“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৩৩

0
2555

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩৩
(নূর নাফিসা)
.
.
একটা পরটা খাওয়ার পর নাহিদা উঠে পড়লো। মেহেদী বললো,
– এগুলো তুলে রাখো। দুপুরে খাবে।
– দুপুরেও পরটা!
– হ্যাঁ। রাতের জন্য অন্যকিছু নিয়ে আসবো।
নাহিদা পরটা প্যাকেটে তুলে রেখে কিচেনে এলো। মেহেরুন বললো,
– রুমের সামনে গিয়ে দেখলাম পরটা খাচ্ছিস! এতো সকালে পরটা খাওয়ালো কেন!
– কি জানি, মা! ভাত খেতেও নিষেধ করে দিয়েছে আমাকে।
– কেন!
– জানি না তো! বুঝতে পারছি না কিছুই! শুধু বললো, আপনার কাজে হেল্প করতে কিন্তু কোনো খাবার খাওয়া যাবে না। দুটো পরটা আছে, দুপুরে যেন সেগুলো খেয়েই থাকি আর রাতের জন্য অন্যকিছু নিয়ে আসবে! তিনি উপার্জন করবেন তারপরই আমার খাওয়া হবে!
– বাব্বাহ! এতো কঠোর নীতিমালা!
– পাগলের নীতিমালা! কি রান্না করবো, রাতের খাবার দেখছি সবই আছে!
– থাকবে না! তোর বাবা অল্প খেয়েছে ছেলেটা তো না খেয়েই চলে গেলো। তুইও খাসনি, আমিও খাইনি!
– কেন!
– আত্মা টানে না! এগুলোই গরম করে দেই। তারা খেয়ে নিলে রান্না বসিয়ে দিবো।
নাহিদা খাবার গরম করে নিলে মেহেদীর ডাক পড়লো। সে রুমে এসে দেখলো মেহেদী গোসল করে বেরিয়েছে।
– কি হয়েছে?
– শার্ট আয়রন করো।
– ওয়ারড্রবে আয়রন করে রাখা আছে দুইটা। একটা পড়ে নিন।
– বের করো।
নাহিদা ওড়নায় হাত মুছে একটা শার্ট বের করে দিতেই মেহেদী ইশারা করলো পড়িয়ে দিতে! নাহিদার গতকালের ঘটনা মনে হতেই সে তার হাতে শার্ট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– আমি কিচেনে কাজ করছি, আপনি পড়ে নিন!
মেহেদী তার হাত ধরে বললো,
– আজ দায়িত্বের কথা মনে পড়ে না! আমাকে রেডি করে তারপর যাও কিচেনে।
শার্ট আবার তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে দাড়িয়ে রইলো। নাহিদা দ্রুত শার্টের বোতাম লাগাতে গিয়ে উল্টাপাল্টা লাগিয়ে ফেলেছে! তা দেখে মেহেদী বললো,
– কি করছো এসব?
– শার্টের বোতাম লাগাচ্ছি!
– আমার তো মনে হচ্ছে শার্টে গিট্টু লাগাচ্ছো! এক ঘর ছেড়েই বোতাম লাগায়! এটা আবার কোন স্টাইল!
নাহিদা আবার বোতাম খুলে ঠিক করে লাগিয়ে বললো,
– শেষ। এবার আমি যাই।
– ঘড়ি পড়াও।
নাহিদা ঘড়ি নিয়ে হাতে পড়িয়ে দিলো। মেহেদী আবার বললো, “জুতা বের করো”। জুতা বের করে দিলে বললো, “ব্লু ব্লেজারটা বের করো।” নাহিদা সেটাও বের করে পড়িয়ে দিলো এরপর দুজন একসাথে বের হলো রুম থেকে। তার মা বাবাকে শুনিয়ে মেহেদী নাহিদার উদ্দেশ্যে বললো, “আবারও বলছি, এক বেলাও কিছু খাবে না! মনে থাকে যেন!”
নাহিদা শুধু তাকিয়ে রইলো। মেহেদী বেরিয়ে গেলে জহিরুল ইসলাম মেহেরুনকে জিজ্ঞেস করলো কি ব্যাপার! তখন মেহেরুন ইসলাম জানিয়ে দিলো ব্যাপারস্যাপার!
.
নাফিসা ফোনে তার এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে বলতে ভার্সিটির গেইট দিয়ে প্রবেশ করছিলো। হঠাৎ করেই কারো সাথে ধাক্কা খেলো আর ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেলো! তাকিয়ে দেখলো আশিক ও সাথে আরেকটা ছেলে। ধাক্কা খেয়েছে সাথের ছেলেটার সাথে। ছেলেটা সরি বলে ফোনটা তুলে দিলো। নাফিসা ফোন হাতে নিয়ে রেগে বললো,
– এই মিয়া! চোখ কি মাথায় তুলে হাটেন!
– আপনি যদি মাথায় তুলে হাটতে পারেন তাহলে আমি কেন নয়!
– আমি মাথায় তুলে হাটতে যাবো কোন দুঃখে!
– তাহলে কোথায় থাকে আপনার চোখ?
– আমার চোখ মাথার পেছনে থাকে!
– অহ আচ্ছা! আমারটাও মনে হয় তাহলে পেছনেই থাকে।
– একে তো স্বেচ্ছায় ধাক্কা দিয়ে আমার ফোন ফেলে দিলেন তার উপর মজা নিচ্ছেন!
– সরি খেয়াল করিনি!
– কপালের নিচে চোখ থাকতেও অন্ধের মতো চলাফেরা করে!
– এক্সিউজমি, চোখ তো আপনারও ছিলো। আমার দোষ হলে তো আপনারও দোষ আছে! আপনি যেমন ফোনে কথা বলছিলেন আমিও তেমন ওর সাথে কথা বলতে বলতেই হাটছিলাম।তাহলে আপনিও আমার মতোই অন্ধ!
– আমার দোষ কিভাবে ছিলো! আমি গেইট দিয়ে আগে ঢুকছিলাম! সেটা দেখা সত্ত্বেও কেন আপনি এগিয়ে এলেন! আমি এলে আপনি যেতে পারতেন না!
– আচ্ছা! সরি।
ছেলেটি বলার সাথে সাথে আশিকও বললো,
– নাফিসা, সরি বলেছে তো।
নাফিসা তেজে আশিককে জবাব দিলো,
– রাখেন আপনার সরি! পেয়েছে এক সরি! বনবাদাড়ে যেমন কচু মিলে মুখে এখন সরি সরি! সরি বললেই কি সব মীমাংসা হয়ে গেলো! আমি আপনার পায়ে কুড়াল মেরে সরি বলে চলে যাই আপনি মানবেন!
– এখানে আবার কুড়াল টানছো কেন। এমন কিছু তো হয়নি!
– ফোন ফেলে দিয়েছে সেটা কি আপনার চোখে পড়েনি!
– এটা নিয়ে এখন কি কথা বাড়িয়েই যাবে!
– কোনো ইচ্ছে নেই আপনাদের সাথে কথা বাড়ানোর! আপনাদের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলতেও রুচিতে বাধে আমার।
নাফিসা হনহন করে চলে গেলো। আশিক কিছু বললো না কিন্তু সেই ছেলেটা অল্পতে এতো চাপা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো! আশিক বললো,
– চলো।
– বাব্বাহ! কি চাপারে!
– একটু চঞ্চল তবে যেমন দেখছো তেমন না।
– মানে!
– মানে আমি এখানে বলে এমন ভাবে বলে গেলো। অন্যথায় খুব ভালো।
– কানেকশন কি? হু?
– উল্টাপাল্টা যা ভাবছো তা মোটেও না। ঘৃণার পাত্র! শুধু আমিই না, আমার পরিবারই তার কাছে ঘৃণিত। তার কারণও আছে বটে!
– আশিক, একে না মনে হচ্ছে আমি দেখেছি কোথাও!
– আরাফ ভাইয়ার বিয়েতে দেখেছো হয়তো। ভাবির বোন।
– অহ!
.
মেহেরুন ভাত খাওয়ার পরও নাহিদা খেলো না। মেহেদীর কথা রাখতে পরটাই নিলো খাওয়ার জন্য। পরটা লাঞ্চ করে নাহিদা কল করলো নাজিয়ার কাছে।
– আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো আপু?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ। তুই কেমন আছিস?
– আলহামদুলিল্লাহ। কি করছিলে?
– তেমন কিছু না। খেয়ে রুমে এলাম এইমাত্র। খেয়েছিস?
– হুম। ভাইয়া স্কুলে?
– হ্যাঁ।
– আয়াতের নাকি বিয়ে ঠিক?
– হ্যাঁ। তুই জানলি কার কাছে? তোর ভাইয়া বলেছে?
– না, ভাইয়ার সাথে কথা হয়নি। যার সাথে বিয়ে ঠিক সে-ই বললো।
– তুর্যকে চিনিস তুই?
– তুর্য! তুর্য কে?
– তুর্যের সাথেই তো আয়াতের বিয়ে।
– কি বলো! ওর নাম তো রায়ান! মেহেদীর ফ্রেন্ড।
– আরে না। ভুল জেনেছিস হয়তো। তুর্যের সাথে আয়াতের বিয়ে।
– না, রায়ান নিজে আমাকে বলেছে আয়াতের কথা! তাছাড়া তাকে বিয়ের আগে থেকেই চিনি। আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে।
– আয়াত তো বললো তার নাম তুর্য! তাহলে একাধিক নাম হবে হয়তো।
– হতে পারে। তা জানা নেই! বিয়ের দিন কি পাকাপাকি হয়ে গেছে?
– না, শুক্রবার আসবে তারা। কথাবার্তা বলে তারপর ঠিক করবে।
– অহ!
– কেমন কাটছে তোর দিন? ভালো লাগে সেখানে থাকতে?
– দিন কাটছে ভালোই, কিন্তু মন টানে বাবার বাড়িতে!
– তা টানবেই। তবে সেখানেও টিকতে পারবি না। মন টানবে আবার সে বাড়িতে!
– হয়তোবা।
– ভালো আছে তো বাড়ির সবাই?
– আছে, আলহামদুলিল্লাহ।
– নাহিদা, বৃষ্টির ফোটা পড়ছে। পরে কথা বলি। কাপড়চোপড় বাইরে।
– ওকে, আল্লাহ হাফেজ।
বিকেলের শুরুতেই বৃষ্টি নামলো। নাজিয়া বাইরে থেকে কাপড়চোপড় এনে ভাজ করছে। আরাফ দৌড়ে ঘরে ঢুকলো!
– ধ্যাৎ! ভিজেই গেছি!
নাজিয়া আরাফের দিকে এগিয়ে এসে ফোন, ওয়ালেট নিতে নিতে বললো,
– ভিজে আসার কি প্রয়োজন ছিলো! কোথাও দাড়াতে পারতে!
– বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি তাই ভাবলাম দৌড়ে চলে যাই!
– এখন যে ভিজে গেলে!
আরাফ নাজিয়ার ওড়নার আঁচল টেনে মাথা মুছতে মুছতে বললো,
– তোমার আঁচল খানি আছে তো আমাকে শুকানোর জন্য।
নাজিয়া মুচকি হেসে আরাফের আধভেজা শার্ট খুলতে লাগলো। আরাফ মাথা মুছে নাজিয়ার পেছনে দুহাত রেখে দাড়িয়ে রইলো। শার্ট খোলা শেষ হতেই নাজিয়া বললো,
– শার্ট পড়বে নাকি টিশার্ট?
– টিশার্ট।
– দেখি ছাড়ো।
আরাফ তাকে ছেড়ে দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
– এইদিনে বৃষ্টি, দেখো শীত নামিয়ে ছাড়বে।
– তা তো নামবেই। ধরো।
আরাফ টিশার্ট পড়তে পড়তে বললো,
– বউ, বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি পাকানোর ব্যবস্থা আছে নাকি?
– বললে হয়ে যাবে।
– রান্না বসিয়েছো?
– না।
– কোথায় যাচ্ছো এখন?
– কিচেনে।
– এখনই রান্না বসাবে! বৃষ্টি কমলে পরে যাও।
– মুরগীর মাংস ভিজিয়ে রেখে আসি।
– পরে যাও। আয়াত বাসায় নেই?
– হ্যাঁ, আছে।
– তুর্জের বাসা থেকে লোকজন এসেছিলো?
– শুধু তুর্জের বাবা এসেছিলো। বাবা বললো, শুক্রবার নাকি আংটি পড়াতে ও বিয়ের দিন ঠিক করতে আসবে তারা।
– ওহ্। বাবা বাড়িতে আছে?
– না। বৃষ্টি নামার একটু আগে বেরিয়েছিলেন। টিফিনে খেয়েছো কিছু?
– হুম।
– তুমি বসো, আমি মুরগীর মাংস ভিজিয়ে রেখে মুড়ি মেখে নিয়ে আসি তোমার জন্য।
নাজিয়া আরাফের জন্য মুড়ি মেখে নিয়ে এসেছে। নিজ কক্ষে সুখী দম্পতি মুড়ি খাচ্ছে আর খুশগল্প করছে। বাইরে বাদল ধারা বইছে! ঘরের চালায় ঝুমঝুম শব্দে বৃষ্টির পানি পড়ছে। সারাদিন আবহাওয়া গুমোট থেকে দিনশেষে বৃষ্টি নেমে এলো ভুবনে। ঠান্ডা স্পর্শে শীতল করে দিলো পরিবেশ। সাথে নিয়ে এলো হিমেল হাওয়ার আগমনীবার্তা!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here