“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৩৯

0
2568

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩৯
(নূর নাফিসা)
.
.
মেহেদী পাশের রুমে এলো নাহিদার কথায়। নাহিদা এলো তার বাবার নতুন লুঙ্গি নিয়ে। মেহেদীর দিকে এগিয়ে দিলে মেহেদী বললো,
– এটা দিয়ে কি করবো?
– কি করবে আবার! পড়বে। এই জিন্স পড়ে কি ঘুমাতে পারবে!
– আমি এই লুঙ্গিফুঙ্গি পড়তে পারি না! সরাও!
– এতো বড় ছেলের মুখে এই কথা শুনলে মানুষ হাসতে হাসতে জ্ঞান হারাবে! বাঙালি ছেলেরা আবার লুঙ্গি পড়তে না জানে!
– আমি পারি না।
– না পারলে নেই। এভাবেই ঘুমিয়ে থাকো।
– এভাবে ঘুমানো যায়! অন্য কোনো ব্যবস্থা করো।
– অন্য কি ব্যবস্থা করবো! আমার তো দুএকটা ভাই নেই যে তার স্ট্রিং প্যান্ট অথবা ট্রাউজার এনে দিবো! বাসা থেকে কাপড়চোপড় নিয়ে এলে না!
– আমি কি জানতাম এখানে আসবো!
নাহিদা বিছানা ঠিক করতে করতে বললো,
– তাহলে আমি জানতাম, তাই না?
মেহেদী আর কিছু বললো না। শার্ট খুলে সাদা সেন্টু গেঞ্জিটা দেহে রেখে বিছানায় উঠে পড়লো। নাহিদা কম্বল এনে দিলো। মেহেদী কম্বল জড়িয়ে নিলো। নাহিদাও কম্বল টেনে খাটের একপাশে শুয়ে পড়লো। মেহেদী একবার এপাশ করছে তো আরেকবার ওপাশ! এই প্যান্ট পড়ে ঘুমানো সম্ভব না! আরেকটু ঢিলেঢালা হলে চালিয়ে নেওয়া যেতো! অত:পর উঠে লাইট জ্বালিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে গেলো। নাহিদা মাথা উঠিয়ে তাকিয়ে বললো,
– কোথায় যাচ্ছো?
– লুঙ্গি পড়া শিখতে।
নাহিদা মৃদু হেসে কম্বল টেনে শুয়ে পড়লো। মেহেদী শক্ত করে গিট দিয়ে লুঙ্গি পড়ে নিলো। অত:পর কম্বলের নিচে এসে বললো,
– সকাল পর্যন্ত থাকলেই হয়!
তার কথা শুনে নাহিদা শব্দ করেই হেসে উঠলো। মেহেদী তার হাতটা টেনে এনে দেখলো। কি দেখছে তা বুঝতে না পেরে নাহিদা বললো,
– কি?
ঠোঁটের কোনায় দুষ্টুমি হাসি ফুটিয়ে মেহেদী বললো,
– বলেছিলাম না, রঙ উঠার আগেই চুলকানি উঠবে!
সাথে সাথেই দৃষ্টি নত হয়ে নাহিদার মুখে লজ্জাময়ী রশ্মি ভেসে উঠলো! মেহেদী লাইট অফ করে নাহিদাকে কোলবালিশ ন্যায় জড়িয়ে ধরে বললো,
– ভয় পাচ্ছো? ওকে যাও, চুলকানি পড়ে উঠাবো।
– কতোগুলো কল করেছি, একটাও রিসিভ করার সময় হলো না!
– ফোন সাইলেন্টে ছিলো। রায়ানের শপিং করতে করতে আর ফোন ধরা হয়নি!
– আপু বলছিলো আয়াতের হাসব্যান্ড এর নাম নাকি তুর্য! তোমরা ডাকো রায়ান!
– ওর নিক নেম তুর্য। আমরা ফ্রেন্ডরা ও টিচাররা ডাকি রায়ান। বাকি সবাই তুর্য নামেই চেনে।
– খাট থেকে পড়ে নাকি সত্যিই কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছো?
– কালকেই তো বললাম!
– আমি ভেবেছিলাম ফান করছো। মায়ের কাছ থেকে আজ জানলাম।
– তুমি কি জানো, তুমি একটা চুন্নি!
– হোয়াট!
– ছেলেরা চোর হলে মেয়েরা তো চুন্নিই হয়! তাই না?
– আমি শুধু শুধু চুন্নি হতে যাবো কেন! কি চুরি করেছি!
– আমার কোলবালিশ চুরি করেছো! একদিকে কোমড় ব্যাথা অন্যদিকে কোলবালিশ নিখোঁজ! দুয়ের যন্ত্রণায় আমি ঘুমাতে পারিনি সারারাত! আর তুমি চুরি করে এখানে নিয়ে এসে পড়েছো! আজ যে ধরা পড়েছো এবার কি হবে তোমার!
নাহিদা মৃদু হেসে লজ্জাময়ী কণ্ঠে বললো,
– ব্যাথা কি এখনো আছে?
– ওষুধ দিবে?
– প্রয়োজন হলে দিব।
– থাক, আর প্রয়োজন নেই। ডাক্তারের কাছে গিয়ে পেইন রিমোভাল স্প্রে করেছি। আপাতত ঘুমাতে দাও।
নাহিদা আর কোনো কথা বললো না। মেহেদী তার ওষ্ঠ দ্বারা গালে কোমল স্পর্শ দিয়ে গালের সাথে গাল লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। অতি খুশিতে নাহিদার চোখে পানি এসে গেছে! মেহেদীর এসব কর্মকাণ্ড একটুও অভিনয় মনে হচ্ছে না। এসব বাস্তব। গড়িয়ে পড়ার আগেই সে আঙুল দিয়ে মুছে নিলো আনন্দের অশ্রু।
সকালে প্রথমে নাহিদার ঘুম ভেঙেছে। মেহেদী তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে৷ মৃদুস্বরে নাহিদা ডাকলো মেহেদীকে। “এই শুনছো? এই, ওঠো না?”
মেহেদী ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো,
– হু?
– সকাল হয়ে গেছে। সূর্য উঠে পড়বে তো! নামাজ পড়বে না!
– প্রতিদিনই পড়তে হবে!
– হ্যাঁ। প্রতি দিন কেন, প্রতি ওয়াক্তে পড়তে হবে। উঠো।
মেহেদী এবার চোখ খুলে হাত পা মেলে আড়মোড়া ভাঙল। নাহিদা উঠতে যাবে হঠাৎ মেহেদী চমকে উঠলো এবং নাহিদাকে টেনে শুয়িয়ে দিলো! নাহিদা বিষ্ময়ের সাথে বললো,
– আরে! কি হলো!
– তুমি কিছু দেখেছো?
– কি?
– আমার সামথিং মিসিং!
– সামথিং মিসিং! কি মিসিং?
– লুঙ্গিফুঙ্গি!
নাহিদা লজ্জায় পড়ে গেছে তার কথা শুনে! ভাবছে এই ছেলেটার কি একটুও লজ্জা নেই, কিভাবে এমন আজব কথাবার্তা বলে ফেলে! নাহিদা অন্যদিকে ফিরে চুপচাপ উঠে যেতে চাইলে মেহেদী আবার তাকে টেন বাধা দিয়ে বললো,
– উঠবে না তুমি এখন! আমি আগে ঠিক হয়ে নেই। তারপর।
– আরে! লজ্জা লাগছে যেহেতু, আমি চলে যাই। আমার সামনে ঠিক হবে কিভাবে!
– তুমি উঠলেই তো কম্বল ফাঁক হয়ে যাবে!
– কি আজব ব্যাপারস্যাপার! এতো বড় ছেলে হয়ে একটা লুঙ্গি সামলাতে পারে না!
বিড়বিড় করে কথাটা বলে নাহিদা খিলখিল করে হেসে অন্যদিকে ফিরে শুয়ে রইলো। মেহেদী ঠিকঠাক হয়ে তার আগে উঠে পড়লো। পুরো কম্বলটা টেনে দু’হাতে দলা করে নাহিদার উপর ঢিল দিয়ে বললো,
– আর কত ঘুমাবা! উঠো!
নাহিদা উঠে কম্বল ভাজ করে নিলো। এতোক্ষণে মেহেদী প্যান্ট পড়ে নিলো। একটু-আধটু অসুবিধা হলেও লুঙ্গি পড়ে সে নামাজ পড়তে পারবে না! নাহিদা চুল খোপা করে কাটা আটকে নিলো। দরজা খুলে দুজন ওযু করতে বের হলো। আজ দেড়ি হয়ে গেছে উঠতে। যথাসম্ভব দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ওযু করে দুজনেই ঘরে নামাজ আদায় করলো।
রুমানা বেগম ঘুম থেকে উঠেই রান্নার আয়োজন শুরু করেছে। রাতে মেয়ের জামাইকে কিছুই খেতে দেয়নি অথচ জামাই প্রথম এলো বাড়িতে। সেই ভেবে তড়িঘড়ি করে কাজ করছেন তিনি। নাফিসা এসে হাত লাগালো মায়ের সাথে। নামাজ পড়ে মেহেদী নিয়াজ উদ্দিনের সাথে একটু বেরিয়েছে বাসা থেকে। হয়তো বাজারের দিকেই যাচ্ছে তারা। আরাফ এলেও নিয়াজ উদ্দিন নানান জায়গায় ঘুরতে যায় আরাফকে নিয়ে। তাদের দেখলে মনেই হয় না তারা জামাই শ্বশুর! মনে হয় যেন বাবা ছেলের মতো বন্ধুত্ব তাদের মাঝে! আরাফের ন্যায় মেহেদীর সাথে নিয়াজ উদ্দিন বন্ধুত্বের ভাব জমিয়ে ফেলার জন্য প্রত্যাশিত। এদিকে মা মেয়েরা বাসার কাজ সেড়ে নিয়েছে। গতকাল নাজিয়া ব্যস্ত থাকায় কথা হয়নি তাদের সাথে। তাই আজ সকাল সকাল ভিডিও কল দিয়েছে। এদিকে তারা কিচেনে, ওদিকে নাজিয়াও কিচেনে। মা ও মেয়েরা রান্না করতে করতে জমিয়েছে খুশগল্প!
মেহেদী বাড়ি ফিরে নাহিদাকে রুমে একা ডেকে বললো,
– বাসায় যাবে না?
– আজ!
– আজ না, এখন।
– আরও দুদিন থাকি?
– কত বেলা খাবার মিস হয়েছে মনে আছে তোমার! দুজনের দশ বেলা মিসড!
– কি ধরনের কথাবার্তা এসব! এতো হিসাবী হয় মানুষ!
– এতোসব বুঝি না, দ্রুত রেডি হও। বাসায় গিয়ে অফিস যাবো। আর না হলে অফিস যাবো না।
– আর দুইটা দিন থাকি?
– মাস শেষে আবার আসতে পারবে না?
নাহিদা মুখটা মলিন করে বললো,
– ওকে, খাবার নিয়ে আসছি। নাস্তা তো করবে?
– যাও।
বাবা মা কে বলে নাস্তা করার পরপরই নাহিদা রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলো মেহেদীর সাথে। বাসায় ফিরতেই মেহেরুন দেখে বললো,
– কিরে, এতো তারাতাড়ি চলে এলি যে! তাও আবার সকাল সকাল!
মেহেদী রুমের দিকে যেতে যেতে জবাব দিলো,
– অফিস যাবো না! তাই এসে পড়েছি।
পেছন থেকে নাহিদা বিড়বিড় করে বললো,
– আসছে অফিস ওয়ালা! কিপটে হিসেবী লোক একটা! সেটা আর বলে না!
মেহেরুন তার বিড়বিড় শুনে বললো,
– কি হয়েছে?
– চেয়েছিলাম আরও দুদিন থাকবো, উনার নাকি এদিকে খাবারের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে! সেইজন্য সকাল সকাল চলে আসার তাড়া দেওয়া শুরু করেছে!
মেহেরুন হেসে বললো,
– সেটা হয়তো দুষ্টুমি করে বলেছে। কারো বাড়িতে থাকার অভ্যাস নেই তার। আমি আমার বাবার বাড়ি গিয়েও শান্তি পাইনি আগে তার জন্য। এখন তো সে একাই থাকতে পারে তাই একটু শান্তিতে বেড়াতে পারি। তবুও মন আকুপাকু করে ছেলেটা কখন কি করছে। তবে তোকে না আনলেও পারতো। কে জানে মাথায় কি ঘুরে! মন খারাপ করিস না। কিছুদিন পর না হয় আবার গিয়ে থাকিস মায়ের কাছে। বোরকা খুলে নে।
– মা, ভাবছিলাম ভার্সিটি যাবো।
– তাহলে যা। নাস্তা করেছিস?
– হ্যাঁ। করে এসেছি। বাবা চলে গেছে?
– না, যাবে এখন।
নাহিদা রুমে এসে ব্যাগ থেকে কাপড়চোপড় নামিয়ে রাখলো। মেহেদী ঝটপট গোসল সেড়ে নিয়েছে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে নাহিদাকে এখনো বোরকা হিজাবে কাজ করতে দেখে বললো,
– এখনো বোরকা পড়ে বসে আছো কেন?
– বসে আছি কোথায়? আমি তো দাড়িয়ে কাজ করছি!
– সেটাই বা বোরকা পড়ে কেন?
– ইচ্ছে হলো তাই।
– ইচ্ছেগুলো একপাশে রেখে আমাকে রেডি করো আগে।
– ওহ্! স্কুলে যাবে? টিফিন রেডি করবো? তারপর কি আঙুল ধরে রাস্তা পাড়াপাড় করে স্কুলে দিয়ে আসবো?
মেহেদী মাথা মুছতে মুছতে ঠোঁটের কোনায় দুষ্ট হাসি ফুটিয়ে বললো,
– ওটা বাচ্চাকাচ্চার জন্য জমা রাখো। আপাতত শুধু আমাকে রেডি করো। আর শুনো, এজন্যই তোমাকে এতো তারাতাড়ি বাড়িতে নিয়ে আসা।
নাহিদার খুব বেশি না হলেও একটু-আধটু রাগ হচ্ছে মেহেদীর উপর! রেডি করার জন্য আর দুদিন থাকতে দিলো না তাকে! সে মনে মনে ফুসতে ফুসতে শার্ট এনে ধরলো এবং মেহেদী পড়ে নিলো। একে একে সবকিছু নাহিদার হাতে করালো। সবশেষে বডি স্প্রে টাও নাহিদাকেই করতে বললো। বডি স্প্রে দেখে সেদিনের কথা মনে হতেই নাহিদা বডি স্প্রে করার পর মেহেদীর মুখেও স্প্রে করে হাসতে হাসতে এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here