ে একপ্রকার ছুটে এসে ফারিশের হাত ধরলো এবং কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-“কী দরকার ছিলো এতো হিরোগিরি করার? কতোটা কেটে গিয়েছে আপনার সে খেয়াল আছে? তিলকে তাল না বানিয়ে সঠিকভাবে বোঝাতে শিখুন, মারপিট কোনোকিছুর সমাধান না!”
ফারিশ সানামের থেকে নিজের হাত ঝাড়া দিয়ে নিয়ে বলে,
-“আমার বিষয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। আমার কখন কি করতে হবে, না হবে সেই জ্ঞান নিশ্চয়ই তোমার থেকে নিবো না। এখন বাইকে বসো নয়তো এখানেই নিজের বিএফের জন্য দাঁড়িয়ে থাকো, ড্যাম ইট!” বলেই হেলমেট পরে বাইকে উঠে বসলো। ফারিশের এমন ব্যবহারে সানাম যেন স্টার্চু হয়ে গেলো। সানাম কী এমন করলো যার জন্য ফারিশ এমন ব্যবহার করবে? সানামের চোখের কোণা বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। অতঃপর মাথা নিচু করে চোখ মুছে বাইকে উঠে বসলো কিন্তু ফারিশকে স্পর্শ করলো না। ফারিশ যেই বাইক টান দিলো এতে সানাম হুমড়ি খেয়ে ফারিশের পিঠের ওপর পরলো। এমন হওয়ায় ফারিশের সারা শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুতের শক গেলো। ফারিশ যেন অনুভূতিহীন হয়ে গেলো, তবে কিছু প্রকাশ করলো না, সে একমনে বাইক চালাচ্ছে। এদিকে সানাম নিশব্দে কাঁদতে কাঁদতে চোখ, গাল, নাক রক্তিম হয়ে গেছে। পিপাসা এখনো তার আছে। এতক্ষণ ভাবছিলো ফারিশকে পানির কথা বলবে কী বলবে না৷ যখন বুঝলো পানি না পেলে উপায় নেই তখন আস্তে করে চাপাস্বরে বললো,
-“শুনুন!”
ফারিশের কোনো রেসপন্স নেই। সানাম ফারিশের কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“শুনুন না!”
-“কান খোলাই আছে আমার।”
-“পানি আছে? খুব তৃষ্ণা পেয়েছে।”
ফারিশ রেসপন্স করলো না। কিছুক্ষণের মাঝে একটা টঙের সামনে বাইক থামালো। সানামকে বসতে বলে সে টঙে গিয়ে একটা পানির বোতল কিনে আনলো। সানাম নির্বাক হয়ে ফারিশের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফারিশ বোতলে চুমুক দিয়ে সানামের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“লাগবে?”
সানামের কিছুটা রাগ হলো! মুখ লাগিয়ে পানি খেয়ে এখন পানি সাধছে। কিন্তু ফারিশ যা ভেবেছিলো তা ভুল প্রমাণিত করে সানাম সেই বোতলেই চুমুক দিয়ে পানি খেলো। ফারিশ হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। ফারিশ ভেবেছিলো সানাম এই বোতল নিবে না বা আরেকটা কিনে আনতে বলবে কিন্তু এ যে কোনো অভিযোগ না করেই ডাইরেক্ট খেয়ে নিলো! সানাম ঢকঢক করে পানি খেয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখ মুছে বললো,
-“পানিতে কী চিনি মেশানো হয়?”
-“মানে?” অবাক হয়ে বললো ফারিশ!
-“না, কেমন অমৃত স্বাধ লাগছিলো!” সানামের কথায় ফারিশ বিষম খেলো। অতঃপর সানামের দিকে তাকাতেই দেখলো সানামের চোখ, মুখ, নাক লাল হয়ে আছে। চোখের কাজল চোখের পানিতে লেপ্টে গেছে৷ এতেই যেন ফারিধ ঘায়েল হয়ে গেলো। সানাম ফারিশের সামনে তুড়ি বাজাতেই ফারিশের ধ্যান ভাঙলো। সানাম মিনতিসুরে বললো,
-“চা খাওয়াবেন? প্লিজ! সেই দুপুর থেকে কিছু খাইনি।”
সানামের কথায় ফারিশ না বলতে পারলো না। নিজেকে সামলে ফারিশ চলে গেলো দু’কাপ চা আনতে। ফারিশকে যেতে দেখে সানাম নিজের সব কষ্ট ভুলে গেলো, সবশেষে ঠোঁটজোড়ায় ফুটে উঠলো বিশ্বজয়ের হাসি। কিছুক্ষণ বাদে ফারিশ দু’কাপ চা এনে সানামের সঙ্গে কিছুটা হেলান দিয়ে বাইকে বসলো। সানামকে চা দিয়ে নিজেও খেতে শুরু করলো। সানাম চা এ চুমুক দিচ্ছে আর ফারিশের খাওয়া দেখছে। ফারিশের নজর দূরে, তাই সে সানামের মুগ্ধ দৃষ্টি খেয়াল করছে না। দুজনে রাতের পরিবেশ উপলব্ধি করে চা শেষ করে বাসায় চলে আসলো। আজকের দিনটা সানামের কাছে খুব স্পেশাল একটা দিন, সে পেরেছে ফারিশের সাথে কিছুটা হলেও সময় কাটাতে। কিন্তু ফারিশ তখন তাকে বয়ফ্রেন্ডের কথা বললো কেন? ফারিশ ওই কথাটা কোন সাপেক্ষে বললো? তবে ফারিশের হাতে এখনো ব্যান্ডেজ করেনি যা সানামকে বেশ ব্যথিত করছে।
গভীর রাতে ফারিশ যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন তার রুমে কেউ প্রবেশ করে। ফারিশের দরজা হালকা ভেজানো দেখে কেউ মিনমিন করে বললো,
-“কিরকম ছেলেরে বাবা, দরজা খুলেই ঘুমিয়ে যায়? যদি আমার মনপুরুষকে কেউ চুরি করে নেয়? নাহ আমি থাকতে তাকে কে-ইবা চুরি করবে? আর মশাইয়ের যা রাগ বাবাগো বাবা। দেখি ব্যান্ডেজ করেছেন নাকি না করেই উনি ঘুমে কাত!”
বলেই পা টিপে টিপে ফারিশের দিকে এগিয়ে গেলো। পূর্ণিমার রাত হওয়ায় চাঁদের আলো ফারিশের ঘরকে আবছা আলোকিত করে রেখেছে। ফারিশের ঘুমন্ত মুখটা চাঁদের আলোতে কতোটা নিষ্পাপ লাগছে। কেউ মুগ্ধ হয়ে ফারিশকে দেখছে।
-“এই মনপুরুষ! আপনি এতো সুন্দর কেন বলুন তো? আপনাকে এতো সুন্দর হতে কে বলেছে? আপনার প্রেমে পরতে পরতে যে আমি ক্লান্ত! আর কতো পরবো বলুন তো? কোমড়টা তো মেবি ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে তাও আপনার প্রেমে পরা শেষ হবে না। জানেন আপনাকে কোনো মেয়ে চোখ দিয়ে গিলে খেলে আমার কতোটা ফাটে? দেখেন তাদের অবস্থা? উহু, আপনার তো আবার এতদিকে খেয়াল থাকে না, আপনি তো আপনার ভাব নিয়ে খুব ব্যস্ত। হুহ! সমস্যা নেই অন্য কোনো মেয়েকে দেখা লাগবে না আপনার, আপনি শুধু আমাকে দেখবেন বুঝলেন? এখন আপনার হাতটা দেখি, মনে তো হচ্ছে না ব্যান্ডেজ করবেন কারণ, আপনি তো আবার রাগের গোডাউন। হ্যাঁ ঠিক ভেবেছিলাম, আপনি ব্যান্ডেজ করেননি! হায়রে মাবুদ! এনাকে নিয়ে যে কই যাবো।”
বলেই অতি যত্নে ফারিশের হাত ব্যান্ডেজ করে দিতে লাগলো। ফারিশ হালকা নড়েচড়ে উঠলে সে তার ব্যান্ডেজ করে থামিয়ে দেয়, ফারিশ যখন আবার ঘুমিয়ে যায় তখন আবারও তার কাজে মনোযোগী হয়। ব্যান্ডেজ শেষ হলে ফারিশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ফারিশের চুলে বিলি কেটে দিয়ে সে চলে গেলো রুম থেকে। দরজা ভিজিয়ে দিতে দিতে মুচকি হেসে বললো,
-“শুভ রাত্রি, মনপুরুষ!”
চলবে।