“তৃ-তনয়া” পর্ব- ২৩

0
2700

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২৩
(নূর নাফিসা)
.
.
তার কথা শুনে ওদিকে বড়বোন মেহতাজ অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে। আর মেহেরুন রেগে বললো,
– ফিরে আয় তুই বাড়িতে। তারপর আমি নিজে তোকে হসপিটালে ভর্তি করে আসবো।
মেহেদী রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
– আম্মু, তোমরা কেন বিশ্বাস করো না! এই যে দেখো, কত খাবার কিনে দিয়েছি। এগুলো কিনতে কি খরচ করিনি।
– কিনলেই কি, খায়নি তো কিছু। তাহলে কিনেছিস কেন!
– না খেলে আমার কি! খরচ করেছি টাকা দিবে। আমার পকেট থেকে টাকা গিয়েছে তো।
– টাকা তোর একার খরচের জন্য দেওয়া হয়নি। দুজনের জন্যই দেওয়া হয়েছে। আর সে তোর বউ। দায়িত্ব সম্পূর্ণ তোর উপর। অবহেলা করিস না বাবা। নিজের জীবনটা নিয়ে একটু ভাবতে বস। নাহিদাটাও অনেক ভালো। দুজন ঠিকঠাক মতো ঘুরে আয়। স্বেচ্ছায় সবকিছু গুছিয়ে নে, দেখবি সারাজীবন সুখে কাটবে তোর।
– আম্মু, কি শুরু করেছো! সারাদিন জার্নি করে আমার খুব ঘুম পেয়েছে। আমি ঘুমাবো। বাই…
মেহেদী কল কেটে দিয়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লো। নাহিদাকে রুমে দেখতে পেয়ে বিরক্তি নিয়ে বললো,
– মাথা ব্যথা, ঠ্যাং ব্যথা, বলতে পারলে না হসপিটালে যাবে! আমিও পারবো না ডাক্তারের কাছে নিতে। অর্ধেক পকেট খালি করে দিয়েছো আমার!
– লাগবে না তো আমার ডাক্তারের কাছে যাওয়া। একটু মাথা ব্যথা হলেই ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হয় না।
– তোমার জন্য যে আমি কত টাকা খরচ করলাম সেটা! হসপিটালে না ই বা যেতে, আমার খরচটা উশুল করলে কি হতো!
– এমন কেন আপনি! এতো অপচয় করেন কেন। সাশ্রয়ী হতে পারেন না। টাকা তো আপনারই থাকছে। বাবা মা তো আপনার খারাপ চাইছে না। তাহলে শুনছেন না কেন তাদের কথা! এভাবে আর ক’দিন চলবে।
– এই মেয়ে, চুপ থাকো! বয়সে, বুদ্ধিতে সবদিক থেকেই আমি তোমার চেয়ে বড়। বেশি পটু কথা বলতে এসো না! আমার বাপের টাকা আমি নেই, তাতে তোমার কি! তোমার বাবার টাকা খরচ করছি! যত্তসব ফাউল এসে আমার সামনে পড়ে!
মেহেদী চাদর টেনে শুয়ে পড়লো। এমনিতেই মাথাটা ব্যাথা করছে তার উপর এর খ্যাচখ্যাচ আরও বিরক্তিকর! একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটাই জানা নেই আবার আসছে বয়সে বুদ্ধিতে বড়গিরি দেখাতে! নাহিদাও খাটে উঠে বসলো শুয়ে পড়ার জন্য। কিন্তু সমস্যা এখানেই! বিয়ে হওয়ার গত দু’দিনই বাড়িতে দুজন আলাদা কাথা ব্যবহার করতো। এখানে দুইটা পাবে কোথায়! তাও আবার যেভাবে পেচিয়ে নিয়ে শুয়ে থাকে মেহেদী!
নাহিদা চাদর ছাড়াই এক কোনে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। গোসল করেছে বিধায় এমনিতেই শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। আবার আস্তে আস্তে আবহাওয়ায়ও ঠান্ডা নেমে আসছে! চাদর ছাড়া ঘুম হবে না। তাই নাহিদা এক কোনা টেনে কোনমতে শরীরে জড়িয়েছে। মেহেদী এতোক্ষণ সোজা হয়ে শুয়ে ছিলো। এখন আবার বিপরীত দিকে কাত হয়ে যাওয়ায় চাদরের কোনাও রইলো না নাহিদার দেহে! নাহিদা বিরক্তি নিয়ে এদিকে ঘুরে চাদরের কোনা টেনে বললো,
– এসব কি শুরু করেছেন! আমি ঘুমাবো না!
মেহেদী ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে বললো,
– ইচ্ছে হলে ঘুমাও, আর ইচ্ছে না হলে চলে যাও! আমার ঘুমে ডিস্টার্ব করছো কেন!
– আমি আপনার ঘুমে ডিস্টার্ব করছি নাকি আপনি আমার ঘুমে ডিস্টার্ব করছেন! চাদর নিজের দখলে রেখেছেন কেন! আমি কি নিব!
– সেটা আমি কি জানি! বাসা থেকে চাদর নিয়ে এলে না! এটা টানছো কেন!
– আপনি এটা টানছেন কেন! আপনি নিয়ে এলেন না!
– আমি কেন আনতে যাবো! আমি তো জানিই আমার জন্য একটা চাদর রাখাই আছে।
– ইশ! কি ভি আই পি লোক! ছাড়ুন, আমার মাথা ব্যথা করছে। আমি ঘুমাবো।
মেহেদী চাদর ছাড়তে ছাড়তে বললো,
– সেটা আমাকে শোনাও কেন!তোমার শ্বশুরকে গিয়ে শোনাও!
– কাউকে শুনতে হবে না। আপাতত আপনার মুখটা বন্ধ থাকলেই আমার ওষুধ কাজ করবে।
– আমার মুখের মালিক আমি। সুতরাং যা ইচ্ছে তা করবো, তাতে তোমার কি! প্রয়োজনে তোমার কান বন্ধ করে রেখো।
নাহিদা আর কোনো জবাব দিলো না মেহেদীর দিকে আরেকটু চেপে বিপরীত দিকে মুখ করে এক চাদরের নিচে শুয়ে রইলো দুজন। লোকটার আচরণে কখনো কখনো খুব রাগ হয় আবার কখনো খুব হাসি পায়। আর মাঝে মাঝে মনে হয় একটা পাগল জুটেছে তার নসিবে আর নয়তো সে নিজেই পাগল! নাহ! নাফিসার ধারণা মতে সে পাগলী।
ভাবতে ভাবতে নাহিদা ঘুমিয়ে পড়লো ওদিকে মেহেদীও শান্ত।
নাহিদার আগে মেহেদীরই ঘুম ভেঙে গেছে। রুম অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে নাহিদার দিকে তাকিয়ে দেখলো যেভাবে শুয়েছিলো সেভাবেই আছে, তবে একটু কুকড়ে গেছে! কারণ তার উপর চাদর নেই। ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করার কারণে সবটুকু মেহেদীর কাছেই চলে এসেছে। মেহেদী উঠে বসে পুরো চাদর নাহিদার উপর ছড়িয়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। মাগরিবের আযানের শব্দে নাহিদার ঘুম ভেঙেছে। সে উঠে মাথায় ওড়না দিলো এবং চাদর মুড়িয়েই খাটে হেলান দিয়ে বসে রইলো। এতোক্ষণে খেয়াল করলো সম্পূর্ণ চাদর তার কাছেই! সে কি ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করে মেহেদীর উপর থেকে চাদর নিয়ে নিয়েছে কি-না তা ভাবছে! মেহেদী হাতমুখ ধুয়ে এসে নাহিদাকে খাটে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে বললো,
– রাতে কি খাবে বলো? আর অযথা টাকা নষ্ট করবো না তোমার জন্য।
– কিছু খাবো না। ক্ষুধা লাগলে এসবই খেয়ে নিবো।
– বিস্কুট কেক খেয়ে রাত পাড় করবে!
– হুম।
– মাথা ব্যথা না কমলে স্পিডটা খেয়ে নাও। সেড়ে যাবে।
– আমি এসব খাই না।
মেহেদী আবারও সেই চেচানো কণ্ঠে বললো,
– তো সেটা আগে বলোনি কেন! চৌদ্দ ঘন্টা লাগে তোমার মুখ খুলতে! আগে বললে আমি কি এটাকে গরম হতে দিতাম!
চেচাতে শুনে নাহিদা আবারও বিরক্তিকর ভাবে তাকালো তার দিকে! মেহেদীর সেদিকে কোন লক্ষ্য নেই! সে স্পীডটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– দরজা লাগিয়ে বসে থাকো। আর আমি ডাকার সাথে সাথে খুলে দিবে। আর যদি কোথাও চলে যেতে চাও তাহলে আব্বু আম্মুকে বলে আমাকে জানিয়ে বিদায় হয়ে যেও।
মেহেদী বেরিয়ে গেলো আর নাহিদার হৃদ নামক পাতলা স্বচ্ছ কাচটা বারবার মজবুত হতে গিয়েও দুর্বল হয়ে পড়ে! সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকে মন, না জানি কখন এই কাচটা ভেঙেই যায়! সে তো চায় কাচটা খুব মজবুত হোক, কিন্তু এই মানুষটা এমন কেন! তার কাছে কি কখনো স্ত্রীর মর্যাদা পাবে না! সে কেমন ধাচের কথা বলে গেলো এটা! বিয়ে শব্দটা কি তার কাছে এতোটাই তুচ্ছ! কিভাবে তার বিয়ে করা বউকে বলে গেলো তাকে জানিয়ে যেন বিদায় হয়ে যায়! কোথায় যাবে! চলে যাওয়ার জন্য কি বউ হয়ে তার ঘরে এসেছে! সে এতোটা বেখেয়ালি আচরণ কেন করে সবার সাথে! নিজের পিতামাতার সাথেও তার আচরণ ভালো ঠেকে না! কি আছে মনে, কি তার চাওয়া পাওয়া কে জানে!
মেহেদী সারা সন্ধ্যা বাইরে কাটিয়ে রাতে নিজে খাওয়াদাওয়ার পর নাহিদার জন্য এক প্যাকেট মোরগ পোলাও নিয়ে এলো। খাওয়ার কোনো ইচ্ছে না থাকায় নাহিদা সেটা খায়নি। এমনকি মেহেদী আসার পর নিজ থেকে কোনো কথাও বলেনি। এক টুকরো কেক খেয়ে পানি পান করে ঘুমিয়ে পড়লো। রাতে যদি আবার নড়াচড়ার ফলে চাদর সড়ে যায় সেই ভেবে মেহেদী নিজে থেকেই এবার অল্প দূরত্ব বজায় রেখে নাহিদার দিকে একটু চেপে শুয়েছে।
সকালটা শুরু হলো মেহেদীর মুখ দেখে। বুকে ভর করে চিত হয়ে শুয়ে আছে। মাথার চুল এলোমেলো, অর্ধেক মুখ দৃশ্যমান। বাকিটা বালিশে লুকিয়ে আছে। দেখতে তো খুব ভালো, আচরণটা এমন কদাচার কেন!
বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো বাইরে ফুটে থাকা আলোতে দৃশ্যমান মেহেদীর ঘুমন্ত মুখে। অত:পর মেহেদীর নাড়াচাড়াতে তার ধ্যান ভাঙলো। এবং বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো মেহেদী এখনো ঘুমাচ্ছে। চোখ পড়লো মেহেদীর ফোনের দিকে স্ক্রিনে আলো জ্বলছে আবার নিভে যাচ্ছে। ফোন সাইলেন্ট করা। ধরবে ভেবেও ধরলো না। অত:পর নিজের ফোনটাই পার্স থেকে হাতে নিয়ে দেখলো গতকাল সন্ধ্যা হতে এ পর্যন্ত নাফিসা, মেহেরুন ও মেহতাজের ফোন থেকে মোট উনিশটা কল এসেছে। আরেকটা এলে তো মিল মতো বিশটা হয়ে যেতো! নাহিদা কল ব্যাক করে তার মা বাবা ও নাফিসার সাথে কথা বললো। অত:পর মেহতাজের সাথে কথা বলতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ কাটার পর হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ে ভেসে এলো, “ওই মেহেদী, রোমান্স শেষ হলে এবার ওঠ! আমরা বের হচ্ছি।”
নাহিদা বারান্দায় থেকেই মেহেদীর দিকে তাকিয়ে দেখলো চোখ খুলে তাকিয়েছে । এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি দিয়ে তারপর উঠে পড়লো। মেহেদী ফ্রেশ হতে হতে নাহিদা রাতে নিয়ে আসা খাবার ঝটপট খেয়ে নিলো। মেহেদী পড়নের টিশার্ট পাল্টে আরেকটা টিশার্ট পড়ে নিলো। নাহিদা জিজ্ঞেস করলো,
– কোথায় যাবেন?
– দু চোখ যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই।
– আমিও যাবো।
– তো যাও। না করেছে কে!
– আমি আপনার সাথে যাবো।
– আমার সাথে যেতে পারবে না! ছোট বাচ্চা না তুমি! যে আমি তোমাকে নিয়ে নিয়ে ঘুরাফেরা করবো। আমার পিছু ছেড়ে দাও।
– আমি আপনার সাথে এসেছি, আপনার সাথেই যাবো, ঘুরাফেরা করবো। শুধু রুমে বসে থাকার জন্য আসিনি এখানে।
– যা ইচ্ছে করো, আমার সাথে যাবে না! না! না! এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছি সেটাই অনেক!
– ওকে, আমি গেলাম। আপনি রুম লক করে আসুন।
নাহিদা মাথায় ওড়না দিয়ে তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহেদীকে রুমে রেখেই বেরিয়ে গেলো। মেহেদী তার কাজকর্ম সেড়ে রুম লক করে বেরিয়ে এলো। সিড়ি দিয়ে নেমে আসতেই দেখলো নাহিদা নিচে দাড়িয়ে আছে। সে কিছু না বলে পা চালাতে লাগলো। তার সাথে তাল মিলিয়ে নাহিদাও হাটতে লাগলো। মেহেদী থেমে গিয়ে বললো,
– আমার সাথে কি?
– আপনার সাথে কোথায়! আমি তো আপনার পেছনে!
– আমার পেছনেই বা কি!
– বা রে! আমি আপনার বউ না! বউ তো স্বামীর পিছু পিছুই থাকবে!
– হেই চুপ! কিসের বউ টউ! বউ হলে বউয়ের মতো ঘরে চুপটি মেরে বসে থাকো। বাইরে এসেছো কেন! যাও! আর ক্ষুধা লাগলে এই না, দুইশো দিলাম। খেয়ে নিও।
– আপনি কেমন হাসব্যান্ড! বউয়ের সাথে কেউ এমন আচরণ করে! কোথায় বলবেন “চলো একসাথে ব্রেকফাস্ট করে ঘুরাঘুরি করি!” আর তা না করে আমাকে উল্টো পথে রেখে চলে যাচ্ছেন!
– এই মেয়ে! এতো কথা বলো কেন! তোমার মনে রঙ লাগলেও আমার মনে লাগেনি! আমার সাথে আসবে না ব্যাস! আমি আগেই নিষেধ করেছিলাম আসতে! আমাকে জ্বালানোর জন্য যত্তসব ফাউল চিন্তাভাবনা তোমার! আমার পিছু পিছু আরেক পা এগিয়ে এলে তোমার পা ভেঙে দিবো।
এমনি হিমেল দূর থেকেই বললো,
– মেহেদী, জেনিফা ইজ কামিং!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here