“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৩১

0
2925

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩১
(নূর নাফিসা)
.
.
বিকেলে জহিরুল ইসলাম বাড়ি ফিরেই বললো “মেহেদী আসেনি?”
মেহেরুন ইসলাম বললো,
– না, তো। তোমার সাথেই তো ফেরার কথা!
– আমার সাথে! আমি কি স্টেডিয়ামে বসে বসে খেলা দেখি!
– মানে!
– তোমার বজ্জাত ছেলের জন্য অফিস গেলাম আধঘন্টা লেট করে। প্রথম ঘন্টায় তাকে কাজ দেখিয়ে তার হাতে ফাইল ধরিয়ে দিয়েছি। দ্বিতীয় ঘন্টায় কোম্পানি জুড়ে তাকে আর পাওয়া যায়নি!ম্যানেজারের পকেটে একশো টাকা ও হাতে ফাইল দিয়ে সে উধাও! কল করে দেখি ফোন সুইচ অফ! তৃতীয় ঘন্টায় আমার ফোনে কল আসে, “আব্বু, আমি মিরপুর স্টেডিয়ামে আছি। দারুণ খেলা চলছে। দেখতে ইচ্ছে হলে চলে এসো!” শুনেছো তোমার বজ্জাত ছেলের কথা! কাজ ফেলে রেখে আমাকে দাওয়াত করে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যেতাম!
– ছেলে বজ্জাত হওয়ায় এখন আমার হয়ে গেছে, তাই না! আর ভালো হলে তোমার সুনাম! কাকে কি বলবো! পুরুষ লোকের স্বভাবই ভালো না! আমিও বলতে পারি, যেমন বাপ তেমন ছেলে!
– আরে আরে, রেগে যাচ্ছো কেন! আচ্ছা, যাও! আমার বজ্জাত ছেলে তোমার ভালো ছেলে। হয়েছে এবার?
– বজ্জাত আবার ভালো হলো কবে!
– না, মানে… হয়নি এখনো, হবে একদিন।
– বসে থাকো তুমি তোমার হবে নিয়ে! সব নষ্টের মূল তুমি! বাড়ি থেকে রেডি করে পাঠিয়ে দিলাম অফিসে ধরে রাখতে পারলে না! সেখানেও কি এখন আমাকে যেতে হবে!
– আরে, আমি দেখিনি তো কখন বেরিয়ে গেছে!
– সে কি পিপড়া সমান যে তোমার চোখে পড়েনি! নাকি তোমার চেয়ে গঠন লম্বা দেখে নাগাল পাওনি!
– হবে হয়তো!
মেহেরুন বাপ-বেটা দুজনকেই ফুসতে ফুসতে কিচেনে চলে গেলো। নাহিদা কিচেনে থেকেই তাদের কথপোকথন শুনে মিটিমিটি হাসছিলো। বজ্জাত ছেলে নিয়ে ছোটখাটো একটা মিষ্টি ঝগড়া হয়ে গেলো স্বামী-স্ত্রীর মাঝে! যা দেখলে ভয়ের পরিবর্তে হাসি পায়! বাবামায়ের মধ্যেও এমন মিষ্টি ঝগড়া গুলো দেখে খুব মজা পেতো! আর তারা বোনেরা এক একজন এক দুপক্ষের মজাদার সাপোর্টার হয়ে যেতো! খুব মিস করছে সেই মুহুর্তগুলো। দুই বোন শ্বশুর বাড়ি এসে আলাদা হয়ে গেছে, ওদিকে নাফিসাটাও একা হয়ে গেছে! আর জমে না, আড্ডা! আর না জমে মজার আসর! এখন শুধু তা টুকটাক ফোনালাপ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ!
সেই সকালে বেরিয়েছে আর এখন ইশার আযানের পর বাড়িতে ফিরলো মেহেদী। তার মা বকাঝকা করলো যা তার কান দিয়ে প্রবেশই করলো না! বাইরে থেকে ডিনার সেড়ে এসেছে তাই আর বাসায় খায়নি। ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। সকালে নাহিদা ধাক্কাসহিত ডেকে তুলে নামাজ পড়তে বাধ্য করলো। আজ আর ঘুমায়নি। কিছুটা সময় বাইরে কাটিয়ে এসেছে। নাহিদা রান্নাবান্না শেষ করে রুমে এসে দেখলো মেহেদী বাথরুমে গোসল করছে। নাহিদা গুনগুন করতে করতে রুম গুছিয়ে মেহেদীর শার্ট আয়রন করে দিলো। মেহেদী আজ টিশার্ট পড়েনি। খালি গায়েই বেরিয়েছে বাথরুম থেকে। মাথা মুছে তোয়াল রাখতেই নাহিদা শার্ট এনে তাকে পড়িয়ে দেওয়ার জন্য ধরলো। মেহেদী হাত থেকে নিতে নিলো কিন্তু সে দিলো না! মেহেদী কিছু না বলে তার হাতেই পড়ে নিলো। শার্টের বোতাম লাগাবে নাহিদা সেটাও করতে দিলো না। মেহেদীর হাত সরিয়ে দিয়ে গুনগুন করতে করতে নাহিদা শার্টের কলার ঠিক করে একে একে বোতাম লাগিয়ে দিতে লাগলে মেহেদী বললো,
– আমি কি ছোট বাচ্চা, যে আমি স্কুলে যাবো আর আমাকে এভাবে রেডি করে দিতে হবে!
– না গো! তুমি তো বড় বাচ্চা! এজন্য অফিস যাওয়ার জন্য রেডি করিয়ে দিতে হচ্ছে। স্কুলের জন্য না। গতকালের মতো ফাকি না দিয়ে ঠিকমতো কাজ করবে। এতে তোমার মঙ্গল হবে বুঝতে পেরেছো!
নাহিদার এমন দুষ্টু আচরণ ও বাচ্চাদের মতো পরামর্শ দিতে দেখে মেহেদীর মাথায়ও দুষ্টুমি চাপলো! সে নাহিদার পেছনে এক হাত রেখে এক টানে নিজের সাথে চেপে ধরলো! যা দেখে নাহিদার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো! এদিকে মেহেদীর চোখে মুখে ফুটে উঠেছে দুষ্টুমির হাসি! সে আরেক হাতে নাহিদার গাল স্পর্শ করে ছোট ছোট চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিতে দিতে বললো,
– আচ্ছা! আর কি কি করবো গো। বলো তো একটু শুনি?
নাহিদা তাকে ছাড়ানোর জন্য ঠেলতে ঠেলতে জোরপূর্বক হেসে বললো,
– আর! আর কিছু করতে হবে না তো!
মেহেদী কানের লতি থেকে হাত সরিয়ে সেই হাতও কামিজের ভেতর দিয়ে নাহিদার পেছনে নিয়ে গেলো! এবং বললো,
– আর কিছু না করলে সারাদিন কাটবে কিভাবে আমার! বলো না, আরও কি করতে হবে? বউ তো তুমি! বউয়ের দায়িত্বই তো প্রতিদিন স্বামীকে এভাবে রেডি করিয়ে দিবে, ভালো ভালো উপদেশ প্রদান করবে। বলো বলো?
নাহিদা খুব কঠিন ঢোক গিললো! মেহেদীর স্পর্শে সে শিউরে উঠছে কিন্তু চেষ্টা করেও তার কাছ থেকে ছাড়া পাচ্ছে না! মেহেদীর সাথে দুষ্টুমি করতে গিয়ে এ কোন বিপদে আটকে গেল সে! না পারছে ছাড়াতে আর না পারছে হজম করতে! বড্ড অসস্তি লাগছে তাঁর! সে আমতা আমতা করে বললো,
– অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে তো!
– বউকে আদর করার পরে না আসবে অফিস টাইম!
– এ!
– হ্যাঁ।
– আপনার শার্টের বোতাম লাগানো হয়নি তো!
– তুমি থেকে আবার আপনি হয়ে গেলাম কিভাবে!
– কি..কিভাবে আবার! এমনি! দেখি, ছাড়ুন! মা, টেবিলে খাবার দিতে বলেছিলো!
– মা তার আগে আমাকে রেডি করতে বলেছিলো!
– আপনি তো ছোট বাচ্চা না!
– আরে, আমি তো বড় বাচ্চা। অফিস যাবো। রেডি করবে না আমাকে!
নাহিদার অসস্তি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে যাচ্ছে! মেহেদী তাকে দু’হাতে একদম কাছে টেনে নিয়েছে! যতই সাহসী গিরি দেখাক না কেন, এখন যে ফাদে পা দিয়ে নাহিদার কান্না করতে ইচ্ছে করছে! সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
– রেডি তো হয়েছেনই! এবার আমাকে ছাড়ুন!
– কি যেন গুনগুন করছিলে, গানটা গেয়ে শুনাও তো?
– গান! গানতো আমি গাইতে পারি না!
– না পারলে গুনগুন আসলো কোথা থেকে!
– ওইযে পারি না তাই গুনগুন এসেছে! আমার না..
– কি?
– রান্না করতে করতে খুব ক্ষুধা লেগেছে। আমি যাই?
– কোথায় ক্ষুধা লেগেছে, দেখি?
মেহেদী তাকে পেছন দিক থেকে ছেড়ে পেটের দিকে এক হাত আনতেই সে তাকে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে এক দৌড় দিলো! মেহেদী বললো,
– আরে! আমার শার্টের বোতাম লাগানো হয়নি তো! বাকি আছে আরও!
– আপনি লাগিয়ে নিন!
নাহিদা ছুটে চলে গেলো আর মেহেদী তাকে বিব্রত করতে পেরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো!
খাওয়াদাওয়া শেষ করে মেহেদী আজ তার বাবার সাথে অফিসে গেলো। বিকেলে জহিরুল ইসলাম একা বাড়ি ফিরেছেন। তিনি জানিয়েছেন যা-ই মেহেদীকে চোখে চোখে রেখেছিলো কিছু সময়। জয়েনিংয়ের দুদিন না হতেই গিয়ে বলে “বেতন দাও!” জহিরুল ইসলাম বেতন না দেয়ায় লাঞ্চ টাইমেই সে ফুড়ুৎ!
মাগরিবের নামাজ পড়ে শুকনো কাপড়চোপড় ভাজ করে রেখছিলো নাহিদা। মেহেদী সিটি বাজাতে বাজাতে রুমে প্রবেশ করলো। নাহিদা তাকে দেখে বললো,
– এতোটা আশা নিয়ে আপনাকে অফিসে নিয়ে গেলো আর আপনি কাজে ফাকি দিলেন! এটা কি ঠিক হয়েছে?
– বাড়ির পাশাপাশি আবার অফিসেও চলে গেছো! সেখানেও তোমার রুলস মেনে চলতে হবে আমাকে!
– এতোটা অবুঝ সাজেন কেন! একটু বুঝদার হলে কি এমন ক্ষতি!
মেহেদী নাহিদার দিকে আসতে আসতে বললো,
– আচ্ছা! কেমন বুঝদার হতে হবে আমাকে, বলোতো?
সকালের ঘটনা মনে হতেই নাহিদা হাতের কাপড়চোপড় সব সামনে রেখে নিজেকে জড়িয়ে বললো,
– জানি না আমি!
– না, জানো তো। বলো?
– সত্যি, জানি না আমি!
তার ভয়ার্ত কান্ডে মেহেদী মৃদু হেসে ঘড়ি খুলতে খুলতে ড্রেসিং টেবিলের দিকে চলে গেলো। নাহিদা জামাকাপড় ভাজ করতে করতে মৃদু স্বরে বললো,
– নামাজ পড়েননি নিশ্চয়ই!
মেহেদী আয়নাতেই তার দিকে তাকালো। নাহিদা মলিনতার সাথে আবার বললো,
– নামাজ না পড়লে আর অফিসে ঠিকঠাক মতো কাজ না করলে আজ থেকে আপনার খাওয়াদাওয়া বন্ধ। বাবার আদেশ।
– ভালো।
– শুধু আপনার না, আমারও খাওয়াদাওয়া বন্ধ। স্বামী উপার্জন করলেই স্ত্রীর আহার জুটবে।
মেহেদী তার দিকে ফিরে বললো,
– আচ্ছা!
– হুম। দুপুরেও আমি খাইনি!
– তাই নাকি!
– হুম। খুব ক্ষুধা লেগেছে আমার। এখন আপনার তো উপার্জন নেই, আমি খাবো কিভাবে!
– আহারে! তাহলে এক কাজ করো।
– কি?
– না খেয়ে তো আর বাচা যাবে না, তাইনা?
– হুম।
– তাহলে তুমি তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও। সেখানে তোমাকে না খায়িয়ে রাখবে না! আমি না হয় অন্য কোনো ব্যবস্থা করে নেই।
– কিহ!
-জ্বি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here