“তৃ-তনয়া” পর্ব- ১১০

0
2515

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১১০
(নূর নাফিসা)
.
.
সন্ধ্যার সাঁজে সমুদ্রের তীরে হাটছে দুজন৷ মেহেদীর কোলে তাজ আর পাশাপাশি নাহিদা। আজও তার অভিমান ভাঙেনি। তীব্র বাতাস আর শো শো শব্দ ভেসে আসছে কানে। তাজ বারবার মুখে আঙুল দিচ্ছে আর মেহেদী টেনে নামিয়ে নিচ্ছে। মেহেদী খুব মলিন স্বরে বললো,
– এতো কাছে আছো সবাই তবুও শূন্যতায় ডুবে আছি আমি। এভাবে কি সবসময়ই অভিমান নিয়ে দূরে দূরে থাকবে?
– আমি তো দূরে নেই।
– সত্যিই কি তাই? তাহলে আমি শূন্যতা অনুভব করি কেন?
– আমি কি জানি!
মেহেদী ছোটখাটো এক নিশ্বাস ফেলে আবার বললো,
– আমাদের মাঝে কি সব আগের মতো ঠিক হবে না? আমরা কি আবার আগের মতো হতে পারি না?
– আগের মতো হতে গেলে তো আবারও আগের ভয়াবহতাগুলো এসে দেখা দিবে। সেটাই প্রত্যাশা করেন আপনি?
দুজনেরই হাটা থেমে গেছে। মেহেদী চুপ হয়ে গেছে এবং নিষ্পলক তাকিয়ে আছে নাহিদার দিকে! নাহিদার চোখে পানি চিকচিক করছে। তাজ কান্না করতে করতে নাহিদার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। নাহিদা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে তাজকে কোলে নিলো। এবং সমুদ্র তীর থেকে বিপরীতে হাটা ধরলো। কয়েক কদম এগিয়ে এসে পেছনে তাকিয়ে দেখলো, মেহেদী সেখানেই দাড়িয়ে আছে। প্যান্টের পকেটে দুহাত রেখে বিশাল সমুদ্রের সীমান্তে তাকিয়ে আছে সে। নাহিদা আবার হাটতে লাগলো। খুব কষ্ট লাগছে তার! এমন দিন আসবে তা কি প্রত্যাশা করেছিলো কখনো! তাজকে কোলে নিয়ে হেটে যাচ্ছে আর এক হাতে চোখ মুছে যাচ্ছে। হেটে হেটে কিছু দূর এগিয়ে আবারও পেছনে ফিরে তাকালো। এবার কেউ নেই সেখানে! মেহেদী কোথায় গেলো! আশেপাশে তো কোনো লোকজনই নেই! দুপাশে প্রস্তর বালির মাঠ আর বরাবর বিশাল সমুদ্র! একটা কাকপক্ষীও চোখে দৃশ্যমান হচ্ছে না! এইটুকু সময়ের মধ্যে সে কোথায় হারিয়ে গেলো! সে কি তবে সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে! সে কি তার দ্বারা কষ্ট পেয়ে তাকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেছে! নাহিদা খুব ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলো, “মেহেদী…..!” এবং দৌড় দিলো সমুদ্রের দিকে!
চোখ খুলে বসে পড়লো নাহিদা! হাপাচ্ছে সে! ঘুমের মধ্যে নাহিদার মুখে আবল-তাবল উচ্চারণে মেহেদীর ঘুম ভেঙে গেছে। তাজের ওপাশে থেকেই সে এতোক্ষণ যাবত ঝাকিয়ে ডাকছিলো নাহিদাকে। আর নাহিদা এখন চমকে উঠে বসে পড়েছে। খুব ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে সে! তার চেহারায় ভয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাচ্চাকে পাশে ও মেহেদীকে বাচ্চার ওপাশে দেখতে পেয়ে বুঝতে পারলো এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো সে! মেহেদী জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে?
নাহিদা কোনো জবাব না দিয়ে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! মেহেদী বুঝতে পেরেছে সে দুঃস্বপ্ন দেখেছে নিশ্চয়ই! তাই ওপাশ থেকে নেমে নাহিদার পাশে এসে বসলো সে। জগ থেকে পানি ঢেলে নাহিদার মুখের সামনে ধরলো। ওপাশ থেকে এপাশে আসা অব্দি একবারের জন্যও মেহেদী থেকে দৃষ্টি সরায়নি নাহিদা। আর এখন মেহেদী পানির গ্লাস এগিয়ে ধরলে সে ঝাড়ি দিয়ে গ্লাস সরিয়ে দু’হাতে ঝাপটে ধরে হুমড়ি খেয়ে পড়লো মেহেদীর বুকে! মেহেদী গ্লাস ঠিকমতো ধরে রাখায় হাত থেকে গ্লাস পড়েনি কিন্তু গ্লাসের পানি পড়ে গেছে ফ্লোরে! আর এদিকে নাহিদা কান্না করতে করতে বারবার বলছে,
“সরি! সরি প্রিয়!”
মেহেদী গ্লাস রেখে নাহিদাকে সোজা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু নাহিদা তাকে ছাড়ছে না। বরং আঁকড়ে ধরে বারবার বলে যাচ্ছে, “সরি, আর কখনো রাগ করবো না৷ আর কখনো তোমার অবাধ্য হবো না। একদম হারাতে দেবো না তোমাকে!”
“নাহিদা, হয়েছে কি? তাকাও আমার দিকে! কাঁদছো কেন তুমি? এই যে, বাবু উঠে যাবে কিন্তু!”
মেহেদীর কোনো কথায়ই কাজ হচ্ছে না। সে নিশ্চিত নাহিদা কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে। তাই মেহেদীই চুপ করে রইলো তার কান্না থেমে আসা পর্যন্ত। এক হাতে নাহিদাকে জড়িয়ে অন্য হাত তাজের উপর রাখলো যেন ঘুম ভেঙে না যায়। নাহিদার কান্না কমে এলে মেহেদী বললো,
– দুঃস্বপ্ন দেখেছো?
– হু।
– সেজন্য এতো কান্না করার কি আছে! স্বপ্ন তো স্বপ্নই! বেশি দুশ্চিন্তা কর বিধায় এমন।
মেহেদীর উন্মুক্ত বুকে ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে নাহিদা বললো,
– হ্যাপি এনিভার্সারি, মিস্টার।
কণ্ঠটা যেন ভাঙা শোনা গেলো, সর্দি লাগলে যেমন স্বর ভেঙে যায়! এখনো ঠিক তেমনই শোনা গেলো। তবে উক্ত কথায় মেহেদীর ভেতর এক প্রকার শিহরণ বয়ে গেলো! ঘুমানোর পূর্বের ঘটনা মনে করে সে নিশ্চুপ হয়ে আছে। নাহিদা আবারও একই কাজ করলো এবং একই কথা বললো। এবার মেহেদী নিজেকে একটু ফ্রেশ মাইন্ডে আনতে বললো,
– এতোক্ষণ ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে এখন কি জেগে জেগে সুস্বপ্ন দেখছো?
নাহিদা তার কথায় পাত্তা না দিয়ে আরও একবার ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে বললো,
– অভিনন্দন, তনয়ার আব্বু।
সব শুভেচ্ছাগুলো যেনো জমা করে রেখেছিলো এতোদিন, যা আজ প্রকাশ করে যাচ্ছে সে! এবার কন্ঠটা পরিষ্কার শোনা গেছে! মেহেদী আবার বললো,
– আমার তো মনে হয় এখন আমিই সুস্বপ্ন দেখছি! বলি কি, এসব সকালে মনে থাকবে তো তোমার? এক মিনিট দাড়াও, আমি বরং ফোনে রেকর্ড করে নেই।
নাহিদা মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি শুরু করেছো তুমি!
– আমি! আমি তো কিছুই শুরু করলাম না! তবে অনুমতি পেলে শুরু করতে পারি!
নাহিদা স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মেহেদীর সমস্ত মুখে চোখ বুলালো। মেহেদী মাথাটা নিচু করে কপালে কপাল ও নাকে নাক লাগিয়ে বললো,
– কি দেখলে স্বপ্নে?
– দুঃস্বপ্ন বলতে হয় না।
– ইশ! স্বপ্নটা হুট করে এসে আমার কি যে উপকার করলো!
নাহিদার ঠোঁটে হাসির ঝিলিক ভেসে উঠলো! মেহেদী নাকে নাক ঘেঁষে কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিলো। অত:পর হাত বাড়িয়ে আবার গ্লাসে পানি নিলো। নাহিদা বললো,
– কুলি করবো আমি।
– যাও।
নাহিদা তার ভেজা গাল মুছতে মুছতে পা দিয়ে পাপোশ টেনে ফ্লোর মুছে দিলো। অত:পর বাথরুমে এসে চোখে মুখে পানি দিলো। সে বেরিয়ে এলে মেহেদী গেলো। নাহিদা গ্লাস নিয়ে পানি পান করতে গেলে চোখ পড়লো ঢেকে রাখা কেকের উপর! এক ঢোক পানি গিলে সে কেকটা দেখলো। একটুও খায়নি লোকটা! শুধুমাত্র মেয়ের হাত ধরে ছুরি একবার চালান করেছে আর একটুখানি চকলেট মেয়ের মুখে দিয়েছে। কেকের কোন টুকরোও করেনি। নাহিদা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সময় ১টা বেজে ৫৫মিনিট। সে ছুরিটা হাতে নিয়ে বাবা-মেয়ের করা সেই দাগ হতে আরেক দাগ টেনে ত্রিকোণ আকৃতির টুকরো করলো। মেহেদী বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো সে কেক কাটছে। বিছানার দিকে যেতে যেতে বললো,
– আমরা অনেক মজা করেছি, তুমি মিস করেছো।
– মজা করেছো? আমাকে মিস করোনি?
মেহেদী জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– মন্দ হতো না, যদি তুমি থাকতে!
কথাটা শুনে নাহিদার হাত থেকে ফসকে গেলো কেকের টুকরোটা! মেহেদী তার জায়গায় শুয়ে পড়েছে। নাহিদা অন্যহাতে চোখ মুছে আবার টুকরোটা হাতে নিলো এবং বাকি কেক ঢেকে রাখলো। অত:পর মেহেদীর ওপাশে এসে বসে তার মুখের সামনে ধরে বললো,
– আ’ম সরি। রেলি, সরি ফর লেট দ্যা ভ্যালুএবল টাইম ওয়ান আওয়ার ফিফটি ফাইভ মিনিট!
মেহেদী একবার কেকের দিকে তাকিয়ে আবার তার দিকে তাকিয়ে আছে। নাহিদার দুচোখে অনবরত অশ্রু ঝরছেই! মেহেদীকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে আবার বললো,
– হ্যাপি এনিভার্সারি। ক্যান ইউ টেক ইট? ক্যান ইউ গিভ মি ইউর পিউর লাভ? আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ সো মাচ।
বর্ষপূর্তিতে প্রিয় মানুষটা এভাবে প্রপোজ করলে কি তাকে উপেক্ষা করা যায়! মুহুর্তেই যেন মেহেদীর অপরাধী মনোভাব বিলীন হয়ে গেছে! সে আরও কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে শোয়া থেকে উঠে বসলো। এবং নাহিদার হাত থেকে কেক মুখে নিলো। অত:পর এগিয়ে এলো নাহিদার মুখের সামনে। অতি খুশিতে যেন নাহিদার অশ্রুপাত আরও বেড়ে গেছে! নাহিদা বাইরের অংশটুকু কামড়ে মুখে নিয়ে নিলো! মেহেদী তাকে শক্ত করে বাহুডোরে বেঁধে বললো,
– লাভ ফরএভার বাবুর আম্মু।
নাহিদা চুপচাপ মিশে আছে। কিছুক্ষণ এভাবে নিশ্চুপ থাকায় মেহেদী বললো,
– কি গো? ঘুমিয়ে পড়েছো? আমি ঘুমাবো কখন?
নাহিদা সোজা হয়ে বসলো। তার মুখ ফোলা দেখে মেহেদী বললো,
– খাওনি?
নাহিদা কিছু বললো না। মেহেদী তার দুইগাল চেপে ধরে বললো,
– হা করো দেখি?
নাহিদা ঠোঁট চেপে রেখেছে। মেহেদী বললো,
– মুখে জমিয়ে রেখেছো কেন? দাঁতে পোকা ধরবে তো! খেতে না পারলে দিয়ে দাও আমাকে।
মেহেদী তার গাল আরও চেপে ধরলো। নাহিদা নিশ্চিত সে এটা নিয়ে ছাড়বে। তাই তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত অন্যপাশে চলে গেলো এবং মুখের খাবার চিবিয়ে নিয়ে বললো,
– ছি! কি খারাপ লোক!
মেহেদী হেসে উঠলো। নাহিদা আরও কিছুক্ষণ মুখে খাবারটা রেখে দিতো কিন্তু মেহেদীর জন্য পারলো না! সে পানি পান করে মেহেদীকে পানি দিলো। মেহেদী পানি পান করে রেক্সিনসহ তাজকে একটু এপাশে চাপালো এবং বড় কোলবালিশটা সাইডে রাখলো। অত:পর সে এসে নাহিদাকে তাজের দিকে চাপিয়ে জায়গা দখল করলো। নাহিদা বললো,
– এখানে কেন আবার! ওপাশে যাও।
মেহেদী তার পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে বললো,
– উহুম। অনেক ঘুম পেয়েছে। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি!
এমনি তাজ জেগে ওঠে কান্না শুরু করলো। আর নাহিদা হেসে বললো,
– ইউর ডটার অলওয়েজ স্ট্যান্ড ফর ডিস্টার্বড ইউ! হিহিহি..!
– তার ঘুম কিন্তু ভাঙেনি। আপাতত তুমি চাইলেই সে শান্ত।
নাহিদা তাজকে কাছে টেনে বললো,
– ওকে চাইলাম।
– অভিমান ভেঙেছে?
– হুম।
– এতো বড় অভিমান কেন কর! আমার কষ্ট বেশি লাগে তো।
– সরি, আর করবো না কখনো। কিন্তু নেক্সট টাইম যদি জেদ করে কিছু করেছো তো বিপরীতে আমিও উল্টো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবো। তখন আর অভিমান করবো না ঠিকই। কিন্তু অন্যকিছু করবো।
– অন্যকিছু! কি করবে শুনি?
– যা খুশি তাই করবো।
– যেমন?
– যেমন, বাবুর টয়লেট করা পোশাক ধুতে দিবো!
– হোয়াট! ইম্পসিবল! ডাইপার পড়িয়ে বাবু সারাদিন কোলে নিয়ে ঘুরতে রাজি, কিন্তু ওসব ইম্পসিবল!
– সময় আসুক, পসিবল করে ছাড়বো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here