“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১৩
(নূর নাফিসা)
.
.
– বিলিভ মি, নাফিসাকে ভার্সিটিতে যতবার দেখেছি শুধু ঝালমুড়ি আর ফুচকা খেতে দেখেছি। কখনো মিষ্টি জাতীয় কিছু খেতে দেখিনি। ইভেন, একদিন ডেইরি মিল্ক চকলেটও সেধেছিলাম। নিলো না! তখন থেকে আমি শতভাগ নিশ্চিত সে মিষ্টি মুখে তুলে না সবসময় ঝাল খায় আর সেজন্যই ঝাল ঝাল কথা বলে!
নাফিসা ভেঙচি কেটে বললো,
– ভালো জেনেছেন। হুহ!
নাফিসা বিরক্তি নিয়ে তাদের আগে পা চালিয়ে গেলো। নাজিয়া নাফিসাকে দেখে অবাক সাথে মুখে হাসির ঝিলিক। পেছনে আবার নাহিদাকেও দেখলো। আশিক বললো,
– ভাবি, তোমার বোনেরা পথ ভুলে গিয়েছিলো। আমি দেখে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে এলাম।
নাফিসা বললো,
– একদম মিথ্যে কথা আপু।
নাজিয়া হেসে আশিককে উদ্দেশ্য করে বললো,
– হ্যাঁ জানিতো, পথ ভুলতে নিশ্চয়ই তুমি সহায়তা করেছো।
– ধুর! আমি আরও নিয়ে এলাম তুমি উল্টো আমাকে দোষারোপ করছো!
– না, তো! একটুও দোষারোপ করছি না।
নাফিসা বললো,
– এমন অসময়ে কিসের মাছ কাটতে বসেছো!
– অসময়কেই সময় বানিয়ে নিয়েছি। যা, ঘরে গিয়ে বস। আমার হয়ে গেছে আমি আসছি।
নাজিয়া মাছ ধুয়ে ফ্রিজে রেখে দিলো। অত:পর তার রুমে এসে বললো,
– কি রান্না করবো তোদের জন্য, বল?
নাফিসা বললো,
– কিছু রান্না করতে হবে না। তোমাকে কবে থেকে দেখি না! আজ তাই তোমাকে দেখতে এসেছি আর তোমার সাথে এত্তো এত্তো গল্প করে যাবো।
– খালি পেটে থাকলে তো আর গল্প করতে পারবো না! সবাই তো আর নাফিসা না! নাজিয়া আর নাহিদার পেট থেকে কথা বের হবে না।
– বুঝি না আমি তোমাদের! কখনো আমাকে তোমরা পেটুক উপাধি দিয়ে যাও, আবার কখনো নিখাদক!
– হিহিহি নিখাদক! আচ্ছা, সব কথা বাদ, এবার বল কি রান্না করবো? বিরিয়ানি?
নাহিদা নিষেধ করলো। অত:পর নুডলসের কথা বলতেই নাফিসা হ্যাঁ বলে দিলো। পাচশ টাকার নোটটা বের করে নাজিয়া আশিককে ডাকলো দোকান থেকে নুডলস এনে দেওয়ার জন্য। আশিক টাকা নিয়ে দোকানে চলে গেলো। অন্যসময় হলে নিতো না টাকা কিন্তু তার হাতই আজ ফাকা।
আশিক নুডলস এনে দিলে নাজিয়া রান্না বসিয়ে দিলো। দুইবোন পাশে দাড়িয়েই গল্প করছে। নাহিদা নাজিয়াকে পাঠিয়ে দিলো গোসল করার জন্য আর সে নুডলস দেখছে। নুডলস হয়ে গেলে নাহিদা নাফিসা আয়াতের সাথে বসে টুকটাক গল্প করছে। গোসল শেষ করে এসে নাজিয়া কাচের প্লেট ধুয়ে ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় অসাবধানতাবশত একটা প্লেট পড়ে তিন টুকরো হয়ে গেছে! তা দেখে আয়েশা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন,
– দেখছোস! দেখছোস, কি করলো! কি অলক্ষুণে বউ জুটলো আমার কপালে! কোনো একটা কাজ ঠিকমতো করতে পারছে আজ পর্যন্ত! এইটা কি বিয়ে করে আনছে আমার ছেলে!
নাজিয়া ভাঙ্গা কাচ তুলতে গিয়েছিলো। আয়েশা বেগমের মুখে এমন কথা শুনে তার হাত কেটে গেছে! এদিকে কাচ ভাঙ্গা শব্দ আর আয়েশা বেগমের কর্কশ কণ্ঠ শুনে ছেলেমেয়ে সব বেরিয়ে এলো। আশিক বললো,
– মা, একটা প্লেট ভেঙেছে এর জন্য এসব কি উল্টাপাল্টা বকছো! তোমার হাত থেকে কিছু ভাঙে না!
– শুধু কি প্লেট ভাঙ্গছে! আমার সংসার ভাঙ্গার জন্য উঠেপড়ে লাগছে!
নাহিদা ও নাফিসা দ্রুত পায়ে নাজিয়ার কাছে এলো হাত থেকে রক্ত পড়ছে দেখে। নাহিদা নাজিয়ার হাত দেখতে লাগলো আর নাফিসা বাকি প্লেটগুলো নিয়ে নিলো হাত থেকে। আয়েশা বেগমের কথায় নাজিয়া বললো,
– আম্মা, এসব কি বলছেন!
– চুপ কর, মুখপোড়া! অলক্ষুণে একখান ঘরে বইসা আছে! শান্তি কেমনে জুটবো! আমার ছেলেটাকে বশ কইরা আমার বিপক্ষে নিয়া গেছে। আজ আমার সাথে চোখ রাঙায় আমার ছেলে! মেয়ের বিয়ে ঠিক করি, ওইটাও বারবার ভাইঙা দেয়! এই বাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকে একটা না একটা বিপদ সংসারে লেগেই আছে এই অলক্ষীর জন্য!
আশিক তার মাকে থামতে বলছে কিন্তু শুনছে না তিনি! নাফিসা তার বোনকে নিয়ে এসব শুনতে না পেরে জবাব দিলো,
– কিসব আজেবাজে বকে যাচ্ছেন আন্টি! মুখ সামলে কথা বলুন!
পাল্টা জবাব পেয়ে আয়েশা বেগম ছ্যাত করে উঠলো,
– কিহ! মুখ সামলে কথা বলতাম! আমি মুখ সামলে কথা বলতাম! কি করবি তুই! হ্যাঁ! লজ্জা করে না অন্যের বাড়ি এমন কইরা পইড়া থাকতে! ক’দিন গেছি তোদের বাড়ি! পোড়া কপালী একটা ঘরে পইড়া থাইকা তো সংসার খাইতাছেই, সাথে মানুষের মাথাও খাইতাছে! বিয়ার ছয়মাস চলে, না পারলো আজ পর্যন্ত সংসারে একটু সুখ আনতে আর না পারলো একটা নাতিনাতনি এনে দিতে! কে জানে কোন বন্ধ্যা হইয়া রইছে!
কথাটা প্রচন্ড আঘাত হানলো নাজিয়ার বুকের বাঁ পাশে! নাফিসা রেগে তার হাতের প্লেট সাথে সাথেই আছড়ে ফেলে ভেঙে ফেললো।
– ঝাটা মারি এমন সংসারে! ভাগ্য ভালো নাজিয়ার মতো একটা বউ পেয়েছেন। আপনার মতো এমন শ্বাশুড়িকে তো দা দিয়ে জবাই করা উচিত! অনেক হইছে আর অনেক দেখছি! আপু, চলো। আর এক মুহুর্তেও এ বাড়িতে না! এইটা কোনো মানুষের বাড়ি হতে পারে না! জল্লাদের বসবাস এই বাড়িতে!
– নাফিসা! আর একটা কথাও বলবি না।
– হ্যাঁ, বলতে চাইছিও না! এমন লোকজনের সাথে কথা বলার কোনো রুচি আমার মাঝে নেই! চলো, বাড়িতে চলে যাবে। এবাড়ির পথেও কোনোদিন উঁকি দিবে না।
– নাফিসা হাত ছাড়। আর অফ যা তুই।
– আপু, চলো। এবাড়িতে একটুও ভালো নেই তুমি সেটা অনেক আগেই দেখেছি আমি। এবাড়ির কাউকে দেখতে পারি না আমি। কাউকে মানুষ বলে মনে হয় না। চলো।
– হাত ছাড়তে বলেছি।
– না, তুমি এখন যাবে আমার সাথে। এই বজ্জাত মহিলার ঘরে আর এক মুহুর্তও না!
নাজিয়া সাথে সাথেই নাফিসার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। আয়েশা বেগম ছাড়া সবাই অবাক! নাফিসা গালে হাত রেখে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে নাজিয়ার দিকে! নাজিয়া কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চ কণ্ঠে বললো,
– তোর সাহস কি করে হয় বড়দের সাথে এভাবে কথা বলতে! বাবা মায়ের কাছে এই শিক্ষাই পেয়েছিস! কখন থেকে চুপ করতে বলছি তোকে! আর আমি শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে যাবো কিনা সেটা তোর নির্ধারণ করতে হবে! তোর ইচ্ছাতে আমার কাজ করতে হবে! প্লেট গুলো এভাবে ভাঙলি কেন! কার সাথে কি ধরনের কথা বলতে হয় সেটা তোর জানা নেই! বেরিয়ে যা। এই মুহূর্তে চলে যা এখান থেকে।
– ভাবি, কি বলছো এসব!
– আশিক, এটা আমাদের বোনের ব্যাপার। তুমি কিছু না বললেই ভালো। আর নাফিসা, জেনে রাখ। এটাও আমার একটা পরিবার। আমি পরিবার ছেড়ে কি করে যাবো। বাবা বুঝেশুনে বিয়ে দেয়নি আমাকে! সেখানে তুই এসব বলার কে! আমি এখানে কিভাবে থাকবো না থাকবো তা সম্পূর্ণই আমার ইচ্ছের বিষয়। আর একটা কথাও যেন না শুনি এই পরিবার সম্পর্কে! চলে যা।
– থাকতে আসিনি! আত্মার টানে দেখা করতেই এসেছিলাম তোমার সাথে। চলে যাবো সে আর বলতে কি! আর কোনোদিন এবাড়ির সীমানায় নাফিসার লাশের ছায়াও দেখতে পাবে না। সত্য কি মিথ্যা, দেখে নিও তুমি।
নাফিসা দৌড়ে নাজিয়ার রুমে গেলো। নাহিদা বললো,
– বাবা কি দেখে এমন পরিবারে তোমাকে বিয়ে দিয়েছে তা আমার অজানা। শুধু এটাই চাই আপু, যাতে একটু সুখে থাকো তুমি। নাফিসাও বুঝে আর না বুঝে তোমার সুখটাই কামনা করছে।
কথাটা বলে সেও নাজিয়ার রুমের দিকে গেলো। নাফিসা পার্সটা নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। নাহিদাও নাফিসার জন্য তাড়াহুড়ো করেই বেরিয়েছে। আশিক তাদের ডাকছিলো কিন্তু তারা কোনো সাড়া দিলো না। আশিক নাজিয়াকেও থামানোর জন্য বলছে, কিন্তু নাজিয়াও কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। আয়েশা বেগম তিন বোনকে নিয়েই ফুসতে থাকলে আশিক বললো,
– হয়েছে তো এবার তোমার শান্তি! অযথা ঝাঝালো কথাবার্তা বলে ঝগড়া বাধিয়ে দিলে!
– চুপ থাক তুই! ভাইয়ের মতোই ভাবির টানে বশ হয়ে যাচ্ছিস! উচিত কথা বলেছি আমি। উচিত বললে সবারই গায়ে লাগে! সব চেনা আছে আমার!
আয়েশা বেগম হনহন করে ঘরে চলে গেলো। নাজিয়া ভাঙ্গা প্লেট গুলো তুলে নিচ্ছে হাতে। প্লেট নিয়ে দাড়াতেই আশিক টুকরো গুলো হাতে নিয়ে নিলো অন্যত্র ফেলে দিয়ে আসার জন্য এবং বললো,
– ভাবি, কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি তোমার! এভাবে গায়ে হাত না তুললেও পারতে। প্রিয়জনের কষ্ট তো কারোই সহ্য হয় না। নাফিসারও হয়নি। তোমার হাত কেটে গেছে অনেকটা। স্যাভলন লাগাও। আয়াত, স্যাভলন লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দে।
নাজিয়া তার রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
– লাগবে না।
নাজিয়া রুমে এসে দরজা চাপিয়ে দিলো। আশিক হতাশ হয়ে ভাঙা টুকরোগুলো ফেলতে গেলো। আয়াতও নিজের ঘরে চলে গেলো।