“তৃ-তনয়া” পর্ব- ১৬

0
2898

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১৬
(নূর নাফিসা)
.
.
ক্লাস আজ শুরু হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু স্টুডেন্ট কম হওয়ায় হলো না ক্লাস। নাহিদা একটা ফ্রেন্ডের সাথে টুকটাক কথা বলে ভবনের দিকে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করেই আশিক হাজির। সমান তালে হাটতে হাটতে বললো,
– কেমন আছো?
নাহিদা হাসিমুখেই জবাব দিলো,
– আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ। আমি তো ভেবেছি সেদিনের ঘটনার পর আর আমার সাথে কথাই বলবে না!
– এমন কিছুর কোনো মানেই হয় না। আপনার কোনো দোষ ছিলো বলে আমার অজানা। বাদ দেন ওসব!
– ওকে, তোমাকে একটা নিউজ দেওয়ার ছিলো।
– জ্বি, বলুন।
– ছাদে যাবে একটু? গেইট খোলা আছে।
– ছাদে কেন!
– এমনি। কেন তোমার কোনো তাড়া আছে এখন?
– না, নাফিসার কাছে যাচ্ছিলাম। জানার জন্য, তার ক’টা ক্লাস আছে আজ।
– আচ্ছা, তাহলে পরে যাও। তার তো ক্লাস চলছে এখন।
– ওকে, চলুন।
তারা দুজনেই ছাদে এলো। নাহিদা অনেক দিন আগে এসেছিলো এখানে বন্ধুদের সাথে। ছেলেমেয়েরা এখানে এসে দুষ্টুমি করে বলে গেইট বন্ধ থাকে। আজ আবার পরিষ্কার দেখাচ্ছে ছাদ। হয়তো কোনো কাজ করেছিলো। পাশের ভবনের গেইট আবার সবসময় খোলা থাকে। নাহিদা আশিককে বললো,
– বলুন, কি যেন বলবেন।
– আমার চাকরি হয়েছে।
– তাই নাকি! কিসের চাকরি!
– গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে।
– যাক, ভালোই। বেতন কত?
– কমই, চৌদ্দ পনেরো হাজারের মতো। পরে পদোন্নতিতে বাড়বে।
– সময় কতক্ষণ?
– ফিক্সড কোনো টাইম নেই। ঘুরাঘুরির ব্যাপার। যখন ইচ্ছে তখনই যেতে পারবো। দিন শেষে লেবারের কাজকর্মের নোট জমা দিবো।
– তাহলে খারাপ কি! চৌদ্দ পনেরো কম কিসে! আমার মতে ভালোই।
– খুশি হয়েছো তুমি?
– চাকরি করবেন আপনি আর আমাকে বলছেন আমি খুশি হয়েছি কিনা!
– না, মানে নিউজটা শুনে খুশি হয়েছো কি-না?
– হুম, সেটা তো অবশ্যই।
– কফি খাবে?
– বেতন পেয়ে গেছেন নাকি!
– আরে নাহ।
– চাকরির শুরুতেই কফির অফার! আগে চাকরি করুন, বেতন পান। নিজে সচ্ছলতায় পদার্পণ করুন। তারপর, আমেজ।
– অনেক ভালো বুঝো এবং বুঝাতে পারো তুমি। এজন্যই খুব ভালো লাগে তোমায় আর এজন্যই একটু বেশি ভালোবাসি।
এতোক্ষণ হাসিমুখে কথা বললেও এখন নাহিদার মুখটা মলিন হয়ে গেছে! তা দেখে আশিক নাহিদার একটা হাত ধরে তার দু’হাতে মাঝে নিয়ে বললো,
– বারবার এভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছো কেন? আমি কি দেখতে খারাপ?
নাহিদা ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– না।
– আমার যোগ্যতা কি তোমার চেয়ে অনেক কম?
– না।
– আমি তো কোনো খারাপ কাজের সাথেও জড়িত নেই৷ তাহলে আমাকে ইগনোর করো কেন! আমার পরিবারের জন্য? যদি আমার পরিবার তোমাকে মেনে নিতে না পারে তাহলে তোমাকে নিয়ে আমি আলাদাভাবে বসত গড়ে তুলবো। আর আমার বিশ্বাস, শুধু মা ই অমত পোষণ করতে পারে, এছাড়া সবাই মেনে নিবে। নাহিদা তুমি একবার হ্যাঁ, বলো। আমি তোমার বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠাবো৷ তুমি যতদিন অপেক্ষা করতে বলবে আমি ততদিন অপেক্ষা করবো। তবুও তুমি বলো, আমার জীবনে যুক্ত হবে। বলো প্লিজ!
– না।
আশিক রেগে গেছে এবার। সে আরও জোরে হাত চেপে ধরে বললো,
– সবসময় না কেন! আমি কোন দিক থেকে তোমার অযোগ্য বলো আমকে! কোনো দোষ তো দেখাতে পারছো না! শুধু এক বয়সের অযুহাত দিয়ে যাচ্ছো। সমবয়সী ছেলেমেয়েদের কি বিয়ে হয় না আর! সেখানে আমি তোমার থেকে বড়।
নাহিদা হাত ঝাটকা দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে আংটি পড়ানো আঙুলটা আশিকের চোখের সামনে তুলে ধরে বললো,
– দেখতে পারছেন এটা? বুঝতে পারছেন কিছু? আমি এনগেজড। আরও দেড় মাস আগে থেকে আমি এনগেজড। বিয়ের দিনও পাকা হয়ে গেছে আমার। আজ বা কালের মধ্যে বাবা আপনাদের বাসায় যাবে বিয়ের দাওয়াত করতে। ভাইয়া আপুর কাছে কি বাসায় কিছুই শুনেননি এতোদিনে? আমি তো ভাবতাম আপনি জানতেন তাই আর গত দিন গুলোতে তেমন পাগলামো করেন নি। কিন্তু সেদিন রাতে মেসেজ দেখে বুঝতে পারলাম আপনি হয়তো কিছুই জানেন নি। আপনাকে আমি আরও আগেই বুঝিয়েছিলাম সংসার এমনিতেই হয় না। নিজেদের বুঝ অবুঝের ব্যাপার আছে। যেটা বয়সের কারণে মানুষ পরিপূর্ণ প্রাপ্তি লাভ করতে পারে না। মেয়েরা অল্প বয়সে যেটা বুঝার ক্ষমতা রাখে ছেলেদের তুলনামূলক অধিক সময়ের প্রয়োজন সেই বুঝটা ধারণ করতে। বয়সের ডিফারেন্সে দুজনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো থাকে। আর সেজন্যই বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের বয়সের পার্থক্য পাচ থেকে সাত বছরটা পারফেক্ট ধরে নেওয়া হয়। আর সেজন্যই আমি বয়সের অযুহাত দিয়ে এসেছি এতোদিন।
রিংটা দেখার পর ভেতরটা মুচড়ে গেছে! আশিক খুব শান্ত গলায় বললো,
– রিং কি আমার প্রপোজালের আগে পড়ানো হয়েছিলো?
– না।
– এই রিংয়ের মালিক কি পূর্ব পরিচিত?
– না।
– এতো সহজেই অচেনা লোকের হাতে রিং পড়ে নিলে!
– কেননা, আমার বাবামায়ের পছন্দ। বাবা চেয়েছে বিয়ে দিবে, আমিও রাজি হয়ে গিয়েছি।
আশিক অন্যদিকে ফিরে এক ব্যর্থতার নিশ্বাস ছাড়লো। নাহিদা এবার একটু নরম সুরে বললো,
– আপনার জন্য আমি যোগ্য ছিলাম না। এজন্যই এই অবস্থানে আমি। তাছাড়া যে আপনার জন্য যোগ্য তার অবস্থান হয়তো এখন হাই স্কুল বা ইন্টারমিডিয়েট লেভেলে আছে। আমি নিসন্দেহে বলতে পারি আপনি একজন ভালো মানুষ, ভালো চরিত্রের অধিকারী, মনটা খুবই সহজ সরল। আমি বিনা দ্বিধায় স্বীকার করি প্রেমিক হিসেবে আপনি শ্রেষ্ঠ। যে আপনাকে ভাগ্য করে পাবে সে দীপ্তিময় সুখ হাতের মুঠোয় পাবে। এজ এ ফ্রেন্ড, আমার একটা কথা মানবেন?
– নিচে যাও।
– আগে শুনুন, আপনার মনে গড়া স্বপ্নগুলোর জন্যও আমি দায়ী ছিলাম না। এমনকি আজ মন ভেঙে গেলেও সেখানে আমি দায়ী না। বন্ধুত্বের খাতিরে একটা অনুরোধ, কোনো কারণে নিজেকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না কখনো। আল্লাহ খুব যত্ন করে আপনাকে আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আবেগের বশে সেই সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দিবেন না কখনো। সৃষ্টি কর্তা খুশি হবে এমন কাজেই জড়িত থাকুন। ইনশাআল্লাহ, খুব ভালো কাউকে উপহার স্বরূপ পেয়ে যাবেন।
– নিচে যেতে বলেছি।
– আপনি এখানে দাড়িয়ে আছেন কেন?
আশিক নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে সাথে সাথেই কঠিন দৃষ্টি সরিয়ে তার আগেই পা চালালো। এই দৃষ্টিটা খুব খারাপ লাগলো নাহিদার কাছে। তবুও কিছু করার নেই, তার সাথে যে সম্পর্কটা বেমানান হয়ে যায় সেটা অনেক আগেই বুঝিয়েছিলো আশিককে। নাহিদাও এক দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে আশিকের পিছু পিছু নেমে এলো।
নাফিসা মাত্রই ক্লাস থেকে বেরিয়েছে। আশিকের সাথে নাহিদাকে সিড়ি দিয়ে নামতে দেখে সে এগিয়ে এসে বললো,
– এই লোকের সাথে কি করো! এদের সাথে কোনো কথাবার্তা নেই। কোনো নোট ও দিতে যাবে না কখনো। প্রয়োজন হলে যেন আমাদের পরিবার ছেড়ে অন্য কাউকে দেখে।
– নাফিসা! কি বলছিস এসব! চুপ থাক!
– অনেক থেকেছি চুপ। আর না। চুপ থেকে থেকেই আজ ত্যাজ্য হতে চলেছি। তুমি ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি কিছু।
আশিক তার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। সে দ্রুত পায়ে হেটে চলে গেলো তার পথে। আর এদিকে নাহিদা নাফিসাকে চোখ রাঙিয়ে চুপ করতে বললো এবং তাদের গন্তব্যে যেতে লাগলো।
বিকেলে নিয়াজ উদ্দিন সাহেব একা নাজিয়াদের বাড়িতে গেল নাহিদার বিয়ের দাওয়াত দিতে। রুমানা যায়নি সাথে কেননা আয়েশা বেগম বিয়ের পর কখনো তাদের বাড়িতে আসেনি, তাই তিনিও যান না মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। এদিকে মেহেদির বোন মেহেতাজ নাহিদা নাফিসাকে শপিং করার জন্য তাদের সাথে যেতে বলল। নাহিদা যেতে চাইনি তবুও মেহেতাজ জোর করলো যার ফলে যেতেই হলো। মেহেদীর বাড়ি থেকে শুধুমাত্র মেহেদী ও মেহেতাজ এসেছে মেহেদী ড্রাইভ করছে পাশে বসানো হয়েছে নাহিদাকে আর মেহেতাজ ও নাফিসা পেছনের সিটে বসেছে। সাথে দু বছরের আরিশা আছে। পেছনে বসে দুইজন গল্পেরঝুরি খুলে বসেছে আর এদিকে সামনে বসে নাহিদার খুব বোরিং লাগছে। না পারছে তাদের সাথে আড্ডা দিতে আর না পারছে মেহেদির পাশে বসে থাকার অস্বস্তি দূর করতে। তাই সে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে আনমনে বাইরে তাকিয়ে আছে আর মেহেদী একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। মেহতাজ বললো,
– তোমাদের এমন নিরবতার কারণ কি! আমরা আছি বলে লজ্জা পাচ্ছো! বেশি না, আর কিছুদিন অপেক্ষা কর। আমরা আর বসে নেই তোমাদের লজ্জা দিতে। আপাতত আমাদের সাথেই যুক্ত হয়েই নিরবতা ভেঙে ফেলো। কি বলো নাফিসা?
– হুম।
নাফিসা খিলখিল শব্দ করে হেসে উঠলো। নাহিদা লজ্জা পেলো তার কথায় আর মেহেদীর কোনো রিয়েকশন নেই। কিছুটা সময়ের মধ্যেই আরিশা নাফিসার সাথে ভালো ভাব জমিয়ে ফেলেছে। খেলায় মেতে উঠেছে তারা। শপিং যত তারাতাড়ি সম্ভব, সম্পাদন করে নিলো। রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে বিকেলে তারা বাড়ি ফিরে এলো। নাহিদা নাফিসাকে তাদের বাসায় রেখে তারা চলে গেলো। নাহিদার সাথে মেহেদীর তেমন কোনো কথা হয়নি। শুধু রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার করার সময় জিজ্ঞেস করেছিলো “কি খাবে”!
বাকিদের ধারণা তাদের সামনে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে, কিন্তু নাহিদা অবাক হয়েছে। কেননা সে যেই মেহেদীকে চিনে সে চুপচাপ থাকার লোক না! তাহলে মেহেদী এতটা নীরব কেন!
দুদিন পর নাহিদা ভার্সিটি এসেছে ক্লাসও করবে, তার ফ্রেন্ডদেরও দাওয়াত করবে। ক্লাসে প্রবেশ করার সময় আশিকের সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছেন, ভাইয়া?
আশিক কোনো জবাব না দিয়ে তাকে এড়িয়ে চলে গেলো। নাহিদা বুঝতে পেরেছে সে তাকে ইগনোর করছে। তার কাছে সেটা স্বাভাবিক মনে হলো। কেননা, ইগনোর করলেও এখন সবার জন্য সেটাই শ্রেয়। ক্লাসে মন বসলো না তার, ঘুরেফিরে সেই আশিককেই মনে পড়ছে! একটু পরপর দৃষ্টি তাকেই খুজছে! সে তখন এসেছিলো কিন্তু এখন ক্লাসে নেই কেন! নাহিদার মনে হচ্ছে আশিক তার জন্যই ক্লাসে আসেনি! চাইছে আশিকের ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে কিন্তু পারছে না! এসবের কারণ কি! সে কি তার ইগনোর করা মেনে নিতে পারছে না! না, মানতে হবে। এটা হতেই পারে! আহামরি কিছু না।
নিজেকে নিজেই বুঝ দিচ্ছে আবার নিজেই ভাবতে শুরু করেছে! অবশেষে বাকি ক্লাস না করেই নাফিসাকে রেখে চলে এসেছে বাসায়। কেননা তার মনযোগ হারিয়ে গেছে ক্লাস থেকে। বাসায় এসে নিজেকে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত রাখছে আশিকের কর্মকাণ্ড ভুলতে। কাজে কাজে সেটার সফলতাও অর্জন করে ফেলেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here