তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী,পর্ব ১৬
লাবিবা_ওয়াহিদ
-“ফারিশ তোর পায়ে ধরি প্লিজ আর খাইস না এসব! অনেক রাতও হইছে বাসায় যাবি না? ভাই প্লিজ এগুলা অফ দে!!”
সেজান এতো বলেও ফারিশকে থামাতে পারছে না৷ ফারিশ ওদের কথা না শুনে সে একনাগারে ড্রিংকস করেই চলেছে। তার চোখের সামনে বারংবার সেই দৃশ্য ভেসে উঠছে। সানামের পানি খাওয়ার দৃশ্য। যখন প্রথম তৃষ্ণার্ত অবস্থায় সানামকে পেয়েছিলো৷ সেই তৃষ্ণায় যে একইভাবে তৃষ্ণার্থ সে। তার প্রেয়সীর অভাবে সে তৃষ্ণার্থ৷ ফারিশ থামছে না দেখে সেজান এবং সামি দুজনে একসাথে টেনে আনলো বার থেকে। ফারিশ নেশায় আবোলতাবোল কথা বলে নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করছে। তার এতোটাই নেশা ধরেছে যে ঠিকমতো দাঁড়াতে অবধি পারছে না।
রাত ১২টার বেশি বেজে গেছে। ফারিশ এখনো ফিরেনি। সানাম ঘরের মধ্যে একনাগাড়ে পায়চারি করেই চলেছে। আগামীকাল সানামের হলুদ সন্ধ্যা। ঘরোয়াভাবে যেহেতু বিয়েটা সম্পূর্ণ হবে সেহেতু হলুদের অনুষ্ঠানও ঘরোয়া ভাবে হবে। সানাম এখনো বুঝতে পারছে না তার বিয়ের সিদ্ধান্ত ঠিক হয়েছে নাকি ভুল। ফারিশ যদি অন্যকারো সাথে হ্যাপি থাকতে পারে তাহলে সানাম কেন পারবে না? ওদের দুজনের সংসারে ওরাই থাকুক, সানাম কেন খামোখা ওদের মাঝে হাড্ডি হয়ে থাকবে? ইচ্ছে করলেও তো সে এবাড়ি ছাড়তে পারবে না তাই বাড়ি ছাড়ার একটাই উপায়, তা হচ্ছে ‘বিয়ে’। আর রাতুল তাকে যথেষ্ট ভালোবাসে। কথায় আছে যে তোমায় ভালোবাসে তাকে গুরত্ব দাও। সানাম আপাতত তাই চিন্তা করেছে। কিন্তু সানামের মন যে কিছুতেই তার সিদ্ধান্তে সাড়া দিচ্ছে না। এদিকে ফারিশের চিন্তায় সে ভেতরে ভেতরে আধা পাগল হয়ে যাচ্ছে।
সানাম ঘরে না থেকে লিভিংরুমের দিকে যেতে নিতেই খট করে দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলো৷ সানাম পিছে ফিরে ফারিশকে ওই অবস্থায় দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। সানামের দিকে তাকিয়ে সেজান তার চোখ নামিয়ে ফেললো। সানামের উপর সে বড্ড রাগ করেছে। ফারিশ নাহয় একটা ভুল করেছে, তার মাঝে তো অবশ্যই কারণ ছিলো। তাহলে সানাম কোন আক্কেলে একই ভুল করলো? তার তো বোঝার উচিত ছিলো? আর সানামকেই বা দোষ দিয়ে লাভ কী? তার সামনে ফারিশও তো কম করেনি। দোষ দুজনেরই। ভেবে সেজান একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফারিশকে দেখে সানাম দ্রুত এগিয়ে এসে উত্তেজিত হয়ে বললো,
-“কী হয়েছে ওনার? এ অবস্থা কেন?”
-“অতিরিক্ত ড্রিংকস করে ফেলেছে। আমি ওকে রুমে দিয়ে আসছি তুমি লেবুর রস নিয়ে আসো। দ্রুত!!”
সানাম একমুহূর্ত দেরী করলো না। এক প্রকার দৌড়ে কিচেনের দিকে চলে গেলো। সেজান এবং সামি ফারিশকে ধরে নিয়ে ফারিশের ঘরে চলে গেলো। ফারিশকে বিছানায় বসিয়ে দিতেই ফারিশ চিৎকার করে বললো,
-“লিভ মি এলোন!”
-“ফারিশ আমাদের কথাটা তো শুন!”
-“আই সে লিভ মি এলোন!!! আমার কথা কী শুনতে পাস না? জলদি আমার বাসা থেকে বের হ, ড্যাম ইট!!”
সেজান এবং সামি আর কিছু বললো না, চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। ফারিশ ওই অবস্থাতেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আগের স্মৃতিগুলো মনে করতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সানাম লেবুর রস নিয়ে রুমে ঢুকলো। সেজান এবং সামিকে না দেখে সানাম খানিকটা অবাক হলো। ওদের ভাবনা সাইডে ফেলে সানাম লেবুর রসটা ফারিশের কাছে গেলো। ফারিশের দিকে তাকাতেই দেখলো সে একদৃষ্টিতে উপরের সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। সানাম কিছু না ভেবে বলে উঠলো,
-“লেবুর রসটা খেয়ে নিন!”
সানামের কন্ঠস্বর শুনে ফারিশ সানামের দিকে তাকালো। আস্তে আস্তে উঠে বসলো, এখনো টলছে সে। সানাম একপলক ফারিশের দিকে তাকিয়ে লেবুর রসটা বেড বক্সে রেখে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে ফারিশ সানামের হাত ধরে আটকালো। ফারিশের শীতল স্পর্শে সানাম কিছুটা কেঁপে পিছে ফিরলো। চোখদুটো রসোগোল্লার ন্যায় বড় করে রেখেছে।
-“দয়া দেখাতে এসেছো?”
-“দয়া তো আপনারা এতোদিন দেখিয়েছেন, আমার মতো বোঝা আপনার ঘাড়ে চাপিয়েছেন। তাই আপনায় সাহায্য করা আমার কর্তব্য।”
“বোঝা” শব্দটা শুনে ফারিশের মাথায় যেন চট করে আগুন জ্বলে উঠলো। সানাম ফারিশের থেকে নিজের হাত ছাড়াতেই ফারিশ ঢলে ঢলে উঠে দাঁড়িয়ে সানামের দিকে এগোতে লাগলো। সানাম ফারিশের এহেম কান্ডে ভীতি দৃষ্টিতে ফারিশের দিকে তাকাতে তাকাতে পেছনের দিকে যেতে লাগলো। একসময় পিছে যেতে যেতে সানাম দেয়ালের সাথে লেগে গেলো। সানাম চোখ বড় করে পিছে তাকালো তো আরেকবার ফারিশের দিকে। ফারিশের এগোনো দেখে সানামের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। এমন কেন লাগছে সানামের? তার মন চাচ্ছে দেয়াল ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে পরতে। ফারিশ আস্তে আস্তে সানামের অনেকটাই কাছে চলে আসলো। ড্রিংকসের বাজে গন্ধে সানামের গা গুলিয়ে আসছে। আচমকা ফারিশ সানামকে জড়িয়ে ধরলো। সানাম পুরোই হতভম্ব হয়ে রইলো। তার মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে। এভাবে কিছক্ষণ সময় কেটে গেলো। এর মাঝে ফারিশ সবচেয়ে আকস্মিক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। ফারিশ সানামকে ছেড়ে ঢুলে ঢুলে দূরে সরে যায়। সানাম ঘাড়ে হাত দিয়ে সেভাবেই থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। তার সারা শরীরে বারংবার কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে। ফারিশ অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বললো,
-” রুম থেকে বের হও!!”
ফারিশ পুরো কথা শেষ করার আগেই সানাম ছুটে বেরিয়ে গেলো। সানাম বেরিয়ে যাওয়ার পর ফারিশ ঠাস করে দরজা লাগিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। কী এক অঘটন ঘটিয়ে ফেললো সে। ফারিশ জলদি লেবুর রসের গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সবটা গিললো। কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে রইলো। কয়েক মিনিট পর ফারিশ মুখে হাত চেপে ওয়াশরুমে ছুটলো।
সানাম রুমে এসে হাঁপিয়েই চলেছে। এমন একটা ঘটনা সানামের অপ্রত্যাশিত ছিলো। ঘাড়ের সেই স্থানটা যেন তার অবশ হয়ে আছে। কী হচ্ছে তার সাথে? ফারিশের এমন ব্যবহারের মানে কী?
পরেরদিন একে একে সবাই সানামকে হলুদ ছোঁয়ালো। ফারিশকে সকাল থেকে বাড়িতে দেখা যায়নি। সানাম যেন রোবটের মতো বসে আছে। ইকরাম ফরিদ সানামকে হলুদ ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে নিচু স্বরে বললো,
-“আমার মন বলছে তোর এই বিয়েতে মত নেই। নয়তো এমন মনমরা হয়ে আছিস কেন? তুই ঠিক আছিস তো?”
সানাম নির্বাক হয়ে ইকরাম ফরিদের দিকে তাকিয়ে, কৃত্রিম হাসার চেষ্টা করে বললো,
-“আরে না আঙ্কেল, আমি খুশি আছি। শুধু তোমাদের ছেড়ে যাবো ভেবে…!” বলেই মাথা নিচু করলো সানাম। কেন যেন মিথ্যাটা তার গলা দিয়ে আসছে না। ইকরাম ফরিদ বুঝলো সানামের অবস্থা। সে নিরাশ হয়ে উঠে চলে গেলেন। আলিফ এসে সানামকে অভিনন্দন জানালো। দূরে ইতি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধি আগামীকাল আসবে। সানাম তার বিয়েতে শুধুমাত্র ইতি এবং আলিফকেই পাশে পাচ্ছে। দূরে সেজান এবং সামি আনমনে হয়ে চুপচাপ বসে আছে। সেজান সানামের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বললো,
-“ফারিশের কোনো খবর পেয়েছিস?”
-“না। ফোন সুইচড অফ বলছে।”
-“আচ্ছা ওরে ওর মতো থাকতে দে। এখন আমাদের যা করার করতে হবে।”
-“কী করা যায়? আমাদের পক্ষে কী সম্ভব?”
সেজান কিছুক্ষণ ভাবলো। অতঃপর আলিফের দিকে তার নজর গেলো। হ্যাঁ কাজ এবার সারছে। সেজান শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
-“হবে ব্রো হবে! এই সেজানের বুদ্ধি এতো কাঁচা না। জাস্ট গুটিটা পয়েন্টে লাগালেই কাজ তামাম!”
-“মানে? কী বলতে চাইছিস?”
-“মানে খুব সোজা। আগে চল ওই বলদটাকে গিয়ে ধরি!”
বলেই সেজান সামিকে নিয়ে আলিফের কাছে গেলো। সেজান মুখে হাসি ঝুলিয়ে আলিফের কলার ধরে অন্যদিকে নিয়ে আসলো। আলিফ হতভম্ব হয়ে রইলো। সামিও বুঝতে পারছে না সেজান কী করতে চাইছে। সেজান এদিক ওদিক তাকিয়ে আলিফের উদ্দেশ্যে বলে,
-“সানামের ফ্রেন্ড তুই তাই না?”
-“হ্যাঁ, কেন?”
-“সানামকে খুশি দেখতে চাস?”
-“এখনো তো দেখছি।”
-“আরে বলদ!!”
বলে সেজান চোখ বুজে তার রাগ কান্ট্রোল করার চেষ্টা করলো। একটা লম্বা শ্বাস ফেলে সিরিয়াস হয়ে বললো,
-“দেখ আলিফ, সানাম খুশি নয়৷ সানাম অন্যকাউকে ভালোবাসে বাট চাপে পরে আরেকজনকে বিয়ে করছে। তুই যদি আমাদের সাহায্য না করিস তাহলে সানামের লাইফ বরবাদ হয়ে যাবে। তুই কী তা চাস?”
আলিফ একবার সানামের দিকে তাকালো। সানামকে আসলেই তেমন খুশি দেখাচ্ছে না। আলিফকে চুপ থাকতে দেখে সেজানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। সে নিজের রাগ দমাতে না পেরে আলিফের কলা ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-“তুই যদি আমাদের এই বিয়ে ভাঙতে সাহায্য না করিস তাহলে তোর হাত-পা ভেঙ্গে তোরে হসপিটালের বেডে শুইয়ে দিবো। এখন তুই-ই সিদ্ধান্ত নে, বিয়ের বিরিয়ানি খাবি নাকি ডাক্তারের ইঞ্জেকশন?”
আলিফ ভিষণ ভয় পেয়ে যায় সেজানের এমন থ্রেটে। আলিফ সাথে সাথে এক নিঃশ্বাসে বলে উঠলো,
-“আমি করবো, করবো। বলো আমায় কী করতে হবে?”
চলবে।