“তৃ-তনয়া” পর্ব- ২১

0
2753

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২১
(নূর নাফিসা)
.
.
সারাদিন পিঠা আমেজ চলেছে নাফিসাদের বাসায়। মেহেদীর বাড়ির লোকজন এসেছে। আরাফের বাড়ির সবাইকেও দাওয়াত করেছেন নিয়াজ উদ্দিন। সম্মান রক্ষার্থে শুধু আলফাজ সাহেব এসেছেন বিকেলে। তাদের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে আবার চলে গেছেন। সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর আচরণ মেহেদীর পরিবারের। যেন বহুদিনের পরিচয় একে অপরের সাথে। প্রাণান্তরের আত্মীয় তারা। শুধু মেহেদীটার মনেই ছটফট। খারাপ লাগছে না তাদের মেলবন্ধন দেখতে কিন্তু তাকে কেন আটকিয়ে রাখা হয়েছে! বন্ধুরা একের পর এক ধাওয়া দিয়ে যাচ্ছে তাকে! এই ট্রিপ টা নিয়ে অনেকদিন ঘোরাতে হয়েছে তাকে! এক একজন যা টাকাপয়সা জমিয়েছে, সব নিষ্পত্তি করতে বসেছে। পিঠার আমেজ উপভোগ করে সন্ধ্যার পরপরই তারা বেরিয়ে গেলো। নাহিদার মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেলো। কান্নাও করেছে আবার। একটুও ইচ্ছে করছিলো না সেখান থেকে চলে আসতে। কিন্তু কি আর করার! সমাজের নিয়মের বাইরে তো চলা যাবে না!
নাহিদা রুমে এসে দেখলো ফুলের ঝাড় এখনো ঝুলে আছে খাটের উপর। সে চেঞ্জ করে এসে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো মেহেদী ঢুকেছে রুমে। আজকেও ময়লা জুতা নিয়ে রুমে এসে পড়েছে! নাহিদা বললো,
– ঝাড়টা একটু ছুটিয়ে দিতে পারবেন?
– পারবো না আমি কিছু! সব কিছুতে একটা ভেজাল বাধিয়ে রাখো তুমি! ওফ্ফ শীট!
– আমি কি করলাম!
– কিছুই করোনি। তবে এখন করবে। যাও, তোমার শ্বশুরকে বলে আসো তুমি হানিমুনে যাবে না। আমি একা বেড়াতে যাবো, তুমি আমার সাথে যাবে না।
নাহিদার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বাইরে থেকে মেহেরুনের কণ্ঠে জবাব এলো,
– নাহিদা, তোর সাথেই যাবে। তা না হলে তোরও যাওয়া হবে না। আর যদি অমান্য করে বেড়াতে গিয়েছিস তাহলে আর বাড়িতে জায়গা হবে না।
– ধ্যাৎ!
মেহেদী জুতা ছাড়িয়ে একদিকে ঢিল মেরে ফেলে দিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। মেহেরুন নাহিদার কাছে এসে তাকেও বসালো নিজেও বসলো খাটে। অত:পর বললো,
– বড্ড বেশি অগোছালো আমার ছেলেটা। আগে এমন ছিলো না। কলেজ পর্যন্ত বাধ্য ছেলে ছিলো। ভার্সিটিতে উঠার পর শাসন মুক্ত হয়ে উশৃংখল হয়ে গেছে! মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে প্রায় এক বছরের বেশি। কবে থেকে বলছে তার বাবা অফিসে জয়েন করতে, ব্যবসা সামলে নিতে। কোনো কথা কানেই নিচ্ছে না। আমরা আজ আছি কাল নেই। এরপর কে তাকে আগলে রাখবে! কবে যে বুঝদার হবে আল্লাহ জানে। তাই বিয়ে করিয়ে বউ বানিয়ে নিয়ে এলাম তোকে। সেদিন ভিডিও কলে দেখেই খুব পছন্দ হয়েছে আমার। আমি তোর শ্বশুরকে দিনের পর দিন জ্বালাতন করেছি তোর খোঁজ নিয়ে ঘরে তোলার জন্য। অত:পর জানতে পারলাম তুই নিয়াজ উদ্দিন ভাইয়ের মেয়ে। তোর মাঝে সাহস, সততা, ন্যায়পরায়ণতা দেখেছি আমি। আমার বিশ্বাস তুই পারবি এই ছেলেটাকে একটু বুঝদার বানাতে। তোর বাবাকেও সবটা জানিয়েই সমন্ধ পাঠিয়েছিলাম। তোর স্বামীর দায়িত্ব এখন তোর। করবি না চেষ্টা?
– আমি চেষ্টা করবো মা। কিন্তু উনি এতো রাগী কেন?
– আদরে আদরে বাদড় বানিয়ে ফেলেছি! সবসময় আদরের পাশাপাশি শাসনেই রাখতাম কিন্তু কলেজ লাইফের পর তোর শ্বশুরের কথায় ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর কত বেধে রাখা যায় এতো বড় ছেলেকে! লাইফটা নিয়ে কখনো ভাবেই না। এখন অবস্থা খারাপ দেখে অপ্রয়োজনীয় টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তার বাবা। তোদের জন্য কক্সবাজারে তিনদিনের জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। অনেক দিন ধরে শুরু করেছে বেড়াতে যাবে। বিয়ের জন্য আটকে রেখেছে। এবার সুযোগ করে দিলো। বেড়ানো শেষ হলেই কাজের চাপ দিবে। সবকিছু গুছিয়ে রাখিস। সকালের ট্রেনে রওনা দিবি। সাবধানে যাবি, আর সবসময় ওর পাশাপাশি থাকবি। গিয়েছিস কখনো সেখানে?
– না।
– তাহলে তো আরও ভয়! মেহেদীর চেনা আছে পথ ঘাট। তার সাথে সাথেই থাকবি। আর যাই হোক, কারো দায়িত্ব ঘাড়ে পড়লে সেটা ঠিকভাবে পালন করতে জানে সে। খেয়াল রাখিস নিজের। যদি সেখান থেকে অন্যকোথাও যায় তাহলে তো সময় আরও বেশি কাটাতে হবে। ব্যবস্থা বাসা থেকে করেই যা।
– উনি একা যেতে চাইছেন। আমার না যাওয়াটাই উত্তম।
– ওর একটা কথা! যা তুই, ঘুরে এলে ভালো লাগবে। আমি নিজেই তো বছরে কমপক্ষে একটা ট্রিপে যাই তোর বাবার সাথে। ঘুরতে আমার খুব ভালো লাগে। নেক্সট টাইম না হয় আবার আমরা ফ্যামিলি ট্রিপে যাবো। ওকে?
– হুম।
– আচ্ছা, তুই কাপড়চোপড় গুছিয়ে নে। আমি খাবারগুলো নামিয়ে রাখি। তোর মা এতো কিছু দিয়ে দিয়েছে। কে খাবে এগুলো!
– আপু চলে গেছে?
– না, যেতে চেয়েছিলো। আমি নিষেধ করলাম। তোরা কাল চলে যাবি, তাই আরও দুদিন থাকতে বললাম।
মেহেরুন ইসলাম চলে গেলেন। নাহিদা ঝাড়ু খুজে এনে রুমটা আবার ঝাড়ু দিলো। মেহেদী জুতা পড়ে আসায় বালি দিয়ে ভরে গেছে! এদিকে মেহেদী বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে খাটে উঠে ফুলের ঝাড় টেনে ছিড়ে ফেললো। এবং রুমে থেকেই আয়াশকে ডাকলো। আয়াশ দোড়ে এসে ঝাড় টেনে নিয়ে গেলো। ঝাড়ু দেওয়া শেষ হতেই গুটি গুটি পায়ে হেটে আরিশা এলো। নাহিদা ময়লা একপাশে চাপিয়ে ঝাড়ু রেখে আরিশাকে কোলে নিয়ে রুমে এলো। মেহেদী আবার গোছগাছ করতে লেগেছে। বহুদিন পর সুযোগ এসেছে, হানিমুন বলুক আর যাই বলুক ট্রিপ মিস দিবে না সে! নাহিদা আরিশাকে কোলে নিয়ে তার সাথে দুষ্ট মিষ্টি কথা বলতে বলতে রুমের মধ্যেই পায়চারি করতে লাগলো। মেহেদী তাকে বললো,
– এই যাবে না তুমি? ব্যাগ গুছাও না কেন!
– আপনার কথাই তো রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম আমাকে যেতেই হবে। যতই হোক পিতামাতার আদেশ তো অমান্য করা যায় না!
– আসছে আমার পিতামাতার বান্দি! সব রেখে আমাকে জ্বালাতন!
মেহেদী বিড়বিড় করতে করতে লাগেজ বন্ধ করে দিলো। নাহিদা আরিশার হাতে খেলনা দিয়ে নামিয়ে দিলো। তারপর নিজের লাগেজ গুছাতে লাগলো। মেহেদী আরিশাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। পেটের উপর বসিয়ে আরিশার সাথে খেলতে লাগলো। মেহেদীর দুষ্টুমিতে আরিশা খিলখিল শব্দ করে হেসে উঠছে। দেখতে ভালোই লাগছে নাহিদার কাছে। একটু পর আয়াশও জামাকাপড় ছাড়িয়ে একটা শর্ট প্যান্ট পড়ে দৌড়ে এসে লাফিয়ে উঠে পড়লো খাটে। মামা ভাগিনাদের মধ্যে দুষ্টুমি আর হৈ-হুল্লোড় চললো কিছুক্ষণ। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে ফোনে কথপোকথন। এক পর্যায়ে নাহিদারও গুছানো শেষ হয়ে গেলো।
সকালে তারা রওনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। জহিরুল ইসলাম নাহিদার হাতে একটা নতুন ফোন তুলে দিলো। তা দেখে মেহেদী বললো,
– আব্বু, আমার ফোনটাও দেখো একটু পুরনো পুরনো লাগছে। এটা চেঞ্জ করতে হবে।
– চারমাস হয়নি এখনই তোমার চেঞ্জ করা প্রয়োজন! প্রায় দেড় লক্ষ দামের দুইটা সেট তোমার কাছে। আগামী পাচ বছরে নষ্ট হয়ে গেলেও কোনো ফোন পাবে না।
– আব্বু, তুমি যে দিন দিন কিপটে হয়ে যাচ্ছো সেটা কি তোমার জানা আছে! একবছর হলে মানা যায়। পাঁচ বছর কিভাবে চলে!
– আমার ফোনের চার বছর চলে। কিছুই হয়নি। তোমাকেও চালাতে হবে। হ্যাঁ আর আমি খুব ভালো করেই জানি আমি কিপটে হয়ে গেছি, তা না হলে উপায় ছিলো নাকি তোমার মতো ছেলে ঘরে থাকতে!
– বেড়াতে যাচ্ছি, এখনো বকাঝকা করছো! যাও, যাবোই না!
– না যাও। ট্রেন মিস হলে হাড়ে হাড়ে উশুল তুলবো আমার টাকার। কষ্টের টাকা।
– আমার কাছে ক্যাশ দাও।
– ত্রিশ হাজার দিয়েছি। তাছাড়া ট্রেনের কেবিন ও তিনদিনের জন্য রিসোর্টে রুম বুক করে দিয়েছি। নাহিদাকে নিয়ে সাবধানে যাও। ওর যত্নাদির যেন কমতি না পড়ে।
– এই টাকাতে তো আমারই চলবে না, আবার তার যত্নাদি!
– ফ্যামিলি ট্যুর হয়ে যাবে এটাতে৷ দুজনের খরচ তো এমনিতেই চলে যাবে। অর্থাৎ চালিয়ে নিবে। চতুর্থ দিনের মাথায় যেন বাড়িতে দেখি তোমাকে।
– যাবো তোমার ইচ্ছায়, আসবো আমার ইচ্ছায়। আল্লাহ হাফেজ।
মেহেদী তার লাগেজ টেনে আগেই পা চালালো। জহিরুল ইসলাম ডেকে আবার নাহিদার লাগেজ ধরিয়ে দিলো। নাহিদা শাড়ি পড়েছে আজ। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেহেদীর সাথে সি এন জি তে উঠলো। জহিরুল ইসলাম তাকে গাড়ি নিয়ে স্টেশন পর্যন্ত দিয়ে আসতে চাইছিলো কিন্তু মেহেদী বললো, এটুকু পথ শুধু শুধু গাড়ি নিয়ে যেতে হবে না। কিন্তু স্টেশনে আসার পর নাহিদা তার প্রকৃত কারণ দেখতে পেলো। মেহেদীর বন্ধুরাও উপস্থিত তাদের সাথে যাওয়ার জন্য। আর এজন্যই মেহেদী নিষেধ করেছিলো বাবাকে গাড়ি নিয়ে আসতে!
তারা আর আলাদা টিকেট বুক করেনি। মেহেদীর কথায় এক কেবিনেই সবাই আছে। মেহেদী, নাহিদা, আর তার তিনজন বন্ধু। নাহিদা জানালার পাশেই একটা সিট দখল করে নিয়েছে। মেহেদীও নাহিদার বিপরীতে জানালার পাশে সিট দখল করেছিলো। কিন্তু তার বন্ধুরা এখানে বসেনি। কাপলকে একপাশে রেখে তারা তাদের ডান পাশের জানালার পাশে ফাকা সিটগুলোতে বসেছে। এবার মেহেদীও এপাশ ছেড়ে বন্ধুদের পাশে চলে গেলো। বন্ধুরা তাকে নাহিদার কাছে বসার জন্য বললো, কিন্তু সে তাদের ঠাট্টা বিরক্তিকর ভাবে নাশ করে আড্ডায় জমে উঠলো। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। তারা কথাবার্তা, হাসিঠাট্টা করছে। আর এদিকে নাহিদা নাফিসার কাছে কল করে নাফিসা ও মায়ের সাথে কথা বললো কিছুক্ষণ। এতোক্ষণে ট্রেন ঢাকা ছেড়ে এসেছে। তীব্র গতিতে ট্রেন চলছে বিধায় প্রচন্ড বাতাস লাগছে। তবে খারাপ লাগছে না নাহিদার। হিজাব পড়নে থাকায় এতোক্ষণ গরম লাগছিলো, এখন ঠান্ডাটা বেশ ভালো লাগছে। একমনে তাকিয়ে উপভোগ করছে ছোট জানালা দিয়ে দৃশ্যমান বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশ। মনে হচ্ছে ট্রেন নয়, স্থীর প্রকৃতি আজ দৌড়ে চলেছে বিপরীত দিকে। বাতাসে গুনগুন হয়ে ভেসে আসছে প্রকৃতির সুর। তার সাথে তাল মিলিয়ে নৃত্য করছে পলক। পলকে পলকে দৃশ্যত হচ্ছে রংবেরঙের ভুবন, আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ও যানচলাচল রাস্তা। প্রকৃতির মাঝে নিজেকে উপস্থিত না করলে কখনো বুঝাই যায় না রংবেরঙের মানুষগুলোর প্রকৃত অবস্থা! সামান্য একটা পথ অতিক্রম করতেই দৃষ্টিতে আটকে যায় হাজারো জীবনের ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here