“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১৪
(নূর নাফিসা)
.
.
নাজিয়া এসে ধপাস করে খাটের কোনে বসে পড়লো। ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে তার! আজ প্রথম বোনটাকে এতো কষ্ট দিয়েছে। কলিজা দুইটা এসেছিলো তার সাথে দেখা করতে আর সে কি-না শ্বশুরবাড়ির পক্ষপাতী হতে গিয়ে কলিজার টুকরো দুইটাকে আঘাত করেছে। একজনের গায়ে হাতও তুলে ফেলেছে! এই হাতই তো শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে এখন!
নাজিয়া খাটের স্ট্যানে হাত দুতিন ঘা মারলো! অত:পর খুব কান্না করতে লাগলো। যে কান্নার শব্দ শুধু ঘরের ভেতরেই সীমাবদ্ধ আর মনের ভেতর ভাংচুর!
কি করে পারলো তাকে এমন কথাবার্তা শুনাতে! যত প্রচেষ্টা ছিলো সংসারে সবটা আজ ব্যর্থতায় ব্যথিত হয়ে গেছে! উপাধি পেয়ে গেছে অলক্ষুণে, অপয়া, বন্ধ্যা! আজ কি বোনদের সামনে এমন কিছু না বললেই হতো না! কতো শখ করে নাফিসাটা বললো নুডলস খাবে। কত শখ করে বোনের সাথে আড্ডা দিতে দিতে নিজেরা রান্না করে নিলো। অথচ মুখে তুলতে পারলো না খাবার! এমনকি এক ফোটা পানিও না! এ কোন পরিস্থিতিতে ধাবিত হলো সে! কি পাপ করেছিলো জীবনে, যার ফলস্বরূপ এমন জীবন অতিক্রম করতে হচ্ছে তাকে! ধৈর্যের ও তো একটা সীমা থাকা দরকার!
স্টুডেন্টদের মডেল টেস্ট চলছে তাই কোচিং অফ থাকায় বিকেলেই আরাফ বাড়িতে চলে এসেছে। নাজিয়া কান্না করতে করতে কখন মেঝেতে বসে গেছে তার খেয়াল নেই। আরাফ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো খাটের পায়ায় হেলান দিয়ে নাজিয়া আনমনা হয়ে বসে আছে। বুকের ভেতরটা চাপ দিলো তার! এভাবে বসে আছে কেন! কি হয়েছে তার!
– নাজিয়া!
আরাফের ডাকে ধ্যান ভাঙলো নাজিয়ার। সে দু’হাতে চোখ মুছে উঠে দাড়ালো। আরাফ দরজা চাপিয়ে দ্রুত পায়ে তার কাছে এলো। হাত বাড়িয়ে মুখখানা ধরে বললো,
– এই, কি হয়েছে তোমার?
নাজিয়া দু’হাতে আরাফের কলার মুঠোয় ধরে বললো,
– বেবি লাগবে আমার। বলো, এনে দিবে না বেবি?
– এমন করছো কেন? কি হয়েছে বলো আমাকে?
নাজিয়া আরাফকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট কামড়ে কাদতে লাগলো। আরাফ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– কথা বলছো না কেন! বলো আমাকে! নাজিয়া, তুমি কাদছো কেন? কেউ কিছু বলছে? মা কিছু বলছে?
আরাফ কয়েকবার একই কথা জিজ্ঞেস করলো কিন্তু নাজিয়া কোনো উত্তর দিচ্ছে না। শুধু কাদছে। উত্তর না পেয়ে আরাফ এবার ধমকের সুরে বললো,
– কি শুরু করেছো এগুলো! সারাদিন বাইরে থেকে দিন শেষে বাড়িতে ফিরেও কি শান্তি পাবো না একটু! ঘরে পা দিতেই মনমালিন্য, কান্নাকাটি দেখতে কি খুব ভালো লাগছে আমার!
আরাফের ধমকে নাজিয়া তাকে ছেড়ে দিয়ে দাড়ালো। এবং দুহাতে চোখ মুছতে মুছতে বললো,
– যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। খাবার এনে দিচ্ছি।
– আমি জিজ্ঞেস করেছি কি হয়েছে তোমার? কাদছিলে কেন?
– কই, কিছু হয়নি তো। আমার আবার কি হবে!
কথাটা বলে নাজিয়া পাশ কাটিয়ে চলে গেলো আলমারির কাছে। কথা চাপা রাখতে দেখে আরাফ রেগে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। যাওয়ার সময় দরজাটা ঠাস করে চাপিয়ে গেলো! নাজিয়া আলমারির কাছে থেকেই আবার ঠোঁট কামড়ে কাদতে লাগলো! আরাফ আয়াতের কাছে যাচ্ছিলো কেননা আয়াত বাড়িতে ছিলো। সে জানবে নিশ্চয়ই কি হয়েছে। কিন্তু আয়াতের দেখা পাওয়ার আগে আশিকের দেখা পেলো সে। আশিক বললো,
– ভাইয়া মাত্র এসেছো?
– হ্যাঁ।
– কিছু কথা ছিলো তোমার সাথে।
– পরে বলি। আয়াতের কাছে যাচ্ছি একটু।
– ভাবির কথা জিজ্ঞেস করতে? আমিও ভাবির কথাই বলতে চাইছিলাম।
আরাফ তার কাছেই ইস্যু পেয়ে গেছে তাই সে আর আয়াতের কাছে না গিয়ে আশিকের সাথেই চলে গেলো। আশিক সবটা বলে দিলো আরাফের কাছে। সাথে এটাও বললো, যে গার্মেন্টসে সে কাজ করেছিলো সেখানে তদারক হিসেবে তাকে আহ্বান জানানো হয়েছে। বেতনও মোটামুটি ভালোই। পরবর্তীতে কাজের ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া হবে। তাই আরাফের কাছে পরামর্শ চাইলো করবে কি-না। এমনকি আশিক নিজের ইচ্ছেও প্রকাশ করলো কাজটা করার জন্য। তাই আরাফ আর নিষেধ করলো না। যদি তার পড়াশোনা প্রব্লেম না হয়, তাহলে করতে পারবে। কথা বলা শেষ হতেই আরাফ সেখান থেকে আবার নিজের রুমে চলে এলো। নাজিয়া আলমারি খুলেই খাটে বসে আছে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলধারা! আরাফকে দেখে আবারও মুছে নিলো গাল। আরাফ দরজা লাগিয়ে এসে তাকে দাড় করালো এবং সবার আগে তার হাত চেক করলো। একটা আঙুলের অনেকটা কেটে গেছে। রক্ত পড়ে শুকিয়ে আছে আঙুলের ধারেই! আরাফ রাগী দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। এবং বললো,
– এতো ভালো, ভালো না বুঝতে পেরেছো! প্রয়োজনে উপযুক্ত জবাব দিতে হয়! সবচেয়ে বড় ভুল তো আমার হয়েছে! আমি কেন বাবাকে দিয়ে তোমার ঘরে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম! তোমার মতো এতো ভালো মেয়ের যোগ্য না এই পরিবার! এখানে ঝগড়াটে মেয়েদের মধ্যে একজনকে প্রয়োজন ছিলো। সেটা আমার মায়ের কাছে ভালো লাগতো। আমাকে আর এমন দিন দেখতে হতো না!
– হ্যাঁ, সবাই মিলে এখন আমাকে বকো। কিছু বলবো না আমি। আমি তো অলক্ষুণে, অপয়া, বন্ধ্যা!
আরাফ বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে এবং একটানে নিজের বুকে মিশিয়ে নিয়ে বললো,
– আরেকবার এমন কিছু মুখে আনলে মেরে ফেলবো একেবারে! তোমাকে এতো কথা শুনিয়ে গেলো তুমি কিছু বলতে পারলে না!
– কি বলবো! নিজের আপনজনদের সাথে কি যুদ্ধ করা যায়!
– নাফিসাও তোমার আপনজন ছিলো। ওর গায়ে হাত তোলা একদমই ঠিক হয়নি তোমার! ও ঠিক কথাই বলেছে। এমন পরিবেশে কোন সুস্থ মানুষ বসবাস করতে পারে না।
নাজিয়া কান্না করতে করতে বললো,
– কি করবো বলো। ও একটু বেশিই বলে ফেলছিলো। এভাবে তো ঝামেলার সৃষ্টি হতো তাইনা! ও আমাকে চলে যাওয়ার জন্য বলছিলো। আমি কি করে যাবো, বলো! বাবা কি চলে যাওয়ার জন্য তোমার কাছে পাঠিয়েছে! এটাও তো আমার পরিবার। এমন অভিমান নিয়ে কি সংসার হয়!
– নাজিয়া, ও ছোট। সংসার নিয়ে তোমার মতো এতোটা জ্ঞান ওর মাঝে নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর যা ভালো মনে হয়েছে, সেটাই বলেছে। তোমাকে খুব ভালোবাসে তো। তাই সহ্য করতে পারেনি তোমার অপমান।
– আমি খুব খারাপ, আরাফ! খুব খারাপ আমি! আমার আচরণে কলিজা দুইটা খুব কষ্ট পেয়েছে আজ। আমি কখনো হাত তুলিনি তাদের উপর! আজ প্রথম এতোটা আঘাত করে ফেলেছি! কত শখ করে এসেছিলো আমার সাথে দেখা করতে আর আমি নিজে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছি। এক ফোটা পানিও তাদের মুখে তুলে দিতে পারিনি। ওরা নিজেরাই নুডলস রান্না করলো সেটাও মুখে তুলতে পারেনি! আমি জানি নাফিসাটা অনেক কান্না করেছে বাসায় গিয়ে। এখনো হয়তো কান্না করছে! খুব ব্যাথা দিয়েছি আমি! থাপ্পড় দেওয়ার সাথে সাথেই গালটা লাল হয়ে গিয়েছিলো। কি করে পারলাম আমি!
নাজিয়ার কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেছে! আরাফ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– এই, কান্না থামাও। নাফিসা হয়তো এই ভেবে আরও কান্না করছে যে তার বোনটা এদিকে অনেক কষ্ট পেয়েছে তাকে মেরে! এভাবে কান্না না করে এবার একটু কথা বলো তার সাথে। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
– কিছু ঠিক হবে না! অনেক অভিমানী নাফিসাটা। নাহিদার মতো এতোটা বুঝ মাথায় নেয় না সে! যখন যা ইচ্ছে তা-ই করে। জানো সে যাওয়ার সময় কি বলে গেছে! ” এ বাড়িতে নাফিসার লাশের ছায়াও পড়বে না কোনোদিন! দেখে নিও তুমি!” কিছু ঠিক হবে না আরাফ! ও অনেক কষ্ট পেয়েছে!
– না বলেই জেনে গেলে কিছুই ঠিক হবে কি-না! আগে তো কথা বলো, তারপর দেখো কি হয়। দেখি সোজা হও।
– বেবি লাগবে আমার।
– ওকে, পরে ভেবে দেখবো।
– পরে না। এখনই ভাববে।
আরাফ দু’হাতে তার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,
– চেহারার কি অবস্থা করেছো সেটা দেখেছো একবার আয়নায়! দুপুরে তো খাওনি কিছু, সকালে খেয়েছিলে?
– হ্যাঁ।
– বসো এখানে।
আরাফ স্যাভলন, তুলা আর সুতি কাপড় নিয়ে নিজেই রক্ত মুছে ব্যান্ডেজ করে দিলো নাজিয়ার আঙুল। আরাফ হাতমুখ ধুয়ে এলো আর নাজিয়া নাহিদার কাছে কল করলো। কিন্তু বিজি দেখালো। নাজিয়া কল কাটতেই নাহিদার ফোন থেকে কল এলো। রিসিভ হতেই শুনতে পেলো তার মায়ের গলা।
– নাজিয়া? কি হয়েছে বলতো আমাকে? নাফিসা কান্না করছে আর নাহিদা বলছে তোর শ্বাশুড়ি নাকি যা তা বলেছে তোকে?
– না, মা। তেমন কিছু হয়নি। একটু রাগারাগি এই ই।
– কি নিয়ে রাগারাগি করলো এমন? পাঠাবো তোর বাবাকে?
– আহ, মা বাদ দাও তো। সংসারে কতকিছুই থাকে, আর একটু আধটু রাগারাগি হতেই পারে। নাফিসা কোথায়?
– ওই যে, তখন থেকে রুমে একা বন্দী হয়ে কান্না করছে। কত ডাকছি, দরজা খুলছে না। খেয়েছে তোর ওখানে কিছু?
– না। ওকে একটু ডাকো, আমার কথা বলো।
রুমানা বেগম নাফিসাকে ডাকলো, নাজিয়ার কথা বললো। নাফিসা শুধু একটা কথাই বললো, “বলে দাও, নাফিসা নাম ধরে যাতে আর কখনো না ডাকে। মরে গেছে নাফিসা!”
কথাটা তীরের মতো বিধলো নাজিয়ার মনে! সে তার মায়ের সাথেও কথা বলতে পারলো না আর। কল কেটে দিলো। নাজিয়াকে ফোনে কথা বলতে দেখে আরাফ নিজেই প্লেটে করে খাবার নিয়ে এলো। রুমে এসে নাজিয়াকে আবারও কাদতে দেখলো। আরাফ বললো,
– আবার কান্না শুরু করেছো! কি বলেছে নাফিসা?
– কথাই তো বললো না! রুমে একা বন্দী হয়ে আছে। সেখান থেকেই চেচিয়ে তার নাম ধরে ডাকতে নিষেধ করে দিলো। বলেছি না আমি! এখনো কান্না করছে!
– এতোটাই যখন চেনো তাকে তাহলে হাত তুললে কেন! তখন মনে ছিলো না! একটুও কান্না করবে না এখন। যাও, হাতমুখ ধুয়ে এসো। আমার সাথে খেয়ে নিবে, তারপর তোমাদের বাড়িতে যাবো।
– খাবো না আমি। তুমি খেয়ে নাও।
– আমি তো খাবোই। তুমিও খাবে। নুডলসটা তো মজাই হয়েছে। নাহিদা নাফিসা মনে হয় আমার জন্যই রান্না করেছে। দ্রুত যাও, হাতমুখ ধুয়ে এসো।
নাজিয়া হাতমুখ ধুয়ে এলো। আরাফ জোর করে দু লোকমা মুখে দিতে পেরেছে। খাবার গিলতে খুব কষ্ট হচ্ছে নাজিয়ার! বোন দুটো এখনো খায়নি! সে ভেবে সেও পারছে না খেতে।
আরাফ খাওয়া শেষ করে নাজিয়াকে নিয়ে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মাকে বলে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন মনে করেনি। বাবা বাড়িতে না থাকায় বাবার কাছে শুধু কল করে বলেছে। আলফাজ সাহেব না করে না কখনো। শেষ বিকেলে তারা নাজিয়াদের বাড়িতে চলে এলো। নিয়াজ উদ্দিন বাড়িতে ফিরে নাফিসাকে সেই রুম থেকে বের করতে পেরেছে। কেননা, বাবা এক ডাক দিতেই মেয়েরা হাজির হয়ে যায়। বেরিয়েছে ঠিকই কিন্তু বেশি কথা বলেনি। অল্প খাবারও খেয়েছে বাবার কথায়। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তাই নাফিসা ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিলো বাইরে থেকে কাপড়চোপড় নিয়ে যাওয়ার জন্য। উঠুনে পা রাখতেই দেখলো আরাফ আর নাজিয়া হাজির! সে কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো। নাজিয়া হিজাব খুলতে খুলতে এগিয়ে আসতেই নাফিসা বললো,
– মা, আমি শিথি আপুর কাছে যাচ্ছি।
কথাটা বলে নাফিসা সাথে সাথেই দৌড়ে উঠুন পাড় হয়ে চলে গেলো পাশের বাড়ির ফুপাতো বোন শিথির কাছে। নাজিয়া পেছন থেকে ডাকছিলো তাকে কিন্তু কোনো সাড়া দিলো না তার ডাকে। সে বেশ বুঝতে পেরেছে তাকে দেখেই ইগনোর করে চলে গেলো! আরাফও নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে আছে! যার জন্য এলো সে-ই পালিয়ে গেলো! কতো কষ্ট করে এ পর্যন্ত মানিয়ে নিয়ে এলো নাজিয়াকে। এখন আবার ইগনোর করে মনটা ভেঙে দিয়ে চলে গেলো!