“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩৫
(নূর নাফিসা)
.
.
মেহেরুন বুঝতে পেরেছে লজ্জা নামক শব্দটা তার ছেলের গায়ে চামড়া পর্যন্ত স্পর্শ না করতে পারলেও নাহিদা লজ্জায় পড়ে গেছে। তাই তিনি হাসি পাওয়া সত্ত্বেও মেহেদীকে ধমকের সুরে বললো,
– আবার কথা বলছিস তুই! আমার ড্রয়ারে গিয়ে দেখ গ্যাস্ট্রিকের ক্যাপসুল আছে। নিয়ে আয়।
মেহেদী গ্যাস্ট্রিকের ক্যাপসুল এনে দিলে নাহিদা খেয়ে নিলো। মেহেরুন দু মুঠো পরিমাণে ভাত এনে নাহিদাকে খেতে দিলো। একটুও ইচ্ছে করছে না খেতে, তবুও জোরপূর্বক খেতে বললো মেহেরুন। অত:পর মেহেদীকে বললো,
– তুই কিছু খেয়েছিস?
– হুম। মোরগ পোলাও।
– যা তা খেয়েই থাক সারাদিন। কিছু বলবো না! অসুস্থ হলে আবার আম্মুকে ডাকবি! আম্মু এসে উঁকিও দিবো না! নাহিদা কাল থেকে, এক বেলাও খাবার মিস করবি না। তোর বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়ে আমি ঘরে তুলে এনেছি তোকে। সুতরাং আমি যা বলবো তা-ই! এই পাগলের কথায় কান দিয়ে মরিস না!
নাহিদা কিছু বললো না। চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে সে। মেহেদী বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। খাওয়া শেষ হতেই নাহিদা প্লেট হাতে নিয়ে বিছানা থেকে নামলে মেহেরুন তার হাত থেকে প্লেট নিয়ে চলে গেলো। আর নাহিদাকে বাথরুম থেকে হাত ধুয়ে ঘুমিয়ে থাকতে বললো। মেহেদী এসে শুয়ে পড়েছে। নাহিদা হাত ধুয়ে এসে শুয়ে পড়লে বিপরীত দিকে ফিরেই মেহেদী বললো,
– আজ ঘুমাও, কিছু বললাম না। কাল থেকে সব আসবাব নিয়ে রুম ছাড়বে। কাউকে আমার কথা শুনতেও হবে না, আমি কাউকে নিয়ে আসিনি, কারো ভারও বহন করতে পারবো না! সুতরাং কারো সাথে রুম শেয়ারও করতে পারবো না!
নাহিদা মনে মনে বললো, “হুহ্! উল্টাইছে ভার বহন করে! বউয়ের পার্স খালি করে ফুটান্টি করে সেই খেয়াল কি আছে! একদিন অফিসে গিয়েই যেন এভারেস্ট জয় করে ফেলছে! সারাদিন এটা নিয়েই গর্ব করে যাচ্ছে! আযব মানুষ!” মনে মনে তিরস্কার করে ভাবতে লাগলো রুম থেকে না যাওয়ার জন্য এবং তার বাকা ঘাড় সোজা করার জন্য কি করা যায়!
নাহিদা বালিশটা টেনে মেহেদীর বালিশের সাথে লাগিয়ে আরও চেপে গেলো। মেহেদী ফোন টিপছে আর নাহিদা তার পিঠের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বললো,
– এসেছি তো আপনার হাত ধরেই।
– এই! আমি তোমার হাত ধরলাম কখন!
– ওইযে, বিয়ে পড়ানোর পর বাবা কন্যা দান করলো! তখন!
– ওইতো, আম্মুর ইচ্ছাতেই হয়েছে! আমার কথা শুনবে না ব্যাস!
– যাইহোক, আপনি বিয়ে করেছেন বলেই তো আমি এসেছি। এমনিতে কি আসতাম নাকি! একটা প্ল্যান এসেছে আমার মাথায়।
– তোমার প্ল্যান তোমার কাছেই রাখো। ছাড়ো আমাকে!
নাহিদা তার টিশার্ট আঁকড়ে ধরে বললো,
– উহু, শুনতে হবে। প্ল্যান টা হলো এই,
– কিছু শুনবো না!
– আরে! শুনুন চুপ করে। আপনি এই টাকাতে কতদিন মোরগ পোলাও খাবেন! তারচেয়ে বলি কি, বাসায় হোটেল ন্যায় বাকিতে খাওয়া যাক। মাস শেষে বেতন পেয়ে বিল পরিশোধ করে দিবেন। এতে তো আপনার এই টাকাগুলো বেচে যাবে। এখন আর না খেয়ে থাকতে হবে না। কাউকে অসুস্থও হতে হবে না।
মেহেদী শুধু ঘাড়টা ঘুড়িয়ে নাহিদার দিকে তাকাতে চাইলো। তা দেখে নাহিদা উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– দারুন না, আইডিয়া টা?
সেকেন্ডের মধ্যে মেহেদী এপাশ ফিরে নাহিদার চুল ফাক করে, মাথা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো। নাহিদা বিরক্তি নিয়ে বললো,
– আরে! কি করছেন!
– দেখছি ছিদ্র কোন দিকে!
– মানে!
– মানে, তোমার মাথায় আইডিয়াটা কোন দিক দিয়ে প্রবেশ করলো সেটাই দেখতে চাইছি!
– কি আশ্চর্য ধরনের কথাবার্তা! আইডিয়া মাথা ছিদ্র হয়ে প্রবেশ করে নাকি মগজ থেকে উৎপত্তি হয়!
মেহেদী হেসে এক হাতে নাহিদার দুই গাল চেপে ধরে বললো,
– মাথা নারিকেলের খোল না তাহলে! ভেতরে পূর্ণতা আছে একটু!
মেহেদীর পাগলের আচরণ দেখে নাহিদার মুখ গোমড়া মুখু হয়ে রইলো। মেহেদী তার মুখ ছেড়ে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,
– রুম ত্যাগ না করার জন্য মগজ খেটেছে তাই না?
ধরা পড়ে নাহিদার মুখে চাপানো হাসির রেখা ফুটে উঠলো! হাসি চাপানো রেখেই দৃষ্টি সরিয়ে বললো,
– যাবো কেন আমি রুম থেকে! স্ত্রীর অধিকার নিয়ে পদার্পণ করেছি আমি এখানে।
– আচ্ছা! তাহলে তো তুমি আমার কোলবালিশ।
– মানে!
– ফেসবুক দুনিয়ায় অগণিত স্ট্যাটাস, বিয়ের পর স্ত্রী নাকি কোলবালিশ হয়ে যায়! তাহলে তুমি আমার কোলবালিশ!
নাহিদা বিস্মিত ও পুলকিত মেহেদীর কথনে! সে নিশ্চিত এটা কোনো পাগল! তা না হলে তখন বাবা-মায়ের সামনে এমন সময় বাবুর কথা কিভাবে বললো! আর এখনই বা স্ত্রীকে কোল বালিশ কি করে বলে! নাহিদা মনে মনে “ছি! ছি!” মনোভাব ও চক্ষু লজ্জা নিয়ে চুপচাপ বালিশ বিপরীত দিকে টেনে বিপরীত মুখী হয়ে গেলো! কিন্তু মেহেদী তা হতে দিলো না! নাহিদার বালিশ টেনে আবার তার বালিশের সাথে লাগিয়ে দিলো। নাহিদাকেও টেনে তার কাছাকাছি এনে হাত পা সব তুলে দিয়ে বললো,
– এতোক্ষণ না অধিকার নিয়ে বড় বড় কথা বলছিলে! এখন পালাচ্ছো কেন! আমার কোলবালিশ হওয়ার ভয়ে!
– আমি! কই, বড় কথা বলিনি তো! আমি ছোট মানুষ, ছোট ছোট কথা বলি।
– ও, তাই! তাহলে ছোট মানুষের মতো চুপটি করে শুয়ে থাকো! কোনো নড়াচড়া নেই! না, তোমার সাথে বিশ্বাস নেই! ওদিকে ঘুরো।
– কেন?
– ঘুরতে বলেছি, ঘুরো।
– পা সড়ান।
মেহেদী পা সড়িয়ে নিলে আবার নাহিদা বিপরীতে ফিরে গেলো। মেহেদী পেছন থেকেই কোলবালিশ ন্যায় জড়িয়ে ধরে মাথার সাথে মাথা লাগিয়ে রেখে বললো,
– এই তোমার মাথায় উকুন আছে?
তার কর্মে ও কথোপকথনে নাহিদার রাগও হচ্ছে আবার হাসিও পাচ্ছে! সে বললো,
– হ্যাঁ, ইয়া বড় বড় এক উকুন আছে আমার মাথায়।
– ফাজলামো না, সিরিয়াস বলো। আমি দেখলাম সেদিন আম্মু তোমার মাথায় বিলি কাটছে!
– মা, তেল লাগিয়েছে। উকুন নেই।
– যাক, না থাকলেই ভালো। বমি টমি করলে ওদিকেই করো ভাই, আমার দিকে ঘুরো না।
– কি? আমি আপনার কি হই?
– বউ।
– তাহলে ভাই বললেন কাকে!
– আরে মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। তাই একটা বললেই হলো।
নাহিদা নিচু শব্দে হিহি করে হেসে উঠলো! আর মেহেদী কম্বল টেনে দুজনেরই মাথাসহ ঢেকে দিলো৷ নাহিদা মাথা ঢেকে ঘুমাতে পারে না তাই তার দিকটা একটু খোলা রাখলো।
জহিরুল ইসলাম সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছেন। মেহেদী এলো হাতে একটা কাগজ নিয়ে। কাগজটা মেহেদী পত্রিকার উপর দিলো। জহিরুল ইসলাম পত্রিকা রেখে কাগজটা নিয়ে দেখলেন, পড়লেন গঅত:পর হাসলেন এবং মেহেরুনকে ডাকলেন। মেহেরুন এলে তিনি কাগজটা এগিয়ে দিলেন। মেহেরুন ইসলাম জানতে চাইলেন,
– এটা কি?
– পড়ে দেখো।
অত:পর তিনি দেখলেন আবেদন পত্র! মেহেদী পিতার কাছে আবেদন পত্র লিখেছে মাসব্যাপী সে ও তার বউ বাকিতে খাবে এবং মাস শেষে খাবার বাবদ পাচ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করবে৷ এতে কিন্তু এই প্রমাণ হয়না যে সে অন্যের উপর নির্ভরশীল। বরং এটা প্রমাণ হয় সে স্বনির্ভর!
মেহেদীর লেখা পত্র পড়ে মেহেরুনেরও হাসি পেল! তাদের হাসতে দেখে মেহেদী বিরক্তি নিয়ে বললো,
– এতে হাসার কি আছে! সুমর্জি হলে সিগনেচার করো আর না হলে রিটার্ন করো!
– আবেদন করে আবার থ্রেড!
– এতো কিছু জানিনা আমি! কাজে আসছি, না হলে অন্য ব্যবস্থা করবো। তুমি কি করবে করো।
– কলম এনেছো?
মেহেদী পকেট খুঁজে বললো,
– নিয়ে আসছি।
জহিরুল ইসলাম পকেট থেকে কলম বের করতে করতে বললো,
– থাক। তার আর প্রয়োজন নেই। তোমার পকেটে কলম থাকবে নাকি! থাকবে শুধু হাত টান! নাও।
জহিরুল ইসলাম সিগনেচার করে দিলে মেহেদী তা নিয়ে রুমে চলে গেলো। রুম থেকে জোর গলায় নাহিদাকে ডাকলো। নাহিদা রুমে এলে বললো খাবার রুমে নিয়ে আসতে। নাহিদা রান্না শেষ করে খাবার রুমে নিয়ে এলো। মেহেদী এতোক্ষণে গোসল সেড়ে নিয়েছে। অন্যদিন মেহেদীকে দেখলেও আজ কেন জানি তাকে খালি গায়ে দেখে খুব লজ্জা লাগছে নাহিদার! মেহেদীর দৃষ্টিতেও তার লজ্জাময়ী দৃষ্টি আটকে গেছে। কেননা নাহিদা রুমে প্রবেশ করার পরপরই একে অপরে চোখাচোখি হয়ে গেছে! আর তখন থেকেই নাহিদার ভেতরটা লজ্জায় কাপছে! কি এমন ছিলো চোখাচোখিতে তার অজানা! সে চুপচাপ খাবারের বাটিগুলো গুছিয়ে রেখে দ্রুত চলে গেলো। খাওয়া শেষে মেহেদী আবার ডাকলো। নাহিদা খাবারের বাটিপ্লেট নিয়ে গেলো। প্লেট নিয়ে যাওয়ার সময় মেহেদী বলে দিলো রুমে এসে যেন তার শার্ট বের করে দেয়। তাই নাহিদা শার্ট বের করে খাটে রাখতেই মেহেদী বললো,
– শার্ট কি খাট পড়বে?
– না, আপনি।
– প্রতিদিন বলে দিতে হবে, পড়িয়ে দাও!
– প্রতিদিনই পড়িয়ে দিতে হবে! দু-একদিন নিজে পড়লে কি হয়!
– আচ্ছা! প্রতিদিনই অফিস যেতে হবে! দুএকদিন না গেলে কি হয়! আজ যাবো না। ওকে?
– এই, না না! আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।
নাহিদা দ্রুত শার্ট নিয়ে মেহেদীর কাছে এলো। মেহেদী তার হাতে শার্ট পড়তে পড়তে বললো,
– এই বয়সেই নানা হয়ে গেলাম! আমার চুল কি পেকে গেছে নাকি!
নাহিদার হাসি পাচ্ছে খুব কিন্তু এতোটা হাসছে না। মৃদু হেসেই বললো,
– জানি না আমি!
এতোটুকু সময়ে নাহিদা একবারও তাকায়নি মেহেদীর দিকে! শার্টের বোতাম লাগানো শেষ হতেই আলমারির দিকে যেতে যেতে বললো,
– ঠান্ডা লাগছে না? ব্লেজার দিবো?
মেহেদী অভিনয় ভঙ্গিতে বললো,
– হু হু হু! শীতে কাপাকাপি শুরু করেছি দেখো না তুমি!
নাহিদা ব্লেজার বের করে এনে তাকে পড়িয়ে দিলো। মেহেদী বাদ্য পিচ্চির ন্যায় এক জায়গায়ই দাড়িয়ে আছে! যেন তার এদিক সেদিক নড়াচড়া মানা! তাকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নাহিদা বেশ বুঝতে পারছে তাকে দিয়ে সব করিয়ে নেওয়ার জন্য এভাবে আছে সে। সে একে একে ফোন ওয়ালেট ঘড়ি এনে তার হাতে দিতে লাগলো। খারাপ লাগছে না তার কাজ করতে কিন্তু মেহেদীর দিকে তাকাতে পারছে না সে! ঘড়ি পড়িয়ে দিয়েছে তবুও মেহেদী এভাবেই দাড়িয়ে আছে। তাই নাহিদা জিজ্ঞেস করলো,
– জুতা তো মেইন ডোরের সামনে। তাহলে আর কি বাকি?
– বউয়ের দায়িত্ব সব শেষ?
– হ্যাঁ।
– সেই কখন থেকে দেখছি, মুরগির মতো মাথা এমন নিচু করে রাখছো কেন!
নাহিদা এবার মাথা তুলে বললো,
– কিহ!
– হায় আল্লাহ! এ কোন কানে কালা বউ বিয়ে করলাম! এক কথা দুই-তিন বার বলতে হয়!
নাহিদা ব্রু কুচকে বললো,
– আমি কানে কালা!
– তাহলে কথায় কথায় “কিহ, কিহ” বলো কেন! দু তিনবার এক কথা বলতে আমার কষ্ট হয় না!
– তাহলে, আপনি আমাকে মুরগি বললেন কেন!
– মাথা নিচু করে ছিলে বলে।
– আমি…
কথাটা বলার পরপরই মেহেদী হঠাৎ করেই নাহিদার গালে চুমু দিলো! ফলস্রুতিতে নাহিদা স্তব্ধ! কিছু বলতে গিয়েও এরপর আর বলতে পারলো না! শুধু গালে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে! ঠোঁটের কোনায় মুচকি হাসি ঝুলিয়ে মেহেদী রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– এটাও তো মেবি, রুলসের মধ্যেই পড়ে! রেগুলার চলবে! রুলস অনুযায়ী “আপনি” উচ্চারণটাও বাদ পড়বে! অফিস জয়েন এর ফার্স্ট ডে’র রুলসটা ভালো ছিলো। আল্লাহ হাফেজ।