“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২৫
(নূর নাফিসা)
.
.
বাচ্চাদের খাবার শেষ হতেই নাহিদা বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে। এমনি মেহেদী দৌড়ে এসে তার পেছনে এক হাত রেখে জড়িয়ে ধরে দাড়ালো। নাহিদা প্রথমে একটু অবাকই হলো এবং একটু কেপেও উঠলো মেহেদীর স্পর্শে! অত:পর দেখলো মেহেদী ভিডিও কল রিসিভ করে বললো,
– আম্মু, এই যে দেখো। তোমরা তো আমার কথা বিশ্বাস করো না। দেখেছো?
– তুই তো বললি সে খাচ্ছে, আমি তো দেখছি সে বাইরে কোথাও দাড়িয়ে আছে!
– ওই যে, পেছনে রেস্টুরেন্ট দেখো না! এই মাত্র বের হয়ে এলাম! কি গো, বলো।
নাহিদা তার এতো বানোয়াট মিথ্যা ও অভিনয় দেখে তার মুখের দিকে তাকালো। মেহেরুন বললো,
– লাঞ্চ করেছিস নাহিদা?
– হ্যাঁ, মা।
– মেহেদী তোর খেয়াল রাখছে তো?
– হ্যাঁ, প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত রেখে যাচ্ছে। আমার সাথে আরও কারো এক্সট্রা খেয়াল রাখছে।
– কার কথা বলছিস?
– জিজ্ঞেস করুন উনাকে।
মেহেদী বুঝে গেছে নাহিদা জেনিফার কথা বলছে। তাই সে নাহিদাকে ছেড়ে দিয়ে হাটতে হাটতে বললো,
– আম্মু, হয়েছে এবার রাখো তো। এতোবার কল করে জাসুস করে আমাদের হানিমুনের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছো!
– নাহিদা কি বলছে!
– আরে, শামুক কিনে দেই নি তাই রাগ করেছে। রাখো রাখো, রাগ ভাঙাই!
মেহেদী কল কেটে নাহিদার কাছে এসে বললো,
– এই মেয়ে তোমার সমস্যা কি! আমি যার তার খেয়াল রাখবো তাতে তোমার কি!
– আমিও তো সেটাই বুঝতে পারছি না, আপনি এতো শত অভিনয় কেন করে যাচ্ছেন! ভয় পান, যদি জেনিফা লুপেজের কথা বাবা মা জেনে যায়!
– শাট আপ! এসব বিষয় নিয়ে আব্বু আম্মুকে কিছু জানাবে না। আমার বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি কম করো। টাকার প্রয়োজন হলে বলো।
– হুহ্! নিজেই টাকার জন্য শ্বাস গণে আমাকে আবার টাকার গরম দেখায়!
কথাটা বলে নাহিদা আগে পা চালালো। হাটতে হাটতে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে হাটতে লাগলো। ঢেউ এসে তার পা ও শাড়ি ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বাতাস চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে একদিকে। ঢেউ ও বাতাসের মিশ্রিত ধ্বনি শো শো শব্দে ভেসে আসছে কানে। খুব ভালো লাগছে পরিবেশটা। কেউ সমুদ্রে ঝাপঝাপি করছে, কেউ কেউ প্রিয় মানুষের হাত ধরে ধীর পায়ে হাটছে আবার কেউ বালিতে ফুটবল খেলছে। খেলোয়াড়দের মধ্যে মেহেদীরা উপস্থিত। রায়ান ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে নাহিদার দিকে। নাহিদা হাটছেই। রায়ান কল কেটে বললো,
– ভাবি এক মিনিট।
– জ্বি?
– জেনিফার কথা বলতে আসছিলাম।
– আমাকে কি একটু নিজের মতো চলতে দিবেন না! খুব মজা পান আপনারা অন্যকে কষ্ট দিয়ে! আপনার বন্ধু বউয়ের সামনে অন্য মেয়েকে নিয়ে চলে গেলো আর আপনি এসেছেন এখন তাদের গল্প শুনাতে। তারা কি করেছে না করেছে আমি এসব কিছু জানতে চাই না। দয়া করে মানুষের মনটাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। আপনাদের কষ্ট না হতে পারে তবে আমার মতো সাধারণ লোকজনের হয়।
– আপনি ভুল ভাবছেন, আমি সেসব বলতে আসিনি। জেনিফা মেহেদীর গার্লফ্রেন্ড না।
– সে নিজে বললো গার্লফ্রেন্ড আর আপনি উল্টো সুপারিশ!
– সুপারিশ না। একসাথে চলাফেরা জেনিফার সাথে। তবে সে নিজেকে মেহেদীর গার্লফ্রেন্ডই ভাবে। ভালো না মেয়েটা, বাজে প্রকৃতির। আমরা একটু এড়িয়েই চলি। কিন্তু ওইযে একসাথে চলাফেরা, সেই সূত্রেই মাঝেমধ্যে দেখা সাক্ষাৎ। আমি বুঝতে পেরেছি তখন আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু যা ভেবেছেন তা নয়। সে একটু লোভী প্রকৃতির মেয়েও বটে। দুর্ভাগ্যবশত সকালে দেখা হয়ে গেছে, আর আমাদের পকেট খালি করে ছেড়েছে। ভাগ্যিস এতো টাকা নিয়ে বের হইনি। সে বরাবরই এমন। আগে জানলে পালিয়ে থাকতাম! তবে এটা ঠিক, মেহেদী পরিবার থেকে সবসময় একটু দূরেই থাকতে চায়। ও স্বভাবতই একটু অন্যমনস্ক এবং আমাদের থেকে আলাদা। আমরা তো অভাবের টানে কোনো না কোনো কাজে নিযুক্ত কিন্তু তার তো কোনো অভাব নেই, তাই এমন। কাজকে সে বোরিং মনে করে এবং সর্বদা এড়িয়ে চলে। বলেছিলাম তাকে কিন্তু কাজ হয়নি। তবে বন্ধুরা মিলে মাঝেমধ্যে নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে একটু পার্টি করি। এছাড়া আর অন্যান্য খারাপ কাজে আমরা কেউই লিপ্ত না। আমি যতদূর জানি, মেহেদীর জন্য আপনার মনে কোনো ই জায়গা নেই। শুধু আপনি না, অন্য কেউ বউ হয়ে এলেও হয়তো একই অবস্থা থাকতো। ও রাতেও আমাদের রুমে থাকতে চেয়েছিলো। এক বিছানায় একসাথে ধাক্কাধাক্কি হবে, আঙ্কেলের টাকা উশুল হবে না এমন নানান কথা বলে তাকে পাঠিয়েছি আপনাদের রুমে। আংকেলের কাছ থেকেও আমাদের কাছে একটা বার্তা এসেছে যাতে তাকে নিজের বুঝটা বুঝতে বাধ্য করি। কিন্তু সে যদি না বুঝতে চায় তাকে জোর করে কি বুঝানো যায়! আই হোপ, আমরা যেহেতু ঠেলে রুম পর্যন্ত পৌছে দিতে পেরেছি সেহেতু আপনি ঠেলে ঠেলে একটু হলেও ঘরে থেকে বাকিটা করতে পারবেন। আই মিন, চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
হঠাৎ রায়ানের ফোন বেজে উঠলো। রায়ান কল রিসিভ করে নাহিদা থেকে দু তিন একদম পিছিয়ে বলতে লাগলো,
– আচ্ছা, তুমি বুঝতে পারছো না কেন! আমি তো অস্বীকার করছি না বেড়াতে এসেছি। মেহেদী হানিমুনে এসেছে আর হঠাৎই ডেকে নিয়ে এসেছে আমাদের। রাগ করে না, পাখি! আমাদের বিয়ের পর আমরা আবার হানিমুনে আসবো। ওকে? ধ্যাৎ!
কথা হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেছে তাই নাহিদা বুঝে নিলো ওপাশ থেকে হয়তো রাগ করে কেটে দিয়েছে। রায়ান ফোন পকেটে রাখতে রাখতে আবার নাহিদার কাছে আসতেই নাহিদা বললো,
– গার্লফ্রেন্ড?
রায়ান মুচকি হেসে বললো,
– গার্লফ্রেন্ড ছিলো এখন হবু বউ। হয়তো ক’দিন পর বউ হয়ে যাবে।
– ভালো। আপনার বন্ধুর মতো হয়ে আবার মেয়েটার কপাল পুড়েন না। মেয়েরা অনেক স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর ঘরে পদার্পণ করে, সেটা কিছু অবুঝ ছেলেরা না বুঝতে পেরে স্বপ্নগুলো গড়ার আগেই ভেঙে দেয়। যাকে বলা যায় গোড়ায় গলদ!
– হুম, যুক্তি আছে আপনার কথায়। স্বীকার করি সেটা তবে কিছু মেয়ে আছে যারা স্বপ্ন বুনতেই জানে না। যাইহোক, আপনি ওকে চিনবেন মনে হয়। আপনাদের আত্মীয়ই হয়।
বলতে বলতে রায়ান পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে একটা ছবি এনে নাহিদার সামনে ধরে বললো,
– চিনেন না?
– আয়াত!
– হুম।
– ও তো আমার আপুর ননদ।
– হ্যাঁ, আপনার বিয়ের দিন জানলাম আপনার আত্মীয়।
– আয়াত কি জানে, আপনি এসব পার্টি করেন আর ড্রিংকস করেন?
রায়ান মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে ফোন পকেটে রাখতে রাখতে দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে বললো,
– জেনেছিলো আর জানার পর থেকেই আমি ওসব থেকে দূরে। এখনো পার্টিতে জয়েন করি তবে নেশা জাতীয় কিছুতে হাত লাগাই না।
– আপনার বন্ধুরা গিলে আর আপনি বসে থাকেন!
রায়ান তাচ্ছিল্যের সাথে নিশব্দে হেসে বললো,
– নিজ মনের ইচ্ছাশক্তি হচ্ছে সবচেয়ে বড় শক্তি! আমি যদি স্বেচ্ছায় ওদিকে না যাই তাহলে অন্যদের দ্বারা আমাকে ওদিকে নেওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ২%। আমার মতে যেটা, সেটা বললাম আরকি! আমি ৯৮% এ টিকে আছি সেদিনের পর থেকে। কেননা আয়াতকে নিয়ে আমার খুব ভয়! অল্পতেই অনেক ভেঙে পড়ে এবং ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়ে ফেলে! তাই তার অপছন্দের দিকে যেতে আমাকে শতবার ভাবতে হয়!
– প্রকৃত প্রেমিক, তবে প্রেমটা বিয়ের পর হলেই ভালো হতো। যাইহোক, ড্রিংকসের কথা শুনে কি এমন ভয়ংকর পদক্ষেপ নিতে চেয়েছে সেটা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।
– তখন কিছু করেনি, শুধু আমাকে ওয়ার্নিংএ রেখেছে। তার মা বিয়ে ঠিক করাতে নাকি গলায় ফাস দিতে গিয়েছিলো! ভাবি মানে আপনার বোনই বাচিয়েছে। কাউকে কিছু জানায়ওনি, হুটহাট এমন সিদ্ধান্ত!
– হোয়াট! আপনি পূর্ব থেকে জানতেন না তেমন কিছু! এমনও তো হতে পারতো যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে! ডিরেক্টলি সুইসাইড!
– বিশ্বাস করবেন! তখন থেকে ফুললি মেড মনে হয়েছে তাকে! ভেবেছি শেষ পর্যন্ত একটা পাগলকে ভালোবেসেছি যে কিনা নিজের জীবনকে ভালোবাসতে জানে না! সে নিজেই এমন পদক্ষেপ নিয়েছে আবার নিজেই আমাকে ঠান্ডা মাথায় এই গল্প শুনিয়েছে! আমি তখন রাগান্বিত হবো নাকি হাসবো নিজেই বুঝতে পারছিলাম না! তবে এরপর থেকে মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে। এখন আমার কাছে আনতে পারলেই আমি টেনশন মুক্ত!
হঠাৎই মেহেদী দৌড়ে এসে বললো,
– ওই, তুই এখানে কি করছিস রে! এর সাথে কি! খেলবি না?
– না, তোরা খেল।
– শুনে যা একটু।
মেহেদী রায়ানের কাধে ধরে নাহিদা থেকে একটু দূরে গিয়ে ফোন ওয়ালেট দিয়ে বললো,
– এগুলো রাখ তোর কাছে। জেনিফা আবার আসছে! তুই এদিকেই থাক। ওদিকে যাওয়া তোর বারন।
কথা ফিসফিস করে বললেও নাহিদার কান পর্যন্ত এসেছে। মেহেদী আবার দৌড়ে চলে গেলো খেলায়। জেনিফাকে আসতে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র তীরে। রায়ান নাহিদার কাছে একটু সুপারিশ চাইলো। আয়াতকে ভিডিও কল করে নাহিদাকে দেখালো এবং বিশ্বাস করালো যে মেহেদী হানিমুনে এসেছে আর তার বন্ধুদের সাথে নিয়ে এসেছে। তবে মেহেদীর এখনকার আচরণে নাহিদার কাছে পরিষ্কার তার মনে জেনিফার জন্য কোনো ফিলিংস নেই, রায়ান যা বলেছে সব সত্য। রায়ান আর ওদিকে যায়নি, ফোনে কথা বলতে বলতে নাহিদার আশপাশেই হেটেছে। নাহিদাও নোনা জলে পা ভিজিয়ে একা একাই উপভোগ করেছে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। সূর্যাস্ত দেখে তারপর রিসোর্টে এসেছে সে। সন্ধ্যার ছায়া নেমে আসায় এবং মেহেদীর বেখেয়ালিপনা দেখে রায়ান স্বেচ্ছায় রিসোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছে নাহিদাকে৷ মেহেদীরা তখনও সমুদ্রের তীরেই ছিলো।
রাতে আর নাহিদা ভারি খাবার কিছুই খায়নি। খাওয়ার ইচ্ছেও নেই। সেদিনের কিনে দেওয়া ফাস্টফুড খাবারগুলোই এখনো আছে। নাহিদা সেখান থেকে চিপসের প্যাকেট নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে খেতে লাগলো। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে পেছনে ফিরে দেখলো মেহেদী দরজা খুলে রুমে এসেছে, হাতে তার একটা গ্লাস। গ্লাসটা মেহেদী বেডসাইড টেবিলে রেখে বাথরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। বেরিয়ে এসে দেখলো নাহিদা পানির মতো ঢকঢক করে গিলে ফেললো গ্লাসের সবটুকু! মেহেদী দেখে একদম হা হয়ে গেছে! নাহিদা গ্লাস টেবিলে রেখে মুখ মুছতে লাগলো। মেহেদী তেড়ে এসে বললো,
– এই মেয়ে পাগল হয়ে গেছো! তুমি এটা খেয়ে নিলে কেন! তুমি জানো এটা কি!
– কি আবার! পানি!
– তোমার মাথা! এটা ওয়াইন!