“তৃ-তনয়া” পর্ব- ১১২

0
3133

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১১২
(নূর নাফিসা)
.
.
নাজিয়ার বর্তমান অবস্থা পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিত্তিতে ডাক্তার আট মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই সিজার করতে বলে। ডাক্তারের দেওয়া নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী তারা হসপিটাল হাজির হয়। নাজিয়া আজ খুব ভয়ার্ত! থিয়েটারে প্রবেশ করার পূর্বে নাজিয়া পিছু ফিরে বারবার তার স্বজনদের দিকে তাকাচ্ছিলো! কখনো মা, কখনো বাবা, কখনো নাফিসা আবার কখনো আরাফ! শেষ পলকটা আরাফের উপরই পড়েছিলো! বাবা গম্ভীর, মা ও নাফিসা কান্না চাপা রেখেছে যা স্পষ্ট! আর আরাফ পলকহীন তাকিয়ে ছিলো তার দিকে! লোকটার মাঝে যে ভয়ের তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে নাজিয়া! আর তার মনের অবস্থা সকলেরই জানা! ভয় জমা ভারী মন নিয়ে সে প্রবেশ করলো থিয়েটারে! কে জানে, এটাই নাকি আবার তার স্বজনদের শেষ দেখা হয়! চোখের সামনে তো নিয়মিতই ঘটে যাচ্ছে এমন শত শত ঘটনা! মহান আল্লাহ তায়ালা তার হায়াত আরও বহুদূর রেখেছেন কি-না একমাত্র তিনি ছাড়া আর কে ই বা জানেন!
অপারেশনের জন্য দু ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। আসিফ নিজ থেকেই এসেছিলো রক্ত দিতে। একজন সুস্থ মানুষ তিন মাস অন্তর রক্ত দান করতে পারে। আর সে শেষ রক্ত দান করেছিলো নাহিদাকে প্রায় চার মাস হয়ে গেছে। তাই আজও সে এগিয়ে এসেছে তাদের সাহায্য করতে। একদিকে মানবতা, অন্যদিকে নাহিদার সূত্রে আরাফের সাথে তার বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আরেক ব্যাগ রক্ত নাফিসা দিতে প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু আরাফের সাথে ম্যাচ না হলেও আশিকের সাথে নাজিয়ার রক্তের গ্রুপ ম্যাচ হয়েছে। আয়াতেরটাও ম্যাচিং। ডাক্তার নাফিসাকে উপেক্ষা করে আশিককে গ্রহণ করেছে। কারণ একটাই, মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের শক্তিসামর্থ্য ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। যার ফলে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর আশিক আগেই প্রস্তুত ছিলো, তার ভাবির অপারেশনে রক্তের প্রয়োজন হবে ভেবে।
অপারেশন করার পর ডাক্তার সুসংবাদ নিয়ে বেরিয়েছেন, নাজিয়ার যমজ বাচ্চা হয়েছে। এক ছেলে এক মেয়ে! ছেলেটা হৃষ্টপুষ্ট আর মেয়েটা তুলনামূলক দুর্বল! নাজিয়া বিপদমুক্ত সেই প্রত্যাশাই করছেন ডাক্তার। তবে নিশ্চিত বলতে পারবেন জ্ঞান ফেরার পর। আসিফ সুসংবাদ পাওয়ার পরই বাসায় ফিরে গেছে।
টুইন বেবি হওয়ার সম্ভাবনা আছে সেটা আরাফ জানতো আরও আগেই। ডাক্তার জানিয়েছিলো বিষয়টা। কেবল আরাফই জানতো, নাজিয়াকেও জানতে দেয়নি কারণ সে প্রেশার বেশি নিতে পারে সেই ভয়ে।
তার অপারেশন করা হয়েছে মধ্যাহ্নে। আর জ্ঞান ফিরেছে অপরাহ্নে। কিন্তু তাকে নিয়ে ঝামেলা একটু দেখা দিয়েছে। তার প্রেশার আগেই হাই ছিলো, যার কারণে সিজার করতে হলো। এখনও প্রেশার হাই আছে! একটু পরপরই খিচুনি দেখা যাচ্ছে! ডাক্তার পড়ে গেলো টেনশনে! তাকে যথাসম্ভব ঘুমন্ত রাখার চেষ্টা করছে তারা। ছেলে বাবুটাকে নরমাল রাখলেও মেয়ে বাবুটাকে বিশেষ ট্রিটমেন্টে রেখেছে। পর্যাপ্ত তাপমাত্রার জন্য কয়েক ঘন্টা শুধু ছেলে বাবুটাকে গ্লাসের ভেতর রাখা হয়েছে। সন্ধ্যায় নাহিদা এসেছে মেহেদীর সাথে। তার এক্সাম শেষ হয়েছিলো কিছুদিন আগে। আজ তার ভাইভা ছিলো তাই দিনে আসতে পারেনি। মেয়েকে বাসায় রেখে আসতো কিন্তু সারাদিন এমনিতেই দূরে ছিলো তাই এখন নিয়েই এসেছে হসপিটাল। তাছাড়া এখানে তার প্রয়োজনভেদে বেশিক্ষণ কাটাতে হতে পারে সেই ভেবেও সাথে নিয়ে আসা। সারারাত তো আর এমন দূরে রাখা যাবে না! টুইন বেবি হয়েছে সেটা ফোনে জেনে খুশি হলেও এখানে এসে নাজিয়ার অবস্থা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেছে!
রাত আটটা/নয়টার পর নাজিয়ার প্রেশার কিছুটা কমেছে, তারপরই ছেলে বাবুকে তার পাশে নিয়ে আসা হয়েছে। দু-তিন ঘন্টা অপেক্ষা করে যখন দেখলো প্রেশার অনেকটা স্বাভাবিক, তখন ডাক্তার তার ব্যাপারে আশংকা মুক্ত হলো। সবার আগে আরাফ দেখা করেছে নাজিয়ার সাথে। অবশ্য ডাক্তার তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্যই ডেকেছিলো। পরে ডাক্তার চলে গেলে সে তার সাথে কথা বলার সুযোগ পেল। কেবিনের একপাশে নার্স ছিলো। সে ছেলে বাবুর ড্রেসিংয়ে ব্যস্ত। আরাফ নাজিয়ার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে নিচু স্বরে বললো,
– আলহামদুলিল্লাহ, দুইটা বাবু এসেছে আমাদের ঘরে। জানো তুমি?
নাজিয়া পলক ফেলে মুখে একটু হাসির রেখা টানার চেষ্টা করলো। বিপরীতে আরাফ ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– বাবুদের আম্মুর কেমন লাগছে এখন?
নাজিয়া কম্পিত কন্ঠে বললো,
– আলহামদুলিল্লাহ।
আরাফ নার্সের দিকে একবার তাকিয়ে নাজিয়ার কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিলো নার্সের দৃষ্টির অগোচরে। নাজিয়া বললো,
– বাবুরা কেমন আছে?
– ভালো।
– বাবুদের আব্বু ভালো আছে?
আরাফ ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে চোখে হ্যাঁ সূচক পলক ফেললো। নাজিয়া তার বাবামায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই আরাফ নার্সের কাছে জিজ্ঞাসা করে বাকিদের দেখা করতে বললো। তারা সবাই দেখা করলো। চোখে পানি থাকলেও নাজিয়ার মুখে হাসি দেখে এখন সবার মুখেই হাসি লেগে আছে। নাহিদাও এতোক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছিলো নাজিয়াকে ও বাবুদের দেখার জন্য। আপুর সাথে কথা বলার পর ছেলে বাবুকে কোলে নিয়েছিলো। মেহেদী নাফিসার কাছে তাজকে দিয়ে নাহিদার কানে কানে কিছু বললো! “এভাবে দেখছো কেন গো? চিন্তা করো না, নেক্সট ইয়ারে আমরাও নাহয় ছেলে বাবু চাইবো আল্লাহর কাছে। কেমন? তাজেরও তো একটা ভাই দরকার!”
ফলশ্রুতিতে নাহিদা চোখ রাঙিয়ে তাকালো এবং মেহেদী মুখে দুষ্টুমি হাসি ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলো।
অনেকে নাজিয়ার দিকে মনযোগী হলেও অন্যপ্রান্তে থেকে তাদের খুনসুটি লক্ষ্য করছিলো নাফিসা। এখানে আসার পর থেকেই কয়েকবার লক্ষ্য করেছে তাদের দিকে। আর যখন কানে কানে কিছু বলছিলো তখন সে ইমরানকে খোচা মেরে দেখাচ্ছিলো যে তাদের মাঝে সব ঠিক আছে। নাফিসা তাকে মুখে কিছু বলেনি ঠিক কিন্তু তার ভাবভঙ্গিতে ইমরান স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে সে এটাই বুঝাতে চাইছে। ইমরান কিছু বললো না। একটু পর মেহেদী কেবিনে এসে নাহিদাকে মৃদু স্বরেই বললো,
– বাসায় যাবে না? এগারোটা বেজে যাচ্ছে তো। এখানে প্রয়োজন না হলে বাসায় চলে যাওয়া ই ভালো হবে। স্পেশালি বাবুর জন্য। কাল সকাল সকাল না হয় আবার এসো?
– হুম, যাবো।
নাহিদা বলতে বলতে ওদিকে রুমানা বেগম শুনে বললো,
– হ্যাঁ, তোর অযথা এখানে থাকার প্রয়োজন নেই। এতো মানুষ হসপিটালে থাকাও ঠিক না। রাত বেশি হয়ে গেছে, সাবধানে চলে যা। মেহেদী, আর দেরি করো না।
তারা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। এগিয়ে দিতে সাথে গেলো ইমরান ও নাফিসা। কথা বলতে বলতে বের হচ্ছে এমন সময় আশিকের সাথে দেখা! আশিক রক্ত দান করে বাসায় গিয়েছিলো বিশ্রামের জন্য। এরপর শপিংমলে গিয়েছিলো বাবুর মশারীসহ কিছু আসবাব আনতে। এখন মেহেদীকে দেখে হ্যান্ডশেক করলো। সাথে নাহিদাকেও জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন, ভাইয়া?
– আলহামদুলিল্লাহ।
অত:পর নাফিসার কোলে থাকা তাজের দিকে তাকিয়ে নাহিদাকে জিজ্ঞেস করলো,
– মেয়ের নাম কি রেখেছো?
– মার্জিয়া নুসরাত তাজ।
– সুন্দর নাম।
এদিকে নাফিসা জবাব দিলো,
– সুন্দর দেখে তো রাখছেই!
আর আশিক বললো,
– হু, তাইতো আপনি হিংসায় ফেটে যাচ্ছেন! সবাই সুন্দর সুন্দর নাম রেখে ফেলছে যার ফলে আপনার মেয়ের জন্য নামের অভাব পড়ে যাচ্ছে! দেখবো নে, নিজের মেয়ের নাম কি রাখেন! ভাইয়া, আসি তবে। বাসায় যেয়েন, আল্লাহ হাফেজ।
মেহেদী জবাব দিলো,
– ওকে, আল্লাহ হাফেজ।
নাফিসার কথায় প্রত্যুত্তর করে আশিক মেহেদীকে বিদায় দিয়ে চলে গেলো! আশিকের কথায় সবার মুখে হাসি থাকলেও নাফিসার মুখ কাচুমাচু! বাদড়টা যেন সবসময় তাকে পঁচাতে প্রস্তুত থাকে! যদি পারতো, চিড়িয়াখানায় রেখে আসতো এই বাদড় দেবরটাকে! শুধুমাত্র ইমরানের জন্য পারে না সে এক ধাপ এগিয়ে যেতে! নতুবা এই আশিক্কার খবর নিয়ে ছাড়তো!
নাহিদা, মেহেদী চলে গেলে তারা দুজন কেবিনের দিকে হাটতে লাগলো। নাফিসা বললো,
– দেখছো তোমার ভাই আমার সাথে কেমন শত্রুতা করে! আমি নাকি নাম নিয়ে হিংসা করি! এটা যদি আমার মেয়ের নাম বলতাম তো নিশ্চিত যা তা বলে পঁচিয়ে ফেলতো! আর কি সুন্দর করে তাদের জিজ্ঞেস করলো কেমন আছে! আমিও তো তার বেয়াইন প্লাস ভাবি! অথচ আমার ক্ষেত্রে ভালো মন্দ দূরে থাক, সালাম দিয়েই ঝগড়া শুরু করে! কতটা বজ্জাত তোমার ভাই! দেখেছো!
– তুমি ভাবি বলেই তো এমন করে!
– শুধু কি ভাবি! বিয়ের আগেও সবার সাথে ঠিকই ভালো ব্যবহার আর আমার সাথে ঝগড়া! কি যে ক্ষতি করছি আমি সেটাই বুঝি না! আপুও তো তার বেয়াইন ছিলো তখন, কই আপুর সাথেও তো আবার ভালো ব্যবহারই ছিলো!
ইমরান স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে যেন কিছু ভাবলো তারপর উত্তর দিলো,
– ওইযে, আগেই তো বলেছি তোমাদের সম্পর্কে তোমার চেয়ে আমি বোধহয় একটু বেশিই জানি!
– মানে!
– কিছু না, বাদ দাও।
– বাদ দিবো কেন! এমন অর্ধেক কথা বলবে না আমার সামনে! যেটা বলতে পারবে না সেটা তুলবেই না!
– তাইতো বাদ দিতে বললাম। প্রথমে ভেবেছিলাম জানো। এখন জানোনা যেহেতু আর জানার প্রয়োজন নেই। পুরোনো কথা তুললে জটিলতা বাড়ে।
– তুমি না বলছো আপুর সাথে ভাইয়ার আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো না! দেখালাম তো তার প্রমাণ! আর কতো ভালো হতে হবে!
– তুমিও তো দেখছো এবং বলছোও!
– হু, বলছি। ওটা হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য ছিলো। আমরা যেমন একদিনে মিটিয়ে ফেলতে পারি ওরা হয়তো পারেনি। তবে এখন পেরেছে তো?
– হয়তো। আর ভালো থাকলেই ভালো। সবাই চায় সংসার সুখের হোক। কেউ তো আর অশান্তির জন্য সংসার বাধে না।
– সেটাই। তোমার ভ্রান্তি দূর করলাম প্রমাণ দেখিয়ে।
– এহ! কি আমার উকিল বউটারে!
নাফিসা ভেঙচি কেটে কেবিনে প্রবেশ করলো। মায়ের কাছ থেকে বাবুকে কোলে নিলো। কিছুক্ষণ রাখার পর ইমরানের কাছে দিতে যাবে দেখলো ইমরান বেরিয়ে যাচ্ছে তার বাবা ও আরাফের সাথে কথা বলতে বলতে। এদিকে আশিক এসে তার কাছ থেকে নিয়ে নিলো। আশিক নিয়েছে দুই মিনিটও হয়নি, নার্স এসে বাচ্চাকে নিয়ে গেলো! আর নাফিসা হেসে উঠলো! আশিক তাকে হাসতে দেখে বললো,
– হাসেন? ভাবি, আপনার বাচ্চাকাচ্চাদের একদিনও কোলে নিবো না। দেখে নিয়েন।
– লাগবে না আপনার কোলে নেওয়া! হুহ্, যেনো আমার বাচ্চাকাচ্চা তার কোলে উঠার জন্য বেহুশ হয়ে যাচ্ছে!
– হবে না আবার!
– হু, উল্টাইবো!
আশিক হেসে উঠলো। নাফিসা নাজিয়ার পাশে এসে বসলো। মা কথা বলছে আর সে-ও শুনছে। কিন্তু ভাবছে অন্যকিছু! ইমরান কিসের অতীত বললো যেটা সে জানে না!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here