“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩৮
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে শিথি এসেছে নাহিদার সাথে দেখা করতে। দুজন সমবয়সী। কিন্তু শিথির পড়াশোনা বন্ধ আছে। তিন বোন মিলে আড্ডা দিলো, একসাথে নাস্তা করলো। শিথি আবার জোর করেই তাদের বাসায় নিয়ে গেলো। মা বোনের সাথে বাড়িতে ভালোই কাটছে তার সময়। সারাদিন মেহেদীর সাথে কথা না হলেও বিকেলে মেহেরুন ইসলাম কল করেছে নাহিদার কাছে। তার কাছে জানতে পারলো মেহেদী নাকি রাতে খাট থেকে পড়ে গিয়ে কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছে! এবার বুঝতে পারলো নাহিদা, কাল তাহলে মেহেদী সত্যিই খাট থেকে পড়ে গেছে! সে তো ভেবেছিলো মেহেদী দুষ্টুমি করে বলেছে! বিষয়টা জানার পর এখন খারাপ লাগছে নাহিদার কাছে! আবার রাগও হচ্ছে মেহেদীর উপর! মানুষটা এমন যে, সবসময় মজায় মজে থাকে! কখন সিরিয়াস কথা বলে আর কখন ফান করে বুঝাই যায় না! নাহিদার সাথে কথা বলার পর মেহেরুন রুমানার সাথে গল্প করেছে! ফোন কল কাটার পর মেহেদীকে কল করেছিলো নাহিদা কিন্তু ওয়েটিংয়ে পেয়েছে। সন্ধ্যায় বেশ কয়েকবার কল করেছে তখনও ফোন রিসিভ হয়নি। কোথায় আছে, কি করছে, কে জানে! যেখানেই থাকুক, ভালো থাকলেই হয়!
.
তুর্যের বাড়ির লোকজন এসেছে আজ আরাফের বাড়িতে। নাজিয়া সকাল থেকেই লেগে পড়েছে রান্নাবান্না নিয়ে। আয়েশা বেগম সেদিনের পর থেকে কথা বলে না বললেই চলে। তবে আজ বলে বলে এটা সেটা করাচ্ছে তাকে দিয়ে। কথামতো না হলে মাঝে মাঝে দু একটা ঝাড়িও দিচ্ছে, যেটা তার চিরাগত স্বভাব! দুপুরের শেষ ভাগে এসেছে মেহমান। তুর্য আসেনি তাদের সাথে। এসেছে তুর্যের মা বাবা, দুই চাচা, এক চাচি ও বড় বোন আর দুলাভাই। তারা আসার পরপরই নাজিয়া খাবার রেডি করে দিলো। আশিক আরাফ সবাই বাড়িতে আছে আজ। তারাই সব কিছু আনানেওয়া করছে। খাওয়াদাওয়ার শেষে তুর্যের মা আয়াতের হাতে আংটি পড়িয়ে দিলো। পরক্ষণেই বসলো বিয়ের দিন পাকা করার জন্য এক বৈঠক। দু পরিবারেরই মতামত, ছোটখাটো অনুষ্ঠান করবে তারা। দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে তুর্যের নিষেধ আছে তাই তারা কিছু দাবি করেনি। বাকিটা তাদের ইচ্ছে। এতে যেন আয়েশা বেগম মহা খুশি! অথচ, নিজের ছেলের বেলায় উল্টো মনোভাব! বিয়ের দিন ঠিক করলো দু সপ্তাহ পরে। কিন্তু তুর্যের ভাগিনা-ভগিনীদের পরীক্ষা! এরপর দিলো একমাস পরে! তখন আবার তুর্যের বাবা-মা হজ্জে যাবে! এর পর হজ্জ থেকে ফিরে দিতে গেলে অনেক দেড়ি! তখন আবার আয়াতের পরীক্ষা! এতো দেড়ি আয়েশা বেগম কিছুতেই করবে না! সৃষ্টি হয়েছে প্রকট ঝামেলা! সকল বিষয় বিবেচনায় এনে এক পর্যায়ে তুর্যের বাবার প্রস্তাব আজই বিয়ে হোক। কোনো অনুষ্ঠানের প্রয়োজন নেই! ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হবে, বউ নিয়ে চলে যাবে তারা। এতে কোনো ঝামেলা বাধবে না! এই মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় দেখছে না। আলফাজ সাহেব আর নিষেধ করলো না। কিছু দিন আগে এক ঝড় গেলো, পরিবারে এখন এমনিতেই টানা পোড়েন লেগে আছে! মেয়ের বিয়েতে খরচ করার কথা ভাবতে বসলেও বারবার ভাবতে হবে! হাতে দু পয়সাও নেই, সেখানে ভেবে কি হবে! তাই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। আয়াতের মনটা খারাপ হয়ে গেছে! কেননা তার বিয়েতে জাকজমাক কিছু হবে না! এমনকি ফ্রেন্ডদেরও দাওয়াত করতে পারলো না! তবে মন খারাপের অগ্রভাগে খুশি লেগে আছে। পরিবার যে তুর্যকে মেনে নিয়েছে সেটাই অনেক!
.
বিকেলে মেহেদী তার বন্ধুবান্ধবদের সাথে বুড়িগঙ্গার তীরে ঘুরছিলো। রায়ানের ফোনে তার বাবার কল এলো। রায়ান সালাম দিয়ে রিসিভ করলো,
– আসসালামু আলাইকুম, বাবা। বলো?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। কোথায় তুই?
– ঘুরতে বেরিয়েছি একটু।
– ঢাকাতেই আছিস?
– হ্যাঁ।
– বাসায় গিয়ে পাঞ্জাবী পড়ে কাজীকে সাথে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি আয়।
– কাজীকে সাথে নিয়ে মানে!
রায়ানের বাবার কথা না শুনতে পারলেও রায়ানের মুখের শেষ উক্তি শুনে বাকিরা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে! অপর পাশ থেকে তার বাবা আবার বললো,
– বিয়ে পড়াবে এখন। তারাতাড়ি আয়, আমরা এখানেই আছি।
– বাবা, এখন বিয়ে! আমি বুঝতে পারছি না কিছু!
অত:পর মেহেদী তার হাত থেকে ফোন নিয়ে রায়ানের বাবাকে সালাম দিয়ে কথা বললো। কল কেটে উল্লাসিত হয়ে রায়ানের পিঠ চাপড়ে বললো,
– তুর্য মশাই, চলেন আপনাকে বর সাজাই! দোস্ত আয়, তুর্যের বিয়ে খেয়ে আসি! এমন হঠাৎ হঠাৎ দু একটা দাওয়াত পড়লে কি যে আনন্দ লাগে রে!
জিহাদ বললো,
– মানে কি?
– মানে হচ্ছে, রায়ানের বিয়ে আজ এবং এখন। বিয়ের দিন পাকা করতে গিয়ে উপযুক্ত কোনো দিন ঠিক করতে পারছে না তারা তাই আজই বিয়ে! চল এবার বরকে সাজিয়ে দাত মাজতে মাজতে বিয়েতে যাই।
তুর্য বাদে বাকিরা হেসে উঠলো! মেহেদী তুর্যকে নিয়ে শপিংমলের দিকে ছুটলো আর বাকি দুজনকে কাজী অফিসে পাঠিয়ে দিলো। তুর্যের বোন ও দুলাভাই এসেছে শপিংমলে। সব ব্যবস্থা করে তারা সন্ধ্যার পর আলফাজ সাহেবের বাড়িতে এলো। সন্ধ্যার আগেই নাজিয়া আবার রান্নার আয়োজন শুরু করেছে। আলফাজ সাহেব নিয়াজ উদ্দিনকে গুরুতর ডেকেছে এখানে আসার জন্য। নাজিয়া ও আয়েশা বেগমের কাছে রান্নার আয়োজন সামলানো দায় হয়ে পড়ছে! তাছাড়া নাজিয়াকে আবার আয়াতকেও তৈরি করতে হবে। তাই আয়েশা বেগম আশিককে পাঠিয়ে দিয়েছে তার ছোট বোনকে আনতে যেতে। আশিক তার খালাকে নিয়ে আসার পূর্ব পর্যন্ত নাজিয়া কিচেনে কাজ করেছে। পরবর্তীতে আয়াতকে তৈরি করতে চলে গেছে। তুর্যের বোন ও নাজিয়া আয়াতকে প্রস্তুত করে দিলো। মেহেদী হৈ-হুল্লোড় স্বভাবের হলেও এখানে এসে চুপচাপ হয়ে গেছে! সে জানতো না সে আরাফের বাড়িতে আসছে! এমনকি এটাও জানতো না আরাফের বোন আয়াত! জানবে কি করে, কখনো জানার ইচ্ছেও ছিলো না কারো সমন্ধে! একে তো বউয়ের বোনের শ্বশুর বাড়ি, তার উপর তার শ্বশুর এখানে উপস্থিত! আগে জানলে তো আসতোই না সে! ছোটখাটো ঘরোয়া আয়োজনে বিয়ে সম্পন্ন হলো। কনে বিদায়ের পরপর নিয়াজ উদ্দিন বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। মেহেদী এগিয়ে দেওয়ার জন্য আসতে চেয়েছিলো কিন্তু নিয়াজ উদ্দিন তাকে ছাড়লো না। মেহেদীকে আজ তাদের বাসায় থাকতে হবে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারপর সাথে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার পথে মেহেদী তার বাবার কাছে কল করে বলে দিলো সে নাহিদাদের বাড়িতে যাচ্ছে। অত:পর বাবার কথায় মেহেদী মিষ্টি কিনে নিলো প্রথমবার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে বলে। নিয়াজ উদ্দিন সাথেই ছিলো। বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও শুনলো না। রাত এগারোটার দিকে জামাই-শ্বশুর বাসায় ফিরেছে। দরজা খুলেছে নাহিদা। বাবার পিছু পিছু মেহেদীকে প্রবেশ করতে দেখে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহেদী নাহিদার চোখের সামনে মিষ্টির প্যাকেট তুলে ধরলো। নাহিদা পেছনে হেলে মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
– আজ আসবে, সেটা আগে জানালে না!
– আমি নিজেই জানি না, আসবো। তোমাকে জানাবো কি করে!
ওদিকে নিয়াজ উদ্দিন হাক ছাড়লেন,
– রুমানা, দেখো কে এসেছে।
রুমানা এ রুমে এসে মেহেদীকে দেখে বললো,
– মেহেদী! নাহিদা, তুই তো কিছু বললি না আজ আসবে!
– মা, আমি জানতাম না! আমাকে এমন কিছু বলে নি!
– ধুর! জানিয়ে দিবে না তুমি! আগে জানালে তো আমি রান্নাবান্না করে রাখতাম!
মেহেদী জবাব দিলো,
– না, মা। আমি এখন খাবো না কিছু! খেয়ে এসেছি বিয়ে বাড়িতে।
– কার বিয়ে?
নিয়াজ উদ্দিন বললেন,
– আয়াতের বিয়ে ছিলো আজ। মেহেদীর বন্ধু আয়াতের বর। সেখানেই দেখা হলো মেহেদীর সাথে। তাই জোর করে নিয়ে এলাম সাথে।
– এজন্যই বেয়াই জরুরি তলব করেছে?
– হ্যাঁ।
– এমন চুপিচুপি বিয়ে কেন!
– তারিখ নির্ধারণ করতে পারছিলো না। কোনো না কোনো পক্ষের সমস্যা তৈরি! তাই আজই বিয়ে হয়ে গেলো।
– যাক, ভালো হয়েছে। মেহেদী, হাতমুখ ধুয়ে নাও। মিষ্টি এনেছো কেন শুধু শুধু! মিষ্টি খাদক এই ঘরে নেই! সবাই টকের পোকা! এক কেজি তেতুল আনলেও দুদিনে খাওয়া হয়ে যেতো!
– শ্বশুর বাড়িতে কেউ তেতুল নিয়ে আসে, জানতাম না তো আমি! আগে জানলে তেতুলই নিয়ে আসতাম!
জামাই শ্বাশুড়ির কথা শুনে একজোটে সবাই হেসে উঠলো! তাদের কথাবার্তা ও হাসির শব্দ শুনে নাফিসার কাচা ঘুম ভেঙে গেছে! চোখ ঢলতে ঢলতে সে এ রুমে এসে বললো,
– কি হয়েছে তোমাদের?
মেহেদী তাকে বললো,
– ঘুমে হাটছো নাকি তুমি! চোখ খুলে দেখো, তোমার জন্য তেতুল এনেছি। তারাতাড়ি খাও।
– ধুর! স্বপ্নে আমি খাই না!
তার কথাবার্তায় সবাই মজা পাচ্ছে! সবাই বুঝতে পারছে সে এখনো ঘোরে আছে! হাই তুলতে তুলতে নাফিসা আবার তার রুমের দিকে পা বাড়াতেই নাহিদা তার হাতে মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– স্বপ্ন না। সত্যিই এনেছে। নে খা।
নাহিদা হাসতে হাসতে তোয়ালে হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মেহেদীও বেরিয়ে এলো। বাথরুমে হাতমুখ ধুয়ে আবার ঘরে এলো। নাহিদা আগে আর মেহেদী পিছে। নাফিসা মিষ্টির বাক্স হাতে নিয়েই বসে আছে! নাহিদাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– আপু, ভাইয়া এসেছে?
নাহিদা কিছু বলার আগেই মেহেদী পেছন থেকে জবাব দিলো,
– না, আমার প্রেতাত্মা এসেছে!
– বহু দিনের ইচ্ছে, প্রেতাত্মার সাথে বন্ধুত্ব করবো আর দোয়াদরুদ পড়ে ফুক দিয়ে তাকে শুন্যে মিশিয়ে দিবো! হা হা হা….
মেহেদী আর নাহিদা হেসে উঠলো। নাফিসা মেহেদীর হাতে জোরপূর্বক একটা মিষ্টি ধরিয়ে দিয়ে প্যাকেট ফ্রিজে রেখে দিলো। অত:পর সে আবার ঘুমাতে চলে গেলো।