“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০১
(নূর নাফিসা)
.
.
– মা, আমি নিশাতকে বিয়ে করবো।
ছেলের মুখে হঠাৎই এমন কথা শুনে আয়েশা বেগম বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌছে গেছেন! ঝাড়ু দেওয়া থামিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন আশিকের দিকে। ওদিকে নাজিয়ার কাজও স্থগিত! আশিক একবার তার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে আবার ভাবির দিকে! কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ থেকে নাজিয়া ফিক করে হেসে উঠলো! আশিক বললো,
– হাসো কেন?
– ভাবছি স্বপ্ন টপ্ন দেখে এলে নাকি! তা কি বলেছো সেটা তোমার মনে আছে তো?
– ভাবি, উপহাস করবে না। সিরিয়াসলি বলছি।
আয়েশা বেগম বললেন,
– তুই কি প্রেমটেম করছ নিশাতের লগে?
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে আশিক বিরক্তি নিয়ে একবার মায়ের দিকে তাকালো আরেকবার ভাবির দিকে! নাজিয়া মুখ চেপে হাসছেই! আর আয়েশা বেগম উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে আশিকের মুখপানে! আশিক বললো,
– বিয়ে করতে হলে প্রেম করতে হয়? প্রেম ছাড়া বিয়ে হয় না? ভাইয়া বিয়ে করেনি?
– চুপ থাক! কই আরাফ আর কই তুই! প্রেম না করলে এই বয়সেই বিয়ার শখ জাগছে ক্যা? আরাফরে তো হাজার বইলাও বিয়া করাইতে পারলাম না!
– তুমি আছো আরেক সংস্কার নিয়ে! মেয়ে ইন্টার পরীক্ষা না দিতেই বিয়ে দিয়ে দাও আর ছেলে ভার্সিটির শেষ প্রান্তে অথচ তার ক্ষেত্রে যেন আকাশ থেকে পড়লে।
– মেয়ের সাথে ছেলের জোড়া দিলে চলবো! তুই উপার্জন করবি, বাড়িঘর গুছাইয়া নিবি তারপরে না…
– বাড়িঘর গুছানোই আছে। আর স্বল্প উপার্জনও আছে। তাছাড়া বউ বাড়িতে আনবো না এখন। শুধুমাত্র বিয়েটা করে রাখবো। এখন তুমি তোমার বোনের মেয়েকে আমার জন্য আনবে কি-না সেটা বলো?
– আমারও তো ইচ্ছা, নিশাতরেই ঘরে তুলমু। তোর একটা ভালো ব্যবস্থা হইলেই প্রস্তাব পাঠামু।
– আমার ব্যবস্থা ভালোই আছে। এবার প্রস্তাব পাঠাও। নতুবা দেখবে পরীক্ষাটা শেষ হতেই নিশাতকে বিয়ে দিয়ে দিবে খালামনি। তোমার প্রস্তাবের অপেক্ষায় থাকবে না।
– আইচ্ছা।
– কি আইচ্ছা?
– আবিদার কাছে প্রস্তাব পাঠামু।
– হুম, তারাতাড়ি করো৷ এই রমজান মাসের মধ্যেই যেন কাজ সম্পন্ন হয়।
– তোর এতো তাড়া ক্যা? আমি বইলা রাখমু পরে একসময় বিয়া হইলেই হয়।
– না, তোমার একসময় নিয়ে বসে থাকবো না। দিনকাল ভালো না, জানো না সেটা? আশেপাশে দেখো না প্রেমপিরিতির কারণে দিনরাত পালিয়ে যাচ্ছে ছেলে মেয়ে? কোনদিন না আবার তোমার বোনের মেয়েরও এই অবস্থা হয়ে যায়! তার চেয়ে ভালো আগেই বিয়ের ঝামেলা শেষ করে রাখো।
– বাবা রে বাবা! এতো বিয়ার জন্যে এতো ফাল ক্যা তোর!
– এমনি। এটা একটা চ্যালেঞ্জ ভাবতে পারো। এই রমজান মাসের মধ্যে নিশাতের সাথে বিয়ে না হলে কিন্তু বাড়িতে আর ছোট বউ আসবে না কখনো।
কথা বলতে বলতে আশিক বাথরুমে চলে গেলো। প্রথমে হাসলেও নাজিয়া এখন হতবাক হয়ে আছে! এ আবার কোন পাগল! আর কিসের চ্যালেঞ্জ এর কথা বললো আশিক! সে ভাবতে ভাবতে এদিকে আয়েশা বেগম তাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
– কিসের চ্যালেঞ্জ কইলো?
নাজিয়া জবাব দিলো,
– জানি না তো আম্মা!
আয়েশা বেগম আবার ঝাড়ু দিতে দিতে বিড়বিড় করতে লাগলো,
– আজকালকার পোলাপাইন! বিয়া নিয়া ও নাকি চ্যালেঞ্জ ধরে! নির্ঘাত বন্ধুবান্ধবদের লগে পাল্লা ধরছে বিয়া করার!
আশিক গোসল সেড়ে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেলো। নাজিয়া হাড়িপাতিল ধুয়ে কিচেনে রেখে রুমের দিকে যাচ্ছিলো। আশিক বেরিয়ে তার মাকে না দেখতে পেয়ে বললো,
– মা আবার কোথায় গেলো!
– বাথরুমে গেছে।
– ভাইয়া স্কুলে গেছে না?
– হুম।
– স্কুল না প্রথম রোজা থেকেই বন্ধ দিয়ে দিলো!
– জেএসসি ও এসএসসির কোচিং চলে যে!
– ফিরে কখন?
– এগারো বারোটার মধ্যেই ফিরে আসে।
– সবই ভালো, আমরাই কপাল কুন্ডলা! যাদের আটটা থেকে চারটা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয়!
– ওইযে, এক ঘন্টা কমিয়ে দিছে।
– ধুর! চারটা পর্যন্ত করতে পারলে পাঁচটা পর্যন্ত কে না পারবে!
– তোমার তো যখন ইচ্ছে তখন গেলেই হয়।
– কারো ভালো কেউ দেখতে পারে না, বুঝেছো? ম্যানেজার যেই দেখছে সারাদিনে দুতিন ঘন্টা কাজ করে আমি তেরো হাজার বেতন পাই সেই মালিকের কানে ফুসলে দিছে। আর মালিক আমার ঘাড়ে কৌশলে আরও কাজ ফেলছে। এখন আমি আবার চেষ্টা করছি ওই পন্ডিতের পন্ডিতি কমানোর। দেখি, মালিককে খুশি করে পদোন্নতির মাধ্যমে ওই ম্যানেজিং পদটা দখল করতে পারি কি-না!
– উনার সাথে হিংসে করছো? তাহলে সেটা মোটেও ঠিক হবে না।
– হিংসে নয়, ভাবি। আমি যোগ্যতার সাথে পদার্পণ করতে চাইছি। শুধু অনার্স কমপ্লিট করার অপেক্ষা। এরপর অন্যকোনো ভালো পদে বা অন্যত্র চাকরিতে ট্রাই করা যায়।
– হুম, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি, বলোতো? হঠাৎ নিশাতের দিকে ঝুকে পড়লে! হুম? রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি!
– কিসের রহস্য! ক’দিনের জন্য পৃথিবীতে এসেছি। বিয়ে তো একসময় না একসময় করতেই হবে। তো শুধু শুধু অবিবাহিত থেকে প্রেমের সময়টা এভাবে নষ্ট করার কি আছে বলোতো!
নাজিয়া হেসে বললো,
– ভুল বলোনি, তাই বলে ডিরেক্টলি নিশাত!
– ভালো লাগলো তাই বলে দিলাম।
– কিন্তু চ্যালেঞ্জটা কিসের? বুঝলাম না!
আশিক ফিসফিসিয়ে বললো,
– আরে চ্যালেঞ্জ ট্যালেঞ্জ কিছু না! মাকে একটু তাড়া দেওয়া আরকি।
– নিশাত সমন্ধে আবার খারাপ বললে যে! নিশাতকে কি তোমার এমন মনে হয়েছে কোনো দিক থেকে, যে পালিয়ে যেতে পারে!
– এটাও সেই তাড়া দেওয়ার জন্যই।
আশিকের সাথে নাজিয়াও হেসে উঠলো। এদিকে আয়েশা বেগমকে দেখতে পেয়ে আশিক বললো,
– মা, আমি আসছি। খালামনিকে আজকেই খবরটা দিও কিন্তু।
.
পরীক্ষার দিনগুলোতে বেশিরভাগ আরমান ই গিয়েছে নিশাতের সাথে। আর মাঝে মাঝে ইমরান৷ আজ শেষ পরীক্ষায় এক্সাম হলে ইমরান গিয়েছিলো নিশাতের সাথে। সাথে নাফিসাও গেছে। এক্সাম চলাকালীন দুজন আশপাশ ঘুরেছে। আর এক্সাম শেষে তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে চলে গেছে। ঘুরাফেরা শেষে বিকেলে বাড়ি ফিরেছে।
নিশাত আজ থেকে স্বাধীন। শুধু প্রাকটিক্যাল এক্সাম বাকি। সেটা নিজ কলেজেই। আসরের নামাজ ঘরে পড়ে ইমরান বই নিয়ে বসেছে। নাফিসা বড় ঘরে গিয়েছিলো। কিছুক্ষণ পর আবার রুমে এসে দরজা চাপিয়ে বললো,
– আমি তো অবাকের চেয়েও বেশি অবাকিত!
ইমরান বই থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– এ আবার কেমন কথা!
নাফিসা ধপাস করে খাটে বসে বললো,
– যেমন শুনেছো ঠিক তেমনই। আমি গিয়েছিলাম নিশাতের ব্যাপারটা নিয়ে বড়মার সাথে একটু কথা বলতে! গিয়ে শুনি উল্টো গীত! খালা শাউড়ী আম্মা নাকি আশিক ভাইয়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠাইয়া দিছে! তা-ও নাকি এই রমজান মাসেই বিয়ে!
– হু, কে বলছে এসব!
– ওই, তোমার কি মনে হয় আমি মিথ্যে বলছি!
– সত্য মনে করার তো কোনো কারণ দেখছি না! আর সত্য হলেও নিশাতকে এখন বিয়ে দিবো নাকি!
– ওই, তুমি এমন করো কেন! বিয়ে হলে সমস্যাটা কি! আশিক ভাইয়া তো ভালোই, নিশাতও লাইক করে! আর আম্মাতো দেখলাম আনন্দিতই! আর আমি শীঘ্রই একটা বিয়ে খাবো তার জন্য বিমোহিত!
ইমরান বই রেখে চলে গেলো বড় ঘরের দিকে। নাফিসা ভেঙচি কেটে ঝাড়ুটা হাতে নিয়ে ঘরটা ঝাড়ু দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ইমরান ফিরে এসে দেখে নাফিসা ঘর ঝাড়ু দেওয়া শেষ করে রুমে প্রবেশ করছে আর গান গাইছে,
“নিশাত বানুর বিয়া গো, বিয়ার বাজনা বাজে পে পো পো…”
যদিও ইমরান জানে না কিন্তু সুর টেনেছিলো সে ইমরানকে এদিকে আসতে দেখেই। ইমরান বললো,
– রোজা থেকে এসব কি!
– কই কি!
– কিসের পে পো শুরু করছো! আর তুমিই না নিশাতের ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে তাকে উক্ত পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে চাইছিলে আর এখন বিয়ে নিয়ে নিজেই বিমোহিত!
– ধুর! প্রেম হারাম তাই উক্ত পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে চাইছি। বিয়ে করতে নিষেধ করছি নাকি! যত আগে ছেলেমেয়ে বিয়ে দেয়া যায় ততই ভালো। তারা আর হারাম পথে লিপ্ত হয় না। আমি তো এটাই চিন্তা করছিলাম যে, আমার বাচ্চারা প্রাইমারি লেভেল পার করলেই বিয়ে দিয়ে দিবো।
– তাই নাকি! তাহলে তুমি ভার্সিটি লেভেলে উঠেও বিয়ে করতে চাওনি কেন! কান্না করে যেই জ্বালাতনটাই না করছো আমাকে!
– হুহ্! আমার সাথে সবার জোড়া? সবাই তো আর এক না! পোলাপাইন টিনএজ এ পড়লেই নিজের ভবিষ্যৎ সহ বাচ্চাকাচ্চার ভবিষ্যৎ ও চিন্তা করে ফেলে! আর আমি তো নিজের বিয়ের কথাই কখনো মাথায় আনলাম না! তখন শুধু এটা মাথায় ছিলো যে অন্যের বিয়ে কবে খাবো আর জীবনের বর্তমান মুহুর্ত গুলোকে দুষ্টুমি ফাজলামোর সাথে কিভাবে মাতিয়ে রাখা যায়। তো এমন সময় বিয়ে দিলে কান্না করবো না!
– ইশ! কাদুনী বুড়ি!
– এতো কথা বাদ। ওই ঘরে গেলে, কি শুনে এলে? আমি মিথ্যা বলছি?
– হুম, এখন না বললেও আগে বলছো।
– আগে! আগে কি বলছি?
– তুমি না বলছো নিশাত আশিককে পছন্দ করে? তাহলে নিশাত এখন আশিককে বিয়ে করতে রাজি না কেন?
– কি! নিশাত রাজি না? আমি শিওর সে আশিককে পছন্দ করে। নতুবা সেদিন মিটিমিটি না হেসে আমাকে ডিরেক্টলি নিষেধ করে দিতো!
– ঘোড়ার ডিম শিওর তুমি। আশিককে পছন্দ করলে কি সে এখন বিয়ের কথা শুনে অমত পোষণ করতো? সে তো প্রায় কান্নাই শুরু করছে দেখলাম। আশিককে বিয়ে করবে না। অন্য কারো সাথে বিয়ে হলেও নাকি তার আপত্তি নেই কিন্তু আত্মীয়ের মধ্যে সে বিয়ে করবে না!
– এ..! তাহলে কি এখন বিয়েটা খাওয়া হবে না আমার!