“তৃ-তনয়া” পর্ব- ১৯

0
2727

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১৯
(নূর নাফিসা)
.
.
নাহিদা গোসল সেড়ে নামাজ পড়ে নিলো। মেহেদী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। নাহিদা আবার এসে দাড়িয়ে রইলো জানালার পাশে। এবার গ্লাস খুলে দিয়েছে। প্রভাতের মৃদু বাতাস দেহে শীতল স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে। সূর্য উদয়ের সময় হয়ে গেছে, পূর্বাকাশে লালিমার ঝলক দেখা যাচ্ছে। মানুষের কোলাহল হয়তো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আর যানবাহন! সে তো দিন নেই, রাত নেই, শহরের পরিবেশকে সর্বদা অশান্ত করে রাখতে প্রস্তুত! একের পর এক লাইন ধরে ছুটে চলে ডানে বামে আর থেমে থেমে বাজিয়ে যায় হর্ন!
সূর্য উদয়ের একটু পরেই নাহিদার কানে শব্দ এলো,
– ওফ্ফ! ঘুমাতে এসেও শান্তি নেই! এই মেয়ে, গ্লাস খুলে রেখেছো কেন! পর্দা টানো!
নাহিদা পেছনে ফিরে লক্ষ্য করলো সূর্যের সোনালী কিরণ জানালার গ্রিল ভেদ করে মেহেদীর চোখ বরাবর এসে পড়েছে। নাহিদা একটু চেপে দাড়ালো যাতে তার ছায়ায় মেহেদীর মুখে পড়া কিরণ ঢেকে যায়। মেহেদী বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। মাথা তার এখনো ঝিম ধরে আছে তাই ভারি ভারি লাগছে। বিছানায় থেকেই সে শেরওয়ানী খুলে ফেললো। অত:পর হেলেদুলে হেটে বাথরুমে চলে গেলো। নাহিদা বিছানার পাশে এসে ময়লা চাদরটা তুলে নিলো। অত:পর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে আলমারির চাবি খুজতে লাগলো। কিন্তু পাওয়া গেলো না, কোথায় রাখে কে জানে! সে বাকিসব গুছিয়ে বসে রইলো। মেহেদী বাথরুম থেকে বেরিয়ে ওয়ারড্রব খুলে জামাকাপড় নিতে লাগলো। নাহিদা বিছানায় থেকে বললো,
– আলমারির চাবি কোথায় রাখেন?
– কেন?
– এক্সট্রা বেডশিট আছে? এটা ময়লা হয়ে গেছে।
– বাড়িতে না আসতেই বেডশিট ময়লা করে ফেলেছো!
– আমি করিনি। আপনি করেছেন।
– হোয়াট! আবার মুখের উপর তর্ক করো! আমি তো তোমাকে জেল ফাস দিচ্ছি না, দোষ আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছো কেন!
– আমি কারো উপর দোষ চাপাতে চাইছি না। আপনি রাতে জুতা পড়েই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছেন। জুতার ময়লায় বিছানা ময়লা হয়ে গেছে।
– তাহলে তো দোষ জুতার!
– আমি তো কাউকেই দোষারোপ করছি না! শুধু একটা বেডশিট চাইলাম!
– বেডশিট থাকবে কাপড়চোপড়ের সাথে ওয়ারড্রবে, তুমি আলমারির চাবি চাইছো কেন! মতলব তো তোমার ভালো দেখছি না! টাকা কিন্তু আমি গণে রেখেছি, এক টাকা কম হলে তোমার খবর আছে।
– কি আযব কথাবার্তা বলছেন! আমি আপনার টাকা নিয়ে কি করবো। আলমারির চাবি চাইছি গহনাও তো রাখতে হবে! আর ওয়ারড্রবেই যদি সব কাপড়চোপড় রাখা থাকে তাহলে আলমারিতে কি থাকে!
– সেগুলো তোমাকে জানতে হবে না। আলমারির চাবি ওয়ারড্রবের ড্রয়ারে রাখা আছে, এখান থেকে নিয়ে আবার কাজ শেষে এখানেই রেখে দিবে।
মেহেদী আবার কাপড়চোপড় এলোমেলো করে তার কাঙ্ক্ষিত জামা খুজতে লাগলো। নাহিদা খুব অসহায় ভঙ্গিতে বললো,
– আপনি মদ্যপান কেন করেন? কি মজা পান এসব করে! এসব কি ঠিক! এগুলো তো হারাম। হারাম জিনিস কেন মুখে তুলেন!
– তাতে তোমার কি? তোমাকে বলেছি আমার শিক্ষক হতে! আমার কোনো ব্যাপারে নাক গলাবে না। বিয়ে হয়েছে বলে ভেবো না যা খুশি তাই বলতে পারবে! এসব বিয়ে টিয়েতে আমার কিছু যায় আসে না। আমাকে নিয়ে না ভেবে নিজেকে নিয়ে ভাবো। তোমার পথ তুমি দেখো আর আমার পথে আমি। আর আমার কোনো ব্যাপারে আব্বু আম্মুকেও জানাতে যাবে না। যদি জানিয়েছো তো, তোমার কি হাল করবো আমি ভেবে পাবে না!
মেহেদী জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। বিয়ে তো ভাগ্যের ব্যাপার। নসিবে যেটা লেখা আছে সেটা কি পেন্সিল কালির ন্যায় মুছে ফেলা যায়! পিতামাতা জানলেও তো কপাল চাপড়াবে যে, মেয়েকে নেশাখোরের ঘরে পাঠিয়েছে! না, এভাবে কষ্ট পেতে দিবে না পিতা মাতাকে। দেখা যাক ভাগ্যের পরিহাস শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে। নাহিদা চোখ মুছে ওয়ারড্রবের কাছে এলো। ওয়ারড্রব খুলতেই মনে হলো যেন ধোপার কাছে কেচে দেওয়ার জন্য বালতি ভর্তি কাপড় দিয়ে গেছে! এমন নাজেহাল অবস্থা করে রেখেছে ড্রয়ারের! বাকি ড্রয়ার খুলে দেখলো একই অবস্থা! একজন মানুষের এতো কাপড়চোপড়! তাও আবার এলোমেলো! নাহিদা চাবিটা নিয়ে যেমন ছিলো তেমনই লাগিয়ে দিলো ড্রয়ার। একটা ড্রয়ার শুধু পরিপাটি যেটাতে তার কাপড়চোপড় নেই। শুধু একটা কম্বল আর তিনটা বেডশিট আর একটা কাথা রাখা। নাহিদা, গোলাপি রঙের বেডশিটটা নিয়ে বিছানায় বিছিয়ে দিলো। সাথে ম্যাচিং কুশন কভার। অত:পর আলমারি খুললো সাথে সাথেই ধপাধপ্ দুইটা বাক্স পড়লো। নাহিদা ভয়ে পিছিয়ে গেছে! এসব কি রাখা আলমারিতে! সে নিচু হয়ে বাক্স ধরে দেখলো হালকা লাগছে। খুলে দেখলো একটা খালি অন্যটাতে পলিথিন জাতীয় প্যাকেটে মোড়ানো কিছু রাখা আছে। লেখা দেখে বুঝে নিলো এটা স্যুট সেটের প্যাকেট। বিয়ের জন্য শপিং করতে গিয়ে তো এটা কিনে নি! বাক্সের লোগো দেখে বুঝতে পারলো পার্সেল পাঠানো হয়েছে। স্যুট সেট বাক্সের ভেতর রেখে আলমারির কাছে এসে দেখলো লাগেজ ও ব্যাগ নিয়ে আলমারির ভেতর রেখে দিয়েছে! জুতাও সব রাখা আছে এখানেই। অন্যথায় জামাকাপড় কিছু নেই। ব্যাগ লাগেজ কি আলমারির ভেতরে রাখার জায়গা! এগুলো থাকবে সানশেডে! সেটাও তো নেই ঘরে! তবে আলমারি কিংবা ওয়ারড্রবের উপরও তো রাখা যেতো!
নাহিদা গুছাতে গিয়েও গুছালো না। এসব গুছাতে গেলে তার দিনের অর্ধেকটা সময় লাগবে! সে লাগেজ নামিয়ে জায়গা করে তার গহনা ও জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে রেখে দিলো। অত:পর আলমারি লক করে টুল এনে দাড়িয়ে মেহেদীর লাগেজটা আলমারির উপর তুলে দিলো। আর তারটা নিচেই রেখে দিলো। কেননা আজ আবার লাগবেই। বাথরুম থেকে বেরিয়ে নাহিদাকে লাগেজ উপরে তুলতে দেখে মেহেদী বললো,
– এই, কি করছো এসব! এতো মাতব্বরি করতে বলছে কে! নামাও এটা!
– সমস্যা কি? এটা তো এখন প্রয়োজন পড়ছে না। আলমারিতে জায়গা ছিলো না আমার কাপড়চোপড় রাখার তাই এটা সরিয়ে দিলাম।
– নামাতে বলেছি নামাও! এটার প্রয়োজন আছে আমার। জায়গা না পেলে তোমার কাপড়চোপড় নিয়ে রাখো সেখানে!
নাহিদা বিরক্তি নিয়ে নামিয়ে দিলো। মেহেদী সেটা নিয়ে ওয়ারড্রবের কাছে রেখে দিলো। মাথা মুছে তারপর ওয়ারড্রব খুলে বেছে বেছে জামাকাপড় গুছাতে লাগলো লাগেজের ভেতর। সে কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিচ্ছে কেন! নাহিদার গত রাতের কথা মনে হলো। তাহলে কি সত্যিই আজ সে বেড়াতে চলে যাবে! আজ না বাড়িতে রিসিপশন প্রোগ্রাম! এখন কিছু জিজ্ঞেস করলেও তো আবার বকাঝকা শুরু করবে! তাই নাহিদা চুপচাপ তুলে রাখা বেডশিট নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। মেহেদী তার কাপড়চোপড়ও রেখে গেছে। নাহিদা রুমে এসে শেরওয়ানীটাও নিয়ে গেলো। বিশ্রী গন্ধ লেগে আছে জামাকাপড়ে! সব ধুয়ে দিলো। এতোক্ষণে মেহেদীর গুছানো শেষ। নাহিদা বাথরুম থেকে বের হতেই সে ব্রু কুচকে বললো,
– এসব কি? তোমার জামাকাপড় বারান্দায় রেখেছো কেন? এটা বস্তি এলাকা না যে, বারান্দায় কাপড় থাকবে! দ্বিতীয় বার দেখলে জানালা বাইরে সোজা নিচে চলে যাবে।
নাহিদা বারান্দার দিকে যেতে যেতে মনে মনে বললো, “নিজের আলমারি আর ওয়ারড্রবের ভেতরে বস্তি বানিয়ে রেখেছে সেটা কিছু না, বারান্দায় কাপড় নেড়ে দেওয়ায় দোষ হয়ে গেছে!”
তাকে বারান্দার দিকে যেতে দেখে মেহেদী বললো,
– আবার এগুলো নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? একবার কি বললাম কানে যায়নি?
– তাহলে ভেজা কাপড় শুকাতে দিবো কোথায়! ছাদে যাবো?
– রুম থেকে বের হও।
– কি!
– রুম থেকে বের হতে বলেছি। রুম থেকে বেরিয়ে বা দিকে গিয়ে দেখবে বারান্দার মতো খোলামেলা একটা বড় রুম আছে। ওটাতে কাপড়চোপড় শুকাতে দিবে। এটা ভাড়াটে বাসা। ছাদে গেলে চুরি হতে পাচ মিনিট সময় লাগবে।
“এভাবে ধমকে বলার কি আছে, ষ্টুপিড লোক! ভালোভাবে বলা যায় না কথা!” নাহিদা বিরক্তি নিয়ে দরজার কাছে এসে থেমে গেলো। বাড়িতে কারা না কারা আছে, সকাল সকাল নতুন বউকে বালতি ভরে কাপড়চোপড় নিয়ে যেতে দেখলে কি না কি ভাববে বা বলবে কে জানে! তাই আবার পেছনে ফিরে বললো,
– আমি তো চিনি না কিছু। আপনি রেখে আসতে পারবেন?
– কি! আমি তোমার জামাকাপড় নিয়ে যাবো!
– আমার গুলো আজ এখানেই থাক। পরে আর রাখবো না। আপনার গুলোই নিয়ে যান। বাড়ি ভর্তি মেহমান। তাই বলছিলাম।
– মেহমান যেন গিলে ফেলবে!
মেহেদী তার হাত থেকে বালতি নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। মেহেদীর শেষ কথাটা শুনে কেন জানি তার হাসি পেলো! কিন্তু তেমন ভাবে হাসলো না। সে রুমের বারান্দায় এসে দাড়ালো। এখানে সোফা রাখা আছে। অবশ্য এটা সোফা না আরও কিছু তার জানা নেই! সে বসে পরীক্ষা করলো এটাতে বসতে কেমন মজা। সোফায় বসেছে না মেঝেতে বসেছে তার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে! কোনো কাঠ তক্তা কিছুই নেই। কাপড়ের মতো প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো ফোম! বসলে সাথে সাথেই মেঝের সাথে যেন মিশে যাচ্ছে এমন মনে হচ্ছে! এর চেয়ে ভালো মাদুর বিছিয়ে মাটিতে বসা! গদি বলা যায় হয়তো এটাকে! একটা এক সিট, আরেকটা তিন সিটের। স্পেশাল গদি! সে আবার উঠে দাড়ালো। এটা থেকে। পাশে থাকা গোলাকৃতি টুলের উপর রাখা বাকা ফুলদানিটা একটু সোজা করে রাখলো। এমনি রুমে প্রবেশ করলো মেহতাজ। মুখে হাসি ফুটিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
– নতুন বউ বাসায় আসতে না আসতেই কাজে লেগে গেছে! হুম? মেহেদীকে দেখলাম কতো কাপড় নিয়ে যাচ্ছে!
নাহিদা মুচকি হাসলো শুধু। মেহতাজ একটু বিস্মিত কন্ঠে বললো,
– একি! রাতে ঘুম হয়নি একটুও? চোখের নিচে কেমন কালচে ছাপ পড়ে গেছে! মেহেদী বাদড়টা ঘুমাতে দেয়নি নিশ্চয়ই!
– তেমন কিছু না। নামাজ পড়ে আর ঘুমাইনি। তাই হয়তো।
– নামাজ পড়েছো?
– হ্যাঁ।
এমনি রুমে প্রবেশ করলো মেহেদী। তাকে দেখে মেহতাজের উক্তি,
– কিরে, সারারাত জাগিয়ে রেখে গল্প করেছিস! এখন যে চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে গেলো। লোকে দেখবে আর লজ্জা দিবে!
– তাতে আমার কি! আমি কি কারো চোখে ধরে রেখেছি! আমি নিজেও রাত জেগে থাকিনি আর না কাউকে জাগিয়ে রেখেছি! আর লজ্জা দিবে কেন, তোমরা যেই মেকাপ করতে জানো! খোচা দিলে এক ইঞ্চি ডেবে যাবে! কালচে ছাপ আবার কিভাবে দেখা যাবে!
মেহেদী বলতে বলতে বালতি নিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেলো। তার কথায় এদিকে নাহিদার মনোক্তি, “আপনি জানবেন কিভাবে কাউকে জাগিয়ে রেখেছেন কিনা! অন্যের মনে কষ্ট দিয়ে ঘুম হারাম করে নিজে তো মাতাল হয়ে পড়ে ঘুমিয়েছেন।”
মেহেদীর কথায় মেহতাজ হেসে নাহিদার দিকে ঘুরে কাধে হাত রেখে নরম গলায় বললো,
– পরিবারকে মনে করে চিন্তা করেছো আর কান্না করেছো সারারাত, তাই না? দুশ্চিন্তা করো না। প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগেই, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। এক কাজ করো, আমি খাবার এনে দিচ্ছি। খেয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। পার্লার কাছেই। একটু পর যাবো। ততোক্ষণে একটু ঘুমাও।
হয়েছে আর ঘুম! মেহতাজ খাবার এনে দিলে অল্প খেয়ে নিলো। আয়াশ দু একজন সাথে নিয়ে বিছানায় উঠে লাফাচ্ছে, ফুল স্পর্শ করে করে খেলা করছে। মেহতাজ এগুলো ছিড়তে নিষেধ করলো। কিন্তু তাদের বের করতে পারলো না রুম থেকে! এদিকে আবার আরিশা কোলে। নাহিদাও বললো সে এখন ঘুমাবে না।মেহতাজের ডাক পড়লে নাহিদা আরিশাকে কোলে নিলো। মেহেরুন ইসলাম এসে নাহিদার সাথে দেখা ও কথা বলে গেলেন। মেহেদীর চাচিরাও এসেছে রুমে, দেখা করতে। পার্লারে যাওয়ার পূর্বে বাকিটুকু সময় নাহিদা আরিশাকে নিয়েই কাটালো সাথে মেহমানদের সাথে টুকটাক দেখাসাক্ষাৎ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here