“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০৬
(নূর নাফিসা)
.
.
গতদুদিন ধরে ইমরানের মন খারাপ। তার মন ভালো রাখতে নাফিসাও একটু একটু করে চেষ্টা করে যাচ্ছে, ইমরান নিজেও ভালো থাকতে চেষ্টা করছে। অফিস হাফ টাইম হওয়ায় আজ তারাতাড়িই ফিরেছে। জিহানের গাড়ির লাইট নষ্ট হয়ে গেছে, ইমরান ফেরার পরই সেটা ঠিক করে দেওয়ার জন্য ইমরানের পিছু পিছু ঘুরছে। ইমরান বলেছে পরে ঠিক করে দিবে আর জিহান সেই পরেটা কখন আসবে সেই অপেক্ষায়ই আছে! ইমরান রুমে যায় তো পিছু পিছু রুমেই যায়, বাথরুমে যায় তো পিছু পিছু গিয়ে দরজার সামনেই দাড়িয়ে থাকে! লাঞ্চ করতে বড়ঘরে গেছে তো সেখানে পিছু পিছু সে। নাফিসা হাসছিলো তার কান্ড দেখে। অত:পর লাঞ্চ করেই ইমরান নিজের রুমে এসে ফ্লোরে বসে গাড়ি ঠিক করছে। নাফিসা কিচেনে এসে দেখলো বড়মা পায়েস রান্না করছে। সে বললো,
– আহ! মিষ্টি গন্ধে পুরো বাড়ি ভরপুর! তা এমন সময় পায়েস কি উপলক্ষে বড়মা?
– তুই জানিস না কি উপলক্ষে?
– না তো!
– সত্যিই জানিস না? নাকি মস্করা করছিস?
– আরে! সত্যিই কোনো উপলক্ষ আছে নাকি! আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম!
– আজ ইমরানের জন্মদিন, সেটা তুই জানিস না?
নাফিসা পুরোপুরিভাবে বোকা বনে গেলো! সে তো সত্যিই জানে না ইমরানের বার্থডে কবে! সে কোনোভাবে কাটিয়ে গেলো বড়মার কাছ থেকে! সে চরম লজ্জাবোধ করছে! স্টুপিড লোকটাও তো একবার তাকে জানালো না! ধুর! বড়মার কাছে উপলক্ষ শব্দটা না তুললেই পারতো! দিনের অর্ধেকটা সময় পেরিয়ে গেছে! যাক, এখনই উইশ করে দেয়া যাক! কি দিয়ে উইশ করা যায়! ভাবতে ভাবতে নাফিসা নিশাতের রুমে চলে এলো। নিশাত ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত। নাফিসা বললো,
– তোমার কাছে না বেলুন আছে? জিহানের জন্য যে প্যাকেট এনেছিলে। সেটা শেষ?
– না। আছে কিছু।
– দাও তো আমাকে।
নিশাত ড্রয়ার থেকে প্যাকেট বের করতে করতে বললো,
– তুমি বেলুন দিয়ে কি করবে?
– কাজ আছে।
– ভাইয়ার বার্থডে সেলিব্রেট করবে না তো? ভাইয়া কিন্তু এসব পছন্দ করে না।
– হইছে, এখন আর মনে করতে হবে না। দিন ফুরিয়ে গেছে, এখন জানাতে আসছে ভাইয়ার বার্থডে!
নিশাত হেসে বললো,
– কেন তুমি জানো না? আমি তো সেই সকালেই উইশ করেছি ভাইয়াকে।
নাফিসা একটা বেলুন ফুলিয়ে তার রুমে এলো। জিহান দেখেই লাফানো শুরু করেছে,
– চাচী, দাও! চাচী, দাও!
– না, বাবা। এটা দেওয়া যাবে না। এটার কাজ আছে।
জিহান আর তার অপেক্ষায় না থেকে দৌড়ে চলে গেলো নিশাতের কাছে। আর নাফিসা ইমরানে সামনে বসে বেলুনটা মুখের সামনে এগিয়ে ধরে বললো, “হ্যাপি বার্থডে,জানু!”
বেলুন এভাবে ধরায় ইমরানের কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। তাই ইমরান হাতের পিনটা দিয়ে খোঁচা দিয়ে ফাটিয়ে বললো,
“থ্যাংকস, জানু।”
বেলুন হাতে না নিয়ে ফাটিয়ে দেওয়ায় নাফিসা বিরক্ত হলো। সে আবার বেলুন আনতে চলে গেলো। নিশাতের রুমে এসে দেখলো, নিশাত শুয়ে আছে আর জিহান তার গলা চেপে ধরে চিৎকার করছে বেলুন দেওয়ার জন্য! আর তার সাথে তাল মিলিয়ে নিশাত মরে যাওয়ার অভিনয় করছে! নাফিসা দ্রুত পায়ে এসে জিহানকে টেনে বললো,
– আরে! কি করছো! ফুপিকে কেউ মারে!
– চাচী, আমার বেলুন দেয় না!
ওদিকে নিশাত বললো,
– ভাবি, কি দেখালে তুমি! কান্না করলে আমি যা-ই মাঝে মাঝে দু একটা বের করে দেই। এখন প্যাকেট দেখলে সব শেষ করে ফেলবে!
নাফিসা জিহানকে বললো,
– জিহান, তুমি চাচ্চুর কাছে যাও। আমি খুঁজে খুঁজে তোমার জন্য বেলুন নিয়ে আসছি।
জিহান চলে গেলে নাফিসা পাঁচ-ছয়টা নিয়ে গেলো। একটা ফুলিয়ে জিহানের কাছে দিলো। সামনের দিকে জিহান বসে আছে বলে আরেকটা ফুলিয়ে নাফিসা পেছন থেকে ইমরানের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
– হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! কত তম জন্মদিন তোমার?
ইমরান সেটিও ফাটিয়ে বললো,
– আশি তম।
বেলুন ফাটানোর কারনে বিরক্ত হলেও ইমরানের কথায় নাফিসা খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
– এল্লা! বুইড়া বেটার জন্মদিন!
এদিকে জিহান বুঝে আর না বুঝে হেসে উঠলো। হয়তো বেলুন ফাটিয়ে দিয়েছে বলেই! নাফিসা আরেকটা বেলুন ফুলিয়ে ইমরানের মাথায় ঠুসে ফাটানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,
– হ্যাপি বার্থডে বুইড়া বেটা! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ বুইড়া বেটা! ধুর! ফাটে না ক্যা!
দুইবার চেষ্টা করেও যখন ফাটেনি, এইবার একটু জোরে দেওয়ার চেষ্টা করতে যাবে তার আগেই ইমরান পিনের সাহায্যে ফাটিয়ে দিলো! জিহান এবারও হেসে উঠলো! এবার একটু দুষ্টুমি চাপলো নাফিসার মাথায়। নাফিসা পেছনের টেবিল থেকে পানির জগটা হাতে নিয়ে বেলুনের ভেতর পানি নিয়ে তারপর ফুলিয়ে ইমরানের মাথার উপর রাখলো। ইমরান এবারও একই কাজ করলো আর বেলুন ফেটে তার মাথা ভিজে গেলো! ইমরান পুরোপুরি শকড! নাফিসা পাশ কেটে এক দৌড়ে দরজার কাছে এসে থেমে হাসতে হাসতে বললো,
“ভেজা বার্থডে, বুইড়া বেটা!”
নাফিসা হেসে কুটিকুটি! আর ইমরান রেগে তাকালো তার দিকে! ইমরান যে-ই উঠতে যাবে নাফিসা দৌড়ে পালালো! সে ভেবছে ইমরান তাকে তাড়া করার জন্য উঠেছে! আর জিহান হাসতে হাসতে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে! ইমরান তোয়ালে নিয়ে মাথা মুছে নিলো। টিশার্টটাও কাধ ও পেছন দিকে ভিজে গেছে কিছুটা। তাই চেঞ্জ করে অত:পর গাড়ির কাজটা শেষ করে নিলো। পাঁচ মিনিটের কাজ নাফিসার দুষ্টুমির জন্য পনেরো-বিশ মিনিটের মতো লেগেছে তার!
এরপর নাফিসা আর তার সামনে আসেনি। ইমরান তখন রেগে গেছে তাই দূরে দূরে আছে। কিন্তু কতক্ষণ আর এভাবে দূরে থাকা যায়! সন্ধ্যায় কাজকর্ম সেড়ে তার মাঝে সাহস উঁকি দিয়েছে। কি করবে ইমরান? মারবে তাকে? তো মারুক। ব্যাথা পেলে একটু নাহয় কান্না করবে, সেই প্রস্তুতি নিয়েই সে রুমে এলো। কিন্তু আবারও দেখতে পেল সেই বিষন্নতা! যেটা একদমই ভালো লাগে না নাফিসার! ইমরান কোলে বালিশ নিয়ে, পায়ের উপর পা তুলে, খাটে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে! চেহারায় বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট! নাফিসা যে আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে ভেতরে এসেছে সেই খেয়ালেই নেই সে! নাফিসা দরজা লাগিয়ে তার কাছে এলো। ইমরান এবার তার দিকে তাকিয়েছে। নাফিসা কিছু না বলে বালিশটা টেনে সরিয়ে দিলো এবং ইমরানের পায়ের উপর তার সম্পূর্ণ ভার রেখে আরাম করে বসলো। ইমরান শুধু তাকিয়ে দেখছে তাকে। নাফিসা তার মুখখানা দু’হাতে ধরে বললো,
– হয়েছেটা কি তোমার? ভালো লাগে না তো এভাবে দেখতে। একটু বেশি চেষ্টা করো না ভালো থাকতে৷ খারাপ মুহূর্তগুলো টেনে টেনে কেন সবসময়েই বিষন্নতায় কাটাও? হাসিখুশি থাকবে, মন ভালো থাকবে, শরীর সুস্থ থাকবে, তুমি ভালো থাকবে, আমি ভালো থাকবো, আমরা ভালো থাকবো। তুমি এভাবে আছো আর তা দেখে দেখে তোমার পাশাপাশি আমরা কেউই ভালো নেই। স্বপ্ন যখন বেঁধেছ, একবার হেরে গিয়েছো তো কি হয়েছে? দ্বিতীয়বার আবার চেষ্টা করো। ভাগ্যে জয় থাকলে আসবেই, আর না এলেও ব্যর্থতা স্বীকার করবে না৷ বারবার চেষ্টা করেও যদি ব্যর্থ হও তো ভাগ্যকে মেনে নাও। কেননা মহান আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সেটাই দান করবেন যা তোমার জন্য মঙ্গলজনক। আর যা মঙ্গলজনক নয়, তাতে বারবার বাধা দিবেন।
ইমরান এতোক্ষণ যাবত নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। নাফিসা থামতেই সে দুহাত বাড়িয়ে নাফিসার মুখখানা কাছে টেনে নাকে নাক ঘেঁষে বললো,
– এইটা কি সেই পিচ্চি বউটা, যে কারণে অকারণে রেগে যেতো আর জেদ করতো! পিচ্চি বউটা তো বড় হয়ে গেছে! তাই তো আজ আমাকে বুঝাতে প্রস্তুত।
– শুনো, পেট ভরা থাকলেও যদি খাওয়া হয় তো বদহজম হয়। ফলশ্রুতিতে পেটে আর অবশিষ্ট কিছুই থাকে না। আর জ্ঞানী লোকের মাথাভর্তি জ্ঞান থাকে। তাই যদি আরও জ্ঞান নিতে চায় তো বদ হজম হয়ে সব উপচে পড়ে। যেটাকে আমরা বলে থাকি বেশি পড়াশোনা করে পাগল হয়ে গেছে অর্থাৎ, শিক্ষিত পাগল। তোমারও আস্তে আস্তে এই দশা হয়ে যাচ্ছে ধারণা করছি। তাই আমি স্বল্পশিক্ষিতা আসলাম একটু মগজ ঝালাই করে আগে থেকেই সাবধান করতে। এই এক্সাম একাধিকবার দেওয়া যায় না?
– হ্যাঁ, ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত দেওয়া যায়।
– তাহলে পরবর্তীতে আবার দিবে৷ তবুও যদি না হয় তবে মেনে নিবে আল্লাহ চান না তুমি ক্যাডার হও। কি, দিবে না?
– ইচ্ছে নেই।
– থাকতে হবে।
ইমরান কয়েক সেকেন্ড নাফিসার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থেকে বললো,
– তুমি দিবে বিসিএস।
– এ!
– হ্যাঁ। তুমি দিবে।
– আমি! আমি তো বিসিএস এর বি-ও জানি না! শুধু নামটাই জানি! আর জানি যে এটা সরকারি চাকরির অন্তর্ভুক্ত।
– জানতে হবে এবং জানবে।
ইমরান একটু নেড়েচেড়ে বসে সিরিয়াস মুডে বললো,
– শুনো, বিসিএস হচ্ছে “বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস” এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এর আওতাভুক্ত ছাব্বিশটা ক্যাডার আছে। এডমিনিস্ট্রেশন, এগরিকালচার, পুলিশ, ইকোনমিক, কো-অপারেটিভ, অডিট এন্ড একাউন্ট, স্ট্যাটিস্টিক্স, ফুড, ফ্যামিলি প্লানিং, জেনারেল এডুকেশন সহ আরও কিছু ক্যাডার এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তুমি যদি এক্সামে টিকে যাও তো নিজের ইচ্ছে মতো যেকোনো একটা বেছে নিতে পারবে।
– যদি না টিকতে পারি তো!
– এতোক্ষণ না আমাকে বুঝালে। এখন আবার তো আসলো কোথা থেকে! না টিকলে নেই।
– আচ্ছা, আমারটা পরে। এখন তোমার সময় আছে যেহেতু তুমি আবার দিবে।
– ইচ্ছে মরে গেছে।
– ইচ্ছে প্রাণ নয় যে মরে গেলে আর ফিরে আসবে না! তুমি মনটাকে একটু শক্ত করলেই ইচ্ছেটা জাগ্রত হবে। তুমি আবার চেষ্টা করবে। এ নিয়ে আর কোনো কথা নয়, এটাই আমার শেষ কথা।
.
দিন যায় ধীরে ধীরে
চলে গেলে মনে হয়, এইতো সেদিন হলো রে!
প্রহর কাটে গনে গনে,
কেটে গেলে গেলে মনে হয়, এইতো তখন এলো রে!
একে একে পাল্লা ধরে,
দুঃখ সুখ গুলো জীবন ধেয়ে যায় ঘুরে ঘুরে!
ক্ষণে আসে, আবার চলে যায়,
আবারও আসে ফিরে!
ঈদুল আযহা উপলক্ষে নাফিসা ও নাহিদা বেড়াতে এসেছে বাবার বাড়িতে। নয়দিন কাটিয়ে দশম দিনে যার যার নীড়ে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তারা। নাহিদা একটু পরেই যাবে, মেহেদী অফিস শেষে নিতে আসবে তাকে। আর নাফিসা রাতে যাবে ইমরান আসবে। নাজিয়া যায়নি, তার তেমন হাটাহাটি নিষিদ্ধ বলে। নাহিদাকেও যেতে দিতো না, কিন্তু প্রসব পরবর্তী সময়ে নাহিদাকে মেহেরুনের কাছে থাকতে হবে তাই একটু বেড়ানোর সুযোগ দেওয়া হলো। ডেলিভারি ডেট তার নিকটেই। সব রকম সতর্কতার মধ্যেই আছে তার পরিবার। রুমানা বেগম চেয়েছিলেন নাহিদাকে তার কাছেই নিয়ে আসবে। কিন্তু মেহেরুন নিজের কাছে রাখার ইচ্ছা পোষণ করলো। তাই রুমানা বেগমও জোর করলো না এই ভেবে, নাজিয়াকে তার কাছে নিয়ে আসবে। কেননা নাহিদার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকলেও নাজিয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত না। আরাফকে শুরুতেই বলেছিলো নাজিয়াকে তার কাছে দিয়ে আসতে। কিন্তু আয়েশা বেগম রাজি নন তাতে। তার ইচ্ছে বাড়ির বউ বাড়িতেই থাকবে। কিন্তু রুমানা বেগম তাদের সাথে কথা বলে সেই প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিলো যে নাজিয়াকে প্রেগ্ন্যাসির শেষ সময় তার কাছেই রাখবে। আলফাজ সাহেব প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন। যদিও আয়েশা বেগম কিছুটা নারাজ হয়েছিলেন। কেননা তার মাঝে ছেলের বউয়ের প্রতি ইন্টারেস্ট না থাকলেও নাতি নাতনির ব্যাপারে একটু দায়িত্বশীলতা প্রকাশ পেয়েছে!