“তৃ-তনয়া” পর্ব- ২৭

0
2784

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ২৭
(নূর নাফিসা)
.
.
নাহিদা আর শান্তির ঘুমটা নষ্ট করে তাকে ঠেলে উঠলো না। এতোটা সময় সে মেহেদীর ঘুমন্ত মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। মেহেদী আজ গড়াগড়ি দিয়ে চোখ খুলেনি। হয়তো নড়াচড়ায় বাধা পেয়েছে তাই খুব শান্তভাবে চোখের পাতা খুলে তাকিয়েছে। ব্রু কুচকে গেছে, কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়েছে। ঘুমঘুম চোখে মেহেদীকে তাকাতে দেখে নাহিদা লজ্জা পেলো। তাই দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো এবং মেহেদীর গলা থেকে আস্তে আস্তে হাত সরিয়ে নিলো। মেহেদী এতোক্ষণে খেয়াল করলো সে নাহিদাকে এভাবে জড়িয়ে রেখেছে! সেও হাত পা সরিয়ে নিলো। নাহিদা ছাড়া পেয়ে শাড়ি ঠিক করে সাথে সাথেই উঠে বসলো। আর মেহেদী অন্যদিকে ঘুরে বুকে ভর দিয়ে শুয়ে রইলো। নাহিদা ফ্রেশ হয়ে আসতেই মেহেদী বাথরুমে গেলো। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই নাহিদা বারান্দা থেকে রুমে এসে তার দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো,
– বাবা কথা বলবে।
– আব্বু?
নাহিদা দু’দিকে মাথা নাড়াতেই মেহেদী বুঝে গেলো নাহিদার বাবা। সে পানি পান করে গলা পরিষ্কার করে ফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। সালাম দিয়ে কথা বলতে লাগলো। নাহিদা এতোক্ষণে বিছানা গুছিয়ে নিলো। মেহেদী কথা শেষ করে কল কেটে ফোন বিছানায় রেখে দিতেই নাহিদা বললো,
– কাপড়চোপড় কার জন্য রেখে দিয়েছেন! আমার এতো ঠেকা পড়েনি আপনার কাপড়চোপড় ধুয়ে দেওয়ার। মর্যাদা দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি সেই মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য নন!
– হাসের মতো প্যাকপ্যাক কম করো! পড়ে থাকুক, তাতে তোমার কি! পারলে ধুয়ে দাও না হলে থাকুক পড়ে।
– পারবোনা সেটা তো আগেই বললাম।
– না পারলে নেই!
– পচে যাবে আপনার পোশাক।
– পচুক! আরও আছে।
– এমনিতেই দুটো জমা। একটু পর আবার গোসল করলে তো আবারও একটা শেষ! এমন করে কয়টা শেষ করবেন?
– হতে থাকুক যত গুলো শেষ হওয়ার। তাতে তোমার কি! আমার গুলো পচা ধরলে তোমার গুলো উধাও হয়ে যাবে।
– কিহ!
– জ্বি!
মেহেদী ফোন ওয়ালেট নিয়ে বেরিয়ে যেতে গেলে মনে হলো চাবি নাহিদা খাটের নিচে ফেলে দিয়েছে! সে ফোনের লাইট জ্বালিয়ে খাটের নিচ থেকে চাবি বের করে নিলো। অত:পর দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। নাহিদা বিড়বিড় করতে করতে বাথরুমে যেতে লাগলো,
– বিয়ে করেছে, বউ মানে না! আবার উনার কাজ ঠিকই করায়! যেন বউ না, উনার পার্সোনাল মেড আমি! রাবিশ একটা!
নাহিদা তার জামাকাপড় ধুয়ে বারান্দায় শুকাতে দিলো। পেটে ক্ষুধা হাক দিচ্ছে! তাই সে আর সময় নষ্ট না করে নিজের পার্স থেকে এক্সট্রা চাবি বের করে রুম লক করে নিচে নেমে এলো। রিসিপশনের এসে চাবি দিয়ে সে রেস্টুরেন্টে চলে গেলো। মেহেদীদের এতোক্ষণে অর্ধেক খাওয়া শেষ। নাহিদাকে দেখে রায়ান বললো,
– ভাবি, আপনার খাবার প্যাকেট করা হয়েছে রুমে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। আপনি তো এখানেই চলে এলেন। একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ুন।
– সরি এন্ড থ্যাংকস টু।
নাহিদা অন্য টেবিলে এসে বসে পড়লো এবং ওয়েটারকে ডাকলো। মেহেদী প্যাকেট করা খাবার নিয়ে উঠে এসে তার সামনে রেখে বললো,
– কি বললো তোমার কানে যায়নি! এগুলো খাবে কে?
– আমি কি জানি! আপনি কিনেছেন কেন! এবার আপনি খান বেশি করে। কারো খোটা শুনার জন্য আমি বসে নেই।
– সিনক্রিয়েট করছো এখানে! চুপচাপ এগুলো খাও! না হলে তোমার খবর আছে!
মেহেদী জেদ নিয়ে কথা বলে চলে গেলো তার সিটে। নাহিদা তার দিকে তাকিয়ে রইলো! তারও খুব রাগ হচ্ছে! নিজে একা একা এসে খেয়ে নিয়েছে, সেখানে কে বলেছে খাবার কিনে তার প্রতি এমন দরদ দেখাতে! ওয়েটার নাহিদাকে কি অর্ডার করবে জিজ্ঞেস করলে নাহিদা ওয়েটারকে বলে দিলো অর্ডার করবে না। খাবার নিয়ে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে মেহেদীর কাছে এসে তার সামনে টেবিলে রেখে দিলো প্যাকেটটা এবং হনহন করে বেরিয়ে গেলো রেস্টুরেন্ট থেকে! বারবার এমন ইগনোর করায় মেহেদীর প্রচুর রাগ হলো! নিজেকে কন্ট্রোল করে সে খাবার শেষ করে রায়ানের হাতে বিল ধরিয়ে দিয়ে খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে বেরিয়ে এলো। সে এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে প্রথমে রুমের সামনে এলো। এখানে দেখলো তালা দেওয়া, তাই সে ভেবে নিলো সমুদ্রের তীরে গেছে। সে সেখানেই গেলো। যা ভেবেছে তা-ই! নাহিদা সমুদ্রের তীর ঘেঁষে হাটছে। সে ঘন কদম ফেলে এখানে এসে তার বাহু চেপে ধরে বললো,
– এগুলো রেখে এলে কেন?
– আহ! হাত ছাড়ুন!
– আমি কি জিজ্ঞেস করেছি, সেটার উত্তর দাও।
– খাবো না তাই রেখে এসেছি।
ঢেউ নিকটে আসতেই মেহেদী ঢিল মেরে প্যাকেটটা ঢেউয়ের মধ্যে ফেলে দিয়ে বললো,
– এতো পাওয়ার কোথা থেকে পাও! খুব টাকা ওয়ালা হয়ে গেছো? দেখি কত টাকা আছে!
মেহেদী নাহিদার হাত থেকে পার্স নিয়ে নিলো। নাহিদা বললো,
– কি আশ্চর্য! আপনি এমন করছেন কেন!
– কেন করছি জানো না তুমি! আমার টাকা গুলো নষ্ট করালে কেন!
– আমি আপনার টাকা নষ্ট করিনি। আপনি স্বেচ্ছায় কিনেছেন। আমার পার্স দিন।
– পার্স আর পাবে না। স্বেচ্ছায় আর যেভাবেই হোক, কিনেছিলাম তো! তুমি খাওনি তাই নষ্ট হয়েছে। সুতরাং তুমিই টাকা নষ্ট করেছো। এবার দেখি খাবার কোথায় পাও। আমার টাকা ও পাবে না, তোমার টাকাও পাবে না। না খেয়ে মরো!
মেহেদী খুব রাগ নিয়ে কথাগুলো বলে পার্স নিয়ে চলে গেলো! নাহিদারও খুব রাগ হচ্ছে তার উপর কিন্তু কিছুই করতে পারলো না! কি করবে! এখানে পার্স নিয়ে টানাটানি করবে! সমুদ্র তীরে এটা কেমন দেখায়! আর টানাটানি করলেই কি! তার জোরের সাথে কি পারতো সে! নিয়ে যাক পার্স! কিছু বলবে না। খাবেও না!
নাহিদা ঢেউয়ের নাগালেই হাটতে লাগলো। কিছুটা পথ এগিয়ে আসতেই দেখতে পেল পরি আর পারভেজকে! দুই ভাইবোন ঢেউয়ের অপেক্ষা করছে। যখন দেখছে ঢেউ আসছে তখন লাফানো শুরু করেছে। আর ঢেউ চলে গেলে তারা দ্রুত চুনা শামুক ও ঝিনুক কুড়িয়ে আবার ঢেউয়ের অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে। নাহিদা মুচকি হেসে তাদের দিকে এগিয়ে গেলো।
– পরি, কি করছো তোমরা?
– শামুক, ঝিনুক নেই। আপনে আবার কিনবেন?
– এখন তো আমার কাছে টাকা নেই!
– ওহ্, আচ্ছা।
– তোমরা খেয়েছো কিছু?
– হু।
– এগুলো এভাবে না বিক্রি করে, মালা গেথে কিংবা ব্রেসলেট বানিয়েও তো বিক্রি করতে পারো। একটু কষ্ট করলে এতে আরও বেশি টাকা পাবে।
– পারি না তো!
– সুচ আর সুতা দিয়েই করা যায়।
– দেখায় দিবেন? দাদিও কইছিলো মালা বানাইতে। উনি তো চোখে কম দেখে হের লাই শিখাইতে পারে না।
– আমি এখন কিভাবে দেখাবো! সুচ সুতা তো নেই আমার কাছে! তোমার কাছে আছে?
– না। বাড়িতে আছে, খোজলে পাওয়া যাইবো।
– আচ্ছা, তাহলে নিয়ে এসো। আমি দেখিয়ে দিবো।
– আপনারে পামু কই!
– ওই রেস্টুরেন্টটা দেখেছিলে না আমি সেখানেই রুম ভাড়া নিয়েছি। কাল চলে যাবো। ইচ্ছে থাকলে আজকের মধ্যেই নিয়ে এসো। কেমন?
– আচ্ছা।
আবার ঢেউ আসতেই ভাইবোন লাফাতে শুরু করলো। ঢেউ তাদের কোমড় পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়ে গেলো। নাহিদা পিছিয়ে এসেছিলো বিধায় তার পায়ের গোড়ালির উপর পর্যন্ত ভিজেছে। ঢেউ চলে যাওয়ার সাথে সাথে সে শামুক, ঝিনুক কুড়িয়ে পরি ও পারভেজের কাছে দিলো। তাদের সাথে যুক্ত হয়ে ঢেউয়ের সাথে লুকোচুরি খেলা ও শামুক ও ঝিনুক কুড়াতে কুড়াতে নাহিদার মন ভালো হয়ে গেছে। সে ভুলেই গেছে মেহেদীর কথা! বেশ কিছুক্ষণ এখানে কাটানোর পর পরীরা চলে যাবে তাই নাহিদাও রিসোর্টে ফিরে এলো। কেননা সে কিছুটা ভিজে গেছে। সে চাবি নিয়ে রুমে এসে গোসল সেড়ে নিলো। কিছুক্ষণ, অযথা রুমে বসে রইলো। কিন্তু ভালো লাগছে না এখানে থাকতে। ফোনটাও নেই সাথে, যে সময় কাটাবে। পরক্ষণে মনে হলো মেহেদীর আরেকটা ফোন ব্যাগে রাখা আছে। গেমস খেলে সময় কাটানো যাবে। পরে আবার ভাবলো, না! তার ফোন সে ধরবে না। এমনিতেই কথায় কথায় যেই খোটা দেয়! তার খোটা শুনার জন্য সে বসে নেই। রুমের বারান্দায় কিছু সময় কাটিয়ে আবার রুম লক করে চাবি দিয়ে বেরিয়ে এলো রিসোর্ট থেকে। থ্রিপিচ পড়ায় এবার ওড়নাটা মাথায় হিজাব ন্যায় পেচিয়ে নিয়েছে। সে বালিতে হাটতে লাগলে সামনে পড়লো মেহেদীসহ তার বন্ধুরা। কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে মনে হচ্ছে নাকি খেলতে নামবে এই রোদের মাঝে! প্যান্ট ফোল্ড করে কোয়ার্টার বানিয়ে নিয়েছে সবাই। মেহেদী যেন তাকে পার্সটা দেখিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে। যাক না! সে চাইবে না তার কাছে! জিহাদ বললো,
– ভাবি, যাবেন নাকি? আমরা হাতিয়া ও মনপুরা দ্বিপে যাচ্ছি।
– নাহ। আপনারাই যান।
– স্পিডবোটে উঠতে ভয় পান?
– উঠিনি কখনো।
– তাহলে চলুন। মেহেদী, ভাবিকে নিয়ে নে সাথে।
– না ভাইয়া। আমি যাবো না।
নাহিদা উত্তর দিতে দিতে সেদিকে মেহেদীও বললো,
– না, যার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে ঘুরে বেড়াক! আমি কারো ভার বহন করবো না।
জিহাদ তার কাধ চাপড়ে বললো,
– ধ্যাৎ, ব্যাটা! তুই মানুষই না!
– সরতো!
মেহেদী আগে পা চালালো আর জিহাদ বলে গেলো নাহিদাকে সাবধানে থাকতে। তারা দুতিন ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসবে। তারা চলে গেলে নাহিদা আবার হাটতে লাগলো। বালির উষ্ণতা অনুভব করতে সে জুতা খুলে হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাটতে লাগলো। হঠাৎ দেখলো পিচ্চি দুইটা অন্যান্য পিচ্ছির সাথে দৌড়ে যাচ্ছে ভেজা কাপড়েই! হাত আছে শামুকের ব্যাগ আর ডাব! নাহিদা তাদের উদ্দেশ্যে বললো,
– এখনো বাসায় যাওনি! অসুস্থ হয়ে পড়বে তো, ভেজা কাপড়ে!
– ডাব পাইরা আনছি! এহন যামু। যাইবেন আমাগো বাড়িতে?
– না যাও।
– চলেন গেলে। দূরে না। কাছেই আমাগো বাড়ি। কাল তো ফিরাই যাইবেন। আরেকটু জায়গা ঘুইরা যান।
– আচ্ছা! তা কোথায় ঘুরাবে আমাকে?
– আমাগো বাড়ির পথঘাট।
ঠিকই তো! সে একা একা তো সারাক্ষণ এই বালির মাঠ আর সমুদ্রের তীরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর বাইরে কিছু দেখলে মন্দ কি! সাহেবও তো বউ রেখে একা একাই সব ঘুরাঘুরি করছে! তাহলে সে কেন বসে থাকবে! এই ভেবে নাহিদা পরীকে বললো,
– কতোক্ষন লাগে তোমাদের বাড়ি যেতে?
– আপনে যেইহানে থাকেন এর চেয়ে কতখানি পিছনেই। বেশি সময় লাগে না। যাইবেন?
– আচ্ছা, চলো। পথ কিন্তু আমার চেনা নয়। তুমি আবার দিয়ে যাবে আমাকে এখানে।
পরী খুশি হয়ে বললো,
– আচ্ছা।
নাহিদা তার সাথে চলতে লাগলো। মধ্যাহ্নের নিরিবিলি পথ, সারি সারি নারিকেল গাছে ভরে আছে রাস্তার দু ধার। অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে নাহিদার মনে। রিসোর্ট থেকে দশ-বারো মিনিটের পথ অতিক্রম করে এসেছে পরীদের বাড়িতে। ছোট ঘরখানায় অনাথ ভাই বোনের বসবাস। অন্যরকম একটা মায়া কাজ করে বাচ্চা দুটোর উপর। একদিনের পরিচয়েই মনে হচ্ছে যেন তারা বহু দিনের পূর্ব পরিচিত! নাহিদার অনেক ইচ্ছে করছে বাচ্চাদেরকে একটু সাহায্য করার কিন্তু কি দিবে! দেওয়ার মতো তো তার হাতে এখন কিছু নেই! শুধু গলায় একটা চেইন, আর হাতে এনগেজমেন্ট এর রিংটা আছে। গহনা তো শখ করে তাকে উপহার দিয়েছে তার শ্বাশুড়ি। সেটা কিভাবে দিবে! টাকা থাকলে না হয় দেওয়া যেতো। নিরুপায় হয়ে আপাতত শুধু একটু দোয়া করলো মনে মনে। পাশের ঘরের বুড়িটাকে তারা দাদি বলে ডাকে। নাহিদা বুড়ির সাথেও পরিচিত হলো। অত:পর সুচ সুতা দিয়ে দেখিয়ে দিলো কিভাবে মালা গাথতে হয়। শুধু মালা ই না, তার জানা ঝাড়, ফুলদানি সহ আরও জিনিসপত্র বানানোর প্রক্রিয়া দেখিয়ে দিলো তাদের। এসব দেখাতে দেখাতে তার প্রায় অনেকটা সময় কেটে গেলো এখানে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here