“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১১
(নূর নাফিসা)
.
.
নাজিয়া তার ঘরের দিকে যাওয়ার সময় চোখ পড়লো আয়াতের ঘরের দিকে। কেননা আয়াত তার রুমের জানালা ধুপধাপ লাগিয়ে দিচ্ছে। নাজিয়া নিজের ঘরের দিকে না গিয়ে আয়াতের ঘরের দিকেই এলো তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। দরজা মনে হচ্ছে চাপিয়ে রাখা, তাই আর নক করলো না। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে নাজিয়া হতবাক! আয়াত খাটের ওপর চেয়ারে দাড়িয়ে সিলিং ফ্যানে ওড়না বাধছে গলায় ফাস দেওয়ার জন্য! নাজিয়া দৌড়ে এসে তাকে টেনে চেয়ার থেকে নামিয়ে দিলো। ওড়না ফ্যানেই ঝুলছে!
– কি করছো তুমি! পাগল হয়ে গেছো!
– ভাবি! আমার কাজে বাধা দিও না। বেরিয়ে যাও এখান থেকে! বের হও।
– আয়াত কি শুরু করেছো এসব!
– তুমি বের হবে নাকি আমি বিষ যোগাড় করে খেয়ে মরবো!
সাথে সাথেই নাজিয়া সজোরে আয়াতের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো! এবং বললো,
– এই মেয়ে, মৃত্যু সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে! কি করতে যাচ্ছিলে তুমি ভেবে দেখেছো একবার! দুনিয়ায় জীবন আর ক’দিন! পরকালে তো জাহান্নামের স্থান দখল করে নিতে! এদিকে পরিবারকে যন্ত্রণা দিয়ে সেদিকে তুমি জাহান্নামে জ্বলতে চিরজীবন! আত্মহত্যা মহাপাপ, সেটা জানো না তুমি! আরেকবার এ ধরনের কথা বললে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না!
আয়াতের দুচোখে ঝরছে অশ্রু! গালে হাত রেখে কয়েক সেকেন্ড নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে এবার হুহুঙ্কার তুলে কেদে ঝাপটে পড়লো নাজিয়ার গলা ধরে। নাজিয়া আয়াতের অবস্থা দেখে এইটুকু কথা বলেই হাপিয়ে গেছে! আয়াত নাজিয়ার গলা ঝাপটে ধরে কান্না করতে করতে বললো,
– কি করবো ভাবি! আমার একদম ভালো লাগছে না! বাবা-মা তো আমার কথা শুনছে না একটুও! আমি এখন বিয়ে করবো না! এইসব সমন্ধ আমার একটুও পছন্দ না।
– তাই বলে এমন কাজে অগ্রসর হবে তুমি! কেমন মেয়ে হলে তুমি, যদি একটু ধৈর্যই না ধরতে পারো! বললেই তো আর হয়ে যাচ্ছে না বিয়ে! তোমার ভাইয়াও রাজি না এই সমন্ধে। সবাইকে উপেক্ষা করে কি আর বিয়ে দিবে আম্মা!
– শুধু এই সমন্ধ কেন! কোনো সমন্ধেই আমি রাজি না। করবো না আমি বিয়ে! বউ হয়ে যেতে হলে সেই একজনের ঘরেই যাবো। বিয়ে করতে হলে তাকেই করবো। তার ঘরে যেতে না পারলে আর কারো ঘরে যাবো না। আমার উপর জোরজবরদস্তি করতে এলে সোজা দুনিয়া ত্যাগ করবো আমি।
– সেই একজন মানে! কে সেই একজন?
আয়াত নাজিয়ার গলা ছেড়ে দিয়ে চেয়ার ঠেলে খাট থেকে ফেলে দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। নাজিয়া তার পাশে বসে বললো,
– বলো, কার কথা বলছো?
আয়াত চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
– চিনবে না তুমি। ভালোবাসি আমি একজনকে। বিয়ে করতে হলে তাকেই করবো।
– বাবা-মা জানে?
– উহুম। মা একবার শুনেছিলো হয়তো কারো কাছে তখন আমাকে শাসিয়েছে!
– এমন কাজ কিভাবে করতে পারো আয়াত! বাবা-মা, আর ভাইদের কথা ভাববে না তুমি! এসব সম্পর্ক জড়ানো যে পাপ তুমি সেটা জানো!
– এতে পাপের কি হলো! একজন মানুষের ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হয়ে তাকে পছন্দ হতেই পারে। আমি কি অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়েছি তার সাথে! দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা এটুকুতেই কি পাপ হয়ে গেলো!
– হ্যাঁ, এটাও পাপ। সম্পর্ক কতদিনের?
– দু বছর।
– ঘুরতে বেড়াতে যাওনি তার সাথে?
– হ্যাঁ, গিয়েছি।
– লুকিয়ে লুকিয়ে অপরিচিত লোকের সাথে কথাবার্তা, ঘুরাফেরা সবই পাপ। এমনিতেই আমরা হাজার..
– হ্যাঁ, পাপ যেহেতু করেই ফেলেছি তাহলে সেটা শুধরে নিবো তার সাথেই বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে। তাছাড়া অন্য কোথাও পাঠালে সংসার একদিনও টিকবে না দেখে নিও! লাশ পেয়ে যাবে আমার!
– আয়াত জেদ নিয়ে সব কাজ হয় না। বাবামায়ের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
– এটা কেমন বাবা-মা! কিসের প্রাধান্য দিবো তাদের সিদ্ধান্তে! দেখেছো তুমি সেই লোকটাকে, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রেখেছে। দেখে মনে হয় তিন চার বাচ্চার বাপ! এতোদিনে আসছে বিয়ে করতে! এই লোককে কিভাবে পছন্দ হলো বাবামায়ের!
নাজিয়া কি বলবে বুঝতে পারছে না। আয়াতকে বুঝাতে গিয়ে সেও থেমে যাচ্ছে। কেননা এই সমন্ধটি নাজিয়ার কাছেও আয়াতের জন্য একেবারেই ঠিক লাগছে না। তাই বললো,
– তুমি যাকে পছন্দ করো সে কি তোমার সমবয়সী?
– না। আশিক ভাইয়ার চেয়েও বড়। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে এবার।
– তাহলে তো আমাদের বেচের।
– না, তোমার চেয়ে এক ক্লাস সিনিয়র। এক বছর গেপ ছিলো। পড়াশোনার পাশাপাশি একটা চাকরি করে সার্ভিসিং সেন্টারে ম্যানেজার হিসেবে। পরিবার আমাদের পরিবারের অবস্থানের চেয়ে একটু উচুতেই আছে।
– এতোই যখন পছন্দ তাহলে পরিবারকে জানাও। এসব উল্টাপাল্টা কাজ করার চিন্তা মাথায় আসে কিভাবে! কার শান্তি হচ্ছে এতে!
– দেখোনা মা কেমন করে! মানবে আমার কথা!
– এর চেয়ে বোকা লোক পৃথিবীতে আছে! মানবে কি মানবে না সেটা বলে দেখেছো তুমি! বাবামায়ের কাছে না বলতে পারলেও তো ভাইদের কাছে বলতে পারো! তারা কেউ জানলোই না তাহলে মানার কথা কোথা থেকে আসে!
– সাহস হচ্ছে না আমার।
– কি আজব! কথা বলতে সাহস হয় না অথচ আত্মহত্যা করতে সাহস চলে আসে! যত কষ্টই আসুক জীবনে, এরকম কাজে আর কখনো পদার্পণ করবে না।
আয়াত মাথা নিচু করে বসে আছে। নাজিয়া আরও কিছুক্ষণ বুঝালো তাকে। অত:পর চেয়ার তুলে নিজেই ওড়নার বাধন খুলে নিলো ফ্যান থেকে।
সন্ধ্যায় কাপড়চোপড় বাইরে থেকে ঘরে এনে গুছিয়ে রাখছিলো নাজিয়া। এমন সময় আরাফ ঘরে এলো। নাজিয়া বললো,
– কিছু কথা ছিলো তোমার সাথে।
– নিজের কথা হলে বলো। এ পরিবারের কাউকে নিয়ে কিছু বলবে না।
আরাফ স্কুলের খাতাগুলো নিচ্ছিলো। নাজিয়া তো আয়াতের কথাই বলতো কিন্তু সে যে নিষেধ করে দিলো! না, বলতেই হবে। তাকে জানাতে হবে।
– একবার তো শুনো।
– বললাম তো নিজের কথা হলে বলো।
– আমার কথা না। আয়াতকে নিয়ে।
– তাহলে চুপকরে থাকো। আর মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও।
– আচ্ছা, শুনতে সমস্যা কি!
– নাজিয়া, তোমাকে বারবার কেন বলতে হচ্ছে! এ পরিবারের কাউকে নিয়ে কোনো কথা…
– আয়াত গলায় ফাস দিয়ে আত্মহত্যা করতে গেছে।
আরাফের কথা শেষ না হতেই নাজিয়া দ্রুত বলে ফেললো কথাটা। তা না হলে সে একটুও শুনবে না! এদিকে আরাফ হতবাক হয়ে গেছে তার কথা শুনে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,
– মানে! আয়াত আত্মহত্যা করতে গেছে! কখন! কেন!
– তুমি যখন বাইরে বেরিয়ে গেয়েছিলে তখন তার রুমে গেয়ে দেখি সে সিলিং ফ্যানে ওড়না বাধছে!
– এখন কোথায়?
– রুমেই আছে।
– কেউ জানে?
– না।
আরাফ খাতা হাত থেকে রেখে দিতেই নাজিয়া বললো,
– শুনো আগে কথা। পরে যাও।
আরাফ দাড়িয়ে গেলো নাজিয়ার কথা শোনার জন্য। অত:পর নাজিয়া সব বলে দিলো৷ আরাফ স্থির হয়ে খাটের কোনে বসে আছে। কি করবে তার জানা নেই। জীবনের এই রূপ আর ভালো লাগছে না! সবদিকে একটা না একটা টানাপোড়েন লেগেই আছে! একটার অবসান ঘটতেই আরেকটা এসে হাজির!
ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে আশিক দরজার সামনে এসে ডেকে গেলো, “ভাইয়া, বাবা ডেকেছে তোমাকে।”
আরাফ একটা নিশ্বাস ছেড়ে বাবার ঘরের দিকে গেলো।
নাজিয়ার ফোনটা বেজে উঠতেই টেবিলের কাছে গেলো নাজিয়া। দেখলো নাহিদা ভিডিও কল করেছে। নাজিয়া রিসিভ করতেই মানুষের পরিবর্তে দেখলো বুট চানাচুর দিয়ে মাখা মুড়ির বোল। তা দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো, এবং বললো,
– আমাকে লোভ দেখানোর জন্য এই আয়োজন!
সাথে সাথেই ওপাশে দুজনের খিলখিল হাসির শব্দ শুনা গেলো। নাহিদা বললো,
– আপু, সেদিন এক বোল পেয়াজু খেয়ে পরবর্তী দুই দিন নাফিসাকে সেলাইন খেয়ে থাকতে হয়েছে। আজ কি হবে ভাবতে পারছো! তারাতাড়ি এসো, এগুলো শেষ করে দিয়ে যাও এবং নাফিসাকে রক্ষা করে যাও!
নাহিদা খিলখিল করে হেসে উঠলো আর নাফিসা রেগে বোল টেনে নিয়ে বললো,
– স্টুপিড ছো’আপু! একটা মুড়িও পাবে না তুমি!
– যা, লাগবে না মুড়ি। তুই ই খা বেশি বেশি।
– কিউটিপাই ব’আপু, চলে আসো মুড়ি খাই।
নাজিয়া মুচকি হেসে বললো,
– আমি দেখছি তো, তুই খা।
– হুম, খাবোই তো। এই যে দেখো।
নাহিদা তাকে সরিয়ে বললো,
– হুহ্! সর, আমার ফোনের চার্জ শেষ হচ্ছে! আমি কথা বলি এবার! কেমন আছো আপু?
– আলহামদুলিল্লাহ, বাবা-মা আর আমার কিউটিপাই দুইটা ভালো আছে তো?
– হুম, আলহামদুলিল্লাহ। কবে আসবে আবার?
– তোর বিয়েতে।
– ধুর! আসোনা বেড়াতে। কবে থেকে দেখা হয় না! তোমাকে অনেক মিস করি প্রতিটি মুহূর্তে!
– মিসকে ডিশমিশ করে ফুরফুরে মনে কথা বল এবার। পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?
– আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই।
– শেষ কবে?
– পরশু দিলেই শেষ। তারপর আবার ক্লাস!
– এতো তারাতাড়ি ক্লাস!
– হুম, লেট করে এক্সাম হলো তো। তাই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে পরীক্ষার পরপরই।
– ওহ, আচ্ছা। মা কোথায়?
– কিচেনে। ওইতো, বাবাও এসে গেছে।
নাজিয়া বাবা-মায়ের সাথেও কথা বললো কিছুক্ষণ। কল কেটে দেওয়ার পর কিছু মনে হতেই আলমারির কাছে এলো। খুঁজে খুঁজে আরাফের রাখা গহনা বের করলো। সেখান থেকে চেইনটা নিয়ে বাকিগুলো সযত্নে রেখে দিলো। অতপর আয়নার সামনে এসে চেইনটা গলায় পড়ে নিলো। ভালোবাসাটা গলায় ঝুলাতে পেরে অজান্তেই যেন ক্লান্তির নাশ ঘটলো। কিন্তু ভালোবাসাটা উপহারস্বরূপ যে দিয়েছে সেই মানুষটা কি ঠিক আছে! একের পর এক চিন্তা এসে মানুষটার মাথায় ভীড় জমা করে! এসব দুশ্চিন্তার কি অন্ত ঘটবে না কভু!