তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী,পর্ব ১৭

0
1720

তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী,পর্ব ১৭
লাবিবা_ওয়াহিদ

আজ সানামের বিয়ে। সানাম কনে সেঁজে চুপচাপ নিজের ঘরে বসে আছে। বাইরে কিছুটা চেঁচামেচির শব্দ আসছে। ওদিকে ফারিশ বিয়েতেও থাকতে চেয়েছিলো না কিন্তু সেজান তাকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসেছে। ফারিশ বিরক্তি নিয়ে বললো,

-“আমকে বারবার এসবের মধ্যে কেন টানছিস? বললাম না আমার এসব মোটেই সহ্য হচ্ছে না!”

-“তাহলে তুই স্বীকার করছিস সানামকে তুই ভালোবাসিস?”

-“হ্যাঁ করছি স্বীকার!! আর কিছু বলার থাকলে বল নয়তো আমি গেলাম!”

বলেই ফারিশ চলে যেতে নিচ্ছিলো সেজান ফারিশকে টেনে আটকালো।

-“যদি ভালো বেসেই থাকিস, তাহলে এসবের মানে কী? কেন বিয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছিস না!”

-“যেখানে সানাম বিয়ে করতে রাজী সেখানে আমি ভাঙবো কোন দুঃখে!”

-“বুঝছি তোরা দুইটাই একই পদের মানুষ! তোদের দ্বারা আসা করা মানেই বাঁশ খাওয়া। ঠিক আছে তুই বসে বসে ঘুমা, যা করার আমি-ই করবো!!”

-“মানে? কি করবি তুই আবার?”

-“খেলা যখন শুরু হবে তখন বুঝবা মাম্মা! এখন যা রুমে গিয়ে চোখমুখ ধুয়ে আয়। সারারাত তো মনে হয় না কান্নার কারণে ঘুমিয়েছিস!”

ফারিশ চুপ করে রইলো। জলদি সেজানকে এড়াতে সে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।

-“ইতি! আমার পাশে এসে বস?”

ইতি কোনো কথা না বলে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। সানাম বুঝতে পারছে না ইতি কেন তার সাথে কথা বলছে না।

-“তোর সমস্যা কী ইতি? কাল থেকে কেন এমন করছিস?”

-“আমার সমস্যা তোকে নিয়ে! আর কিছু?”

সানাম অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। ইতিকে কিছু বলতে নিবে ওমনি সেজান আসলো রুমে।

-“সরি ডিস্টার্ব করার জন্য। সানাম তোমার সাথে কিছু কথা বলার ছিলো। আমি জানি তুমি ফারিশকে ভালোবাসো, তাও তুমি কেন অন্যকাউকে বিয়ে করছো?” আন্তাজেই ঢিল ছুঁড়লো সেজান। সে নিজেও এ বিষয়ে কনফিউসড।

সানাম অনেকটা অবাক হয়ে গেলো সেজানের কথায়। সেজান কীভাবে জানলো? কিছুক্ষণ সময় অতিক্রম হলো। সানাম ভাবলো যেহেতু জেনেই গেছে আর লুকিয়ে লাভ কী?

-“তাকে ভালোবাসলেও সে তো আরেকজনের বাগদত্তা। সে যদি আরেকজনের সাথে সুখী হতে পারে তাহলে আমিও কেন পারবো না? রাতুল আমায় যথেষ্ট ভালোবাসে। কথায় আছে, যে তোমায় অধিক গুরুত্ব দেয় তুমি তাকেই গুরুত্ব দাও।”

সানামের উত্তরে সেজান ভেতরে ভেতরে লুঙ্গি ডান্স দিয়ে ফেললো সাথে এও বুঝলো এই দুইটাই একই এঙ্গেলের ঘাড়ত্যাড়া। কেউ কারো থেকে এক বিন্দুও কম না। এদের মধ্যে কেউ একজন যদি তার ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতো তাহলে হয়তো এতোকিছুর মুখোমুখি হতো না। সেজান কিছু না বলে চলে যেতে নিবে ওমনি আবার দাঁড়িয়ে বলে,

-“কী বললে ফারিশের বিয়ে? উম.. আমি তো জানি বিয়ে ভেঙ্গে গেছে, ফারিশ ভেঙ্গে দিয়েছে। ও আবার কার সাথে সুখী হবে? তোমার এই ল্যাপ-তোষকের সাথে? মেবি! যাহোক ফারিশ সিঙ্গেল আছে, বিয়ে করলে করো নয়তো ফারিশের কাছে ফিরো। বাই এন্ড হাই কিউটি!!” সানামের আরেক বান্ধুবিকে উদ্দেশ্য করে বললো। মেয়েটা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে দেখে সেজান সেই মুহূর্তেই রুম ত্যাগ করলো।

সানাম যেন সেখানেই থ মেরে বসে আছে। সেজানের কথাগুলো তার মাথার উপর দিয়ে গেছে। তার মস্তিষ্ক যেন বন্ধ হয়ে আছে। এমুহূর্তে কেন এরকম একটা খবর দিলো সেজান? সানাম বুঝতে পারছে না এমুহূর্তে তার কী করা উচিত। সানাম দুই হাত মাথায় দিয়ে বসে আছে।

সেজান ফারিশকে রুম থেকে টানতে টানতে লিভিংরুমে নিয়ে যেতে যেতে বললো,

-“ঘরে বসে কী আলুর চপ খাবা বন্ধু? সার্কাস দেখবা না? আমারে থ্যাংকস জানা আমার জন্য তোর সার্কাস মিস হবে না!”

-“জাস্ট শাট আপ সেজান! এইসব বাকওয়াস বাদ দে।”

সেজান হাসলো এবং ভাবলো তার বন্ধুর জন্য ঠিক কেমন সারপ্রাইজ রেডি রেখেছে। লিভিংরুমের একপাশে দাঁড়াতেই আলিফ, সামি এবং সন্ধি চলে আসলো। সন্ধিকেও সেজান এই প্ল্যানে সামিল করেছে কারণ তার এদিকটা সামলাতে হবে। তাই সেজান নিজের বদলে সন্ধিকে নিয়ে এসেছে। সন্ধিকে ধরার উপায় হলো ইতি। ইতিও প্ল্যানের কিছুটা জানে। ফারিশ তিনজনকে হাঁপাতে দেখে ভ্রু কুচকে বললো,

-“কোন মহৎ কাজ করে এসেছেন আপনারা?”

তিনজনের কেউই ফারিশের প্রশ্নের উত্তর দিলো না। সামি সেজানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

-“কাজ হয়ে গেছে। এখন শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা!”

-“গুড!” বলেই সেজান হাসলো। ফারিশ বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। ওদের কথোপকথনের আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।

-“তোরা ঠিক কোন বিষয়ে কথা বলছিস?”

-“যাব টাইম আয়েগা তাব দেখ লেনা!”

ফারিশ আর ওদের দিকে নজর দিলো না। কিছুক্ষণ পর বরযাত্রী এসে গেলো। বরযাত্রী আসলেও আসেনি বর। বিষয়টা নিয়ে সকলেই চিন্তিত। রাতুলের বাবা-মাও পেরেশানে পরে গেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে গেলো, রাতুলের কোনো খোঁজ নেই। ফারিশ নিজেও নখ কামড়াচ্ছে৷ রাত ৮টা বেজে গেলো রাতুলের অপেক্ষা করতে করতে। কাজীও ক্লান্ত অপেক্ষা করতে করতে। রাতুলের বাবা এতক্ষণ নানান বুঝ দিয়ে তাকে রাখলেও এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে সেজান এবং সামি গুতাচ্ছে ফারিশকে বিয়ের কথা বলার জন্য৷ একসময় সেজান অতিষ্ট হয়ে বললো,

-“দেখ ভাই সুযোগের সৎব্যবহার করতে হয়৷ উপরওয়ালার হয়তো উত্তম পরিকল্পনা আছে তোদের এক করার। ভাই প্লিজ! রাতুল আসলে সানামকে সারাজীবনের জন্য হারাবি। এতো বড়ো সুযোগ মিস দিছ না!”

ফারিশ সেজানের কথাগুলো চুপচাপ শুনে চোখ বুঝলো৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারিশ ইকরাম ফরিদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ইকরাম ফরিদ কাজীকে বোঝাতে ব্যস্ত। এদিকে রাতুলের বাবা হাল ছেড়ে দিয়েছে। তার ছেলে আজ আর আসবে না বেশ ভালো করে বুঝলো। ফারিশ তার বাবাকে ডেকে বললো,

-“বাবা, আমি সানামকে বিয়ে করতে চাই!”

ফারিশের এমন প্রস্তাবে সকলে স্তব্ধ হয়ে গেলো। ইকরাম ফরিদও নিমিষেই চুপ হয়ে পিছে ফিরে ফারিশের দিকে তাকালো। সানাম এতক্ষণ দরজার ধারেই পায়চারী করছিলো। যখন ফারিশের কন্ঠ শুনলো সে এক মুহূর্তও দেরী না করে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে যায়। পরক্ষণে ফারিশের এমন প্রস্তাবে সানাম নিজেও যেন আকাশ থেকে পরলো। সানাম কী ভুল শুনেছে নাকি ঠিক? নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে। এদিকে ফারিশের এমন প্রস্তাব শুনে দূরে সেজান আলিফকে ধুরুম ধারুম ঘুরাচ্ছে খুশিতে। বেচারা মাথা ঘুরিয়ে সামির উপর গিয়ে পরলো। সামি জোরে জোরে হাসছে সেজান এবং আলিফের কাহীনি দেখে। দূরে ইতি সন্ধিরহাত শক্ত করে চেপে ধরে সন্ধির দিকে তাকিয়ে খুব খুশি হয়ে বললো,

-“তোমাদের প্ল্যান সাকসেসফুল, সন্ধি। আমার বান্ধুবীর ভাগ্য তাহলে খুব শীঘ্রই খুলতে চলেছে।”
সন্ধি ইতির মায়াভরা হাসির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসলো।

ইকরাম ফরিদ অবাক হয়ে বললো,

-“তুমি কী শিওর ফারিশ? সানামকে তুমি বিয়ে করবে? আর রাতুল?”

-“বাবা, আসলে তোমাকে বলা হয়নি৷ আমি আমার বিয়েটা ভেঙ্গেছিলাম সানামের জন্য। সানামকে ভালোবাসি আমি। বাসায় যখন জানাবো তার আগেই এরকম একটা পরিস্থিতি এসে গেছে যার কারণে আমি আর কিছুই বলতে পারিনি। রাতুল এখনো আসতে পারেনি তার মানে সানামের বিয়েও ভেঙ্গে গেছে। আমি আর দেরী করতে চাইছি না বাবা।”

সকলেই ফারিশের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদিকে সানামের চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পরছে। এতদিন যার জন্য এতকিছু সহ্য করলো তার মুখে এইসব শুনলে যে কতোটা তৃপ্তি এবং আনন্দ মিলে তা সানাম মুখে প্রকাশ করতে পারবে না। তার এই বিয়ের উছিলায় ফারিশ তার মনের কথা বলেছে, এ-ই বা কম কিসের। সেজান সন্ধিকে বললো,

-“ফুলের ডেলিভারি কী হয়েছে?”

-“হ্যাঁ কিছুক্ষণ আগেই দিয়ে গেছে।”

-“তাহলে জলদি কর, বিয়ে তো হবেই। এখন আমরা নাহয় বাসর সাজানো শুরু করি!”

বলেই সেজান আলিফ, সামি এবং সন্ধিকে নিয়ে ফারিশের রুমের দিকে চলে গেলো বাসরঘর সাজাতে। এদিকে রাতুলের বাবা-মা ওদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বরযাত্রীসহ চলে গেলো। অন্তু আন্টি আপত্তি করলো না কারণ তার স্বামী ইকরাম ফরিদ আগেই দুজনের মধ্যকার সম্পর্কের হালকা ধারণা দিয়েছিলেন। ভেতর থেকে অন্তু ব্যথিত হলেও প্রকাশ করতো না। ফারিশের হুট করে এমন প্রস্তাবে তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।

সানাম ‘কবুল’ বলতেই কাজীসহ ঘরের সকলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ে উঠলো। লিভিংরুম থেকে ফারিশ ওদের আলহামদুলিল্লাহ শুনে হাসলো। ইকরাম ফরিদ ফারিশের কাঁধে হাত রাখলো। ফারিশ এদিক সেদিক তাকিয়ে সেজানদের খুঁজলো। কিন্তু চারটার একটাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। গেলো কোথায় ওরা? ইতিকে রুম থেকে বের হতে দেখে ফারিশ হাঁক ছাড়লো। ইতি দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললো,

-“বলেন নতুন জিজু? বউকে লাগবে নাকি?” মজা নিয়ে বললো.।

-“তেমন কিছু না, একচুয়ালি সন্ধি, সেজান ওরা কোথায়?”

-“আপনার ঘরে।”

বলেই ইতি কিচেনের দিকে চলে গেলো। ফারিশ উঠে তার ঘরের দিকে চলে গেলো। নিজের রুমে ঢুকতে নিলে সামি ফারিশের পথ আটকে দাঁড়ালো।

-“কী চাই?”

-“কী চাই মানে? তোরা আমার ঘরে কী করছিস? বের হ সবকটা!”

-“নো, নেভার! এখন তোমার বাসর সাজাচ্ছি সো লিভিংরুমের দিকে যাও। বাই!”

বলেই ফারিশের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো সামি। ফারিশ এতো ডেকেও ওদের রুম থেকে বের করাতে পারলো না। তাই আর কী করার আবারও সোফায় গিয়ে বসলো।

অন্তু আন্টি সানামকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের সুরে বললো,

-“এমন লক্ষী মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে পাবো কখনো কল্পনাও করিনি।”

-“তোমরা রেগে নেই তো আন্টি?”

-“আরে ধুর, কিসের রাগ? আর এই পাজি আন্টি বলছিস কেন? ‘মা’ বলবি, নয়তো থাপড়িয়ে গাল লাল করে দিবো।”

সানাম কিঞ্চিৎ হাসলো। ওরা এতো ভালো কেন? আল্লাহ ওদের কী দিয়ে তৈরি করেছে তা সানাম ভেবে পায় না। কিছুক্ষণ পর ফারিশকে রুমে এনে সানামের সাথে বসানো হলো। সানামের সারাশরীরে শীতল হাওয়া খেলে গেলো। এটা কী ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার অনুভূতি?

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here