“তৃ-তনয়া” পর্ব- ২০

0
2696

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২০
(নূর নাফিসা)
.
.
রিসিপশন প্রোগ্রাম করা হয়েছে কমিউনিটি সেন্টারে। যেটা তাদের বাসার কাছেই। বিকেলের দিকে নাহিদার বাড়ির লোকজন এসেছে। নাফিসা তো নাহিদাকে দেখে কতো উৎফুল্ল! যেন মনে হচ্ছে এক দিন নয়, বহু দিন পর তার সাথে দেখা হলো। নাহিদাও খুব খুশি তার পরিবারকে দেখে। নাফিসা মেহেদীর সাথেও টুকটাক কথা বলেছে। বাবার আদেশে সবার সাথেই কুশল বিনিময় করলো মেহেদী। আরাফের সাথে আসিফের ভালো ভাব জমে গেছে, যতটা মেহেদীর সাথেও হয়নি। হবেই কিভাবে! মেহেদী সেদিকে লক্ষ্য রাখলে তো! সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হলো সকল আয়োজন। সন্ধ্যায় নাহিদার পরিবারসহ মেহেদীর পরিবার বাড়ি ফিরে এলো। এখান থেকে নাহিদা ও মেহেদী আজ নাহিদাদের বাড়িতে যাবে। বাড়িতে ফিরতেই মেহেদী তার বাবাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বললো,
– আব্বু, সব তো শেষ হলো। আমি সকালেই ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে রেখেছি। এবার আমি যাই।
– হ্যাঁ, আব্বু। যাবেই তো। এতো তাড়া তোমার শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার। আর একটু সময় তো বাপের বাড়ি থাকো। তারপরই বিদায় দিচ্ছি।
– শ্বশুর বাড়ি মানে!
– মানে, এখন তুমি শ্বশুর বাড়ি যাবে।
– আবার শ্বশুর বাড়ি যাবো কেন! এটা কিন্তু কথা ছিলো না। বিয়ে করতে বলেছো, বিয়ে করেছি। ব্যাস।
– হ্যাঁ, অস্বীকার করছি কোথায়! বিয়ে তো এখনো শেষ হয়নি৷ আজ শ্বশুর বাড়ি যাবে, জামাই আদর পাবে, কার্যাদি সম্পন্ন হবে তারপর বেড়াতে যাবে। টিকেট আমি নিজেই বুক করে দিবো।
– আল্লাহ! আর কতো কার্যাদি! আব্বুর মাথায় একটু বুঝ দাও। তিন কবুল বললেই বিয়ে শেষ। এতো কার্যাদি সম্পন্ন করতে হয় না!
– আল্লাহ তোমার কথা কিভাবে শুনবে আব্বু, তুমি নামাজ পড়ো?
– ধ্যাৎ! সেদিন কাজী অফিসে বিয়ে সেড়ে এলেই হতো! তাহলে তো আজ আর এতো এতো কার্যাদি সম্পন্ন করতে হতো না!
– ধৈর্যহীন পুচকে ছেলে আমার! ভদ্র ছেলের মতো বাপের মর্যাদা রক্ষা করো শ্বশুর বাড়ি গিয়ে। উল্টাপাল্টা আচরণ করে বদনাম করে এসো না আমার! যাও, কাপড়চোপড় নতুন করে গুছিয়ে নাও শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য।
– টিকেট কিন্তু তুমি বুক করে দিবে বলেছো।
– ওকে।
মেহেদী বিরক্তি নিয়ে চলে গেলো রুমের দিকে। রুমে এসে দেখলো মেহতাজ সহ তারা তিন বোন কথা বলছে আর নাহিদা কথার পাশাপাশি লাগেজ গুছিয়ে নিচ্ছে। মেহেদী আর ভেতরে প্রবেশ করলো না। দরজার সামনে দাড়িয়েই ভদ্রতার সুরে বললো,
– নাহিদা, একটু এসো তো।
নাহিদা এমন সুরে ডাকতে দেখে একটু অবাক হয়েই তার দিকে তাকালো। নাফিসা বলে উঠলো,
– ভাইয়া, আমরা বাইরে চলে যাবো?
– নাহ। তোমরা যাবে কেন।
মেহতাজ হেসে নাফিসাকে বললো,
– আরে আরে! আমার ভাইটাকে এভাবে লজ্জা দিচ্ছো কেন! এভাবে প্রত্যক্ষ লজ্জা দিতে হয়!
নাফিসা খিলখিল করে হেসে উঠলো। নাজিয়া ও মেহতাজের মুখেও লেগে আছে হাসি। মেহেদীর বিরক্ত লাগছে মেহতাজ তাদের সাথে যুক্ত হয়ে কেমন লজ্জা দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে! সে দরজার সামনে থেকে চলে এলো ছোট ছোট কদমে। একটু এগিয়ে এসে আবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো নাহিদা বেরিয়ে এসেছে। তাই সে দাড়িয়ে গেলো। নাহিদা তার কাছে এসে বললো,
– কি?
– সাথে সাথে এলে কি আমাকে এই কথাগুলো শুনতে হতো!
– এখন কি বলবেন কিছু? নাকি চলে যাবো?
– হুহ্! নিজের বাড়ির লোকজন দেখে যেন দাপট বেড়ে গেছে! জেনে রেখো, মোল্লার জোর মসজিদ পর্যন্তই।
– জানা আছে আমার। আরও কিছু বলবেন?
– বলা তো শুরু ই করলাম না!
– সেটাই তো জানতে চাইছি, শেষ করবেন কখন?
– রুমে যাও।
নাহিদা আবার তাদের রুমের দিকে পা বাড়ালে মেহেদী বললো,
– ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? এই রুমে যেতে বলেছি।
নাহিদা আবার ফিরে এসে পাশের রুমে পদার্পণ করলো। এটা মেহতাজের রুম। নাহিদা প্রবেশ করার পরপরই মেহেদী রুমে এসে দরজা লক করে দিয়ে বললো,
– একদম মিথ্যে বলবে না, রিসিপশনের দিন কি ছেলেদের শ্বশুর বাড়ি যেতে হয়?
– আমি জানি, হয়।
– আচ্ছা, মনে করো এখন আমরা পালিয়ে কাজী অফিসে বিয়ে করে এসেছি। তাহলে তো রিসিপশন হতোই না, শ্বশুর বাড়িও যাওয়া হতো না। রাইট?
– হুম।
মেহেদী মুচকি হেসে নাহিদার মাথার চুল, দোপাট্টার পাড় ও টিকলি স্পর্শ করতে করতে বললো,
– গুড, তাহলে এবার তুমি সেটাই ভেবে নাও যে আমরা কাজী অফিস থেকে বিয়ে করে এসেছি। তাই এখন আমরা শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি না। তোমার যেতে ইচ্ছে করলে যাও, কিন্তু আমি যাচ্ছি না। আর আমাকে যেতে হবে না। এটা গিয়ে তোমার আব্বু আর আমার আব্বুকে বলে দিবে। কেমন?
– দুঃখিত। এখন যেহেতু তেমন কিছু হয়নি এবং বিয়েটা আনুষ্ঠানিকভাবে হয়েছে এবং রিসিপশনও হয়েছে তাহলে এখন এই কার্যটিও হবে। আমি কাউকে এর বিপরীতে কিছু বলছি না।
সাথে সাথেই মেহেদীর মুখে বিরক্তিকর ভাব নেমে এলো! সে ধমকের সুরে বললো,
– বের হও। যাও। এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে যাও।
– হুম। যাচ্ছি। আপনার কাপড়চোপড় কোনগুলো নিবো সেটা বলে দিন।
– কিছু গুছাতে হবে না। যাও।
– ওকে। পরে আবার আমাকে দোষারোপ করতে পারবেন না। ওবাড়িতে গেলে পড়নের জামাকাপড়ে নতুবা বাবার লুঙ্গী পড়ে ও খালি গায়ে থাকতে থাকতে হবে।
নাহিদা বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। নাহিদা রুমে আসার দুই মিনিট পর মেহেদী এসে বললো,
– দুইটা টিশার্ট, দুইটা শার্ট আর তিনটা জিন্স নাও। ওয়ারড্রব থেকে নিও না। ওই লাগেজ থেকে নাও।
নাহিদার কাছে এসে তুলনামূলক আস্তে বললেও বাকিদের কানে পৌছেছে। কেননা এতোটা আস্তে বলেনি। তা শুনে মেহতাজ বললো,
– মেহেদী তুই ক’দিনের সফরে যাচ্ছিস শ্বশুর বাড়িতে? মাত্র একদিনের জন্য এতো কিছু!
– একদিন!
নাজিয়া বললো,
– না, ভাইয়া। আপনার যতদিন ইচ্ছে ততদিন থাকতে পারবেন।
– তাহলে না গেলে হয় না?
এমন প্রশ্নে নাহিদা মলিন মুখে তার দিকে তাকালো। এদিকে নাজিয়া হাসিমুখে বললো,
– সেটাও আপনার ইচ্ছে। তবে যে নীতি পালন করা হয় সে অনুসারে যেতে হয়।
– ওহ্।
মেহেদীর কল আসতেই সে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সব গোছগাছ করে তারা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তারা আজ নিজেদের গাড়িতে যাবে না। নাফিসারা যে গাড়ি রিজার্ভ করে এসেছে সে গাড়িতে যাবে। লাগেজ নিয়ে আগেই তুলে রাখা হয়েছে। মেহেদী রুমে এসেছিলো তার ফোনের চার্জার সাথে নিতে। নাহিদা জুতা চেঞ্জ করে নিলো। সেটা পড়ে হাটতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। দুজনেই একসাথে রুম থেকে বের হওয়ার সময় পেছন থেকে নাহিদা মেহেদীর ব্লেজার টেনে ধরলো। মেহেদী পেছনে ফিরে তাকাতেই নাহিদা ছলছল চোখে অসহায় ভঙ্গিতে বললো,
– দয়া করে আমার পরিবারের সাথে কোনো দুর্ব্যবহার করবেন না। আর ড্রিংকস যদি আপনার নিয়মিত অভ্যাস হয়ে থাকে তাহলে আজকের জন্য সেটা বাদ রাখুন প্লিজ।
মেহেদী কিছু বললো না তার প্রতুত্তরে। কথা শেষ হতেই সে নাহিদার হাতের দিকে তাকালো। তাই নাহিদা ব্লেজার ছেড়ে দিলো। মেহেদী তার আগেই বেরিয়ে গেলো। গতরাতের কথা সারাদিন মনে ছিলো না তার কিন্তু এখন খুব ভয় লাগছে! ওবাড়িতে গিয়েও যদি সে মদ্যপান করে! কেউ কিছু বললে যদি রেগে গিয়ে উল্টাপাল্টা বলে! তখন তো তার পিতামাতা অসম্মান বোধ করে কষ্ট পাবে! সেটা কিভাবে সহ্য করবে সে! এমন কিছু যেন না হয়, সেই প্রার্থনাই করে যাচ্ছে মনে মনে। মেহেদীর পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যায় তারা বেরিয়ে পড়লো। আসা-যাওয়ায় বেশি সময় লাগে না। মাত্র পনেরো-বিশ মিনিটের পথ।
বাসায় ফিরে রুমানা বেগম চিতুই ও পুলি পিঠা বানাতে লেগে গেছেন। এখন সময় কম হওয়ায় আপাতত এই দুটোই। কাল বানাবে অন্যান্য। কেননা মেহেদীর পরিবারের বাকি সদস্যরা আসবে কাল। নাফিসা দুই ভাইয়ার ই যত্ন নিচ্ছে। তবে নতুন জামাইয়ের তুলনায় আরাফের যত্নটা বেশি। কেননা মেহেদী নিজ থেকে তেমন অতিরিক্ত কথাবার্তা বলছে না। আরাফের সাথেই নাফিসা গল্পসল্প বেশি করছে। আর মেহেদীর বন্ধুরা একের পর এক কল করে তাকে বকাঝকা শুরু করেছে। কেননা সে তাদের বলেছিলো আজ রেডি হয়ে থাকতে। কিন্তু আজও যাওয়া হলো না। সে শ্বশুর বাড়ি পড়ে আছে। বন্ধুরা নিজ থেকে তার শ্বশুর বাড়ি আসার দাওয়াত নিতে চাইলো কেননা সে একা পিঠার স্বাদ নিচ্ছে। অথচ মেহেদী ডিরেক্টলি নিষেধ করে দিলো তাদের। পিঠা খেতে হলে যেন দোকান থেকে কিনে খায়! তা নিয়ে তার বন্ধুরাও কিপটে বলতে লাগলো। তাদের মতে মেহেদী শ্বশুর বাড়ির খরচ বাচাতে চাইছে।
আরাফ চলে যেতে চেয়েছিলো থাকার জায়গার স্বল্পতার কারনে। নাফিসা নিষেধ করলো। সে, শিথির কাছে চলে যাবে। নাফিসা, শিথি ও আরাফের সাথে টুকটাক গল্প করতে করতে মেহেদী শ্বশুর বাড়িতে পিঠার আমেজ উপভোগ করলো। নাজিয়া নাহিদা মায়ের সাথে কাজে ব্যস্ত। নিয়াজ উদ্দিনও দুই ছেলের সাথে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলেন। ঘুমানোর সময় নাফিসা শিথির সাথে চলে গেলো। আর তারা দুই বোন দুই রুম দখল।
মেহেদী পোশাক পাল্টে একটা টিশার্ট পড়ে নিলো। নাহিদা মশারি টানাতে টানাতে বললো,
– আপনার কিছু লাগবে? লাগলে বলুন।
– হ্যাঁ, লাগবে তো। আমার রুমটা লাগবে। আমার বেড টা লাগবে, কুশনটা লাগবে, আমার চাদরটা লাগবে।
– দুঃখিত। এসব কিছুই দিতে পারছি না আজকের জন্য। সামর্থ্যের ভেতরে থাকার মধ্যে কিছু প্রয়োজন হলে বলুন।
– সকাল সকাল মুক্তিটাই প্রয়োজন।
কথাটা বলেই মেহেদী কাথা টেনে শুয়ে পড়লো। নাহিদা আরও একটা কাথা নিয়ে লাইট অফ না করেই খাটের একপাশে শুয়ে পড়লো। মেহেদীর তো এখানকার কিছু চেনা নেই। যদি রাতে উঠতে প্রয়োজন হয় তাই লাইট জ্বালানোই রাখলো। তা দেখে মেহেদী বললো,
– এমনিতেই তো ঘুম হারাম করেছো। এখন কি ঘুমানোর চেষ্টাও করতে দিবে না!
– আমি আবার কি করলাম!
– লাইট অন থাকলে আমি ঘুমাতে পারি না।
– ওকে।
নাহিদা লাইট অফ করে দিয়ে শুয়ে পড়লো। দুদিন পর এখন তার দেহ ক্লান্তি শেষ করলো বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে। মেহেদীর আচরণ নিয়ে একটা ভয় ছিলো, সেটা থেকেও মুক্তি পেলো সে। নিজেকে চিন্তামুক্ত করে বিশ্রামে আনতে পেরে অনুভব করছে অপরিমেয় সুখ ও শান্তি। ক্লান্তি নাশে তাই চোখে ঘুম নামতেও বেশি সময় নেয় নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here