“তৃ-তনয়া” পর্ব- ২৪

0
2631

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২৪
(নূর নাফিসা)
.
.
– মেহেদী, জেনিফা ইজ কামিং!
মেহেদী ও নাহিদা দুজনেই তাকালো তার দিকে। তারা তিনজন সহ একটা মেয়ে আসছে তাদের সাথে। পড়নে তার শর্ট কটি আর জিন্স। কালার করা চুল চোখের সানগ্লাস মাথায় রাখা, হাতে বাচ্চাদের মতো ছোট একটা পার্স! পায়ে পেন্সিল হিল।
মেহেদী মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– ওয়াও! হোয়াট এ সারপ্রাইজ!
জেনিফা মেহেদীর সাথে হাগ করে বললো,
– হেই জান। এতো ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে কেন তোমাকে! এই মাত্র ঘুম থেকে উঠেছো রাইট?
– ইয়েপ!
– শুনেছি বিয়ে করেছো। বউ নিয়ে মাস্তিতে আছো! আমাকে ইনভাইট পর্যন্ত করলে না!
– ধুর! কিসের বিয়ে! আমি নিজেই তো ইনভাইটেশন পেলাম না! পুতুলের মতো শুধু সেজে মঞ্চে উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছি!
– ওহ-হো!
জেনিফা হেসে উঠলো। মেয়েটার বেশ ও মেহেদীর সাথে ঘেঁষে দাড়ানো মোটেও পছন্দ হচ্ছে না নাহিদার কাছে। জেনিফা নাহিদাকে দেখিয়ে বললো,
– এটা কে?
– ওহ্ এর জন্যই পুতুল সাজতে হয়েছিলো। চলো পরিচয় করিয়ে দেই। হেই সি, সে হচ্ছে জেনিফা। আমার গার্লফ্রেন্ড। গার্লফ্রেন্ড তো বুঝো! এবার আমার পিছু ছেড়ে দাও। আমি আমার আশিকা কে পেয়ে গেছি, তুমি এবার তোমার আশিককে খুঁজে নাও। বাই বাই, চলো বেবি..!
জেনিফা মেহেদীর পেটে খোচা দিয়ে বললো,
– কতো দুষ্টু তুমি! চলো ব্রেকফাস্ট করবো।
মেহেদীসহ বাকিরা চলে গেলো। নাহিদার চোখ ছলছল করছে! এই বুঝি অশ্রু গড়িয়ে পড়বে! তার জীবনে এমন সব মুহূর্তগুলো এসে ধরা দিবে তা কখনো কল্পনাও করেনি! রায়ান এখানে দাড়িয়ে ছিলো। কিছু বলতে যাবে তারও সুযোগ হলো না! নাহিদা এক প্রকার দৌড়ে রিসোর্টে ঢুকে পড়লো। রায়ানের ডাক পড়তেই সে আবার তার বন্ধুদের কাছে চলে গেলো। নাহিদার খুব কান্না পাচ্ছে! সে দ্রুত পায়ে হেটে তাদের রুমের সামনে এসে পড়লো। কিন্তু রুম যে তালা লাগানো! সে দরজার সামনেই মেঝেতে বসে কান্না করতে লাগলো! তাদের উপর তলা থেকে লোকজন নামতে দেখে সে উঠে দাড়ালো এবং চোখ মুছতে মুছতে রিসিপশনের কাছে এসে তাদের রুমের এক্সট্রা চাবি নিয়ে গেলো। সে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে তারপর মনেপ্রাণে কাদতে লাগলো! যেন সমুদ্রে সৃষ্ট ঝড় শুধুমাত্র তাকেই ধ্বংস করে গেছে! এটা জানতো তার হাসব্যান্ড একটু বেখেয়ালি কিন্তু এটা তো জানতো না সে এতোটা নীচ! আজকালকার ছেলেমেয়েদের গার্লফ্রেন্ড থাকা স্বাভাবিক হতে পারে তাই বলে এমন অজ্ঞাত রিলেশনে কিভাবে থাকে! বউয়ের সামনে বউকে নিচু করে গার্লফ্রেন্ডকে পাহাড় সমান মর্যাদা দান করে! বউকে নাক ছিটকে সে এমন একটা পুচকে মেয়েকে নিয়ে ব্রেকফাস্টে চলে যায়! তাও সবটা আবার পরিবারের কাছে লুকিয়ে! এতোটাই যখন পছন্দ ছিলো তাহলে বিয়ে করে ঘরে তুললো না কেন! তার বাবা মা নিশ্চয়ই না করতো না! এখানে এতো সুন্দর সারপ্রাইজ তার জন্য অপেক্ষা করছে সেটা আগে জানা থাকলে কখনোই আসতো না এখানে!
দু’হাতে হাটু ঝাপটে ধরে মেঝেতে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে নাহিদা। চোখের জল গাল গড়িয়ে শুকিয়ে আছে। দৃষ্টি পলকহীন তাকিয়ে আছে মেঘে ঢাকা ধূসর আকাশ পানে! কানে ভেসে আসছে বাতাসের শো শো ধ্বনি আর সমুদ্রে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ! ঢেউ যেন সমুদ্রের নয়, এ যেন মনের ভেতরে সৃষ্ট উথাল-পাথাল ঢেউয়ের শব্দ!
সকাল পেরিয়ে দুপুর এসে হানা দিয়েছে। নাহিদা চোখ মুছে উঠে দাড়ালো। মেনে নিতে হবে ভাগ্যকে। সে ও তো দেখার অপেক্ষায় আছে, ভাগ্যের পরিহাস শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে!
লাগেজ থেকে জামাকাপড় নিতে গেলো গোসল করবে বলে। থ্রিপিস হাতে নিয়েও সেটা রেখে দিলো। শাড়ি পড়ে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে হাটবে সে। সে-ও তো ঘুরাঘুরির জন্যই এসেছে, তাহলে অন্যের অবহেলা সহ্য করে বসে থাকবে কেন!
গোসল করে শাড়ি পড়ে বেরিয়ে এসে দেখলো মেহেদী ভেজা কাপড়ে হাতে ফোন নিয়ে দাড়িয়ে আছে বারান্দায়। ওয়ালেটটা খাটে রাখা আছে। নাহিদা ভেজা কাপড় নিয়ে বারান্দায় যেতেই মেহেদী বললো,
– এতোক্ষণ লাগে বাথরুমে! সেই কখন থেকে দাড়িয়ে আছি ভেজা কাপড়ে!
নাহিদা তার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। নিজের কাজ করতে লাগলো। মেহেদী ফোন রেখে জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। নাহিদা দেয়ালে আটকানো আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে সজ্জিত করতে লাগলো। ঘন কালো লম্বা চুলগুলো আঁচড়ে বাকা সিতি করে খোলা রাখলো। কাজল নিয়ে চোখে চিকন রেখা টানলো। ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক ব্যবহার করলো। মেহেদী মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে তাকে সাজুগুজু করতে দেখে বললো,
– এতো সাজুগুজু করছো কার জন্য! আশিক খুজে পেয়ে গেছো নাকি! নিতে আসবে? রুম শিফট হবে?
নাহিদা তার দিকে ফিরে বললো,
– আপনাকে কোনো কিছু জানাতেই বাধ্য নই! তা জামাকাপড় রেখে আসছেন কার জন্য! নিজের কাজ নিজে করুন, জামাকাপড় বাথরুমে দেখলে জানালা দিয়ে সোজা নিচে চলে যাবে।
– হু! আমার খেয়ে, আমার পড়ে, আমার রুমে থেকে আমাকেই ধমকি দাও!
– আপনার রুম কিভাবে হলো! এটা রিসোর্টের মালিকের রুম!
– আমি ভাড়া করেছি তো এখন আমা..
– আপনি ভাড়া করেননি। আমার শ্বশুর মশাই ভাড়া করে আমাকে এখানে পাঠিয়েছে।
– বাহ! আমি বাপের দাপট দেখাতে পারবো না আর তুমি শ্বশুরের দাপটে আছো!
– লজ্জা করে না এতো বড় ছেলে হয়ে এখনো বাপের দাপটে চলেন! নিজের দাপট কবে সৃষ্টি করবেন!
– এই মেয়ে! তুমি কিন্তু লিমিট ক্রস করে যাচ্ছো!
– আমি তো লিমিট স্পর্শই করতে পারলাম না, ক্রস করলাম কখন!
– কথা কম বলো।
– আমি তো বলতেই চাই না কিছু! শুরুটা তো আপনিই করলেন!
– তুমি!
– আপনার মাথা!
নাহিদা জুতা পড়ে ফোনটা হাতে নিলো। দুশো টাকা খাটে রাখা মেহেদীর ফোনের উপর ঢিল মেরে ফেলে বললো,
– এই নিন আপনার দুশো টাকা। আপনারই কাজে লাগবে সেটা।
নাহিদা সাথে সাথেই তার পার্স হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো। এভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে মেহেদী বললো,
– এই, কোথায় যাচ্ছো তুমি!
– যেদিকে দু চোখ যায় সেদিকে যাচ্ছি!
নাহিদা আর এক সেকেন্ডও দাড়ালো না সেখানে। দরজাটা ঠাস করে চাপিয়ে বেরিয়ে এলো। প্রথমেই ঢুকেছে রিসোর্টের রেস্টুরেন্টে। এখানে লাঞ্চ সেড়ে নিবে। তার নিজেরও কিছু টাকা ছিলো আবার মেহেদীর অগোচরে জহিরুল ইসলাম এখানে আসার সময় তার হাতে পাচ হাজার টাকা দিয়েছিলো নিজ খরচের জন্য। আর মেহেদীকে জানাতেও নিষেধ করেছিলো কেননা সে জানলে তার জন্য নিজ পকেট থেকে এক টাকাও খরচ করবে না। নাহিদা এখন সেই টাকা নিজের জন্য কাজে লাগাচ্ছে। সে অল্প খাবার অর্ডার করলো যতটুকু এখন তার প্রয়োজন। রেস্টুরেন্টের প্রথম টেবিলেই সে বসেছে। খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে মেহেদীসহ তার বন্ধুরা রেস্টুরেন্টে এলো। নাহিদা একবার তাদের দিকে তাকিয়েও আবার নিজের খাওয়ার দিকে মনযোগ দিলো। হিমেল বললো,
– কিরে মেহেদী! তোকে ছাড়াই ভাবি রেস্টুরেন্টে! ভাবি, আপনি একা একাই খাচ্ছেন! আমাদের ডাকবেন তো একবার!
– কেন! আপনারা ঘুরাঘুরি করার সময় কি আমাকে ডেকে নেন! তাছাড়া আপনাদের জেনিফার লোপেজ চলে গেছে! তার কাছে যান।
– আর বলেন না, সকালে পকেট খালি করে ফেলেছে। শুধু খাওয়ার ধান্দা!
কথাটা বলে হিমেল এখানেই বসে পড়লো। চেয়ার গুলো খালি থাকায় মেহেদীও এখানেই বসে পড়লো। চারটি চেয়ার ছিলো, তাই রায়ান অন্য টেবিল থেকে একটা টেনে এখানেই বসিয়ে নিলো। মেহেদী ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার দিলো। নাহিদার সামনে রাখা জুসের গ্লাসটা ধরতে যাবে এমন সময় নাহিদা টেনে নিয়ে বললো,
– এটা আমার জুটা।
– গ্লাস তো ফুলফিলই দেখছি!
– তো কি হয়েছে! আমার তো!
– আরেকটা নিয়ে নিলেই হয়!
নাহিদা তার জবাব না দিয়ে একটু জুস খেয়ে আবার প্লেটের বাকি খাবার খেতে লাগলো। তার ভাব দেখে মেহেদী একটু বিরক্ত হলো আর বাকিরা অবাক! নাহিদা সেদিকে তোয়াক্কা না করে নিজের খাবার শেষ করে বিল দিয়ে তাদের সামনে থেকে উঠে চলে গেলো।
বাইরে এসে সমুদ্রের পথে যেতে লাগলো। এমন সময় তার সামনে একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে এসে দাড়ালো। মেয়েটার বয়স আট কিংবা নয় হবে আর ছেলেটা পাচ কিংবা ছয়। মেয়েটা নাহিদাকে বললো,
– মেডাম শামুক কিনবেন? সমুদ্রের সাদা চুনা শামুক।
নাহিদা মৃদু হেসে বললো,
– শামুক দিয়ে আমি কি কি করবো!
– কে, শামুক দিয়া তো কত কিছুই বানানো যায়। আপনেও বানাইবেন। নেন না। বিশ টাকার নেন। ভাইডার ক্ষিধা লাগছে। আমার তো টাকা নাই। আজকা এক টাকারও বেচতে পারি নাই।
– ও তোমার ভাই?
– হু।
– নাম কি তোমার?
– পরি। আর আমার ভাই পারভেজ।
– তোমার বাবা-মা কোথায়?
– মায়ের খবর জানি না তো! বাবা, সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়া হারায় গেছে।
মুহূর্তে নাহিদার মুখটা মলিন হয়ে গেছে! সে মলিন মুখে বললো,
– থাকো কোথায়?
– বাড়ি আছে তো আমাগো।
– ওহ, তুমি আর তোমার ভাইই থাকো বাড়িতে?
– হু।
– রান্না করে কে?
– একটা দাদি আছে, চাইল ডাইল নিয়া দিলে রান্না কইরা দেয়।
– তুমি খেয়েছো কিছু?
মেয়েটি মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে “না” জবাব দিলো। নাহিদা বললো,
– আচ্ছা, আমি পঞ্চাশ টাকার নিবো শামুক। এখন চলো আমার সাথে।
– কই যামু?
– আমি খাবার কিনে দেই।
– আপনে কি ছেলেধরা!
নাহিদা মুচকি হেসে বললো,
– উহুম, আমি ওই রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য বলছি। খাবার কিনে দিবো তোমাদের। তোমরা খেয়ে আবার চলে যেও। চলো।
নাহিদার সাথে বাচ্চা দুটি রেস্টুরেন্টে এলো। মেহেদী ও তার বন্ধুরা খাচ্ছে। তারা তাকে দেখে আবার সাথের জনদের দিকে তাকালো। নাহিদা তাদের দিকে না তাকিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে অন্য একটা টেবিলের দিকে গেলো। যেটাতে কোনো মানুষ নেই। বাচ্চাদের সেখানে বসতে বলে সে খাবার অর্ডার করলো। মেহেদী ও বাকিরা খেতে খেতে নাহিদার দিকেই দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করছে। খাবার অর্ডার করে নাহিদা তাদের কাছেই বসে রইলো। এমনি নাফিসার কল এলো। সে ফোনে কথা বলতে লাগলো। ওয়েটার খাবার এনে দিলে নাহিদা কথা বলতে বলতেই বাচ্চাদের দিকে প্লেট এগিয়ে দিয়ে খেতে বললো। বাচ্চারা খেতে লাগলো। মেহেদীর খাওয়া শেষ হলে উঠে এসে বললো,
– এতো টাকা পেলে কোথায়! নিজের খাওয়া আবার এদের এনে খাওয়াচ্ছো!
– আপনার কাছে আমি হিসাব চেয়েছি কিছুর! তাহলে আমার টাকার হিসেব নিয়ে আপনার এতো মাথাব্যথা কেন!
এমন পালটা জবাব শুনে মেহেদী ব্রু কুচকে তাকালো তার দিকে। নাহিদা বাচ্চাদের থেকে নেওয়া শামুক গুলো টেবিলে নেড়েচেড়ে খেলতে লাগলো। মেহেদীরা তাদের বিল পরিশোধ করে বেরিয়ে গেলো। বাচ্চাদের খাবার শেষ হতেই নাহিদা বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে। এমনি মেহেদী দৌড়ে এসে তার পেছনে এক হাত রেখে জড়িয়ে ধরে দাড়ালো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here