“তৃ-তনয়া” পর্ব- ১৮

0
2672

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১৮
(নূর নাফিসা)
.
.
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একসময় আগমন ঘটলো কানন রাজার। রানী এক পলক তাকালো রাজার দিকে। অনেক কিছুই বুঝতে চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না! রাজার মুখখানা এমন গম্ভীর কেন! চোখ জোড়াও কেমন যেন লাল হয়ে আছে!
নাহিদা বিছানা ছেড়ে নেমে দাড়ালো। মেহেদী দরজা লক করে এগিয়ে এলো তার দিকে। দৃষ্টি যেন তার নিভু নিভু! ঝাপসা চোখে দেখছে লাল টুকটুকে পরীকে। একটা হাত বাড়িয়ে নাহিদার মুখখানা চেপে ধরে মাতাল কণ্ঠে বললো,
– কোন পাগলে ধরেছিলো আমাকে, যে তোকেই সেদিন নিয়ে যেতে হলো ভার্সিটি থেকে! একটা ভিখারিনী বোবা মেয়েকে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন ছিলো, আমার কাজ হাসিল করার জন্য! লাইফটার মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিস তুই! না তোকে দেখতো আমার আব্বু আম্মু, আর না আজ আমাকে বিয়ে করতে হতো!
মেহেদী কথা বলার সাথে সাথে পুষ্পরেণুর সুভাসকে হার মানিয়ে ভেসে এলো বিশ্রী সুবাস! যেটা নাহিদার কাছে অসহ্যকর! সে মেহেদীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পিছিয়ে গেলো এবং বললো,
– এসব কি! এমন করছেন কেন আপনি! এমন বিশ্রী গন্ধ কেন আপনার সাথে! আপনি কি মদ্যপান করে এসেছেন?
নাহিদার ধাক্কায় মেহেদী পড়ে যেতে নিয়েও হেলেদুলে সোজা হয়ে দাড়ালো। এতোক্ষণ ঠিকঠাক ভাবে হেটে এলেও আস্তে আস্তে তার দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। সে নিজ মুখে আঙুল দিয়ে নাহিদাকে চুপ থাকতে ইশারা করে ফিসফিস করে বললো,
– হুশশশ! আস্তে বলো। এ কথা যেন বাইরে না যায়। আব্বু আম্মু জানতে পারলে গলা কেটে দিবো তোমার! মাইন্ড ইট! হোয়াটএভার, থ্যাংক ইউ সো মাচ। বিয়ের জন্য ত্রিশ হাজার টাকা পেয়েছি আমি। আজকে একটুখানি, এইটুকু ছোট্টো একটা পার্টি করে এলাম, আগামীকাল ফুড়ুৎ করে উড়াল দিবো টেকনাফ টু তেতুলিয়া।
মেহেদী নাহিদার কাছে এগিয়ে এসে গলার নেকলেস স্পর্শ করে বললো,
– এই, এগুলো কি অরিজিনাল গোল্ড? অনেক টাকা হবে না বিক্রি করলে?
নাহিদা তার হাত ঝাটকা দিয়ে সরিয়ে দিলো। এ কি দেখছে সে আর এ কি শুনছে! আদৌ কি এগুলো সত্য ঘটছে তার সাথে, নাকি স্বপ্ন! এটা কিভাবে সম্ভব! শেষ পর্যন্ত একটা মাতাল জুটলো তার ভাগ্যে! মেহেদী শেরওয়ানীর টপার বোতামটা খুলতে খুলতে বললো,
– এনি ওয়ে, তোমার জিনিসের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই আমার। বউ আছো বউয়ের মতোই থাকবে। গার্ল ফ্রেন্ড হতে এসো না আবার। আমার সাথে বাড়াবাড়ি করতে আসবে ধাক্কা মেরে ছাদ থেকে ফেলে দিবো। মাইন্ড ইট।
এসব পাগলের প্রলাপ শুনতে একটুও ভালো লাগছে না নাহিদার! জীবনটা স্বাপ্নিক মনে হচ্ছে শুধু। এসব হয়তো স্বপ্নে ধরা দিচ্ছে তার সামনে!
মেহেদী তার ভাবনা কাটিয়ে বিছানার দিকে যেতে যেতে আবার বললো,
– এই মেয়ে, শোনো। আমার বিছানায় ঘুমাতে পারবে না। এই যে দেখো। এই বিছানায় আমি থাকবো আর এই পাশেরটায় তুমি থাকবে। ক্লিয়ার? আব্বু আম্মুর কানে যেন না যায় এসব। তাহলে রাতে ভুত হয়ে গলা টিপে মেরে দিবো।
নাহিদা তার আঙ্গুলের ইশারায় খাটের দিকে তাকালো। ডানে বামে আঙুল নাড়িয়ে এক বিছানাকেই মাতাল মেহেদী দুইটা দেখাচ্ছে। কথা বলার পর বেল্ট না খুলেই পা নাড়িয়েছে জুতা খুলার জন্য। না পেরে জুতাসহই ধপাস করে বালিশে শুয়ে পড়লো। হাত বাড়িয়ে মোটা চাদরটাও টান দিলো। মাত্র এক কোনা এটেছে তার দেহে! বাকিটা ভাজের ভাজই রয়ে গেছে!
নাহিদা ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়লো। স্তব্ধ তার প্রান, আর নিস্তেজ দেহ! কপালে লিখন কি আর বদলাতে পারবে কেহ! কেউ স্বপ্ন দেখেছিলো তাকে নিয়ে লাখো স্বপ্নের নৌকায় করে ভেসে যাবে সীমান্ত ছাড়িয়ে অফুরন্ত চলমান স্রোতে! কিন্তু সে করেছিলো তাকে হেলা, বিশ্বাস ছিলো ভাগ্যের পরিহাস হয়তো মিলিয়ে দিবে যোগ্য পথিক। যে কিনা স্বপ্ন বাস্তব করতে জানবে। দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে জীবনের মুহুর্তগুলোকে রাঙিয়ে দিতে জানবে! ডানাকাটা পরী বানিয়ে তাকে ভুবনে কদম ফেলে উড়তে শেখাবে! ভালোবেসে, ভালোবেসে, ভালোবাসায় পূর্ণ করে দিবে তার ক্ষুদ্র ভুবন!
কিন্তু তার পরিবর্তে কি হলো আজ! এমন অনাকাঙ্ক্ষিত জীবন কেন তার সম্মুখে এসে দাড়ালো! এটাও কি সৃষ্টিকর্তার পরীক্ষা! অন্যান্য সমস্যা হলে না হয় মানিয়ে নেওয়া যেতো, কিন্তু মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে স্বামীর মর্যাদা কিভাবে দিবে!
নাহিদা দু’হাতে মুখে চেপে কান্না করতে লাগলো। বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত সবার মাঝে আনন্দ আর পুষ্পিত কাননের রানীর মাঝে মহাপ্রলয়! সে কি কখনো ভেবেছিলো বিয়ের রাতে তাকে এভাবে কান্না করতে হবে! ভেতরের সপ্ন, সুখ, শান্তি, ইচ্ছে, প্রেম যা ছিলো সব আজ মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে শূন্যে মিশে গেছে!
বেশ কিছুক্ষণ কান্না করে নাহিদা অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। মেহেদীকে নড়াচড়া করতে দেখে তার দৃষ্টি সজাগ হলো। হাতের পিঠে নিরবে অশ্রু মুছে নিলো। তার বাবা নিশ্চয়ই জানতো না ছেলেটা এমন। তাহলে তো আর তাকে বিয়ে দিতো না এখানে! বাবা কিভাবে জানবে ছেলের বাবা-মা ই তো জানে না! না, কোনো হট্টগোল বাধতে দিবে না নাহিদা। কাউকে কিছু জানাবে না। তাহলে উনারা খুব কষ্ট পাবে! কাউকে কষ্ট পেতে দিবে না। নিজের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাকে ঢেলে দিবে লোকটাকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে। বিয়ের আগেই তো শ্বশুর বলেছিলো ছেলেটাকে সংসারের প্রতি আকৃষ্ট করতেই এখন বিয়ে করাতে চাইছে। তাহলে নাহিদা এখন সেই প্রচেষ্টাই করবে, তাকে সজ্জিত সংসারের প্রতি আকৃষ্ট করতে। কে জানে সফল হবে কি-না! না, সংশয়ে থাকলে চলবে না। সফল হোক বা না হোক, চেষ্টা করবেই।
ভাবতে ভাবতে আবারও অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। নাহিদা তা হাতের আঙ্গুল দ্বারা মুছে নিলো এবং উঠে দাড়ালো। শীতকাল আসতে চলেছে, দিনে স্বাভাবিক থাকলেও রাতে ঠান্ডার প্রভাব পড়ে আবহাওয়াতে। মেহেদীরও হয়তো ঠান্ডা লাগছে কিছুটা, তাই এমন নড়াচড়া করছে। আর ঘুমের মধ্যে থেকে বারবার ভাজ করা চাদরটার কোনা টেনে যাচ্ছে। নাহিদা এগিয়ে এসে পা থেকে জুতা খুলে দিলো। জুতার ময়লায় বিছানা ময়লা করে ফেলেছে! জুতা জোড়া রুমের একপাশে রেখে আবার মেহেদীর কাছে এলো। চাদরের কোনাটা তার কাছ থেকে ছাড়িয়ে সম্পূর্ণ ভাজ খুলে তার উপর ছড়িয়ে দিলো। বালিশটা একটু টেনে মাথাটা বালিশের মাঝামাঝিতে এনে দিলো। সুইচ বোর্ড খুঁজে লাইটটা অফ করে নাহিদা জানালার পাশে এসে দাড়ালো। ইচ্ছে থাকলেও গ্লাস খুললো না। শুধু পর্দাটা সড়িয়ে দিলো। সাথে সাথেই কক্ষে রূপালী চাঁদের আলো ছিটিয়ে পড়লো। বাইরের পরিবেশটা খুব শান্ত, শুধু গাড়ি চলাচলে যতটা অশান্ত হওয়ার কথা ততটুকুই। ক্ষীণ চাঁদের আলোয় জানালার বাইরে দেখা যাচ্ছে ছোট বড় ভবন আর ভবন। সে কত তলায় আছে তা জানা নেই। তবে আনুমানিক ধারণা করে নিলো তিন বা চার তলায় তার বর্তমান অবস্থান। কেননা গাড়িগুলো অনেকটা নিচে দেখা যাচ্ছে। বিয়ে বাড়ি, প্রথমে হৈ-হুল্লোড় থাকলেও কখন যে সেটা নিরিবিলিতে পরিনত হয়েছে সেই খেয়ালই নেই নাহিদার। হয়তো এখন মাঝরাত! সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। শুধু নববধূর চোখেই ঘুম নামক শব্দটা হারাম হয়ে গেছে! আনমনে বাইরে তাকিয়ে থাকার এক পর্যায়ে কারো গোঙানির আওয়াজ ভেসে এলো কানে! হঠাৎ করেই সেই আওয়াজ পরিনত হয়ে গেছে “ওফ্ফ! আহ!” শব্দে! নাহিদা সুইচবোর্ডের পাশে এসে লাইট অন করে দেখলো। মেহেদী দু’হাতে মাথা চেপে ধরে এমন শব্দ করছে আর এপাশ থেকে ওপাশে নড়েচড়ে ছটফট করছে! নাহিদা দ্রুত পায়ে হেটে পাশে এসে বসলো। মেহেদীর মাথায় হাত রাখতে চেষ্টা করে বললো,
– কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন?
তার কথায় মেহেদীর কোনো জবাব নেই। থাকবে কিভাবে সে এখনো ঘুমের ঘোরে ও মদ্যপানের কারণে মাতাল! চোখ বন্ধ রেখেই শুধু মাথার চুল টানছে, দু’হাতে মাথা চাপ দিচ্ছে আর ছটফট করছে। নাহিদার যতটুকু ধারণা, মেহেদীর মাথা ব্যথা করছে। হয়তো ব্যথা সহ্য করতে পারছে না, তাই এমন ছটফট তার মাঝে! সে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে খুজতে লাগলো কোনো ব্যথার ওয়েনমেন্ট রাখা আছে কি-না। কিন্তু এমন কিছুই খুজে পেলো না। সে লাগেজের কাছে এসে লাগেজ খুললো। দেখলো সেখানে তেল জাতীয় কিছু রাখা আছে কিনা। খুজতে খুজতে পেয়েও গেলো। সেটা নিয়ে আবার বিছানায় এসে বসলো। মেহেদীর মাথাটা স্পর্শ করতেই মেহেদী ছটফটিয়ে ঝটপট বালিশ ছেড়ে নাহিদার কোলে মাথা রাখলো এবং নাহিদাকে দু’হাতে জড়িয়ে রেখে তার পেটে মুখ গুজে রাখলো। ঘটনা এতো তারাতাড়ি ঘটেছে যার ফলে নাহিদার শরীর কেপে উঠেছে! যেন বিদ্যুৎ শক লেগেছে তার দেহে! সে যেন এক মুহূর্তের জন্য কম্পিত পাথর হয়ে গেছে! মেহেদী মাথা ব্যাথার যন্ত্রণায় নাহিদাকে আরও বেশি জড়ো করে নিচ্ছে। যেন তার মাঝে সে মিশে যেতে চাইছে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ও একটুখানি শান্তির খোঁজে! নাহিদার পেটের উপর থেকে শাড়ি সরে গেছে আর স্পর্শ পড়েছে মেহেদীর জ্বিভ ও উষ্ণ ঠোঁটের। অত:পর দাতের আঘাতও পড়ে গেছে। নাহিদা সাথে সাথেই তার চুল আকড়ে ধরলো। যে মুখে মদ স্পর্শ করেছে সেই মুখের স্পর্শে নাহিদার ভেতরে সৃষ্টি হয়েছে এক অসহ্য যন্ত্রণার! সে তার মাথাটা সরানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অসহায় লাগছে আজ নিজেকে। কান্না করতে ইচ্ছে করছে খুব, কিন্তু সেটাও যেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাকে! সে ধৈর্যের বাধ বেধে রেখে নিজেকে শক্ত করতে চেষ্টা করলো। অত:পর হাতে তেল নিয়ে মেহেদীর মাথায় মেসাজ করতে লাগলো। চুলে হালকা টান ও বিলি কেটে দিতে দিতে নিরবে অশ্রু ফেলতে লাগলো। এতোক্ষণে যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে মেহেদীর ছটফট বন্ধ হয়ে গেছে। তাকে শান্তভাবে থাকতে দেখে নাহিদা বুঝে গেছে সে শান্তি পেয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে পড়েছে। কেননা তার হাতের বাধনও হালকা হয়ে গেছে। তবুও নাহিদা বসে বসে বিলি কাটতে লাগলো তার মাথায়।
এক সময় ভেসে এলো আযানের ধ্বনি। ফজরের আজান পড়ে গেছে। আযান শেষ হতেই নাহিদা বালিশটা ঠিক করে রেখে মেহেদীর মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে দিলো। তার উপর চাদরটা ভালোভাবে দিয়ে সে বিছানা ছেড়ে নেমে গেলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে একবার দেখে নিলো তার বধূ বেশ! হতভাগী বধূ যার প্রথম রাত কাটে মাতাল স্বামীর সেবাযত্ন করে! সে মাথা থেকে দোপাট্টা সরিয়ে নিলো অত:পর একে একে সব গহনা শরীর থেকে ছাড়িয়ে নিলো। সবশেষে ছাড়ালো মায়ের গড়ে দেওয়া বালা জোড়া। জহিরুল ইসলাম নিষেধ করেছিলো যেন কোনো কিছুই না দেয়। উনার মতে নিয়াজ উদ্দিনের অতিরিক্ত কোনো খরচ করার প্রয়োজন নেই, যা দেওয়ার তারাই দিয়ে ঘরে তুলবে নববধূকে। কিন্তু মায়ের গিফট তো মা দিবেই। নাজিয়ার মতো তাকেও এক জোড়া বালা গিফট করেছে রুমানা বেগম।
নাহিদা গহনা খুলে রেখে পেটের উপর থেকে শাড়িটা সড়িয়ে দেখলো, রক্ত জমাট বেধে লাল হয়ে আছে পেটের একটা অংশ। মেহেদীর একটা কামড়ই যথেষ্ট ছিলো রক্ত জমাট বাধিয়ে দেওয়ার জন্য। সে লাগেজ থেকে জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো গোসলের জন্য। আর যাইহোক, দেহে মদ্যপায়ী মুখের স্পর্শ নিয়ে নামাজ পড়তে পারবে না সে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here