“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১২
(নূর নাফিসা)
.
.
আলফাজ সাহেব উক্ত বিয়ে ক্যান্সেল করে দিয়েছেন সেটাই আরাফকে বলার জন্য ডেকেছেন। সেই সুবাদে আরাফ আয়াতের বিষয়ে বাবাকে সব টা জানিয়ে দিলো। সমন্ধটি আলফাজ সাহেব ফিরিয়ে দেওয়ায় আয়েশা বেগম শুরুতে গোমড়া মুখু হয়ে ছিলেন। আর এখন আয়াতের কথা শুনে তো তেলে বেগুন জ্বেলে উঠলেন! আয়েশা বেগম রেগে বসা থেকে উঠে আয়াতের কাছে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে যেতে লাগলে আরাফ বাধা দিয়ে বললো,
– মা, এখন উল্টাপাল্টা কিছু বলতে যেও না। বিপরীতে আরও ভয়ংকর কিছু ঘটাতে পারে। তার বয়সটা এখন আবেগময়! সবাই নিজেকে আপ্লুত রাখতে পারে না। কাউকে কোনো কিছু না জানিয়েই যেহেতু আজ এতো বড় পদক্ষেপ নিতে পেরেছে, এখন এসব নিয়ে তুমি বকাঝকা করলে জেদের বসে আরও ভয়ংকর কিছু ঘটাতে দ্বিতীয়বার ভাববে না আয়াত! বাবা তুমি ঠান্ডা মাথায় কথা বলো তার সাথে। হয়তো এতে কাজ হবে। আর কি করবে ভেবে দেখো। তবে দুশ্চিন্তা করো না। ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে ভাবো। আল্লাহ যা করে সব ভালোর জন্যই করে।
আরাফ এখন তার বাবাকে যা বুঝালো একটু আগে ঠিক এই কথাগুলোই নাজিয়া আরাফকে বলেছিলো। আর আরাফ সেটা ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই ভেবেছে এবং বাবামায়ের সামনে নির্দিধায় তুলে ধরেছে। আলফাজ সাহেব এসব বিষয় নিয়ে আয়াতকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করতে নিষেধ করে দিলেন আয়েশা বেগমকে। কেননা আরাফ ঠিক বলেছে, এইটুকুতেই তার মেয়ে গলায় ফাস দিতে গিয়েছে! সেখানে যদি রেগে গিয়ে বকাঝকা বা মারধর করে তাহলে ভয়ংকর কিছু ঠিকই ঘটিয়ে ফেলবে!
আলফাজ সাহেব আরাফকে নিয়ে নিজে আয়াতের ঘরে গেলেন। ছেলে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে আর আয়াত মাথা নিচু করে সব উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বললো ছেলে যদি এখন বিয়ে করতে চায় তাহলে যেন তার পরিবার নিয়ে আসে। আর যদি বিয়ে করতে না চায় তাহলে তারা অন্যত্র ব্যবস্থা করবে আর আয়াত সেখানে অবাধ্য হতে পারবে না। আয়াত নিশ্চিত করলো সে তুর্যকে জানাবে।
.
গতকাল নাহিদার পরীক্ষা শেষ হলো। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বিছানাপত্র গুছাতে গুছাতে দুইবোন পরিকল্পনা করছে আগামীকাল নাজিয়ার বাসায় যাবে কিন্তু জানাবে না তাকে। হঠাৎ করে গিয়ে সারপ্রাইজ দিবে বড় আপুকে। অনেকদিন হলো বোনের সাথে দেখা হয় না। সে তো আসতেই পারে না, তাই তারাই যাবে কাল, আর জমিয়ে আড্ডা দিবে তিনবোন। ঘুমানোর জন্য দুজনেই শুয়ে পড়লো। নাহিদা ফেসবুকে লগইনের জন্য মোবাইল হাতে নিতেই দেখলো কোনো এক অজানা নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে,
” নিশিতে মিশে থাকো তুমি,
আর সেই নিশিপথে হেটে যাই আমি।
পথ ভুলে যাই তবু না ভুলি তোমায়।
শুধু তোমায় ভালোবেসে নিজেকে মাখাই সেই পথের ধূলিকণায়।
অযথা কেন করছো এমন হেলা!
তুমি এলেই না তবে সার্থক হবে আমার সর্বাঙ্গের ধুলিমাখা খেলা।”
নাহিদার আর ফেসবুকে লগইন করা হলো না! সে সাথে সাথেই মেসেজটা ডিলিট করে মোবাইল রেখে দিলো। মানুষটা এমন কেন! এতোকরে নিষেধ করার পরও এভাবে প্রেমে আহ্বান জানায়! চাইলেই কি সম্ভব! সে কি বুঝে না, ম্যাচুরিটি বলেও একটা বিষয় আছে! তাহলে এতোটা পাগলামো কেন করছে! আর সে কি জানেনি এখনো তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এমনকি এনগেজমেন্টও হয়ে গেছে! হয়তো জানে না! তাহলে তাকে জানাতে হবে। দিনের পর দিন তার এমন পাগলামো সহ্য করা যাবে না।
সকালে নাস্তার পর নাহিদা গোসলের জন্য কাপড়চোপড় নিয়ে বাথরুমে গেলো। এক মিনিট হতে না হতেই দরজায় দাপদুপ ঢোল বাজতে লাগলো। আর সাথে কণ্ঠধ্বনি,
– আপু! আপু! দরজা খুলো!
নাহিদা ভেতর থেকে জবাব দিলো,
– আরে! কি হয়েছে তোর!
– আরে বেরিয়ে এসো তারাতাড়ি!
– কেন?
– আমি যাবো।
– আমার পরে।
– আরে, গোসল না। আমার এখন যাওয়া জরুরি! মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট!
– আমি গোসলে আসলে তোর মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট এসে যায়!
– হু, তারাতাড়ি বের হও! আর পারছি না!
ওদিকে রুমানা বেগম ঘরের ভেতর থেকে নাফিসাকে এমন ঢাকঢোল পিটাতে দেখে ধমকাচ্ছেন। আর এদিকে নাহিদা বুঝে গেছে নাফিসা টয়লেটে যাবে। তাই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সে। নাফিসা তাকে ঠেলে সরিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়লো,
– ওফ্ফ! সরো সরো!
– ইশ! কোনো সময় গময় নেই! অসময়ে এসে শুধু বিরক্ত! যত্তসব! এজন্যই বাড়িতে আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা রাখতে হয়!
নাফিসা বাথরুমে চলে গেলে নাহিদা গুনগুন করতে করতে উঠুনে হাটতে লাগলো। তিনচার মিনিটের মতো অতিক্রম হওয়ার পরও নাফিসা বের হচ্ছে না তাই নাহিদা বাইরে থেকে বললো,
– নাফিসা, ঘুম পেয়েছে? বালিশ এনে দিবো?
নাফিসা বাথরুমের দরজা খুলে মাথা বের করে বললো,
– কিউটিপাই আপ্পিটা, আমার জামাকাপড় গুলো এনে দিবা? খাটের এক কোনে রেখে এসেছি আমি।
নাহিদা তাকিয়ে দেখলো নাফিসার মাথা ভেজা! সে মিথ্যে বলে এতোক্ষণে গোসল সেড়েছে! মেজাজ তার এখন প্রচন্ড খারাপ হচ্ছে! কতবড় ভন্ড মেয়ে! ভন্ডামিতে এক নম্বর ওস্তাদ! নাহিদা রেগে বললো,
– নাফিসা….! তোর মাথা ফাটায় ফেলবো আমি! বের হ! বের হ বলছি!
নাফিসা দাত বের করে হেসে বললো,
– তুমি জানো না, আমার চুল শুকাতে সময় লাগে! তাহলে আগে ঢুকেছো কেন! এর শাস্তি এটা! যাও যাও, ভদ্র আপুর মতো আমার জামাকাপড় গুলো এনে দাও। ভেজা কাপড়চোপড়ে ঘরে প্রবেশ করলে তো মা বকা দিবে।
নাহিদা তেড়ে এদিকে আসতে আসতে বললো,
– তোর জামাকাপড় এনে দিবো আমি! জামাকাপড় কেন, চটের বস্তাও পাবি না তুই! বের হ…!
নাফিসা হাসতে হাসতে দ্রুত দরজা বন্ধ করে চেচিয়ে বললো,
– চটের বস্তা লাগবে না। জামাকাপড় নিয়ে এসো। নতুবা তোমার জামাকাপড়ই পড়ে নিবো!
– নাফিসা! মেরে ফেলবো একেবারে!
– হু হু হু হা হা হা! তারাতাড়ি যাও, গোসল আমার এখনো অর্ধেক বাকি!
নাহিদা জোরে দরজায় লাথি দিলো! তাদের হৈ-হুল্লোড় শুনে রুমানা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ধমকের সুরে বললো,
– এমন শুরু করেছিস কেন তোরা!
– দেখো না, তোমার ইতর ভন্ড ছোট মেয়ে আমাকে বাথরুম থেকে বের করে সে গোসল সেড়ে নিচ্ছে! এখন আবার বলছে তার জামাকাপড় নিয়ে আসার জন্য!
– তোর চেয়ে কত ছোট সে আবার তোকে বের করে কিভাবে!
– সেটাই তো আমার প্রশ্ন!
– চরম বোকা মেয়ের জন্ম হয়েছে আমার ঘরে! ক্ষনে গলাগলি, ক্ষনে ঝগড়া! এগুলো নিয়ে যে কোথায় যাই!
বিড়বিড় করতে করতে রুবিনা ঘরে চলে গেলো। আর নাহিদা কপাল চাপড়ে বললো,
– ওফ্ফ! এই নাফিসার জন্য, শুধুমাত্র এই নাফিসার জন্য আজ মায়ের কাছে বোকা মেয়ে হয়ে গেলি নাহিদা! নো নো নো! নাফিসা, তোর তো আমি খবর নিয়ে ছাড়বো!
– ওক্কে! খবরাখবর পরে নিও! আপাতত আমার জামাকাপড় নিয়ে এসো।
– পারবো ন আকার না!!!
রুবিনা বেগম নাফিসার জামাকাপড় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দুজনকেই বকাঝকা করতে করতে নাফিসার হাতে জামাকাপড় দিয়ে গেলো। গোসল সেড়ে নাফিসা দাত কেলিয়ে বের হলে নাহিদা এক ঘা মারার জন্য হাত বাড়াতেই নাফিসা “মা…!” বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো আর নাহিদা বাথরুমে ঢুকে পড়লো!
দুজনেই ঝটপট রেডি হয়ে গেলো আপুর বাসায় যাওয়ার জন্য। মায়ের কাছে বলে বেরিয়ে গেলো তারা। নাজিয়া মাছ কাটছিলো উঠুনের এক কোনে বসে। আশিক মাত্রই বাড়ির দিকে আসছিলো, তার আগেই দেখলো নাফিসা নাহিদা তাদের বাড়িতে প্রবেশ করছে। দ্রুত পা চালিয়ে পেছন থেকেই বললো,
– হেই, ডাবল এন! ওহ না! ট্রিপল এন, কেমন আছো?
নাহিদা নাফিসা দুজনেই পেছনে তাকালো এতোক্ষণে আশিক তাদের পাশাপাশি এসে হাটতে লাগলো তাও আবার নাহিদার পাশ দিয়েই। নাহিদা জবাব দিলো “আলহামদুলিল্লাহ” আর নাফিসা বরাবরের মতোই ত্যাড়াব্যাড়া (আঁকাবাকা)।
– ভালো না থাকলে এই পর্যন্ত আসতে পারতাম নাকি!
– হুম তা তো ঠিকই। তবে আগে জানলে তো আমি বাসা থেকে নিয়ে আসতাম। তাহলে আরও ভালো থাকতে পারতে!
– আল্লাহ, পা দিয়েছে এবং পায়ে যথেষ্ট শক্তি দিয়েছে। তাহলে আপনার কাধে ভর করে কেন আসতে যাবো!
আশিক মাথা চুলকানো ভঙ্গিতে বললো,
– নাহিদা, নাফিসাকে কি আন্টি মধুর বদলে মরিচ খায়িয়েছে?
নাফিসা চোখ রাঙালো আশিকের দিকে আর নাহিদা নিশব্দে হেসে উঠলো! নাহিদার হাসিতে তাল মিলিয়ে আশিকও নিশব্দে হেসে বললো,
– বিলিভ মি, নাফিসাকে ভার্সিটিতে যতবার দেখেছি শুধু ঝালমুড়ি আর ফুচকা খেতে দেখেছি। কখনো মিষ্টি জাতীয় কিছু খেতে দেখিনি। ইভেন, একদিন ডেইরি মিল্ক চকলেটও সেধেছিলাম। নিলো না! তখন থেকে আমি শতভাগ নিশ্চিত সে মিষ্টি মুখে তুলে না সবসময় ঝাল খায় আর সেজন্যই ঝাল ঝাল কথা বলে!
নাফিসা ভেঙচি কেটে বললো,
– ভালো জেনেছেন। হুহ!