“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৩০

0
2779

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩০
(নূর নাফিসা)
.
.
মেহেদী বিষন্নতার সাথে বললো,
– আব্বু, এটা ঠিক না। এটা চিটিং! আমার ক্যাশ লাগবে।
– ক্যাশ তো আর বাতাসে উড়ে না! চাকরি করো, তবেই না ক্যাশ আসবে!
– লাগবে না আমার এই চাকরি।
– মানুষ জুতার তলা ক্ষয় করে ফেলে একটা চাকরির জন্য আর তুমি ফ্রী তে পেয়ে তার মূল্য দিচ্ছো না!
– ধ্যাৎ!
মেহেদী উঠে চলে গেলো। মেহেরুন ডেকে বললো,
– ভাত খাবি না!
– না!
জহিরুল ইসলাম বললো,
– ওকে খাবার না ই দেওয়ার প্রয়োজন। আল্লাহর কাজ করে না, আল্লাহর দান কেন গিলবে! নামাজ পড়ে সারাদিনে এক ওয়াক্ত!
মেহেদী রুমে এসে আবার বেরিয়ে টেবিলে চলে এলো। হাত ধুয়ে চুপচাপ খেতে লাগলো। কেউ কিছু বললো না। মেহেদীর সীমিত রাগ দেখে নাহিদার অপ্রকাশ্যে হাসি পেল! খাওয়াদাওয়া শেষে নাহিদা রুমে এসে দেখলো মেহেদী তার পার্স সামনে নিয়ে টাকা গুনছে! সে দরজা লাগিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
– এসব কি করছেন?
মেহেদী তার জবাব না দিয়ে টাকা গণনা শেষ করে বললো,
– মাত্র পাঁচ হাজার তিনশো ষাট! সমস্যা নেই, আমার হলেই হলো।
– আপনার হলেই হলো মানে!
– নাও, তিনশো ষাট টাকা রেখে দিলাম, আর পাঁঁচ হাজার আমার পাওনা।
– আপনার পাওনা মানে!
– ওই, এতো মানে মানে খুজছো কেন! জানো না তুমি মানে! এই সেই কিনে তো আমার পকেট খরচ করে দিয়েছো! তারউপর যাতায়াত ভাড়া, রুম ভাড়া, খাওয়াদাওয়া এসব কি তোমার নানার হোটেলে ছিলো! সেগুলো আমার পাওনা না?
নাহিদা পার্সটা হাতে নিয়ে রেখে দিতে দিতে বললো,
– ঠিক আছে। নিয়ে যান।
– হুম, নিবই তো!
নাহিদা তার কাছে এসে কাগজটা হাতে দিয়ে বললো,
– এবার তো আপনার উদ্দেশ্য হাসিল হলো। সুতরাং, কাল থেকে অফিস জয়েন করবেন। এবং এক ওয়াক্ত নামাজও যেন কাযা না হয়!
মেহেদী উঠে আলমারির কাছে যেতে যেতে বললো,
– তুমি রুলস করার কে!
– আপনার বউ।
– হুহ্! বউ বউয়ের জায়গায়ই থাকো, গার্লফ্রেন্ড হতে এসো না!
– আমি বউয়ের জায়গায়ই আছি। গার্লফ্রেন্ড হতে যাবো কোন দুঃখে! আমি তো শরীয়ত মোতাবেক লাইসেন্স প্রাপ্ত অসীম মর্যাদার সসীম অধিকারী!
– তোমার এই লাইসেন্স এর দাম দুই আনাও না আমার কাছে!
– উহুম, ষোলো আনাই আছে! সময় হলে বুঝতে পারবেন।
কথা বলতে বলতে নাহিদা বিছানা ঠিক করে শুয়েও পড়লো। ফোনে এলার্ম দিয়ে ফোন পাশেই রেখেছে।
ভোরে এলার্ম বাজতেই নাহিদা উঠে পড়লো। আর মেহেদীকে ডাকতে লাগলো। মেহেদী ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে বললো,
– হয়েছে টা কি তোমার!
– উঠুন, নামাজ পড়বেন।
– পড়বো না এখন।
নাহিদা কাথা টেনে সরিয়ে দিয়ে বললো,
– পড়তে হবে! উঠুন!
– যাবে এখান থেকে!
মেহেদী উপুড় হয়ে আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো! নাহিদা চুল খোপা করে নেম গেলো। ওদিক আজান পড়ছে। সে বাথরুমে এসে পানির মগ নিয়ে রুমে এলো। হাতে পানি নিয়ে মেহেদীর মুখে ছিটিয়ে দিলো। মেহেদী ব্রু কুচকে তাকালো তার দিকে! নাহিদা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– উঠে পড়ো সাহেব। না হলে বেগমের দ্বারা বিছানায় গোসল সাড়বে এখন!
মেহেদী কাথা এক টানে সরিয়ে নিয়ে উঠে পড়লো। বিছানা ছেড়ে দাড়িয়ে নাহিদার হাত থেকে পানির মগ নিয়ে মাথায় ঢেলে দিয়ে বললো,
– সকাল সকাল বেগমের এতো গোসলের তাড়া জেগেছে যখন, তাহলে সেড়ে নেক না গোসল!
মাথায় পানি ঢেলে মগ হাতে ধরিয়ে দিয়ে মেহেদী চলে গেলো বাথরুমে। নাহিদা প্রথমে স্তব্ধ হয়ে গেলেও এখন খুব হাসি পাচ্ছে! কেননা, সে এখন গোসল করেই নিতো! কিন্তু রুমে গোসল করিয়ে দিয়ে তো কাজটা বাড়িয়ে দিয়ে গেলো! ফ্লোর ভিজে গেছে! সে একটু ভয়ে ছিলো, না জানি মাইর দেওয়া শুরু করে! অন্যদিকে মেহেদীকে জানার সুত্রে এটাও বিশ্বাস ছিলো, সে তার গায়ে হাত তুলবে না। যদি গায়ে হাত তোলার অভ্যাস থাকতো তাহলে কক্সবাজারে অন্তত একটা লাগিয়ে দিতো সেদিন! ভাবতে ভাবতে নাহিদা ফ্লোর মুছে দিলো। এখন অপেক্ষা শুধু মেহেদী নামাজ পড়ে কি-না তা দেখার!
নাহিদা কাপড়চোপড় নিয়ে দাড়িয়ে আছে। মেহেদী ওযু করে এসে টুপিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নাহিদার খুব খুশি লাগছে! লোকটা তাহলে এতোটা বাকা না! তাকে পুরোপুরি সোজা করার চান্স আছে তাহলে! নাহিদা খুশিমনে বাথরুমে এসে যতদ্রুত সম্ভব গোসল সেড়ে নিলো। এবং নামাজ আদায় করে মেহেরুনের কাছে এসে কুরআন চাইলো। মেহেরুন জানালো মেহতাজের রুমে কুরআন শরীফ রাখা আছে। নাহিদা সেটা নিয়ে পড়তে লাগলো আর মেহেদী এতোক্ষণে মসজিদ থেকে ফিরে আবার ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত।
কুরআন পাঠ করে নাহিদা কিচেনে এলো। সে আসার পরপরই মেহেরুন এসেছে। দুজন কথাবার্তা বলতে বলতে রান্নার আয়োজন করে ফেললো। সকাল আটটা বাজলে জহিরুল ইসলাম মেহেদীকে ডাকলো। মেহেদী চোখ ডলতে ডলতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
– কি হয়েছে, আব্বু?
– একসাথে অফিস যাবো। রেডি হয়ে এসো।
– সরি, আজকের জন্য মাফ করো৷ কালকে থেকে ভেবে দেখবো।
– ভাববার কোনো প্রয়োজন নেই! বছর ফুরিয়ে যাবে কিন্তু তোমার ভাবনা ফুরাবে না। এখনই এসো।
মেহেদী এখনো একই কান্ড ঘটালো! কানে আঙুল দিয়ে চলে গেলো রুমে। নাহিদা টেবিলে খাবার রেখে রুমে এসে দেখলো মেহেদী হাতমুখ ধুয়ে নিচ্ছে। নাহিদা আস্তে আস্তে বাথরুমে এসে অতি দ্রুত ঝর্ণাটা ছেড়ে দিলো আর মেহেদী ভিজে চমকে উঠে একপাশে দাড়িয়ে গেলো! নাহিদা হাসতে হাসতে দ্রুত বেরিয়ে এসে বললো,
– সকাল সকাল তো বেগমের গোসল হয়েছে। এখন না হয় সাহেব গোসল সেড়ে নেক! অফিস যেতে হবে তো!
– তোমাকে তো এখন!
মেহেদী বের হতে গেলে নাহিদা এক প্রকার দৌড়ে রুমের বাইরে চলে এলো। মেহেদী ভেজা শরীরে নিশ্চয়ই বাইরে আসবে না! তবুও সে মেহতাজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। দুতিন মিনিট পার হতেই রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো বাথরুমের দরজা বন্ধ। তারমানে গোসল করছে! রুমটা আবার ওয়ারড্রব পর্যন্ত ভিজে গেছে মেহেদীর দেহের পানির ফোটা পড়ে। নাহিদা তা মুছে মেহেদীর একটা শার্ট আয়রন করে দিলো। মেহেদী বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলে নাহিদা শার্ট নিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
– টিশার্ট খুলো।
মেহেদী অবাক হয়ে বললো!
– হু!
– টিশার্ট খুলতে বলেছি।
– আপনি থেকে আবার তুমি!
– হুম।
– লজ্জা করে না, অন্যের বডি দেখতে!
– না, করে না! টিশার্ট খুলো নয়তো!
– নয়তো কি?
– বমি করে দিবো!
– ছি! পিশাচ মেয়ে!
– ভালো। এবার টিশার্ট খুলে ভদ্র স্বামীর ন্যায় শার্ট পড়ে অফিস যাও। নয়তো আমিও অভদ্র হয়ে যাবো!
– যাবো না অফিস!
– একশো বার যাবে, হাজার বার যাবে।
– তুমি বলার কে!
– বউ।
নাহিদা এবার নিজেই মেহেদীর টিশার্ট খোলার জন্য টানতে লাগলো যদিও তার দ্বারা সম্ভব না! কেননা মেহেদী তার থেকে অনেকটা লম্বা! তবুও সে টানাটানি করতে লাগলো। মেহেদী বিরক্তি নিয়ে টিশার্ট খুলে বললো,
– আহ! হচ্ছে কি এসব!
– বউয়ের দায়িত্ব পালন হচ্ছে।
নাহিদা শার্ট নিয়ে মেহেদীকে পড়িয়ে দিতে লাগলো। মেহেদী বারবার হাত সরিয়ে দিচ্ছে নাহিদা বারবারই চেষ্টা করছে। হাল ছাড়ছে না সে। অবশেষে মেহেদীই হাল ছেড়ে শার্ট নিয়ে পড়তে পড়তে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাড়ালো। অত:পর বডি স্প্রে করতে লাগলো। নাহিদা ফোন, ওয়ালেট এনে মেহেদীর সামনে রাখতেই মেহেদী নাহিদার মুখে স্প্রে করলো! নাহিদা দু তিন কদম পিছিয়ে এসে বললো,
– ওয়াক থু! এসব কি হচ্ছে!
– বউ বারাবাড়ি করায় শাস্তি দেওয়া হচ্ছে!
দুষ্টু হেসে কথাটা বলে ফোন ওয়ালেট নিয়ে মেহেদী বেরিয়ে গেলো রুম থেকে! নাহিদা বাথরুমে যেতে যেতে বললো,
– খাটাশ একটা! যেন উনার ক্ষতি করছি আমি!
জহিরুল ইসলামের খাওয়া শেষ। তিনি বসে আছেন মেহেদীকে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য। খাওয়াদাওয়া শেষ করে চুক্তি সম্পাদনাসহ তার পাওনাদির নানান কথা বলতে বলতে অবশেষে মেহেদী অফিস গেলো বাবার সাথে! তারা বেরিয়ে যাওয়ার পর মেহেরুন ও নাহিদা বড়সড় নিশ্বাস ছেড়ে একে অপরকে দেখে হেসে উঠলো! মেহেরুন বললো,
– নাহিদা, আমাদের সাথে তুইও তোর মতো করে আরেকটু টাইট দে। আমার বিশ্বাস এর মেরুদণ্ড সোজা হতে বেশি সময় লাগবে না! আপাতত অফিসে ঠিকমতো কাজকর্ম করলেই হয়।
– মা, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
– আচ্ছা, চল। খেয়ে নে এবার।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে নাহিদা লেগে পড়লো ঘরোয়া কাজে। আজ ওয়ারড্রব আলমারি সব গুছিয়ে ফেলেছে। দুপুরের শেষ দিকে নাফিসা এসেছে নাহিদার কাছে! কলিং বেল বাজায় মেহেরুন দরজা খুললো। নাফিসা সালাম দিলো।
– আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ।
– ভেতরে এসো। ইশ! চেহারাটা এমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন?
– ভার্সিটি থেকে এসেছি।
– খুব চাপ পড়াশোনার?
– এতোটা না। আংকেল বাসায় নেই?
– না। অফিসে গেছে।
– আপু কোথায়?
– রুমেই আছে। যাও।
নাফিসাকে রুমে ঢুকতে দেখে নাহিদা অবাক হলো! নাফিসা দাত চেপে হেসে নাহিদাকে জড়িয়ে ধরলো।
– নাফিসা! তুই আসবি, মা তো কিছু বললো না!
– মা জানলে তো বলবে! ভার্সিটি থেকে এসেছি আমি।
– তাহলে এতো লেট হলো কেন!
– একটা ট্রেইনিং করছি। ভার্সিটির ক্লাসের পর ট্রেইনিং ক্লাস করে তারপর এলাম।
– কিসের ট্রেইনিং?
– সেল্ফ-এমপ্লয়মেন্টের ফ্রী ট্রেনিং এসেছে ভার্সিটির অপজিটে সানফ্লাওয়ার সেন্টার আছে না, সেখানে।
– সেল্ফ এমপ্লয়মেন্ট! কি কোর্সে?
– কয়েকটা কোর্সই আছে। আমি পোল্ট্রি ফার্মেরটা করছি।
– পোল্ট্রি ফার্ম! এটা দিয়ে তুই কি করবি শুধু শুধু! অন্য কিছু নিতে পারতি।
– শুধু শুধু না, কাজে লাগাবো। দেখো তুমি।
– বাবা মা জানে?
– হুম। বাবা প্রথম দিতে চায়নি। আমার জোরাজুরিতে যখন দেখলো মাত্র বারো দিনের কোর্স তখন রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করেছে।
– কবে থেকে শুরু হলো?
– অলরেডি পাচ ক্লাস শেষ।
– তোর ফ্রেন্ডরাও করে?
– হুম। তারা সুয়িং এ গেছে। আমার তো ওটার প্রয়োজন নেই। ওটা আমার জানাই। তাই এটাতে গেলাম। ভাইয়া কোথায়?
– অফিসে গেছে।
– চন্দ্রনাথ পাহাড়ে তোমাদের কাপল পিক দেখলাম! অসম্ভব সুন্দর হয়েছে!
– তুই কোথায় দেখলি!
– তোমরা সীতাকুণ্ড থাকাকালীন ভাইয়ার সাথে কথা বলে পিক পাঠাতে বলেছিলাম। তারপর পাঠিয়ে দিয়েছে। আজ ভাবলাম দেখাও করে যাই, বাকি পিকও দেখে যাই! তোমার ফোন কোথায়?
– ছবি তুলিনি। দেখবি কিভাবে! যা দেখেছিস শুধু তা-ই তুলেছি।
– এটা কেমন কথা! এতো জায়গা ঘুরে এলে অথচ ছবি তোলো নি!
– কেমন কথা আবার! ছবি তুলতে গিয়েছি নাকি! উদ্দেশ্য ছিলো ঘুরবো তাই ঘুরে এসেছি।
– ধুর! নিরামিষ জার্নি!
মেহেরুন এসে বললো,
– তাহলে চলো এবার আমিষ দিয়ে ভাত খাই।
নাহিদা হেসে উঠলো। নাফিসা স্টুডেন্টদের কথা বলে চলে যাওয়ার তাড়া দিচ্ছিলো কিন্তু মেহেরুন খায়িয়ে তারপর ছাড়লেন। সাথে নাহিদা তার জন্য আনা শামুক ও ঝিনুকের গহনাদিও দিয়ে দিলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here