“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৩৭

0
2809

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩৭
(নূর নাফিসা)
.
.
বিষয়টা ভীষণ ভাবাচ্ছে নাহিদাকে! মেহেদীর রিপ্লাই না পেয়ে সে মন খারাপ করে অনলাইনে ঢুকলো। ফ্রেন্ডের কাছ থেকে ফোর্থ ইয়ার বুক লিস্ট সংগ্রহ করে নিলো। অনলাইনেও মন টিকছে না। তাই কিছু সময় পর আবার অফলাইনে চলে এলো। নাফিসা রুমে এসে পড়তে বসেছে। নাহিদা উঠে তার ছোট্ট ব্যাংকটা হাতে নিলো। প্রায় তিন হাজারের মতো জমা আছে। আরও কিছু ছিলো যেটা কক্সবাজার খরচ করে ফেলেছে। এগুলো দিয়ে বই কেনা হবে কিনা কে জানে! না হলেও কিছু করার নেই। এখন সে বিবাহিতা, বাবার কাছে বইয়ের কথা বলতে পারবে না। শ্বশুর শ্বাশুড়ির কাছে তো আরও আগে বলতে পারবে না! আর স্বামী! তাকে কিভাবে বলবে! বললেই সে দিবে কিভাবে! সে নিজেই তো বউয়ের পার্স ফাকা করে চলাচল করছে! আপাতত নিজের এই সম্বলটুকু কাজে লাগানো যাক। যেগুলো কেনা যায় সেগুলোই পড়া যাক।
ইশার নামাজ আদায় করে দুই মেয়ে ও পিতামাতা একসাথে খেতে বসলো। খাওয়ার পরপর আবার নাজিয়া ও আরাফের সাথে ফোনে কথা বললো তারা। শতদিকে ব্যস্ত থাকার পরও নাহিদার মাথায় মেহেদী ঘুরপাক খাচ্ছে! এতটা সময়ে সে নিশ্চিত হয়ে গেছে, আজ নিশ্চয়ই সে তার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় জমে গেছে! সে কি মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরবে! নাকি বাড়িতেই ফিরবে না! রাত দশটার পর মেহেদীর ফোন থেকে কল এলো। নাহিদা ফোন সাইলেন্ট এ রেখে শুয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো। ফোনের স্ক্রিন জ্বেলে উঠায় হাতে নিলো। নাফিসা এ রুমে পড়ছে তাই সে ফোন নিয়ে পাশের ফাকা রুমটাতে চলে এলো। একবার কেটে গিয়ে দ্বিতীয়বার কল আসতেই নাহিদা রিসিভ করলো। কিছু না বলে কানে ধরলো মেহেদীর কথা শুনার জন্য।
– হ্যালো?
-….
– হ্যালো? শুনতে পারছো না?
-…..
– নাহিদা? হ্যালো? আরে, ফোন রিসিভ করলো কে! নাহিদা? নাকি নাফিসা? কথা বলছো না কেন?
– জ্বি?
– ফোন রিসিভ করে কোথায় চলে গেলে! এখন যে আমার ব্যালেন্স কতটা কেটে গেলো? জরিমানা দাও।
– কত টাকা?
– একটা কোলবালিশ।
– ঠিক আছো? আমার কন্ঠ বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে!
– টেনশন হচ্ছিলো?
নাহিদার চোখে পানি এসে গেছে! সে কাপানো কণ্ঠে বললো,
– খুব! খুব টেনশন হচ্ছিলো আমার! এখনো হচ্ছে! বুঝতে পারছি না আমি কিছু! ফোনে তো আর প্রকৃত কণ্ঠ ভেসে আসে না! তাছাড়া আজ প্রথম কথা হচ্ছে ফোনে। ফোন কলে এই কণ্ঠটা কেমন হতে পারে সেটা আমার মুখুস্ত নয়! একটুও মুখুস্ত নয়!
– রিলেক্স! যখন মেসেজ দিয়েছিলে তখন আমি গাড়িতেই ছিলাম বেইলি রোডে। সাথে ফ্রেন্ডস ছিলো। একের পর একজন বেশ কিছুক্ষণ ড্রাইভিং-এ ছিলাম! ইশার আযান পড়তেই একত্রে নামাজ পড়েছি। অত:পর রেস্টুরেন্টে ডিনার চললো। ডিনারে ছিলো চিকেন ফ্রাই, রাইস, মাটন কারি এন্ড কুল্ফি। এর বাইরে কিছুই ছিলো না! ডিনারে আমার পকেট থেকে এক টাকাও খরচ হয়নি। সেখান থেকে চলে গেলাম ব্যাডমিন্টন ক্লাবে। মাত্র ত্রিশ মিনিট খেলেছি। সেখান থেকে বাসার দিকে রওনা দিয়েছি, সাথে নিয়েছি….. কি যেন বলে! ওই যে আচারের সাথে মিক্স করে, ঝোল টাইপ, ঝাল টক মিষ্টি স্বাদ! কি যেনো…
– টনিক?
– অহ হ্যাঁ, টনিক! ওটা খেতে খেতে রাস্তা পাড় করে বাসায় ফিরে এখন বেড রুমে বেডে আছি। বিশ্বাস না হলে ইমোতে কল দিয়ে দেখো। না হয় তোমার ইমো নম্বর দাও। আমি তোমার এই নম্বরে ট্রাই করে পেলাম না!
– এটা ইমোতে নেই।
– তাহলে যেটা আছে সেটা সেন্ট করো।
– লাগবে না।
– টেনশন কমেছে?
– হুম।
– আমার যে খুব টেনশন হচ্ছে! আমি ঘুমাবো কি করে! আমার এখন ঘুমই আসবে না!
– কেন?
– আমার কোলবালিশটা খুজে পাচ্ছি না! দেখেছো তুমি?
– কোনটা? আমি তো কোনো কোলবালিশ ইউজ করতে দেখলাম না এই কদিনে!
– দেখোনি তুমি!
– না।
– দেখবে কিভাবে! তুমি তো শোয়া মাত্র ঘুমে তলিয়ে যাও!
– ওহ! কিন্তু ঘুম ভাঙলেও তো দেখলাম না কখনো! মেহতাজ আপুর রুমে তিনটা দেখেছিলাম। দুইটা বড় একটা ছোট। সেগুলোর মধ্যে কি একটা?
– আরে না! গত রাতে যেটা নিয়েছিলাম সেটা। ভুলে গেছো?
এবার নাহিদার মাথায় ধরা দিলো! সে সত্যিই ভুলে গিয়েছিলো গত রাতের কথা! এখন যে বড্ড হাসি পাচ্ছে! সে কি করবে! পাশের রুমে নাফিসা! তাকে হাসতে শুনলে দৌড়ে এসে পড়বে! কিন্তু হাসি চেপেও রাখতে পারছে না! মুখে হাত রেখে নিচু শব্দে সে ফিক করে হেসেই দিলো! মেহেদী তার হাসির শব্দ শুনে বললো,
– আমার ঘুম নষ্ট করে হাসো! ভুলে যাও কেন, আমি যে মেহেদী! তোমার হাতের রাঙা মেহেদী! গাঢ় রঙ আমার! রঙ উঠার আগেই চুলকানি উঠবে দেখো!
হঠাৎই ভেসে এলো নাফিসার কণ্ঠ!
“ভাইয়া! রঙ উঠার আগেই চুলকানি উঠবে মানে? বুঝলাম না ব্যাপারটা! বাট বুঝার জন্য ইন্টারেস্টেড!”
নাহিদা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে নাফিসা তার হাসির শব্দ শুনে হঠাৎ এসে ফোন টেনে নিয়ে যাওয়ায়! অন্যদিকে আবার হাসিও পাচ্ছে খুব! এই ভেবে যে নাফিসার কন্ঠ শুনার পর মেহেদীর আর কোনো শব্দ শুনা যাচ্ছে না! সে কি শকড!
নাফিসা জবাব না পেয়ে বললো,
– হ্যালো, ভাইয়া? শুনতে পাচ্ছেন?
– হ্যাঁ?
– মিনিংটা বুঝান?
– কিসের মিনিং?
– ওই যে, রঙ উঠার আগেই চুলকানি উঠবে…!
– এতোক্ষণ ধরে কি তুমি আমার সব কথা শুনছিলে?
– না, আপুর হাসি শুনে এসে এটুকুই শুনলাম। কিন্তু বুঝলাম না কিছুই?
– তাহলে আর বুঝতে হবে না। অর্ধবচন বুঝতে নেই! রাত অনেক হয়েছে তো! ঘুমিয়ে থাকো তোমরা।
– ধুর! আপুর মতো, কথা খুব চাপানো রাখতে পারেন আপনিও! হাসতে ভালো লাগে তাই ভাবলাম আমিও একটু হাসি। তা আর হলো না। নাও, ধরো তোমার ফোন!
নাহিদার হাতে ফোন দিয়ে নাফিসা চলে গেলো। মেহেদী তার প্রতুত্তরে বললো,
– আমার যে এখন হাসি আসছে না!
– নাফিসা চলে গেছে। কিন্তু হাসি আসছে না কেন? শকড হয়েছো?
– শুধু কি শকড হয়েছি! বেড থেকে সোজা ফ্লোরে চলে গেছি!
নাহিদা আবারও হেসে উঠলো এবং বললো,
– আচ্ছা! এই ঠান্ডার মধ্যে ফ্লোরে বসার প্রয়োজন নেই। বিছানাটা বেশ আরামের। সেখানে থাকলেই ভালো হয়!
– তুমি তো আছো মজে! তোমার মজা এদিকে আমার সাজা! রাত অনেক হয়েছে, ঘুমাও গিয়ে।
– ওকে। গুড নাইট। আল্লাহ হাফেজ।
– হু, গুড নাইট ফর ইউ! বেড নাইট ফর মি! আল্লাহ হাফেজ।
মেহেদী কল কেটে দিলো। নাহিদা হাসলো তার কথায়। অত:পর ঘুমানোর জন্য বিছানায় চলে গেলো। নাফিসাও শুয়ে পড়েছে। নাহিদার মনটা খুব খুশি খুশি লাগছে। অন্ধকার রুমে শুয়ে শুয়ে সে মেহেদীর কথাগুলোই স্মরণ করছে! কলটা রিসিভ করার সময় ভয়ে ভেতরটা কাপছিলো আর এখন হাসিয়ে তারপর কল কাটলো লোকটা! অদ্ভুত একটা মানুষ! কে বলেছে সে বজ্জাত! সে তো তার পরিবার সহজাত! সে সম্পূর্ণ তার বাবামায়ের মতোই রসিক ও ফুরফুরে মনমানসিকতার মানুষ! যেটা সে অতি দ্রুতই প্রমাণ করে দিচ্ছে! খুব অল্প সময়ে সে যে কতটা ডেবে গেছে এই মনের কাদায় সে কি জানে সেটা! সে জানবে কোথা থেকে! এই মনের মালিক ই তো মাত্র জানলো! কিন্তু এতো দ্রুত এমনটা হওয়ার কারণ কি! এটা কি সেই বিয়ে নামক অটুট বন্ধনের মোহনীয় জাদু! হবেই না কেন! পবিত্র একটা সম্পর্কে যে আবদ্ধ হয়েছে তারা! এটা খুব শক্তিশালী বন্ধন! এর মাঝে অনেক জাদু আছে! মানুষের চামড়া থেকে শুরু করে হাড়ের ভেতর পর্যন্ত আক্রমণ করে ফেলে এবং বিপুল পরিমাণে বদলে দেয় মানুষ ও তার জীবনধারণ!
কিন্তু মেহেদীকে দেখে কখনো এমনটা মনে হয়নি যে, সে এতো তারাতাড়ি নিজেকে এভাবে বদলে নিবে! যতই থাকুক মা-বাবা আর স্ত্রীর প্রচেষ্টা, নিজেকে নিজে শুধরাতে না চাইলে কারো সাধ্য নেই তাকে শোধরানোর! নিজের ভেতর প্রচেষ্টা থাকলেই না অন্যের ধাক্কায় মাঝি আটকে যাওয়া নৌকা ভাসাতে পারে! কিন্তু মেহেদীর ক্ষেত্রে এতো তারাতাড়ি এটা কিভাবে সম্ভব হলো! এর কেন্দ্রীয় কোনো কারণ ধরা পড়ছে না নাহিদার চোখে! যতই অদৃশ্যমান হোক, এর মূলে নিশ্চয়ই কিছু আছে! কিন্তু সেটা কি!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here