“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১১৪
(নূর নাফিসা)
.
.
আল্লাহর রহমতে পরবর্তী দুদিনে মেয়ে বাবুটার উন্নতি হয়েছে। আগের চেয়ে অনেকটা স্বাভাবিক তার অবস্থা। এই ক’দিন নাফিসা তাকে নিয়ে থেকেছে, যত্ন নিয়েছে, ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী কিছুটা নার্সিংয়ের কাজ করেছে। মেয়েটা মায়ের আগে খালামনির যত্ন পেয়েছে! এ যেন নাফিসারই মেয়ে! সবমিলিয়ে মেয়ে বাবুকে পুরো দশদিন রাখা হয়েছে হসপিটালে। নাজিয়া থাকাকালীন ছয়দিন আর এরপরে অতিরিক্ত চারদিন। এরমাঝে নাহিদা মেহেদীর সাথে একদিন এসে দেখে গেছে বাবুকে। আর এমনিতে ফোনে আলাপ।
হসপিটালের ঝামেলা শেষ করে আজ নিয়াজ উদ্দিনের বাসায় সবাই। নাজিয়া মেয়েকে কোলে নিয়ে মহা খুশি! তার ঘর আজ পরিপূর্ণ! আর নাফিসা ছেলে বাবুকে কোলে নিয়ে বসে ছিলো অনেক্ক্ষণ! কেননা গত চারদিন ধরে সে হসপিটালে পড়ে আছে। যার ফলে বাবুকে কোলে নিতে পারেনি! সন্তানের খুশিতে আজ নিয়াজ উদ্দিন ও রুমানা বেগমও খুশি! এতোদিন যেন কারো চেহারায় তাকানোর মতো অবস্থা ছিলো না!
বাবুদের নাম রাখা হয়েছে, আশফাক আহমেদ নির্ঝর এবং আরোহী নুযহাত। ছেলে বাবুর নাম রেখেছে নাফিসা। আর আরোহী ছিলো আরাফের দেওয়া নাম। তার সাথে যুক্ত হয়েছে নুযহাত। নুসরাতের সাথে মিল রেখে নুযহাত রেখেছেন নিয়াজ উদ্দিন। সাথে এটাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তাদের সাথে মিল রেখে ইমরানের তনয়ার নাম যেন রাখে ইসরাত। নুসরাত, নুযহাত, ইসরাত। নাফিসা ছেলে বাবুর নাম জানতে চাইলে বললো সেটা পরে ঠিক করে নেওয়া যাবে। এখন তো বোন বেশি তাই আরেক বোনের নামও চিহ্নিত করে ফেলেছে।
পরদিন নিশাত ও তার মায়েরা এসে দেখে গেছে সবাইকে। আয়েশা বেগম আরও চারদিন নাতি-নাতনীদের সাথে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। কেননা আয়াত চলে যাবে, তার শ্বাশুড়ি ফোন করে চলে যাওয়ার তাড়া দিচ্ছে। আয়েশা বেগম যেমন ছেলের বউকে বাড়ির বাইরে রাখতে চান না তেমনই তার মেয়ের শ্বাশুড়ি। তবে আয়াতের শ্বাশুড়ি খুব যত্নবান ছেলের বউয়ের প্রতি। আর আয়াতও শ্বাশুড়ির আদুরে বউমা। যার ফলে শ্বাশুড়ির ডাকের সাথে সাথেই তার চলে যাওয়ার তাড়া!
তিনি চলে যাওয়ার পর থেকে নাফিসা, আরাফ থাকে এখানে। আশিক দুএক দিন পরপর এসে দেখে যায়। ইমরানও মাঝে মাঝে আসে। নাহিদা এসেছিলো দেখা করতে৷ তারা সবাই জোরপূর্বক রেখে দিলো দুদিন। তাজ কোলে আসার পর সে আর বেড়াতে আসেনি এখানে। কেননা নাজিয়া এখানে। সে যদি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেড়াতে আসে তো তার মায়ের ঝামেলা আরও বেড়ে যাবে। তাই সে এখনও বেড়াতে আসেনি৷ আর এখন তো নাজিয়ার দুই বাচ্চা নিয়েই হুলস্থুল! সে এলে আরও বেশি কোলাহল! সে তো কোনো কাজে আসবেই না বরং আরও ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে এটা নাহিদার ধারণা। যা-ই এসেছিলো আপুকে দেখতে, বাকিরা আহ্লাদে তাকে রেখে দিয়েছে! তারা ঝামেলা পোহাতে রাজি তবুও নাহিদাকে থাকতে হবে। দুদিন পর সে ইচ্ছাকৃতভাবে চলে গেলো আবার। তবে ঝামেলার চেয়ে নিয়াজ উদ্দিন ও রুমানার আনন্দটা বেশি ছিলো তৃ-তনয়াকে একসাথে পেয়ে সাথে নাতি-নাতনি!
নাফিসা ছুটি নিয়ে এসেছিলো এক মাসের! কিন্তু তার ডাক পড়ে গেছে বিশ দিনের মাথায়! আবিদা বেগম তার ভাইয়ের বাড়ি থেকে ফোন করেছে। বাসায় বড়মা আর নিশাত আছে। জেরিন চলে আসবে তাই তাকে বাড়িঘর ঠিকঠাক ভাবে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। নিশাত একা পারবে না এতোসব! তার এখন চলে যাওয়া প্রয়োজন। নাফিসার ইচ্ছে ছিলো না যাওয়ার। তবে বিশ দিন থাকতে দিয়েছে বিধায় রুমানা বেগমই বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। ইমরানকে কল করেছিলো। ইমরান বিকেলে এসে নিয়ে গেছে। আর বাড়িতে এসেই নাফিসা কাজে লেগে গেছে। সন্ধ্যার পূর্ব থেকে রাত পর্যন্ত সে আর নিশাত রুমের আসবাবপত্র ধুয়ে মুছে রাখলো। কেননা তারা নাকি সকালে আসবে। তাহলে আর এসব কাজ করবেই কখন! বড় মা বলেছিলো বিকেলে আসতে। আবিদা বেগম জানালো আরমান সকালে তাদের বাসায় পৌছে দিয়ে অফিস যাবে! তাই এতো তাড়া! বড় মা রান্নার দিক সামলে নিয়েছে। তারাহুরো করে এতোসব করে ঘুমানোর সময় নাফিসার হাত ব্যাথায় প্রায় কান্না করার উপক্রম হয়েছে! আর ইমরান তাকে বকাঝকা করতে করতে সেবা করে যাচ্ছে! কেননা ইমরান নিষেধ করেছিলো এতোসব করতে। এতোই যেহেতু তাড়া একটু ঝেড়ে পরিষ্কার করে রাখলেই পারতো। কে বলেছে এই রাতের বেলা বিছানার চাদর, জানালার পর্দা, টেবিল ম্যাট কাচা কাচি করতে! অন্যদিকে নিশাত সুস্থ আছে। কেননা সে নাফিসার হেল্পার হিসেবে কাজ করছিলো বিধায় তার এতোটা পরিশ্রম হয়নি।
পরদিন সকালে আবার লেগে গেছে উঠুন বাড়িঘর ঝাড়ু দিতে! ইমরান বাজার থেকে ফিরে তাকে ঝাড়ু দিতে দেখে রেগে বললো,
“আবার ঝাড়ু ধরছে!”
নাফিসা ইমরানকে দেখে উঠুন অর্ধেক ঝাড়ু দেওয়া বাকি রেখেই ঝাড়ু ফেলে দৌড় দিলো নিজের ঘরে! কেননা গত রাতে ইমরান ঘুমের অর্ধেক সময় নষ্ট করেছে তার সেবা করেই!
ইমরান বড় ঘরে চলে গেলে নাফিসা নিশাতের কাছে এসে বললো বাকিটুকু ঝাড়ু দিয়ে দিতে। আর নাফিসা নিশাতের রুমে বন্দী হয়ে রইলো যতক্ষণ পর্যন্ত না ইমরান অফিসের জন্য রেডি হয়! ইমরান রেডি হয়ে গেলে সে এসে নাস্তা দিয়েছে। অত:পর ইমরান অফিস চলে গেলো! নিশাত, নাফিসা কেউই ভার্সিটি যায়নি বাসায় বাবু আসবে বলে। তারা হসপিটাল গিয়ে দেখে এসেছিলো এরপর আর দেখেনি বাবুকে। কিন্তু আফসোস! সারাদিন অপেক্ষা করেও বাবুর দেখা পেলো না! ইমরান বাসায় ফিরে নাফিসাকে ঘরে দেখে বললো,
– কোথায় তোমাদের বাবু? রাতেই সব কাজের তাড়া! এখন তো সারাদিন পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে!
নাফিসা মুখটা মলিন করে বললো,
– আমি কি জানি! আম্মা বলছে সকালেই নাকি আসবে!
– হু, আসবে! বেড়াতে গিয়েই কি সকালে কোনোদিন বাড়ি এসেছে!
– সেটা আমি জানি! আমাকে এভাবে বলো কেন!
– বলবো না! না করা সত্ত্বেও আমার কথা তোমার কান অব্দি পৌছায় না! নিজের মর্জিতে কাজ করে যাও।
নাফিসা চুপ হয়ে আছে। ইমরানও চুপ। নাফিসা আবার নিচু স্বরে বললো,
– ভাইয়া কি অফিস যায়নি?
– হুম।
– কথা হয়েছে, আজ আসবে কি আসবে না?
– অফিস টাইম শেষ করে গেছে। নিয়ে আসবে এখন।
কিছুক্ষণ পরেই তারা এসে গেছে। বাবু ও জেরিন উভয়েই সুস্থই আছে। সিজারিয়ান পেশেন্ট না হওয়ায় জেরিনকে দেখতে অনেক ভালো লাগছে নাফিসার কাছে। আর এসময় তার আপুদের দিকে তাকালে তার কান্না আসে! তারা না পারে কোনো কাজ করতে আর না পারে ইচ্ছে মতো একটু নড়াচড়া করতে। নাহিদার কতদিন পেরিয়ে গেলো, এখনো তাকে বেছে বেছে কাজ করতে হয়!
বাবুর নাম রাখা হয়েছে জিদান। বাসায় নতুন অতিথি এলে সবসময়ই নাফিসার মাঝে অন্যরকম আনন্দ কাজ করে। রান্নাবান্নার কথা যেন সে ভুলেই গেছে। বাবু সজাগ থাকায় অনেক্ক্ষণ যাবত তাকে কোলে নিয়ে রেখেছিলো। জেরিন কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখছিলো আর নিশাত ও নাফিসা বাবুর সাথে দুষ্টুমি। জিহান পড়ে আছে তার চাচ্চুর কাছে! কতকিছু তার নষ্ট হয়ে আছে, তা সব জমা করে রেখেছে চাচ্চু ঠিক করে দিবে বলে। চাচ্চু তার পার্সোনাল মেকার। তার বাবাকে দেখতেও দেয় না কিছু। তার মতে কেবল চাচ্চু পারে আর চাচ্চুই ঠিক করবে সব। চাচ্চু বলবে বাতিল তো সাথে সাথে ময়লায় ছুড়ে ফেলে। আর অন্যকেউ বাতিল বলে ফেলে দিলে চিৎকার করে কান ঝালাপালা করে ফেলে ময়লা থেকে উঠিয়ে এনে দেওয়ার জন্য!
তারা আনন্দে মেতে আছে বিধায় বড়মা একা একাই রান্না করছেন। আবিদা বেগম এসে নাফিসাকে বললো,
– এহন কি বাচ্চা কোলে নিয়াই বইসা থাকবা! বুবু যে একলা রান্না করে, দেখবা না একটু!
রান্নার কথা মনেই ছিলো না বিধায় নাফিসা জ্বিভ কেটে বাবুকে রেখে কিচেনের দিকে অগ্রসর হলো। সে এলে বড়মা মাগরিবের নামাজ পড়তে চলে গেলো। আবিদা বেগম কিচেনে এসে নাফিসার সাথে কাজে হাত লাগালো এবং বললো,
– আরাফের বাচ্চারা কেমন আছে?
– আলহামদুলিল্লাহ। ভালোই আছে।
– হু, আল্লাহ হায়াতে বরকত দিয়া ভালো রাখলেই হয়।
– বউ সুস্থ হয় নাই?
– আগের চেয়ে কিছুটা ভালো।
– চলাফেরা করতে পারে?
– ঘরের মধ্যেই চলাচল করে। এমনিতে কোনো কাজ করতে দেয় না মা।
– যাক, সুস্থ হইয়া যাইবো। তুমিও বাচ্চাকাচ্চা নিয়া নেও।যাতে লেলেপুলে বড় কইরা দিয়া মরতে পারি। ক’দিন আল্লাহ হায়াত রাখছে কে জানে! বড় ছেলের ঘরে নাতি দেখার সুযোগ তো আল্লাহ দান করছে। দুই নাতি দেখলাম।
নাফিসা চুপচাপ তার কাজ করে যাচ্ছে। তার এখানে বলার মতো কিছুই নেই! শুনতেও লজ্জা লাগছে! যদি পারতো মুখের সাথে কানও বন্ধ রাখতো!
নাফিসার ধাক্কাধাক্কিতে ইমরান আবার বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বই হাতে নিয়েছিলো। ডিনার শেষে ইমরান ঘরে চলে এসেছিলো আর নাফিসা কিছুক্ষণ জেরিনের কাছে বসেছিলো। পরে ঘুমানোর জন্য নিশাতের সাথে নিজেদের ঘরে চলে এসেছে। দরজা চাপানো রেখে ইমরান বই নিয়ে পড়ছে। নাফিসাকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে ইমরান বললো,
– তোমাকে নিষেধ করেছিলাম জেরিনের কাছ ঘেঁষতে।
– আমি বাবুকে দেখতে গেছি।
– হুম, মানলাম বাবুকে দেখতে গেছো। তবে আবারও মনে করিয়ে দিলাম কথাটা। এমন করে প্রতিদিন বাবুকে দেখার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা তার পাশে পড়ে থাকতে যেন না দেখি। আমিও বাবুকে কোলে নিয়েছি, তাই বলে জেরিনের সাথে আড্ডায় জমে যাইনি।
– ভাবি কিন্তু আগের মতো নেই। ভালো হয়ে গেছে।
– আমি কারো ভালো খারাপ দেখতে চাইনি। তোমাকে সাবধান করাটা প্রয়োজন মনে করেছি তাই করেছি। এবার মানবে কি মানবে না সেটা তোমার ব্যাপার।
– সরি, আর আড্ডা দিবো না।
– পড়াশোনা তো তোমাকে ছেড়ে অনেক দূর চলে গেছে! ধরতে চেষ্টা করবে কবে থেকে? ওবাড়িতে থেকেছো, দুই একটা বই সাথে নিলে কি ফ্রী টাইম পড়াশোনায় কাজে লাগানো যেতো না! এতোটা ব্যস্ত তুমি থাকোনি সেটা তো আমার খুব ভালোই জানা আছে! এতো ফাকিবাজি কেন দেখা যাচ্ছে?
নাফিসা কিছু বললো না। চুপচাপ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মাথা আঁচড়ে নিচ্ছে। কি আর বলবে! ফ্রী টাইম থাকলেই কি! এতো মজার মুহূর্তে কি পড়াশোনায় মনযোগ বসে! সেটা একটু বুঝে না কেন পাজি লোকটা! ইমরান পড়া বন্ধ করে বই বুকসেল্ফে রাখতে রাখতে বললো,
– কাল থেকে যেন বই নিয়ে বসতে দেখি।
নাফিসা চুল বিনুনি করতে করতে বললো,
“তুমিও বাচ্চাকাচ্চা নিয়া নেও।যাতে লেলেপুলে বড় কইরা দিয়া মরতে পারি। ক’দিন আল্লাহ হায়াত রাখছে কে জানে! বড় ছেলের ঘরে নাতি দেখার সুযোগ তো আল্লাহ দান করছে। দুই নাতি দেখলাম। ছোট ছেলের ঘরে কবে দেখমু?”
শেষ কথাটা একটু বাড়িয়ে বলে আড়চোখে ইমরানের দিকে তাকালো সে! ইমরান ব্রু কুচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে! তাই সে বললো,
– আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমি বলিনি এই কথা। আম্মা বলছে। তোমাকে শোনানোর জন্য একটু রিপিট করলাম। এই আরকি।
– আম্মা বলছে?
– হু।
– আর জবাবে তুমি কি বলছো?
– বলছি, আমার কাছে বলে কোনো লাভ নেই আম্মাজান। আপনার ছেলের কানে পৌছে দিয়েন কথাটা।
ইমরান বিস্ময়কর ভাবে বললো,
– বলছো তো এই কথা?
– হু।
– আচ্ছা।
ইমরান দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে। নাফিসা ঝটপট জিজ্ঞেস করলো,
– কই যাও?
ইমরান পিছু ফিরে বললো,
– তুমি যেহেতু বলেছো আমার কানে পৌছে দিতে আমিও তোমার আম্মার কানে পৌছে দিয়ে আসি যে, ছোট বউমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হলে নাতিনাতনি আসবে।
নাফিসা মুখে বিষন্নতার ছাপ এনে বললো,
– আমি তো মনে মনে বলছি সেই কথা!
ইমরান হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো। নাফিসা দ্রুত দরজার কাছে এসে উঁকি দিয়ে দেখলো সে সত্যি সত্যিই আবার মায়ের কাছে যায় কি-না! ইমরান বাথরুমের কাছে এসে রুমের দিকে তাকিয়ে নাফিসাকে উঁকি দিতে দেখে ফেললো! নাফিসা দ্রুত রুমে চলে এলো। এবং নিশ্চিত হলো সে বাথরুমে যাচ্ছে। ইমরান রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিতেই নাফিসা তাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে আছে! মুখে তার হাসি বিদ্যমান। ইমরান অবাক হয়ে বললো,
– আরে! হলো টা কি!
নাফিসার কোনো জবাব নেই। ইমরান তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলে সে আরও আঁকড়ে ধরে রইলো! ইমরান শান্ত গলায় ডাকলো,
– নাফিসা?
এবার নাফিসা চোখ বন্ধ রেখেই ফিসফিস করে বললো,
– সবার ঘরেই বাবু আছে। আমাদের ঘরে নেই কেন? আমাদের ঘরেও তো বাবুর প্রয়োজন।
– মাথায় চেপে গেছে বুঝি ভুত!
– হু, আমি কিন্তু সিরিয়াস।
– আমাদের ঘরেও আসবে ইনশাআল্লাহ চারপাঁচ বছর পরে।
নাফিসা মাথা তুলে ব্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– চারপাঁচ বছর পরে কেন?
ইমরান তার নাক টেনে বললো,
– বাবুর মা কে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে হবে আগে।
– বাবু এলে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা যাবে না?
– অন্তত তোমার পক্ষে সম্ভব না।
– কেন?
ইমরান এবার গম্ভীর হয়ে বললো,
– ফার্স্ট ইয়ারে সেকেন্ড ক্লাস পাইছো, মনে আছে? এতো সুবর্ণ সুযোগ থাকতেও পারোনি পড়াশোনায় একটু মনযোগী হয়ে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে আসতে, আবার বাবু!
– প্লিজ, এইবার পারবো।
– কোনো প্রয়োজন নেই তো! আগে পেরে দেখাও।
নাফিসা গোমড়া মুখু হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
– এখন কি বাবু আসবে না?
– না।
নাফিসা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে হনহন করে বিছানায় যেতে যেতে বললো,
– হুহ্, দেখবো নে ক’দিন থাকে এমন! এসে গেছে না বাড়িতে! পাশের ঘরে যখন দুইটা টেও টেও একসাথে বাজবে তখন দেখবো নিজের এমন সিদ্ধান্ত ক’দিন স্থির থাকে!
ইমরান মুখ টিপে হাসলো তার কথায়। অত:পর লাইট অফ করে ঘুমানোর সময় নাফিসাকে টাচ করলেই নাফিসা তার হাতে এক ঘা মেরে দিলো। ইমরান তাকে হাত পা দ্বারা নিজের সাথে গুটিয়ে নিয়ে বললো,
– আমার ঘরে এই টেও টেওয়ের জ্বালায়ই তো বাঁচি না! আরো টেও টেও এলে আমি কাকে রেখে কাকে সামলাবো!
– ছাড়ো! একদম টাচ করবে না আমাকে!
– বাবুর মা আরেকটু বড় হোক, পড়ে বাবুদের চিন্তাভাবনা। নড়াচড়া করলে মাইর দিবো কিন্তু এখন। চুপচাপ ঘুমাও।
নাফিসা জানেই তার শক্তির কাছে হার মানতে হবে তাই আর অযথা নিজের শক্তি খরচ করলো না।
সকালে জেরিন জিহানকে ভাত খাওয়াচ্ছিলো। আর নিশাত জিদানকে নিয়ে হাটছে ঘরের ভেতরেই। ইমরান মাত্র নাস্তা করেছে। নিশাতকে আবিদা বেগম ডাকলে সে ইমরানকে বললো,
– ভাইয়া, ধরো তো একটু।
ইমরান ফোনে কথা বলছিলো তার কোনো এক ফ্রেন্ডের সাথে। সে ফোন কাধে চেপে হাত বাড়িয়ে ধরতে যাবে এমনি নাফিসা এসে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজে কোলে নিয়ে বললো,
– সরো, বাবুদের একদম টাচ করবে না তুমি!
ইমরান হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে! নাফিসার কথায় জেরিন তাকিয়েছিলো তাদের দিকে। নাফিসাকে গোমড়া মুখু হয়ে বেরিয়ে আসতে দেখে জেরিন বললো,
– কি হয়েছে?
– কিছু না। জাস্ট ওর বাবু কোলে নেওয়া নিষেধ।
নাফিসার মুখভঙ্গি দেখে জেরিন মুখ টিপে হেসে নিজের কাজে মনযোগ দিলো। ইমরান বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললো,
“থাক, না ই বা নিলাম আমি। তুমিই নাও বেশি বেশি। বইটাও যেন কোলে নিতে দেখি।”
সন্ধ্যায় দুইভাই টিভিতে নিউজ দেখছিলো। আরমান বাইরে যাবে তাই জেরিনকে ডাকলো কোলে থাকা জিদানকে নেওয়ার জন্য। জেরিন নিজের রুমে কিছু করছিলো যার ফলে দুই মিনিট সময় চাইলো। তাই ইমরান তার কাছ থেকে নিজে কোলে নিয়ে বসে রইলো। আরমান বেরিয়ে গেলো। নাফিসা এসে দেখলো সোফায় বসা ইমরানের কোলে জিদান, একহাতে ফোন, অন্যদিকে টিভিও চলছে, আর খাটে জিহান এলোমেলো হয়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। ইমরানের মনযোগ ফোনের দিকে। হঠাৎই নাফিসার মাথায় দুষ্টুমি চাপলো! সে সিটি বাজাতে শুরু করলো। ইমরান আড়চোখে তার দিকে একবার তাকিয়েছিলো। আশেপাশে কেউ না থাকায় সিটি বাজানোর কারণে কিছু বললো না। আবার নিজের কাজে মনযোগ দিলো। নাফিসার সিটি বাজানোতে এদিকে জিদানও তার কাজ সেড়ে নিলো! জিদানের কাঁথা ভেজা অনুভব করতে পেরে ইমরান চমকে দাড়িয়ে গেলো! আর কাজ হয়ে যাওয়ায় নাফিসা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো! কাথা তো ভিজেছেই, ইমরানের লুঙ্গিও গেছে! একটু পর ইশার নামাজ পড়তে যাবে, এখনই এমন কিছু হওয়াটা প্রয়োজন ছিলো! সে এতোক্ষণে বুঝতে পারলো নাফিসা কেন সিটি বাজিয়েছে! তাকে দাত কিড়মিড়িয়ে তাকাতে দেখে নাফিসা গান ধরলো,
“তেরিহি, মেরিহি, তেরি মেরি… তেরি মেরি কাহানী…! হিহিহি…!”
ইমরান জিদানকে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– নামাজ পড়তে যাবো, এমনটা না করলেই কি পারতে না! যাক, আমার কি! এগুলো ধুয়ে দিবে কে? হুম?
নাফিসা ব্রু কুচকে বললো,
– একদম পারবো না আমি।
– না পারো। আমিও পারবো না। পড়ে থাকুক!
নাফিসার রাগান্বিত মুখ দেখে এবার সে-ও গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে গেলো, “তেরি হি, মেরি হি, তেরি মেরি…! তেরি মেরি কাহানী….!”