“তৃ-তনয়া” পর্ব- ১৫

0
3006

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১৫
(নূর নাফিসা)
.
.
নাজিয়ার কণ্ঠ শুনে রুমানা বেগম বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। আরাফ সালাম দিলো। তিনি নাজিয়া আরাফকে ঘরে যেতে বললেন। নাহিদাও আরাফকে দেখে সালাম দিলো। নাফিসার সাথে কথা না হওয়ায় আরাফ নাজিয়াকে বললো,
– নাজিয়া, তুমি না হয় থাকো এখানে। আমি চলে যাই। নাফিসা যেই রেগে আছে, তা শেষ হবে না মনে হচ্ছে।
– আমি থাকবো আর তুমি চলে যাবে!
– আমার তো কাল সকালে তাড়া আছে, আবার খাতা দেখা বাকি! এগুলো সম্পাদন করতে হবে না!
রুমানা বেগম বললো,
– আরাফ, তাহলে রাতে খেয়ে যাও। তুমি আসায় ভালো হয়েছে। তোমার সাথে কিছু কথাও আছে। তোমার বাবা নামাজ পড়ে আসুক, দেখা করে কথাবার্তা বলে যাও।
– আচ্ছা।
নাজিয়া বললো,
– আজান, পড়ে যাচ্ছে। মসজিদে যাবে? নাকি বাসায় জায়নামাজ দিবো?
– না, মসজিদেই যাবো।
– ওকে, যাও তাহলে।
আরাফ মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। নাজিয়া নাহিদাকে বললো,
– নাহিদা তুই খেয়েছিস বাসায় ফিরে?
নাহিদা মলিন মুখে জবাব দিলো,
– হ্যাঁ, খেয়েছি।
– মা, তোমার এই মেয়ে দুইটা এমন কেন! আমাকে কি একটুও বুঝে না! তাদের মন ভালো করতে কি এখন পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবো!
– আপু!
– ডাকবি না আমাকে আপু বলে! খুব অভিমানী হয়ে গেছিস এক একজন! এতোটাই খারাপ আমি যে, আমার সাথে কথা বলতেও তোদের রুচিতে বাধা পাচ্ছে!
নাহিদা সাথে সাথেই নাজিয়ার গলা জড়িয়ে ধরলো। দুই বোনের চোখেই পানি! পাশে দাড়িয়ে আছেন রুমানা বেগম। মেয়েদের কর্মকান্ড দেখে কখনো খুব হাসি পায় আবার কখনো খুব রাগ হয়! তিনি চলে গেলেন কিচেনের দিকে। আরাফের জন্য একটু ভালো খাবারের আয়োজন করা দরকার। নাজিয়া নাহিদাকে ছাড়িয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললো,
– যাও নামাজ পড় গিয়ে, আমি আসছি শিথিদের বাসা থেকে।
নাজিয়া বোরকা খুলে শিথিদের বাড়িতে চলে গেলো। ফুপুর সাথে দেখা হতেই সালাম দিয়ে কথা বললো। তার কণ্ঠ শুনা মাত্র শিথির রুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে! নাফিসার কথা জিজ্ঞেস করতেই ফুপু বললো শিথির সাথে তার রুমে বসে আছে। নাজিয়া দরজায় নক করলো কিন্তু দরজা খুলছে না। শিথির নাম ধরে ডাকতেই ভেতর থেকে উত্তর এলো,
– আপু, নাফিসা আমাকে ধরে রেখেছে। দরজা খুলতে দিচ্ছে না!
– নাফিসা, আপু দরজা খুলো। আমি কি চলে যাবো? আর কখনো কিন্তু আসবো না! নাফিসা! নাফিসা, তুমি এমন করলে যে ব’আপু টা খুব কষ্ট পায়! খুলবে না দরজা?
নাফিসা এবার শিথিকে ছেড়ে দিলো এবং শিথি এসে দরজা খুলে দিলো। নাজিয়া ভেতরে এলো। নাফিসা জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে, গাল গড়িয়ে টুপটাপ পানি পড়ছে। দৃষ্টি তার মেঝের দিকে। নাজিয়া তার মুখটা ধরে উপরের দিকে তুলে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
– সরি, কিউটিপাই! চেহারার একি অবস্থা করেছো! কান্না করে একেবারে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে! শিথি, দেখতো নাফিসাকে পুরো পেঁচার মতো দেখাচ্ছে না!
শিথি হাসলো আর নাফিসা গোমড়া মুখুই রয়ে গেছে! নাজিয়া আবার বললো,
– এই পচা মেয়ে! ব’আপু সরি বলেছি তো! আর কখনো মারবো না। একটু বকাও দিব না। এই যে কান ধরছি আমি।
নাজিয়া কানের কাছে হাত নিতেই নাফিসা টেনে নামিয়ে দিলো এবং কান্না করতে করতে গলা জড়িয়ে ধরলো। নাজিয়ার চোখে পানি থাকলেও মুখে ফুটে উঠেছে হাসি! কেননা তার বিশ্বাস ছিলো নাহিদার মতো নাফিসাও তাকে সামনে দেখলে বেশিক্ষণ রেগে থাকতে পারবে না। অবসান ঘটেছে নাফিসার ক্রোধের!
নামাজ পড়বে সেই তাড়া দিয়ে সে নাফিসাকে মানিয়ে নিয়ে এলো বাড়িতে।
আরাফ নিয়াজ উদ্দিনের সাথেই বাড়ি ফিরেছে নামাজ শেষে। আরাফের সামনেও যাচ্ছে না নাফিসা। আরাফ কিছু জিজ্ঞেস করলেও তার উত্তর দেয়নি। নাজিয়া লক্ষ্য করেছে বিষয়টি কিন্তু কিছু বললো না। কেননা এমনিতেই এক অভিমান ভেঙেছে, এখন আবার কিছু বললে উল্টো রিয়েকশন এটাক্ট করবে! নিয়াজ উদ্দিন জানালেন আগামীকাল জহিরুল ইসলামের বাড়িতে যাবেন বিয়ের তারিখ পাকা করার জন্য আর আরাফকে সাথে যেতে হবে। আরাফ জানালো দুপুরের পর হলে যেতে পারবে, তাছাড়া তার পক্ষে সম্ভব না। নিয়াজ উদ্দিন দুপুরের পরই যাবেন, তবুও আরাফকে নিয়ে যাবেন। নাহিদা আরাফকে খাবারদাবার এনে দিলো। সবসময়ই সে যথাসম্ভব আপ্যায়ন করে আরাফ ও অন্যান্যদের। কিন্তু নাফিসা কাছও ঘেঁষে না। তার মতে দোষ একজন করলেও ফল ভোগ করবে সবাই! আরাফ বিয়ে না করলে নাজিয়াকে এমন পরিবারে যেতে হতো না সেটা নাফিসার ধারণা। তাই আরাফকেও অতটা মর্যাদা দেয় না!
খাওয়া শেষে আরাফ বিদায় নিয়ে চলে গেলো। নাজিয়া থেকে গেলো।
পরদিন আরাফ ও নাফিসার বাবা-মা মেহেদীর বাসায় গিয়ে বিয়ের দিন পাকা করে এলো। আর তিনবোন মিলে বাসায় গল্পসল্প, দুষ্টুমি, রান্নাবান্না! নাজিয়া নুডলস রান্না করে খাওয়ালো। অত:পর রাতের জন্য বিরিয়ানি রান্না করলো। আরাফসহ বাবা মা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলো। আরাফ নাফিসাকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– নাফিসার মন কি ভালো হয়েছে?
নাফিসা জবাব না দিয়ে এড়িয়ে চলে গেলো আর আরাফের মন রক্ষার্থে নাহিদা হাসিমুখে জবাব দিলো,
– হুম, হয়েছে। তাইতো আপনার জন্য বিরিয়ানি রান্না করলো।
– তাই নাকি! সম্পূর্ণ রান্না কি নাফিসা করেছে নাকি একটু নাড়াচাড়া করেই রাধুনি নাম করেছে!
নাহিদা হেসে উঠে বললো,
– হুম, নাড়াচাড়াতেই রাধুনি! সবার নাড়াচাড়াই পড়েছে শুধু আর বাকি কাজ আপুর।
নাজিয়া শুনছে ও দেখছে তাদের। লোকটা সবসময় সকলের সাথে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করে যায়! নাফিসাটা ইগনোর করে চলে গেলো অথচ একটুও মন খারাপ করলো না! কে বলেছে সে অসুখী! সে তো সবচেয়ে বেশি সুখী যে আরাফের মতো এমন একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে! তাকে নিয়ে কতটা ভাবতে পারলে এখানে ছুটে আসে বোনদের রাগ অভিমান ডিশমিশ করার জন্য! কতটা আপন ভাবলে বাবা ডাকা মাত্র কাজকর্ম চাপিয়ে রেখে বারবার এসে হাজির হয়। নিজের একেবারে আপন মানুষটা যদি পাশে থেকে সবসময় সঙ্গ দিয়ে যায় তাহলে আর কি লাগে সুখী হতে! আর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই।
নাজিয়াকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে আরাফ নাহিদার হাতে আইস্ক্রীমের বাটিটা দিয়ে বললো,
– নাজিয়া, তুমি কিন্তু আবার এটাতে ভাগ নিও না!এটা নাহিদা আর নাফিসার জন্য। তোমারটা না হয় আমার কাছে পাওনা থাকুক আপাতত।
নাজিয়া মুচকি হেসে বললো,
– এখনই কি চলে যাবে? নাকি রাতে?
– কেন, তুমি চলে যাবে?
– হুম, নাহিদার বিয়েতে তো আবার আসবোই। তাই আজ চলে যাবো।
– ওকে, তাহলে রাতেই যাই।
রাতে জামাই শ্বশুর মিলে বিরিয়ানির স্বাদ উপভোগ করলো সাথে বিয়ের আয়োজন নিয়ে গল্পসল্প হলো। নাজিয়া নিজ হাতে নাফিসাকে আইস্ক্রীম খায়িয়ে দিয়েছে। নাহিদাকেও খায়িয়েছে আবার তাদের ইচ্ছাতে নিজেও খেয়েছে। অত:পর রাতে আরাফের সাথে বাড়ি ফিরে গেছে।
সকাল থেকেই দেখছে আয়েশা বেগন কেমন মুড অফ! তার সাথে কথা বলছে না। নাজিয়া কি রান্না করবে, চা করে দিবে কিনা এমন কিছু জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পাচ্ছে না। তিনি নিজে নিজের কাজকর্ম করে কিচেন ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। নাজিয়া বুঝতে পেরেছে তার সাথে কথা বলতে চাইছে না। নিজে বকাঝকা করেই এখন নিজেই কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই সেও আর কিছু বলে বিরক্ত করলো না। ভাত বসিয়ে দিয়ে আলফাজ সাহেবকে চা দিতে গেলো। তখন আলফাজ সাহেব কড়া ভাবে বললেন, আয়েশা বেগম তাকে কোনো রকম বকাঝকা করলে বা কোনো কিছু নিয়ে খোটা দিলে যেন সাথে সাথেই আলফাজ সাহেবকে জানায়। এবার নাজিয়া বুঝতে পারলো তার শ্বশুর নিশ্চয়ই বকাঝকা করেছে আয়েশা বেগমকে তাই এমন হয়ে আছেন তিনি! আরাফকে গোসল সেড়ে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে নাজিয়াও সেখান থেকে তাদের ঘরে এলো। এসেই আরাফের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
– তুমি বাবাকে ওসব বলেছো কেন! যা হবার হয়েছে, এগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করার কোনো প্রয়োজন ছিলো। এখন তো আমাকে আরও দোষী করে দিলে। আম্মা কি ভাববে না, আমি তোমার কাছে নালিশ করে বাবার কাছে বকা খায়িয়েছি!
আরাফ লোশনের কৌটা হাতে নিতে নিতে বললো,
– আমাকে শুধু শুধু দোষারোপ করো না। আমি কিছু জানাইনি বাবাকে। সেদিন তোমাকে নিয়ে তোমাদের বাসায় যাওয়ার পর রাতে আশিক জানিয়েছে। আর সেসব শুনে বাবা মাকে বকাঝকা করেছে। সাবধান করে দিয়েছে তোমার সাথে কিংবা তোমার পরিবারের সাথে যেন কোনো দুর্ব্যবহার না করে। যাইহোক, আমার মতে ভালো হয়েছে। তোমার স্বাধীনভাবে চলার সুযোগ হয়েছে। তাছাড়া এখন আমি বলছি, তুমি এসব নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করো না। যার যেভাবে ইচ্ছে চলতে দাও। অন্যথা যদি তোমার সমন্ধে কাউকে কটু কথা বলতে শোনো তাহলে এক কান দিয়ে প্রবেশ করলে অন্য কান দিয়ে বের করে দিবে। অপ্রিয় ঘটনা দ্বিতীয়বার মাথায় আনবেই না। মানবে তো?
– হুম।
নাজিয়া আবার কিচেনে চলে গেলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here