“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২৬
(নূর নাফিসা)
.
.
– এই মেয়ে পাগল হয়ে গেছো! তুমি এটা খেয়ে নিলে কেন! তুমি জানো এটা কি!
– কি আবার! পানি!
– তোমার মাথা! এটা ওয়াইন!
– ওয়াইন! ওয়াইন আবার কি!
– ড্রিংকস বুঝো!
– ধুর! পাগল হয়ে গেছেন আপনি! আমি বোতল থেকে ঢেলে পানি খেলাম আর আপনি বলছেন ড্রিংকস!
– এ! বোতল থেকে আবার ঢেলে নিয়েছো!
– কি আশ্চর্য! এই যে পানির বোতল!
– বোতল তো পানির। গ্লাসে যে কিছু ছিলো সেটা তোমার চোখে পড়েনি!
– হ্যাঁ, গ্লাসের অর্ধেক পানি রাখা ছিলো। আমি এক গ্লাস পানি পানের জন্য বোতল থেকে ঢেলে গ্লাস ভরে নিয়েছি।
– ওফ্ফ! শীট! আমি আমার জন্য এতো টাকা খরচ করে এটুকু নিয়ে এলাম, এদিকে এই মাথামোটা গিলে বসে আছে!
– কি খেয়ে এসেছেন আপনি বলুন তো! এমন আজেবাজে বকে যাচ্ছেন কেন আমাকে! আমি আপনার মতো না! আমার ঘুম পেয়েছে, ডন্ট ডিস্টার্ব মি!
কথাটা বলেই নাহিদা দাড়ালো এবং সাথে সাথেই ধপাস করে বসে পড়লো খাটে! ঘন ঘন পলক ফেলে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
– আপনি এভাবে ঘুরছেন কেন, বলুন তো! আমার সামনে থেকে যান! কাউকে ঘুরতে দেখলে আমার মাথা ঘুরে! যান বলছি!
নাহিদার কথায় মাতলামো নেমে এসেছে! মেহেদী বেশ বুঝতে পারছে একশন করে ফেলেছে তাকে! এখন নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে তার! এই মেয়ে না জেনে হঠাৎ গিলে ফেললো, এখন না জানি কি অবস্থা হয়! এর কি এসবের অভ্যাস আছে! তার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে নাহিদা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– এই! আপনি এভাবে ঘুরবেন না একদম! আমাকে ধরুন, আপনার ঘুরাঘুরি বন্ধ হয়ে যাবে। কি হলো ধরুন। আমি উঠতে পারছি না কেন! ওয়াশরুমে যাবো কিভাবে এখন!
মেহেদীর এখন কান্না করতে ইচ্ছে করছে! তবুও সে হাত বাড়িয়ে নাহিদাকে টেনে দাড় করালো। নাহিদা দাড়িয়েছে ঠিকই তবে মেহেদীর উপর হেলে পড়েছে। অত:পর দু’হাতে কলার মুঠোয় ধরতেই মেহেদী বললো,
– আরে কি করছো! সোজা হয়ে দাড়াও!
– হেই! চুপ! একটা কথাও না! এত্তো বদমাশ, বদমেজাজি কেন আপনি!
– হোয়াট!
– আবার বলে হোয়াট! একদম চুপ! আমি কথা বলছি না! আমার কথার মাঝে কোনো কথা না! আপনি আমাকে এতো ইগনোর করেন কেন! এতো বকাঝকা করেন কেন! একা একা ঘুরেন কেন! হানিমুনে কেউ বউ রেখে একা ঘুরে! ওই ওই কি যেনো, ধুর লুপেজ টুথপেজ কি যেন! ওই মেয়ের সাথে আপনার কিসের সম্পর্ক! ওর সাথে কিসের ঘুরাফেরা! আমি আছি না, আপনার বউ! হু?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ আছো। আমার কলার ছাড়ো। টিশার্ট ছিড়ে যাবে।
– চুপ! ছিড়ে যাক! ওয়ারড্রব ফুলফিল টিশার্টে! একটাই তো ছিড়বো, বউ না আমি!
– আরে কি শুরু করেছো! পাগল হয়ে গেছো! সোজা হও!
– চুউউপ! তুই পাগল, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠী পাগল!
– কিহ! আবার তুই তোকারি শুরু করেছো!
– ওহ্! না, সরি সরি, আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠী পাগল।
মুহুর্তেই গলার সুর আহ্লাদী হয়ে গেছে নাহিদার! সে আহ্লাদী কন্ঠে বলতে লাগলো,
– এমন কেন আপনি! বিয়ে হয়েছে আমাদের! আমি তো আপনার বউ! কিভাবে পারলেন আমার সামনে দিয়ে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে চলে যেতে। আমি খেয়েছি কিনা সেই খবর নেই, আপনি এমন বাজে একটা মেয়েকে নিয়ে যান ব্রেকফাস্ট করার জন্য! কিভাবে পারলেন আমাকে ধমকে একা ফেলে ঘুরতে যেতে! আমার তো খুব কষ্ট লেগেছে! খুব কষ্ট হয় আমার একা থাকতে! আপনি আমাকে একা রেখে বেড়াতে যান কেন! বাবা একসাথে পাঠিয়েছে না! তবুও আপনি বউ ছেড়ে অন্য মেয়েকে নিয়ে ঘুরেবেড়ান! ওই মেয়েটা কি ভালো! ও তো দেখতেই বাজে! কি ছোট একটা টপস্ পড়েছে! ছেলেদের মতো জিন্স পড়েছে! সে তো মেয়েদের কাতারেই পড়ে না! ছেলে না মেয়ে সেটা লোকেদের বুঝতে অসুবিধে হবে! তাহলে ও আপনার গার্লফ্রেন্ড হয় কিভাবে! আমি কি ভালো না! হ্যাঁ? আমি তো এমন বাজে পোশাক পড়ি না, ছেলেদের সাথে এভাবে মিশি না। তাহলে আমি কি ভালো মেয়ে না?
কথা বলতে বলতে নাহিদার গাল গড়িয়ে জলধারা বইছে! দৃষ্টি তাদের একে অপরের দিকে। নাহিদার উত্তরে মেহেদী তার হাত ছাড়াতে ছাড়াতে নরম গলায় বললো,
– হ্যাঁ, তুমি অনেক ভালো।
কথাটা বলার সাথে সাথেই নাহিদা মেহেদীর গলা ঝাপটে ধরলো। কাশতে লাগলো, যেন কাশতে পারছে না ঠিকমতো! এদিকে মেহেদী ছাড়াতে চেষ্টা করলো। কিন্তু নাহিদা তার টিশার্ট আঁকড়ে ধরে রাখলো!
– নাহিদা, ছাড়ো। সোজা হও।
– উহু, আপনি এমন কেন! আমি তো খারাপ না। আমি ভালো। তাহলে আমাকে সরিয়ে দিচ্ছেন কেন! ওই মেয়েটা আপনাকে এভাবে ধরলে আপনি সরিয়ে দিতেন?
– হ্যাঁ, দিতাম। ছাড়ো।
– কই দেননি তো! সকালে ধরেছে না আপনাকে! আমি আপনার বউ, আমাকে সরিয়ে দিচ্ছেন কেন!
– তুমি না ওয়াশরুমে যাবে। যাও। রাত হয়েছে ঘুমাবো তো!
কথা বলে সারতে পারেনি মেহেদী! নাহিদা তার উপর বমি করে দিয়েছে! নাহিদা এবার তাকে ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো বমি করতে করতে! মেহেদীর এখন চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে! এমন সময় তার টিশার্টের এ কি হাল করলো মেয়েটা!
– হোয়াট রাবিশ! এসব কি করেছো!
নাহিদা তার কথায় কোনো রেসপন্স করলো না! সে কোনোমতে উঠে বাথরুমে দৌড় দিলো! বমি করে মুখে পানি ছিটিয়ে হেলতে দুলতে বেরিয়ে এলো। মেহেদী না পারছে সইতে আর না পারছে এই মাতাল মেয়েকে কিছু বলতে! সে তার জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো গোসলের জন্য! এই রাতের বেলা তাকে আবার গোসল করতে হলো! বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখলো নাহিদা মেঝেতে হাটু ভেঙে বসে খাটের উপর মেহেদীর ফোন নিয়ে কিছু করছে! মেহেদী এসে ফোন নিয়ে নিলো হাত থেকে এবং দেখলো গেমস খেলছে সে! ফোন পকেটে নিয়ে সে দরজার দিকে যেতে লাগলো। নাহিদা দাঁড়িয়ে বললো,
– কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
– তোমার সাথে এখানে এই রুমে থাকবো আমি আরও!
কথাটা বলে মেহেদী দরজা খুলতে লাগলো কিন্তু দরজা লক করা! নাহিদা চাবি দেখিয়ে হেসে উঠলো। মেহেদী চাবি নিতে গেলে সে লাফিয়ে খাটে উঠে পড়লো এবং হাসতে লাগলো। মেহেদীও খাটে উঠে তার হাত থেকে চাবি নেওয়ার চেষ্টা করলে নাহিদা সুযোগ বুঝে তাকে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দিলো। এবং চাবি খাটের স্টেনের পেছনে ঢিল মেরে ফেলে দিয়ে মেহেদীর উপরে শুয়ে পড়লো। মেহেদী তাকে সরানোর জন্য চেষ্টা করতেই নাহিদা তার গলা ঝাপটে ধরে ঘাড়ে জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিলো!
“আহ!”
নাহিদা মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো। মেহেদী বিরক্তি নিয়ে বললো,
– এই মেয়ে! পাগল হয়ে গেছো! কামড়াচ্ছ কেন!
– আপনি এই রুম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কেন!
– তাই বলে এতো জোরে কামড় দিবে!
– হুহ্! চেচান কেন! আপনিও তো আমাকে কামড় দিয়েছেন! আমি চেচিয়েছিলাম!
– শাট আপ! মাতাল হলে সবাই সত্য বলে আর তুমি মিথ্যে বলছো কেন! আমি তোমাকে কখন কামড় দিলাম!
– দেননি! ভুলে গেছেন! বাসর রাতে আমার পেটে কামড় দেননি! এখনো তো ব্যাথা পাই আমি!
নাহিদা তাকে ছেড়ে দিয়ে বসে পেটের শাড়ি সরিয়ে বললো,
– এই যে! দাগ এখনো আছে।
মেহেদীও ওঠে বসে পড়লো এবং দেখলো সত্যিই দাগ আছে পেটে। কিন্তু সে এসব করেছে বিশ্বাস হচ্ছে না তার! সে কিছু না বলে নামতে যাবে, এমন সময় নাহিদা তার পায়ের উপর বসে পড়লো! মেহেদীকে ধাক্কা দিলো শুয়ে পড়ার জন্য কিন্তু মেহেদী দু’হাতে ভর দিয়ে হেলে পড়ে বসেই আছে। নাহিদা চাদরটা তাদের উপর টেনে নিয়ে মেহেদীর গলা ঝাপটে ধরে বললো,
– রুম থেকে চলে যাবেন কেন আপনি! আমি আপনার বউ না! বিয়ের পর তো বউয়ের সাথে থাকতে হয়। আপনি যাবেন না। আমি একা থাকতে ভয় পাবো তো! সত্যি বলছি, আর কামড় দিবো না৷ আপনি যাবেন না!
মেহেদী ব্যর্থ হয়ে হাতের ভর ছেড়ে দিয়ে ধপাস করে খাটে শুয়ে পড়লো। বালিশটা টেনে মাথার নিচে দিয়ে বললো,
– যাচ্ছি না আমি। তোমার বালিশে যাও।
– উহুম।
– উহুম মানে! যাবো না তো আমি, নিজের বালিশে যাও!
নাহিদা মেহেদীর সাথে মিশে তার টিশার্ট আঁকড়ে ধরে একটু আরাম করেই শুয়ে বললো,
– উহুম। এখানেই থাকতে ভালো লাগে। আমি ঘুমাবো আর ডিস্টার্ব করবেন না আমাকে। গুড নাইট।
মেহেদী এবার সত্যি করেই কপাল চাপড়ালো! একে তো তার ওয়াইন খেয়ে ফেলেছে! তারউপর এতো ঝড় প্রবাহিত করে এখন টিশার্ট যেভাবে মুঠোয় ধরেছে তাকে ছাড়ানোরও কায়দা নেই! উল্টো ছাড়াতে গেলে তার টিশার্টের বারোটা বাজবে! তবে পা দিয়ে ঠেলে তার উপর থেকে পা সরিয়ে দিতে পেরেছে সে।
সকালে ঘুম ভাঙলে চোখ খুলে নিজেকে মেহেদীর হাত পায়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকতে দেখলো নাহিদা। তার মাথাও বালিশে, চোখ বরাবর মেহেদীর ঠোঁট। নাকের গরম নিশ্বাস এসে পড়ছে নাহিদার কপালে। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো নিশ্বাসের জন্য এদিকসেদিক ছড়িয়ে যাচ্ছে। মেহেদীর হাত তার কোমড় জড়িয়ে রেখে পায়ের উপর এক পা তুলে রেখেছে। নড়াচড়ার কোনো সুযোগ নেই তার! সে মাথাটা হালকা উপরের দিকে তুলে দেখে নিলো মেহেদীর ঘুমন্ত মুখখানা! পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে সে! নাহিদার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো! তার হাত এখনো মেহেদীর গলা ঝাপটে আছে! বারান্দার দরজা সারারাত খোলাই ছিলো বিধায় বাতাসে রুম ঠান্ডা হয়ে আছে! আর মেহেদী চাদর মুড়িয়ে নাহিদার সাথে কোমল উষ্ণতার ছোয়ায় জড়িয়ে আছে।